গল্পের নাম রাজমহল
লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব-১
প্র্যাগনেন্সি কিট নিয়ে বরাবরেই খুব আগ্রহ থাকায় আমি আর আমার চাচাত বোন সন্ধি কিটটা নেড়েচেড়ে দেখছিলাম। প্রগন্যান্সি কিটটা মূলত আমার বড় আপু সায়রার। আপুর বিয়ে হয়েছে তিন মাস হলো। মূলত আপুর প্যাগনেন্সি টেস্টের জন্য কিটটা আনা হয়েছে। দুজনেই প্র্যাগনেন্সি কিটটা দেখছিলাম আর মুচকি মুচকি হাসছিলাম।বেশ কৌতুহল বশত সন্ধি বলে উঠল
- আচ্ছা তন্দ্রা এ কিটটা দিয়ে আমি আর তুই প্র্যাগনেন্সি টেস্ট করলে কেমন হয় বলতো।
আমার নাম তন্দ্রা। সবে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে উঠলাম। বয়স ১৭ থেকে ১৮ ছুঁই ছুঁই। আমার পরিবারে আমি আর আমার বড় আপু সায়রা আছে৷ আমার বাবা মা দু বছর আগে রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়।
যাইহোক সন্ধির কথাটা শোনে আমারও বেশ কৌতুহল জাগল বিষয়টা পর্যবেক্ষণ করার। আমিও বেশ উৎকন্ঠা নিয়ে বললাম
- হুম করা যায়। তবে সায়রা আপু জানলে বকবে ইচ্ছা মতো।
সন্ধি আমার কথার পাত্তা না দিয়ে হালকা ঝেড়ে কাশি দিয়ে বলল
- সায়রা আপুর কথা বাদ দে। বলবই না আপুকে কিটটা আমরা নিয়েছি। তুই টেস্ট করবি নাকি আমি?
আমি মুখে হাই তুলে বললাম
- আমি করব না। তুই কর। কারণ তোর পেটে না ইদানীং কি নড়ে চড়ে বললি। মাথায় পেইন হয়। দেখ পেটে বাচ্চা কাচ্চা আছে কিনা।
সন্ধি ভ্রুটা কুঁচকে তার নীল ফ্রেমের চশমাটা ফাঁকা করে বলল
- তুইও না সবসময় মজা করিস। গ্যাস্ট্রিকে এমন হচ্ছে।আচ্ছা আমিই টেস্ট করাব। এখানে তো নিয়ম লেখায় আছে।
সন্ধির পরিচয় তো দেওয়া হলো না।সন্ধি আমার বড় চাচার মেয়ে আমাদের বাসায় থেকে পড়াশোনা করে। বড় চাচা মারা গিয়েছে সন্ধি পেটে থাকা অবস্থায়। সন্ধির জন্মের সময় তার মা ও মারা যায়। এরপর থেকে সে আমাদের বাসায় থেকে বড় হয়। সন্ধি ক্লাস নাইনে পড়ে বয়স পনের। বয়স কম হওয়ায় সব বিষয়ে কৌতুহল বেশি।
যাইহোক আমি সন্ধির হাত থেকে প্র্যাগনেন্সি কিটটা নিয়ে নিয়মগুলো পড়া শুরু করলাম। লেখা আছে সকালে উঠে প্রথম ইউরিন কিটে দিয়ে পরীক্ষা করতে হবে।দুইটা দাগ আসলে পজিটিভ আর একটা দাগ আসলে নেগেটিভ।সন্ধির বেলায় একটা দাগ আসবে সেটা নশ্চিত ছিলাম। আমি আর সন্ধি কিট টা আস্তে হাতে সরিয়ে ফেলি সায়রা আপুর অগোচরে।
দিন পেরিয়ে রাত নামে। রাতে দুজনেই বেশ কৌতুহলী যে পরদিন সকালে কিটটা দিয়ে পরীক্ষা করব। তারপর কি আসে সেটা দেখার জন্য। সন্ধি বলে উঠল
- আচ্ছা কিটটা যদি পজিটিভ হয় তাহলে কি হবে?
আমি হাসতে হাসতে জবাব দিলাম
- তাহলে তোর পেটে একটা ভূতের বাচ্চা হবে।
সন্ধি ভয়ে আমাকে ঝাঁপটে ধরে বলল
- ধুর তুই সবসময় ভয় দেখিয়ে কথা বলিস।এমন ভয় দেখিয়ে কথা বললে রাগ লাগে খুব।
আমি সন্ধির ভয় দেখে সন্ধিকে ছাড়িয়ে দিয়ে বললাম
-তুই অবিবাহিত মেয়ে তোর পজিটিভ আসবে নাকি বোকা। আমি তো মজা করলাম।মজাও বুঝিস না। কি যে পাগলি একটা।
সন্ধি একটা নিঃশ্বাস নিয়ে কৌতুহল গলায় বলল
- আচ্ছা ভূতের বাচ্চা দেখতে কেমন হয়?
মুখটাকে বাঁকা চাঁদের মতো প্রশস্ত করে প্রথমে একটা নিঃশব্দ হাসি তারপর একটা সশব্দ হাসি দিয়ে উঠে বসলাম। সন্ধিও আমার সাথে সাথে উঠে বসলো। পাশে বসে সন্ধি আমার দিকে মনোযোগ সহকারে তাকিয়ে আছে। আমিও তার মনোযোগের সুযোগ নিয়ে বললাম
- ভূতের বাচ্চার দাঁতগুলো রক্তে মাখা থাকে। চোখগুলো কালো থাকে। হাত একটা কাঁটা থাকে। পা উল্টো থাকে।
বলেই দাঁতগুলো বের করে হাসি দিলাম। খেয়াল করলাম সন্ধি বেশ ভয় পাচ্ছে। বুঝতে পারলাম আমার কথায় ভয় পাচ্ছে। তাই তাকে ধরে স্বাত্ত্বণা দিতে চাইলে সে ভয়ে দূরে সরে গিয়ে বলল
- তন্দ্রা আপু তোর দাঁত দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। কি বিচ্ছিরি দেখা যাচ্ছে তোকে। তোর চোখগুলোও কালো হয়ে গেছে। একদম ভূতের বাচ্চার মতো লাগছে যেমনটা তুই মাত্র বললি।
আমি বুঝতে পারছিলাম সন্ধি আমার কথাগুলে কল্পনা করে আমাকে ঐরকম ভাবা শুরু করেছে। আমি সন্ধির ভয় কাটানোর জন্য সন্ধির দিকে এগুতে থাকলাম। আর সন্ধি পিছুতে পিছুতে দেয়ালে ঠেঁকল। এবার সন্ধিকে ধরতে যাব সন্ধি দেয়াল থেকে সরে পাশের দিকে হেলে ভয়ে আঁচড়ে পড়ল।সন্ধির কান্ড দেখে নিজেই হতবাক হলাম। এবার কিছু রাগ নিয়ে সন্ধিকে ধরতে গিয়ে আয়নায় প্রতিবিম্ব দেখে নিজেই ভয়ে আঁৎকে উঠলাম। সত্যিই তো সন্ধি যা বলেছিল সেটাই ঠিক। মাথাটা ঝিম ঝিম শুরু করল সেই সাথে জোরে একটা আওয়াজ বের হলো গলা থেকে। আমিও সন্ধির উপর পড়ে গেলাম।
খানিকক্ষণ পর পানির ঝাঁপটা পেয়ে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে দেখলাম সায়রা আপু পাশে বসে আছে আর সন্ধিও পাশে বসে আছে। আমাকে সায়রা আপু চোখ খুলতেই জিজ্ঞেস করলো
- কি ব্যাপার কি এমন হলো পড়ে গেলি যে?
পাশ থেকে সন্ধি বলে উঠল
- কি হয়ছিল তোর এভাবে পড়ে গেলি কেন?
সন্ধির কথাটা শোনে একটু আশ্চর্য হয়ে বললাম
- একটু আগে তুই আমার সাথে ছিলি না?
সন্ধি মাথা নেড়ে বলল না। তার মানে এটা আমার মতিভ্রম। চুপ হয়ে রইলাম খানিকক্ষণ এর মধ্যে সায়রা আপু পুনরায় ডেকে বলল
- আরে কি হয়েছিল বলবি তো?
আমি আমতা আমতা করে বললাম
- না কিছু না। এমনি মাথাটা ঘুরে গেছিল। তুমি যাও আমি আর সন্ধি ঘুমিয়ে পড়ছি এখনেই।
সায়রা আপু আমাকে হালকা বকতে লাগল। সারাদিন খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো না করলে এমনেই হবে তোর। এসব বলতে বলতে রুম থেকে প্রস্থান নিল। আমি সন্ধিকে আর কোনো প্রশ্ন না করে ওকে নিয়ে শুয়ে পড়লাম।
দুজন শুয়ে আছি এর মধ্যে সন্ধি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন আর আমি শুধু কিছুক্ষণ আগের কথা ভাবছি। ভাবছি এটা কি আমার মতিভ্রম নাকি সত্যি। ভাবনার অতল সাগরে ডুবতে ডুবতে ঘুমের সাগরেও ডুবে গেলাম। সকালে সন্ধির হালকা হাতের ধাক্কায় আর ফিসফিস আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গল। উঠে খেয়াল করলাম সকাল সাড়ে ছয়টা বাজে আর সন্ধির হাতে সেই প্র্যাগনেন্সি কিট টা। সন্ধি কিছুটা ভয়ার্ত গলায় বলল
- দেখ তো এমন কেন হলো? আমি তো বিবাহিত না।
আমি কিট টা দেখার পর আমার চোখ যেন মাথায় উঠল। কিটে বরারবর দুটো রেখা। তার মানে সন্ধি প্র্যাগনেন্ট। ভয়ার্ত স্বরে কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। অবিবাহিত মেয়ে প্র্যাগনেন্ট বিষয়টা ভালো ঠেঁকল না। মনের মধ্যে প্রশ্ন চড়ে বসলো তাহলে কি সন্ধির কোনো ছেলের সাথে রিলেশন চলছে। সন্ধি বয়সে ছোট আবেগে হাবুডুবু খেয়ে এমন করতেই পারে। আমি খানিকটা স্তব্ধ হয়ে গেলাম এটা ভাবার পর। হালকা গলায় বললাম
- তোর পিরিয়ড হয়তো ঠিক করে?
সন্ধি ধীর গলায় জবাব দিল
- আমার তো এমনিই ইরেগুলার। দুমাস যাবত হয় না। এর আগেও তিনমাস পর হয়েছিল।
কথাটা শোনার পর অজানা একটা ভয় মনে বাসা বাঁধলো। আমি হালকা রাগী গলায় বলতে গিয়েও পরক্ষণে গলাটা শান্ত করে বললাম
- আমাকে সত্যি করে বল কোনো ছেলের সাথে সম্পর্ক আছে কিনা?
সন্ধি নীরব আমার কথা শোনে। বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলাম। এক পর্যায়ে বলল তার কোনো সম্পর্ক নেই। রিতীমতো হাজার বার জেরা করার পরও তার উত্তর একই ছিল। বিষয়টা আরও গভীরভাবে ভাবা উচিত। কিটে ভুল আসা অস্বাভাবিক না। আমি সন্ধিকে বললাম
- তোর কিট থেকে এটাই বুঝায় তুই প্র্যাগনেন্ট। কিন্তু কীভাবে হলি সেটা তুই বলতে পারবি। আমার সাথে তুই ডাক্তারের কাছে যাবি নাস্তা খেয়ে। আর আপুকে কিছু বলবি না। যদি সত্যি সত্যি তুই প্র্যাগনেন্ট হস তাহলে এ আকামটা কার সাথে করেছিস বলবি নাহয় প্রাণে মেরে ফেলব।
সন্ধি আমার কথা শোনে ভয় পেয়ে গিয়ে বলল
- সত্যি আমি কারও সাথে কিছু করেনি।
সেই সাথে চোখের জল ফেলতে লাগল। আমি সন্ধির দিকে না তাকিয়ে রুম থেকে বের হয়ে চলে আসলাম। এরপর খানিকটা নাস্তা করলাম। সন্ধি নাস্তা করতে বসে শুধু নাস্তা হাত দিয়ে নাড়ছিল। একটা দমক দিয়ে বললাম
-তাড়াতাড়ি খেয়ে রেডি হ তোকে নিয়ে একটু বাইরে যাব।
পাশ থেকে সায়রা আপু বলে উঠল
- এত সকাল সকাল কোথায় যাবি?
আমি আমতা আমতা করে বললাম
- হাসপাতালে যাবে?
সায়রা আপু চোখ বড় বড় করে বলল
- কেন?
- আমার বান্ধবীর বাবা অসুস্থ দেখতে যাব।
- ওহ আচ্ছা তাড়াতাড়ি ফিরিস।
- হুম
তারপর নাস্তা শেষে সন্ধিকে নিয়ে গেলাম ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার চেকআপের পর সন্ধির প্র্যাগনেন্সি নিশ্চিত করার সাথে আরেকটা চাঞ্চল্যকর তথ্য দিল।
গল্পের নাম রাজমহল
লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব-2
ডাক্তার চেকআপের পর সন্ধির প্র্যাগন্যান্সি নিশ্চিত করার সাথে একটা চাঞ্চল্যকর তথ্য দিল। ডাক্তার জানালো যে সন্ধি জমজ বাচ্চার মা হতে চলেছে। আর তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা। ডাক্তারের কথা শোনে আমার মাথায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে লাগল। গলার স্বর ভারী হয়ে যেতে লাগল। সন্ধি কারও সাথে কিছু করেছে কিনা এটা ভেবে মনে হাজারটা প্রশ্নের ঝড় বইতে লাগল। তার উপর সন্ধি বলেছিল দুইমাস আগে তার পিরিয়ড হয়েছিল। তাহলে পেটে বাচ্চা থাকলেও তো সেটা দুইমাসের বেশি হওয়া সম্ভব না কিন্তু তিনমাসের অন্তঃসত্ত্বা কীভাবে হয়?তাহলে কি সন্ধি ভয়ে মিথ্যা বলল? প্রশ্নগুলো মাথায় তালগোল পাঁকাতে লাগল। পাশেই সন্ধির দিকে তাকিয়ে দেখলাম ভয়ার্ত মুখের আদল নিয়ে বসে আছে। আমি নিজেকে সামাল দিয়ে ডাক্তারকে স্থিত গলায় বললাম
- আপনি কি নিশ্চিত সন্ধি প্র্যাগন্যান্ট? আর ও তো বলেছিল ওর পরিয়ড হয়েছিল দুমাস আগে। তাহলে তিনমাসের অন্তঃসত্ত্বা হয় কী করে?
ডাক্তার জোর গলার জবাব দিল
- অবশ্যই নিশ্চিত। আল্ট্রা রিপোর্ট দেখুন। আর আমাকে ও ঠিক করে ডেটটা বলতে পারেনি। দুই তিনমাস আগে হয়েছে বলেছে আমি সেটার ভিত্তিতেই রিপোর্ট করেছি। জমজ বাচ্চার মা হতে চলেছে আপনার বোন। এত অল্প বয়সে কনসিভ করেছে ব্যাপারটা কিন্তু বেশ ভয়ের। তার উপর জমজ বাচ্চা হবে। সাবধানে রাখবেন আর ভালো মন্দ খেতে দিবেন।
আমি কোনোরুপ কথা না বলে মাথা নাড়িয়ে চেম্বার থেকে প্রস্থান নিলাম। সারা রাস্তা সন্ধিকে জেরা করতে লাগলাম। সন্ধি তার কথাতেই অটল রইল। একই কথা বারবার বলতে লাগল যে, সে কারও সাথে কিছু করেনি। বাসায় এসেও আমার রাগটা আমি থামাতে পারছিলাম না। তবুও রাগ নিবারণের যথেষ্ট চেষ্টা করছিলাম। সায়রা আপু জানলে বিষয়টা আরও গোলমেলে হবে। তবে এখন আমি কি করব? কীভাবে সন্ধির মুখ থেকে সত্যটা বের করব সেটাই চিন্তার বিষয়।
ড্রইং রুমে মনের অগোচরে সোফায় বসে আনমনে এসবেই ভাবছিলাম। এমন সময় সায়রা আপু মাথায় ধাক্কা দিয়ে বলল
- কি রে বসে বসে কি ভাবছিস? দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতে চলল। খাবি কখন?
আমি ভাবনার অতল সাগর থেকে নিজেকে বের করে এনে বললাম
- হুম এখনেই খাব।
- তা তোর বান্ধবীর বাবা কেমন আছে?
- হ্যাঁ ভালো আছে এখন। কালকে আবার একটু হাসপাতালে যাব উনাকে দেখতে।
- সে না হয় যাস। এখন খেতে চল।সন্ধি কোথায়?
সন্ধির কথা বলতেই আমার মাথায় একগুচ্ছ প্রশ্ন চড়াও করে উঠল পুনরায়। চুপ করে ঘুরপাক খাওয়া প্রশ্নগুলোর উত্তর বের করার চেষ্টা করছিলাম। সায়রা আপু আমার নীরবতা দেখে মাথায় পুনরায় ধাক্কা দিয়ে বলল
- কি রে কি হয়েছে তোর? এত চুপচাপ কেন? আর কি এত ভাবছিস?
- নাহ কিছু না। ঐ তো আন্কেলের কথা ভাবছিলাম। আমি দেখছি সন্ধি কোথায়৷ ঘরেই আছে হয়তো। তুমি যাও টেবিলে। আমি সন্ধিকে নিয়ে আসছি।
বলেই সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। বরাবর আমার রুমের দিকে এগুলাম।দরজার সামনে যেতেই খেয়াল করলাম সন্ধি হাঁটু মুড়ি দিয়ে হাঁটুর উপর মাথা ঠেঁক দিয়ে খাটে বসে আছে। কাছে গিয়ে পিঠে হাত রাখতেই ভয় পেয়ে আমার দিকে তাকাল। লক্ষ্য করলাম অজোর ধারায় শ্রাবণের বৃষ্টি তার চোখ দিয়ে বইছে। কিছুটা অস্বস্তি হচ্ছিল তার কান্না দেখে। পাশে বসে তার চোখটা মুছে দিলাম। আমার আলতো হাতের স্পর্শ পেয়ে সে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিয়ে বলল
- তন্দ্রা আপি সত্যিই আমি কিছু করিনি। তুই আমাকে ভুল বুঝিস না। এখন আমি কি করব?আমার তো কিছুই ভালো লাগছে না। আমি কিছু করলে তো তোকে বলতাম। আর আমি তো পড়ি গার্লস স্কুলে ছেলে কোথায় পাব? আর আমার তো মোবাইল নেই যে কোনো ছেলের সাথে প্রেম করব।
আমি বুঝতে পারছিলাম না কি বলব। সন্ধির কথাতেও বেশ যুক্তি ছিল।আবার প্র্যানেন্সির বিষয়টাও সঠিক। কোনটা বিশ্বাস করব কোনটা করব না সেটাই এখন বড় বিষয়।বেশ অসহায় লাগছিল তখন। সন্ধিকে অবিশ্বাস করতেও বেশ কষ্ট হচ্ছে আবার বিশ্বাস করতেও পারছি না।উভয় সংকটে পড়ে গেলাম মনে হচ্ছে। কিছু না বলে সন্ধির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম
- চিন্তা করিস না।কালকে ডাক্তারের সাথে কথা বলে গর্ভপাতের ব্যাবস্থা করে আসব। কারও সাথে কিছু না করলে প্র্যাগনেন্ট হতি না। অবশ্যই কিছু করেছিস। জানি তোকে জিজ্ঞেস করলে মিথ্যায় বলবি। এখন তো গর্ভাপাত ছাড়া কোনো উপায় নেই এটাই করিয়ে আসব আগে।আর যার সাথেই এ নিকৃষ্ট কাজটা করেছিস দ্বিতীয় বার করার আগে ভেবে করিস। কারণ নিজের সন্তান খুন করতে হচ্ছে তোকে আর যেন সেটা করতে না হয়।
সন্ধি আমার কথা শোনে জোরে কেঁদে দিয়ে বলল
- কেন যে তুই আমাকে বিশ্বাস করছিস না। তোকে তো আমি সব বলি এমন কিছু হলে তো লুকাতাম না। আমাকে বিশ্বাস কর প্লিজ।
আমি সন্ধির কথাটা এড়িয়ে গিয়ে বললাম
- এখন আর এসব বলতে হবে না। চল এবার খেতে চল। বিষয়টা সায়রা আপুর কানে যেন না যায়। সায়রা আপু জানলে প্রাণে মেরে ফেলবে তোকে, সেই সাথে আমাকেও। তাই বিষয়টা নিয়ে কোনো বাড়াবাড়ি কান্নাকাটি আর দেখতে চাই না। হাত মুখ ধুয়ে টেবিলে আয়। চুপচাপ খেয়ে উঠবি।
সন্ধি আমার কথা শোনে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ গুলো মুছতে লাগল। আমি সন্ধির দিকে তাকিয়ে থাকার সাহস করলাম না কারণ তাকিয়ে থাকলে পুনরায় আবেগে গধোগধো হয়ে যাব।চুপ করে রুম থেকে বের হয়ে চলে আসলাম। টেবিলে গিয়ে খেয়াল করলাম আপু খাবার নিয়ে চুপ করে বসে আছে। আমি যেতেই আপু বলে উঠল
- আয় খেতে বস। সন্ধি আসবে না?
- আসতেছে ও।
- ভাইয়া আসবে কখন?
- তোর ভাইয়া ব্যবাসায়ের কাজে ঢাকায় গেছে আসতে কয়েকদিন দেরি হবে।
উল্লেখ্য যে ভাইয়া সায়রা আপুর সাথে আমাদের বাড়িতেই থাকে। কারণ আপু শ্বশুর বাড়ি চলে গেলে আমাদের দেখার মতো কেউ থাকবে না তাই আপু এ রাজমহলেই থাকে। রাজমহল বলতে এটা রাজাদের রাজমহল না। এটা আমাদের বসবাসকৃত বাসাটা।আমার বাবার শখ ছিল রাজাদেের মতো বাড়ি বানাবে। তাই শহর থেকে একটু দূরে নিরিবিলি একটা জায়গায় লোকালয়ের একটু আড়ালে স্বস্তায় জমি কিনে। জমিটা পানির দামে পেয়েছিল একদম। তারপর সে জমিতে এ বাড়িটা বানিয়েছিল আর নাম দিয়েছিল রাজমহল। দুঃখের বিষয় এটাই যে আমার মা বাবার কেউ এ বাড়িতে থাকতে পারেনি। যেদিন আমরা এ বাড়িতে শিফট হই সেদিন বড় একটা এক্সিডেন্ট হয়। সে এক্সিডেন্টে আমরা তিন বোন বেঁচে গেলেও বাবা মা মরে যায়। বাবা মা এ বাড়িতে এসেছিল তবে লাশ হয়ে। নিজের বানানো রাজমহলটা সাজানোর পর বাবা এ বাড়িটা দেখতে পারেনি এটা ভেবেই কষ্টে বুক ফেটে যায় এখনো। এরপর থেকে আমরা তিন বোনেই এ বাড়িতে থাকি। মা বাবা বিহীন এতিম মেয়ে। এর মধ্যে তিনমাস আগে সায়রা আপুর অনিক ভাইয়ার সাথে বিয়ে হয়। বেশ ভালোই চলছিল আমাদের জীবন। তবে সন্ধির বিষয়টা এখন ভাবাচ্ছে বেশি।
যাইহোক ঘটনায় আসা যাক। আমি আপুকে আমার মুখটা হালকা প্রশস্ত করে বললাম
- আচ্ছা তাই বলো।
এর মধ্যেই সন্ধি উপস্থিত হলো টেবিলের সামনে। চেয়ারটা টেনে বসলো। সায়রা আপু দুজনকে খাবার দিল। দুজনেই খাবারটা নিয়ে নাড়তে লাগলাম। গলা দিয়ে যেন খাবার নামছে না। সায়রা আপু কিছুটা দমক দিয়ে বলল
- তোরা খাবার না খেয়ে এমন ভাবে বাচ্চাদের মতো খাবার নাড়ছিস কেন?
সায়রা আপুর তীর্যক কন্ঠে দুজনের ভেতরেই ধক করে উঠল। দুজনেই আমতা আমতা করে একসাথে বলে উঠলাম
- খেতে ইচ্ছা করছে না।
সায়রা আপু গলাটা বজ্রপাতের ন্যায় কর্কশ করে বলল
- দশ মিনিটের মধ্যে সব খাবার শেষ কর। নাহয় পিটিয়ে পিঠের ছাল তুলব। সারাদিন খাবে না তারপর মাথা ঘুরে পড়বে আর বলবে আমার কেমন জানি লাগছিল। চুপ চাপ খেয়ে উঠ।
আমি আর সন্ধি সায়রা আপুর বকা শোনে চুপচাপ খেয়ে উঠলাম। যদিও জোর পূর্বক গিলেছি শুধু।রুমে এসে দুজনেই শুলাম। সন্ধি ঐদিক ফিরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর আমি একবার এপাশ আরেকবার ওপাশ হয়ে শুধু ভাবছি কি করব। বাচ্চা গর্ভপাত করাতেও মন সায় দিচ্ছে না। জমজ দুইটা বাচ্চার খুনী হব ভেবেই যেন বুকে কষ্টের বান বিদ্ধ হচ্ছিল। নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না। হালকা পানি পড়তে লাগল চোখ দিয়ে। কাঁদতে কাঁদতেই মাথায় ঘুরতে থাকা সব এলোমেলো প্রশ্ন নিয়ে ঘুমিয়ে গেলাম।
আমি ঘুমিয়ে গেলেও সন্ধি ঘুমায়নি। হুট করে তার মনে হলো সন্তান খুনের চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো। তার উপর এতকিছু হচ্ছে যার কোনো ভিত্তি নেই। এসব ভেবে মনের অশান্তি বাড়ছিল তার। কচি বয়স, বাচ্চা মেয়ে তার চিন্তা ভাবনার বিস্তৃতিও কম। তাই সিদ্ধান্ত নিল যে,নিজেকে শেষ করে দিবে। যেই চিন্তা সেই কাজ। বুকের উড়নাটা ফ্যানে ঝুলিয়ে দিয়ে খানিকক্ষণ চুপ থেকে ঝুলে পড়ল।
সকাল বেলা এটুকু ঘটনা বলেই সন্ধি হাঁপাতে লাগল। সন্ধির মুখ থেকে এটুকু শোনে আমি অবাক হয়ে বললাম
- তুই যদি ফ্যানে ঝুলে পড়িস তাহলে তো তোর মরে যাওয়ার কথা কিন্তু বেঁচে আছিস যে?
সন্ধি গলার স্বরটা গম্ভীর করে বলল
- তারপর যা হয়েছিল সেটার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। এমন কিছু হবে আমি চিন্তা করেনি। কেনই বা এমন হলো সেটার যৌক্তিক কারণ আমার জানা নেই। জানিনা তুই বিশ্বাস করবি কিনা। তবে সত্যি যা ঘটেছে তা বিশ্বাস যোগ্য না।
আমি সন্ধির কথা শোনে অবাক চোখে তার দিকে খেয়াল করে দেখলাম তার কপালে ইষৎ ঘামের আভাস পড়েছে। নীচের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করছে। আমি হালকা হাতে তার বাহু ধরে বললাম
- কী হয়েছে?
সন্ধি আমার দিকে তাকাল। তাকতেই সন্ধির চোখগুলো দেখে ভয় পেয়ে গেলাম। খেয়াল করলাম চোখ দুটো লাল হয়ে ফুলে আছে। হুট করে চোখ ফুললো কীভাবে ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত লাগল।আর চোখটা এমনভাবে লাল হয়ে ফুলেছে যে চোখের মনি ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে এভ্রোথেভ্রো পাহাড়ের টিলা চারপাশে উঠে চোখটা গর্তে চলে গেছে। সন্ধির এ অবস্থা দেখে ভয় পেয়েও নিজেকে সামলে নিলাম। এর মধ্যে সন্ধি তড়িৎ গতিতে নিঃশ্বাসটা জোরে জোরে নিয়ে বলল-
গল্পের নাম রাজমহল
লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব-3
এর মধ্যে সন্ধি তড়িৎ গতিতে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল
- আমি ফ্যানে ঝুলে পড়েছিলাম এটা একদম সত্য। আমি যখন ফ্যানে ঝুলে পড়লাম তখন মনে হলো আমি ফ্যানে না একটা ফুলের দোলনায় ঝুলছি। একটা বড় গাছ। গাছটা কি গাছ জানি না। তবে সে গাছে দঁড়ি দিয়ে একটা দোলনা ঝুলানো ছিল। সেই দোলনাটা ফুল দিয়ে সাজানো গোছানো ছিল।খেয়াল করলাম আমি সেখানে দুলছি। চারদিক থেকে ফুলের সৌরভ ভেসে আসছে। পাখির কিচিরমিচির ডাক শোনা যাচ্ছে। সূর্যটা তখন পশ্চিম দিকে হেলে পড়ে আকাশটা লালচে হয়ে ছিল।শুভ্র বাতাস চারদিকে বইতেছিল। অসম্ভব এক মায়াময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে যা বলে বর্ণণা করা দুষ্কর।
এর কিছুক্ষণ পর কেউ একজন আমার সামনে আসলো। আমি তাকিয়ে দেখলাম লোকটা কালো লুঙ্গি টাইপ কিছু পরে আছে। মুখে আবার জাদলেরি গোফও আছে। বলিষ্ঠ দেহের ভয়ংকর মুখ অবয়ব বিশিষ্ট। লক্ষ্য করলাম হাতে ছুরি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমার কাছে এসে হুংকার দিয়ে বলল
- আরেকবার যদি মরার চেষ্টা করিস তাহলে তোর কপালে অনেক দুঃখ আছে। একদম মরার চেষ্টা করবি না। তবে একবার যখন মরার চেষ্টা করেছিস এখন তোকে শাস্তি না দিলে আবার এমন ভুল করবি। তাই তোকে ছোট করে একটা শাস্তি দিব।
লোকটার কথাগুলোতে যেন মাটিও কাঁপছিল। আমি বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। গলার পানি শুকিয়ে গেল আমার। লোকটা আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। আমি ভয়ে দোলনা থেকে নামতে নিলে লোকটা আমায় ধরে আমার চোখদুটো উপরে দিল। কি যে এক অবস্থা বলে বুঝাতে পারব না। আমার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। আমার চোখ দিয়ে তখন রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগল। আমি ব্যাথায় কাতর হয়ে কাঁপতে লাগলাম।তারপর চোখটা বন্ধ করলাম।
চোখ বন্ধ করার সাথে সাথে মনে হলো কোথাও আঁচড়ে পড়লাম আমি। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম আমি বিছানায় শুয়ে আছি। বন্ধ ফ্যানটা প্রবল গতিতে চলছে। গলার উড়নাটা পাশে পড়ে আছে। উড়নায় রক্ত দেখে হালকা ভয় পেয়ে গেলাম। রক্তটা ভালো করে খেয়াল করতে গিয়ে দেখলাম আমার চোখ বেয়ে রক্ত পড়ছে। মনে হলে এখনো গা টা শিউরে উঠে। বলেই সন্ধি চোখটা বন্ধ করে নীচের দিকে তাকিয়ে পড়ল।
সন্ধির কথাগুলো শোনে আমার বুকটা ধকধক করছিল। হার্টবিট যেন প্রবল ভাবে উঠানামা করছিল। সন্ধির চোখগুলো ওমন হলো কি করে সে বিষয়টাও ভাবাচ্ছিল। ভয়ে ভয়ে সন্ধির কাঁধে হাত দিতেই সন্ধি আমার দিকে তাকাল। সন্ধিকে এবার দেখে আমি শিউরে উঠলাম। গায়ের লোম কাঁটা দিয়ে উঠল। সন্ধির এভ্রোথেভ্রো পাহাড়ের মত ফুলা চোখটা দিয়ে অজোর ধারায় রক্ত বের হচ্ছে। যে বিষয়টা একটু আগে সন্ধি বর্ণনা করল ঠিক সেভাবে। আমি একটা চিৎকার দিয়ে নীচের দিকে তাকালাম।
আমার চিৎকার শোনে পাশের রুম থেকে সায়রা আপু দৌঁড়ে আসলো। আপু এসে আমাকে ধাক্কা দিতে দিতে বলল
- কি হয়েছে তোর? এমনভাবে চেঁচিয়ে উঠলি কেন?
আমি কোনো কথার জবাব দিতে পারছিলাম না। নীচের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলাম।নিঃশ্বাস ক্ষণে ক্ষণে গভীর হতে লাগল। আপু আমার কথার জবাব না পেয়ে সন্ধিকে জিজ্ঞেস করতে লাগল।
- কি রে সন্ধি তন্দ্রা হুট করে চেঁচিয়ে উঠল কেন?তুই কি কিছু করেছিস?
সন্ধি হালকা ঢুক গিলতে গিলতে বলল
- জানি না কি হলো তন্দ্রা আপুর। কেনই বা চেঁচিয়ে উঠল জানি না। আমি সত্যিই কিছু করেনি।
সন্ধির কথা শোনে ভাবতে লাগলাম সায়রা আপু সন্ধির চোখের অবস্থা কি দেখেনি? দেখলে এতটা স্বাভাবিক ভাবে সন্ধির সাথে কথা বলছে কীভাবে? এসব ভেবে নিজের মনে সাহস জুগিয়ে মাথাটা উপরে তুলে সন্ধির দিকে তাকালাম। বেশ অবাক হলাম। কারণ সন্ধি একদম স্বাভাবিক আর সন্ধির চোখও একদম স্বাভাবিক । তাহলে ঐটা আমার ভুল ছিল নাকি এখনের বিষয়টা ভুল। সায়রা আপু আমাকে সন্ধির দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে সন্ধিকে ধমক দিয়ে বলল
- তুই নিশ্চয় ওকে কিছু করেছিস। নাহয় ও তোকে এভাবে দেখছে কেন? কি করেছিস ওকে আর এভাবে ও চেঁচিয়ে উঠল কেন? তোরা এত লাগতে পারিস। সকালে উঠেই মারামারি শুরু করে দিয়েছিস।আমার হয়েছে যত জ্বালা।
সন্ধি আপুর কথা শোনে অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল আমার দিকে। আমি ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম
- আপু ও কিছু করেনি। আমার যে কি হলো। তেলাপোকা দেখে এভাবে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম। সন্ধি কিছু করেনি।
আপু তেলাপোকার কথাটা শোনে বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল
- তোরা পারিস ও। সারাটা দিন কি গুজোর গুজোর ফুসোর ফুসোর করিস রে।
আপুকে কি উত্তর দিব বুঝতে পারছিলাম না। আমি আর সন্ধি দুজন দুজনের দিকে তাকালাম পরক্ষণে আপুর দিকে তাকিয়ে আমি বললাম
- আরে কি যে বলো না। সন্ধি জানই তো কেমন আমার পিছনে লাগে।
সন্ধি চোখগুলো বড় বড় করে বলল
- আপু আমি কিছু করিনা তন্দ্রা আপু আমার সাথে শুধু ঝগড়া করে।
আমাদের একে অপরের দোষ দেওয়ার বিষয়টা আপু দেখে বলল
- হয়েছে আর একে অন্যকে দোষ দিতে হবে না। এখন হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বস। এক ঘন্টা পড়বি। তারপর খাবার টেবিলে যাবি। যা বলেছি তাই করবি। কথার নড়চড় যেন না হয়।
আমি আর সন্ধি দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে মুখটাকে বাঁকা চাঁদের মতো প্রশস্ত করে বললাম
- আচ্ছা ঠিক আছে।
সায়রা আপু রুম থেকে বের হলো। সায়রা আপু বের হওয়ার সাথে সাথে সন্ধি বলে উঠল
- কি রে তোর কি হয়েছিল? এভাবে চেঁচিয়ে উঠলি কেন?
- জানি না কি হয়েছে। তোর চোখগুলো দিয়ে কমন জানি রক্ত বের হচ্ছিল তখন তাই। সত্যিই কি তোর সাথে এমন হয়েছে নাকি স্বপ্ন দেখেছিস?
সন্ধি আমার কথাটা শোনে পাশ থেকে উড়নাটা নিয়ে সেটা প্রশস্ত করে হাত দিয়ে একটা জায়গা নির্দেশ করে দেখিয়ে বলল
- আমি একদম সত্যি বলছি কোনো মিথ্যা বলছি না। যদি এটা আমার স্বপ্ন হত তাহলে এ উড়নায় রক্তের দাগ কি করে আসলো বল। আমি জানি না আমার সাথে কী হচ্ছে। কীভাবে প্র্যাগন্যান্ট হলাম সেটাও আমার জানার অন্তরায়। নিজেকে শেষ করে দিতে চাইলাম তাও হলো না। কী যে হলো আমার আর কেন হচ্ছে জানি না।
বলেই হালকা কেঁদে দিল ও। আমি উড়নার দিকে তাকিয়ে দেখলাম সত্যিই উড়নাটাতে ঘন রক্ত জমাট বেঁধে হালকা কালো কালো হয়ে আছে।মনে হচ্ছে রাতে কেউ এতে রক্ত মেখেছে আর সারা রাতে সেটা শুকিয়ে এমন জমাট বেঁধে আছে। আমি ও বুঝতে পারছিলাম না আমার সাথে এসব কি হচ্ছে। বারবার এসব অভান্তর আজগুবি জিনিসেই বা কেন দেখছিলাম। মনে হচ্ছে বিষয়টাতে কোনো রহস্য আছে। থাকলেই বা সেটাতে কি রহস্য। বেশ অদ্ভূত লাগছে বিষয়টা। সন্ধির দিকে তাকিয়ে দেখলাম সন্ধি ততক্ষণে কেঁদে চোখ ভাসিয়ে একাকার করে ফেলেছে। সন্ধির কান্না দেখে তাকে হালকা ধমক দিয়ে বললাম
-একদম কাঁদবি না।এখন এভাবে কাঁদলে সায়রা আপু সন্দেহ করে বসবে। চল ফ্রেশ হয়ে নিই। ডাক্তারের সাথে কথা বলে গর্ভপাতের ব্যবস্থা করব। আমার কাছে জামনো কিছু টাকা আছে। তোর কাছে কোনো টাকা থাকলে দে।
সন্ধি চোখটা মুছতে মুছতে তার ব্যাগ থেকে জমানো কিছু টাকা বের করে আমার হাতে গুজে দিল। তারপর দুজন ফ্রেশ হয়ে নিলাম। আপুর কথা মতো একঘন্টা পর খাবার টেবিলে গেলাম। দুজনেই খেয়ে নিলাম। বান্ধবীর বাবাকে দেখার কথা বলে দুজন আবার বের হয়ে ডাক্তারের চেম্বারের দিকে রওনা দিলাম।
অবশেষে ডাক্তারের কাছে পৌঁছালাম। ডাক্তারকে অবশ্য বলিনি সন্ধি বিবাহিত না। ডাক্তারকে বলেছিলাম সন্ধি বিবাহিত।
ওহ তখন তো ডাক্তারের পরিচয় দেওয়া হয়নি৷এখন দিয়ে দিই তাহলে। ডাক্তারের নাম রাহনুমা পারভীন।
আমি আর সন্ধি ডাক্তার রাহনুমা পারভীনের চেম্বারে ঢুকতেই উনি একটা হাসি দিয়ে বলল
-কি ব্যপার আজকে আবার আসলেন। আমি তো বলেছিলাম একমাস পর চেক আপ করতে আসতে।কোনো সমস্যা হয়েছে কি?
আমি হালকা ঢুক গিলতে লাগলাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সন্ধিও আমার পাশে নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। গর্ভপাতের বিষয়টা কীভাবে বলব সেটাও ভাবতে লাগলাম। ভয় হচ্ছিল ভেতরে। কথা বলতে গিয়েও যেন গলা কেঁপে উঠছিল। আমাকে আর সন্ধিকে এভাবে নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উনি হালকা ডেকে বলল
- কি ব্যপার নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আপনার বোনকে নিয়ে চেয়ারটা টেনে বসুন। আর বলুন কি সমস্যা।
আমি আর সন্ধি চেয়ারটা টেনে বসলাম। তারপর ডাক্তার রাহনুমার দিকে তাকিয়ে বললাম
- সন্ধির বয়স অল্প। আমরা চাচ্ছি না সন্ধি এখনেই বাচ্চার মা হোক। আমার বাবা, মা কেউ নেই আর সন্ধিরও বাবা মা কেউ নেই। হয়তো তারা থাকলে বিষয়টা তারা দেখত। এখন সন্ধির ইচ্ছা এ বাচ্চা জন্ম না দেওয়ার। গর্ভপাতের ব্যবস্থা কি করা যায় না?
ডাক্তার আমার কথা শোনে একটু ভেবে বলল
- গর্ভপাত করানোর আগে একটু ভেবে দেখেন। কারন অনেকে বাচ্চা পায়না। আপনার বোন দুটো বাচ্চার মা হতে চলেছে বাচ্চা নষ্ট করা কি ঠিক হবে?
- ম্যাম ওর বসয় কম। আমাদের বড় কোনো অভিভাবকও নেই। এখন বাচ্চা নিলে লালন পালনেরও একটা বিষয় আছে।শ্বশুড় বাড়িতে ওকে কেউ এখনো মেনে নেয়নি। প্রেমের বিয়ে। একটা বাচ্চার দায়িত্ব নেওয়া অনেক রিস্ক হয়ে যাবে। ও এখনো স্টুডেন্ট। ওর পড়াশোনাও ব্যাঘাত ঘটবে। মানসিক দিক দিয়েও ও প্রস্তুত না। সব দিক বিবেচনা করে আমরা কেউ চাচ্ছি না সন্ধির বাচ্চাটার জন্ম হোক।আপনি গর্ভপাতের ব্যবস্থা করুন।
ডাক্তার রাহনুমা এবার আমার কথা শোনে কিছুক্ষণ ভেবে বলল
- যে বিষয়টা বলেছেন সেটা যদিও ঠিক। তবে অভিভাবক ছাড়া গর্ভপাত করা সম্ভব না। উনার স্বামীকে নিয়ে আসবেন। উনার স্বামী ব্যাতীত গর্ভপাত করতে পারব না। এক সপ্তাহ পর উনার স্বামীকে সহ নিয়ে আসবেন। আর কিছু টেস্ট লিখে দিলাম এগুলো করে রাখবেন। উনার বয়স কম তিনমাস হয়ে গেছে প্র্যগানেন্সির গর্ভপাতেও বেশ ঝুঁকি হতে পারে ভেবে চিন্তায় আসবেন।
- হ্যাঁ তা আসা যাবে। কিন্তু হাসপাতালে কি থাকা লাগবে?
- নাহ থাকা লাগবে না। সকালে করলে রাতেই নিয়ে যেতে পারবেন। সারাদিন থাকতে হবে আরকি।
- আচ্ছা ঠিক আছে ম্যাম। আমরা উঠলাম।
বলেই ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হলাম।রিকশা নিলাম বাসার উদ্দেশ্য। অভিভাবক কোথায় পাব এটা ভেবেই অস্থির হচ্ছিলাম।
অনেক ভেবে হাসিবকে কল দিলাম। হাসিব আমার বয়ফ্রেন্ড। অনার্স চতুর্থ বর্ষে পড়ে। আমার কল ধরতেই ওকে সবটা খুলে বললাম। ওকে সন্ধির অভিভাবক হতে বললাম। স্বামী সাজিয়ে নিয়ে যাব বললাম।ও রাজি হতে চায় নি তবে আমাদের বিষয় বিবেচনা করে রাজি হলো।
বাসায় আসার পর সবকিছু এলোমেলো লাগছিল।দুই দুইটা বাচ্চা খুন করতে হবে ভেবেই যেন আনমনা হচ্ছিলাম বারবার। আপুকে বলব কীভাবে সেটাও বুঝতে পারছিলাম না। বলা উচিত হবে কিনা বুঝতে পারছিলাম না।তবে আপু জানলে প্রাণে মেরে ফেলবে।তাই আপুকে বলা থেকে বিরত থাকলাম।এদিকে সন্ধির বাচ্চার বাবা কে সেটাও বের করতে পারেনি এখনো। তার উপর এত সব ঘটনা সব যেন মনটাকে এলোমেলো করে তুলছিল।এলোমেলো সব প্রশ্ন নিয়েই সারাদিন পার করলাম।
পরদিন সকালে কলেজে না গিয়ে সন্ধিকে নিয়ে গেলাম টেস্ট করাতে। সাথে হাসিবকে নিয়ে গেলাম।হাসিবও সব শোনে অবাক হলো। আমার মতো হাসিবের ও একই প্রশ্ন সন্ধির বাচ্চার বাবা কে? কিন্তু সন্ধি সেটা বলতে নারাজ। তবে এটা নিয়ে ভাবলে তো আর হবে না সন্ধির মান সম্মানটা আগে বাঁচাতে হবে। তাই সন্ধির সকল টেস্ট শেষে কলেজের সময় পর্যন্ত আর সন্ধির স্কুলের সময় পর্যন্ত বাইরে কাটিয়ে বাসায় আসলাম। হাসিব ও চলে গেল।
সন্ধি কেমন জানি মনমরা হয়ে গেছিল। হবেই বা না কেন নিজের সন্তান খুন করতে যাচ্ছে এর থেকে কষ্টের আর কি হতে পারে। আমার ভেতরটাও জ্বলে পুড়ে যাচ্ছিল। দুইটা বাচ্চা খুন করব ভেবেই যেন আকুল হয়ে যাচ্ছিলাম। নিজেকে সামলাতে চেয়েও পারছিলাম না। সারাদিন অসহ্য গ্লানির যন্ত্রণা নিয়ে পার করলাম। রাতে খেয়ে দুজনেই শুয়ে পড়লাম। সন্ধি ওপাশ ফিরে হালকা হালকা কাঁদছে। আমি এপাশ ফিরে আনমনে এসব নিয়ে ভাবছি। ভাবতেই ভাবতেই চোখটা বুজে এলো। এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল। আমি ফোনটা হাতে নিতেই দেখলাম রাত তিনটে বাজে আর হাসিব কল দিয়েছে। আমি ঘুম ঘুম চোখে হাসিবের কলটা ধরে হ্যালো বলতেই হাসিবের কন্ঠস্বর শোনে ভয় পেয়ে গেলাম।
গল্পের নাম রাজমহল
লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব-3
এর মধ্যে সন্ধি তড়িৎ গতিতে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল
- আমি ফ্যানে ঝুলে পড়েছিলাম এটা একদম সত্য। আমি যখন ফ্যানে ঝুলে পড়লাম তখন মনে হলো আমি ফ্যানে না একটা ফুলের দোলনায় ঝুলছি। একটা বড় গাছ। গাছটা কি গাছ জানি না। তবে সে গাছে দঁড়ি দিয়ে একটা দোলনা ঝুলানো ছিল। সেই দোলনাটা ফুল দিয়ে সাজানো গোছানো ছিল।খেয়াল করলাম আমি সেখানে দুলছি। চারদিক থেকে ফুলের সৌরভ ভেসে আসছে। পাখির কিচিরমিচির ডাক শোনা যাচ্ছে। সূর্যটা তখন পশ্চিম দিকে হেলে পড়ে আকাশটা লালচে হয়ে ছিল।শুভ্র বাতাস চারদিকে বইতেছিল। অসম্ভব এক মায়াময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে যা বলে বর্ণণা করা দুষ্কর।
এর কিছুক্ষণ পর কেউ একজন আমার সামনে আসলো। আমি তাকিয়ে দেখলাম লোকটা কালো লুঙ্গি টাইপ কিছু পরে আছে। মুখে আবার জাদলেরি গোফও আছে। বলিষ্ঠ দেহের ভয়ংকর মুখ অবয়ব বিশিষ্ট। লক্ষ্য করলাম হাতে ছুরি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমার কাছে এসে হুংকার দিয়ে বলল
- আরেকবার যদি মরার চেষ্টা করিস তাহলে তোর কপালে অনেক দুঃখ আছে। একদম মরার চেষ্টা করবি না। তবে একবার যখন মরার চেষ্টা করেছিস এখন তোকে শাস্তি না দিলে আবার এমন ভুল করবি। তাই তোকে ছোট করে একটা শাস্তি দিব।
লোকটার কথাগুলোতে যেন মাটিও কাঁপছিল। আমি বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। গলার পানি শুকিয়ে গেল আমার। লোকটা আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। আমি ভয়ে দোলনা থেকে নামতে নিলে লোকটা আমায় ধরে আমার চোখদুটো উপরে দিল। কি যে এক অবস্থা বলে বুঝাতে পারব না। আমার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। আমার চোখ দিয়ে তখন রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগল। আমি ব্যাথায় কাতর হয়ে কাঁপতে লাগলাম।তারপর চোখটা বন্ধ করলাম।
চোখ বন্ধ করার সাথে সাথে মনে হলো কোথাও আঁচড়ে পড়লাম আমি। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম আমি বিছানায় শুয়ে আছি। বন্ধ ফ্যানটা প্রবল গতিতে চলছে। গলার উড়নাটা পাশে পড়ে আছে। উড়নায় রক্ত দেখে হালকা ভয় পেয়ে গেলাম। রক্তটা ভালো করে খেয়াল করতে গিয়ে দেখলাম আমার চোখ বেয়ে রক্ত পড়ছে। মনে হলে এখনো গা টা শিউরে উঠে। বলেই সন্ধি চোখটা বন্ধ করে নীচের দিকে তাকিয়ে পড়ল।
সন্ধির কথাগুলো শোনে আমার বুকটা ধকধক করছিল। হার্টবিট যেন প্রবল ভাবে উঠানামা করছিল। সন্ধির চোখগুলো ওমন হলো কি করে সে বিষয়টাও ভাবাচ্ছিল। ভয়ে ভয়ে সন্ধির কাঁধে হাত দিতেই সন্ধি আমার দিকে তাকাল। সন্ধিকে এবার দেখে আমি শিউরে উঠলাম। গায়ের লোম কাঁটা দিয়ে উঠল। সন্ধির এভ্রোথেভ্রো পাহাড়ের মত ফুলা চোখটা দিয়ে অজোর ধারায় রক্ত বের হচ্ছে। যে বিষয়টা একটু আগে সন্ধি বর্ণনা করল ঠিক সেভাবে। আমি একটা চিৎকার দিয়ে নীচের দিকে তাকালাম।
আমার চিৎকার শোনে পাশের রুম থেকে সায়রা আপু দৌঁড়ে আসলো। আপু এসে আমাকে ধাক্কা দিতে দিতে বলল
- কি হয়েছে তোর? এমনভাবে চেঁচিয়ে উঠলি কেন?
আমি কোনো কথার জবাব দিতে পারছিলাম না। নীচের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলাম।নিঃশ্বাস ক্ষণে ক্ষণে গভীর হতে লাগল। আপু আমার কথার জবাব না পেয়ে সন্ধিকে জিজ্ঞেস করতে লাগল।
- কি রে সন্ধি তন্দ্রা হুট করে চেঁচিয়ে উঠল কেন?তুই কি কিছু করেছিস?
সন্ধি হালকা ঢুক গিলতে গিলতে বলল
- জানি না কি হলো তন্দ্রা আপুর। কেনই বা চেঁচিয়ে উঠল জানি না। আমি সত্যিই কিছু করেনি।
সন্ধির কথা শোনে ভাবতে লাগলাম সায়রা আপু সন্ধির চোখের অবস্থা কি দেখেনি? দেখলে এতটা স্বাভাবিক ভাবে সন্ধির সাথে কথা বলছে কীভাবে? এসব ভেবে নিজের মনে সাহস জুগিয়ে মাথাটা উপরে তুলে সন্ধির দিকে তাকালাম। বেশ অবাক হলাম। কারণ সন্ধি একদম স্বাভাবিক আর সন্ধির চোখও একদম স্বাভাবিক । তাহলে ঐটা আমার ভুল ছিল নাকি এখনের বিষয়টা ভুল। সায়রা আপু আমাকে সন্ধির দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে সন্ধিকে ধমক দিয়ে বলল
- তুই নিশ্চয় ওকে কিছু করেছিস। নাহয় ও তোকে এভাবে দেখছে কেন? কি করেছিস ওকে আর এভাবে ও চেঁচিয়ে উঠল কেন? তোরা এত লাগতে পারিস। সকালে উঠেই মারামারি শুরু করে দিয়েছিস।আমার হয়েছে যত জ্বালা।
সন্ধি আপুর কথা শোনে অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল আমার দিকে। আমি ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম
- আপু ও কিছু করেনি। আমার যে কি হলো। তেলাপোকা দেখে এভাবে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম। সন্ধি কিছু করেনি।
আপু তেলাপোকার কথাটা শোনে বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল
- তোরা পারিস ও। সারাটা দিন কি গুজোর গুজোর ফুসোর ফুসোর করিস রে।
আপুকে কি উত্তর দিব বুঝতে পারছিলাম না। আমি আর সন্ধি দুজন দুজনের দিকে তাকালাম পরক্ষণে আপুর দিকে তাকিয়ে আমি বললাম
- আরে কি যে বলো না। সন্ধি জানই তো কেমন আমার পিছনে লাগে।
সন্ধি চোখগুলো বড় বড় করে বলল
- আপু আমি কিছু করিনা তন্দ্রা আপু আমার সাথে শুধু ঝগড়া করে।
আমাদের একে অপরের দোষ দেওয়ার বিষয়টা আপু দেখে বলল
- হয়েছে আর একে অন্যকে দোষ দিতে হবে না। এখন হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বস। এক ঘন্টা পড়বি। তারপর খাবার টেবিলে যাবি। যা বলেছি তাই করবি। কথার নড়চড় যেন না হয়।
আমি আর সন্ধি দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে মুখটাকে বাঁকা চাঁদের মতো প্রশস্ত করে বললাম
- আচ্ছা ঠিক আছে।
সায়রা আপু রুম থেকে বের হলো। সায়রা আপু বের হওয়ার সাথে সাথে সন্ধি বলে উঠল
- কি রে তোর কি হয়েছিল? এভাবে চেঁচিয়ে উঠলি কেন?
- জানি না কি হয়েছে। তোর চোখগুলো দিয়ে কমন জানি রক্ত বের হচ্ছিল তখন তাই। সত্যিই কি তোর সাথে এমন হয়েছে নাকি স্বপ্ন দেখেছিস?
সন্ধি আমার কথাটা শোনে পাশ থেকে উড়নাটা নিয়ে সেটা প্রশস্ত করে হাত দিয়ে একটা জায়গা নির্দেশ করে দেখিয়ে বলল
- আমি একদম সত্যি বলছি কোনো মিথ্যা বলছি না। যদি এটা আমার স্বপ্ন হত তাহলে এ উড়নায় রক্তের দাগ কি করে আসলো বল। আমি জানি না আমার সাথে কী হচ্ছে। কীভাবে প্র্যাগন্যান্ট হলাম সেটাও আমার জানার অন্তরায়। নিজেকে শেষ করে দিতে চাইলাম তাও হলো না। কী যে হলো আমার আর কেন হচ্ছে জানি না।
বলেই হালকা কেঁদে দিল ও। আমি উড়নার দিকে তাকিয়ে দেখলাম সত্যিই উড়নাটাতে ঘন রক্ত জমাট বেঁধে হালকা কালো কালো হয়ে আছে।মনে হচ্ছে রাতে কেউ এতে রক্ত মেখেছে আর সারা রাতে সেটা শুকিয়ে এমন জমাট বেঁধে আছে। আমি ও বুঝতে পারছিলাম না আমার সাথে এসব কি হচ্ছে। বারবার এসব অভান্তর আজগুবি জিনিসেই বা কেন দেখছিলাম। মনে হচ্ছে বিষয়টাতে কোনো রহস্য আছে। থাকলেই বা সেটাতে কি রহস্য। বেশ অদ্ভূত লাগছে বিষয়টা। সন্ধির দিকে তাকিয়ে দেখলাম সন্ধি ততক্ষণে কেঁদে চোখ ভাসিয়ে একাকার করে ফেলেছে। সন্ধির কান্না দেখে তাকে হালকা ধমক দিয়ে বললাম
-একদম কাঁদবি না।এখন এভাবে কাঁদলে সায়রা আপু সন্দেহ করে বসবে। চল ফ্রেশ হয়ে নিই। ডাক্তারের সাথে কথা বলে গর্ভপাতের ব্যবস্থা করব। আমার কাছে জামনো কিছু টাকা আছে। তোর কাছে কোনো টাকা থাকলে দে।
সন্ধি চোখটা মুছতে মুছতে তার ব্যাগ থেকে জমানো কিছু টাকা বের করে আমার হাতে গুজে দিল। তারপর দুজন ফ্রেশ হয়ে নিলাম। আপুর কথা মতো একঘন্টা পর খাবার টেবিলে গেলাম। দুজনেই খেয়ে নিলাম। বান্ধবীর বাবাকে দেখার কথা বলে দুজন আবার বের হয়ে ডাক্তারের চেম্বারের দিকে রওনা দিলাম।
অবশেষে ডাক্তারের কাছে পৌঁছালাম। ডাক্তারকে অবশ্য বলিনি সন্ধি বিবাহিত না। ডাক্তারকে বলেছিলাম সন্ধি বিবাহিত।
ওহ তখন তো ডাক্তারের পরিচয় দেওয়া হয়নি৷এখন দিয়ে দিই তাহলে। ডাক্তারের নাম রাহনুমা পারভীন।
আমি আর সন্ধি ডাক্তার রাহনুমা পারভীনের চেম্বারে ঢুকতেই উনি একটা হাসি দিয়ে বলল
-কি ব্যপার আজকে আবার আসলেন। আমি তো বলেছিলাম একমাস পর চেক আপ করতে আসতে।কোনো সমস্যা হয়েছে কি?
আমি হালকা ঢুক গিলতে লাগলাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সন্ধিও আমার পাশে নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। গর্ভপাতের বিষয়টা কীভাবে বলব সেটাও ভাবতে লাগলাম। ভয় হচ্ছিল ভেতরে। কথা বলতে গিয়েও যেন গলা কেঁপে উঠছিল। আমাকে আর সন্ধিকে এভাবে নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উনি হালকা ডেকে বলল
- কি ব্যপার নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আপনার বোনকে নিয়ে চেয়ারটা টেনে বসুন। আর বলুন কি সমস্যা।
আমি আর সন্ধি চেয়ারটা টেনে বসলাম। তারপর ডাক্তার রাহনুমার দিকে তাকিয়ে বললাম
- সন্ধির বয়স অল্প। আমরা চাচ্ছি না সন্ধি এখনেই বাচ্চার মা হোক। আমার বাবা, মা কেউ নেই আর সন্ধিরও বাবা মা কেউ নেই। হয়তো তারা থাকলে বিষয়টা তারা দেখত। এখন সন্ধির ইচ্ছা এ বাচ্চা জন্ম না দেওয়ার। গর্ভপাতের ব্যবস্থা কি করা যায় না?
ডাক্তার আমার কথা শোনে একটু ভেবে বলল
- গর্ভপাত করানোর আগে একটু ভেবে দেখেন। কারন অনেকে বাচ্চা পায়না। আপনার বোন দুটো বাচ্চার মা হতে চলেছে বাচ্চা নষ্ট করা কি ঠিক হবে?
- ম্যাম ওর বসয় কম। আমাদের বড় কোনো অভিভাবকও নেই। এখন বাচ্চা নিলে লালন পালনেরও একটা বিষয় আছে।শ্বশুড় বাড়িতে ওকে কেউ এখনো মেনে নেয়নি। প্রেমের বিয়ে। একটা বাচ্চার দায়িত্ব নেওয়া অনেক রিস্ক হয়ে যাবে। ও এখনো স্টুডেন্ট। ওর পড়াশোনাও ব্যাঘাত ঘটবে। মানসিক দিক দিয়েও ও প্রস্তুত না। সব দিক বিবেচনা করে আমরা কেউ চাচ্ছি না সন্ধির বাচ্চাটার জন্ম হোক।আপনি গর্ভপাতের ব্যবস্থা করুন।
ডাক্তার রাহনুমা এবার আমার কথা শোনে কিছুক্ষণ ভেবে বলল
- যে বিষয়টা বলেছেন সেটা যদিও ঠিক। তবে অভিভাবক ছাড়া গর্ভপাত করা সম্ভব না। উনার স্বামীকে নিয়ে আসবেন। উনার স্বামী ব্যাতীত গর্ভপাত করতে পারব না। এক সপ্তাহ পর উনার স্বামীকে সহ নিয়ে আসবেন। আর কিছু টেস্ট লিখে দিলাম এগুলো করে রাখবেন। উনার বয়স কম তিনমাস হয়ে গেছে প্র্যগানেন্সির গর্ভপাতেও বেশ ঝুঁকি হতে পারে ভেবে চিন্তায় আসবেন।
- হ্যাঁ তা আসা যাবে। কিন্তু হাসপাতালে কি থাকা লাগবে?
- নাহ থাকা লাগবে না। সকালে করলে রাতেই নিয়ে যেতে পারবেন। সারাদিন থাকতে হবে আরকি।
- আচ্ছা ঠিক আছে ম্যাম। আমরা উঠলাম।
বলেই ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হলাম।রিকশা নিলাম বাসার উদ্দেশ্য। অভিভাবক কোথায় পাব এটা ভেবেই অস্থির হচ্ছিলাম।
অনেক ভেবে হাসিবকে কল দিলাম। হাসিব আমার বয়ফ্রেন্ড। অনার্স চতুর্থ বর্ষে পড়ে। আমার কল ধরতেই ওকে সবটা খুলে বললাম। ওকে সন্ধির অভিভাবক হতে বললাম। স্বামী সাজিয়ে নিয়ে যাব বললাম।ও রাজি হতে চায় নি তবে আমাদের বিষয় বিবেচনা করে রাজি হলো।
বাসায় আসার পর সবকিছু এলোমেলো লাগছিল।দুই দুইটা বাচ্চা খুন করতে হবে ভেবেই যেন আনমনা হচ্ছিলাম বারবার। আপুকে বলব কীভাবে সেটাও বুঝতে পারছিলাম না। বলা উচিত হবে কিনা বুঝতে পারছিলাম না।তবে আপু জানলে প্রাণে মেরে ফেলবে।তাই আপুকে বলা থেকে বিরত থাকলাম।এদিকে সন্ধির বাচ্চার বাবা কে সেটাও বের করতে পারেনি এখনো। তার উপর এত সব ঘটনা সব যেন মনটাকে এলোমেলো করে তুলছিল।এলোমেলো সব প্রশ্ন নিয়েই সারাদিন পার করলাম।
পরদিন সকালে কলেজে না গিয়ে সন্ধিকে নিয়ে গেলাম টেস্ট করাতে। সাথে হাসিবকে নিয়ে গেলাম।হাসিবও সব শোনে অবাক হলো। আমার মতো হাসিবের ও একই প্রশ্ন সন্ধির বাচ্চার বাবা কে? কিন্তু সন্ধি সেটা বলতে নারাজ। তবে এটা নিয়ে ভাবলে তো আর হবে না সন্ধির মান সম্মানটা আগে বাঁচাতে হবে। তাই সন্ধির সকল টেস্ট শেষে কলেজের সময় পর্যন্ত আর সন্ধির স্কুলের সময় পর্যন্ত বাইরে কাটিয়ে বাসায় আসলাম। হাসিব ও চলে গেল।
সন্ধি কেমন জানি মনমরা হয়ে গেছিল। হবেই বা না কেন নিজের সন্তান খুন করতে যাচ্ছে এর থেকে কষ্টের আর কি হতে পারে। আমার ভেতরটাও জ্বলে পুড়ে যাচ্ছিল। দুইটা বাচ্চা খুন করব ভেবেই যেন আকুল হয়ে যাচ্ছিলাম। নিজেকে সামলাতে চেয়েও পারছিলাম না। সারাদিন অসহ্য গ্লানির যন্ত্রণা নিয়ে পার করলাম। রাতে খেয়ে দুজনেই শুয়ে পড়লাম। সন্ধি ওপাশ ফিরে হালকা হালকা কাঁদছে। আমি এপাশ ফিরে আনমনে এসব নিয়ে ভাবছি। ভাবতেই ভাবতেই চোখটা বুজে এলো। এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল। আমি ফোনটা হাতে নিতেই দেখলাম রাত তিনটে বাজে আর হাসিব কল দিয়েছে। আমি ঘুম ঘুম চোখে হাসিবের কলটা ধরে হ্যালো বলতেই হাসিবের কন্ঠস্বর শোনে ভয় পেয়ে গেলাম।
( Game খেলে লাখপতি হউন , এই মাসে সেরা লাখপতিদের তালিকা )
গল্পের নাম রাজমহল
লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব-4
আমি ঘুম ঘুম চোখে হাসিবের কলটা ধরে হ্যালো বলতেই হাসিবের কন্ঠস্বর শোনে ভয় পেয়ে গেলাম। হাসিব বিমর্ষ কন্ঠে হ্যালো বলেই থেমে গেল। ওপাশ থেকে হাসিবের দীর্ঘ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ভেসে আসছে। কি যেন বলতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না। মনে হচ্ছে তার কন্ঠস্বরটা আটকে আছে। হাসিবের এমন দশা দেখে কিছুটা স্তম্ভিত হয়ে বললাম
- কি হয়েছে হাসিব? এত চুপচাপ কেন? কিছু তো বলো।
হাসিব আমার কথাগুলো শোনেও মিনেট তিনেক নীরব ছিল। ওপাশ থেকে হাসিবের দীর্ঘ নিঃশ্বাস গুলোর শব্দই পাচ্ছিলাম। মিনেট তিনেক পর হাসিব একটু শান্ত হয়ে বলল
- সন্ধি কোথায়?
- কেন?
- আরে বলো না কোথায়?
আমি পাশে তাকিয়ে দেখলাম সন্ধি ঘুমাচ্ছে। তাই হাসিবকে বললাম
- আমার পাশেই তো শুয়ে আছে।
- মানে?
- আরে হ্যাঁ আমার পাশেই শুয়ে আছে। কেন বলতো।
- কিছুক্ষণ আগে সন্ধিকে দেখলাম।
- হাসিব তুমি কি পাগল হয়ে গেছ? সন্ধিকে দেখবে কি করে? সন্ধি আমার পাশে শুয়ে আছে আর ও এত রাতে তোমার কাছে যাবে কি করে?
হাসিব ঢুক গিলতে লাগল। মনে হচ্ছে পানি গদগদ করে ও গিলছে। খানিকটা চুপ থেকে আমাকে বলল
- তাহলে শোনো কি হয়েছে।
-হ্যাঁ বলো।
- আমি ল্যাপটপে কাজ করতেছিলাম একটু আগে। জানোই তো আমার রুমের দরজাটা খুলাই থাকে। রুমের সাথে বলেকনি থাকায় জানালাটাও খোলা রাখি সেই সাথে ব্যালকনির দরজা।
- হ্যাঁ সেটা তো জানি। কি হয়েছে সেটা বলো।
- হ্যাঁ বলছি। আমি কাজ করতেছিলাম। এমন সময় হুট করে আমার রুমের বাতি নিভে গেল। মেঘহীন আকাশটা কালো হয়ে গেল। আকাশের চাঁদটাকে কালো মেঘ ততক্ষণে গ্রাস করে পরিবেশটা নিকষ অন্ধকার হয়ে গেল। চারদিকে থমথমা পরিবেশ। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না এমন কেন হচ্ছে।বাসায় সবাই তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।আমি কিছুটা ভয় পেলেও মনে সাহস রাখলাম। এমন সময় আমার ঘরের দরজাটা থেকে বিকট আওয়াজ পেলাম। অন্ধকারে বুঝতে পারছিলাম না কি হচ্ছিল। তবে টের পাচ্ছিলাম দরজাটা বাতাসে বন্ধ হয়ে গেছে৷ সেই সাথে আরেকটা বিকট আওয়াজ আসলো জানালা থেকে। বুঝতে পারলাম বাতাসে জানালাটাও বন্ধ হয়ে গেছে। পরক্ষণেই টের পেলাম বেলকনির দরজাটাও বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ ঘরের ভেতরে বাতাস হচ্ছিল প্রবল বেগে। এত বাতাস কীভাবে হচ্ছে বুঝতেছিলাম না। মনে হচ্ছিল বাতাসে সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আমার দম নিতেও বেশ কষ্ট হচ্ছিল। এমন সময় একটা আলো দেখতে পেলাম। আলোটা আমার ঘরের জানালার কাঁচটা ভেদ করে ঘরে ঢুকেছে। আলোটা ঢুকার সাথে সাথে আমার ঘরের জানালা দরজা আপনা আপনি খুলে গেল। প্রবল বাতাসও নিমিষেই কমে গেল।কালো মেঘটাও চাঁদের উপর থেকে সরে গেল। চাঁদটা আস্তে আস্তে দৃশ্যমান হতে লাগল। দৃশ্যমান চাঁদটা দেখতে তখন গোলাকার আবার বৃত্তাকার মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এটা ত্রিমাত্রিক স্থানাঙ্ক ব্যবস্থায় আছে আবার মনে হচ্ছে দ্বিমাত্রিক স্থানাঙ্ক ব্যবস্থায় আছে। চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকতেই যেন বেশ অদ্ভূত মায়া মায়া সৃষ্টি হচ্ছিল ভেতরে। এমন সময় বরফ শীতল বাতাস আমার গায়ে এসে শীতলতার অনুভূতি দিল। হালকা শীত শীত লাগছে। চোখটা কেন জানিনা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। পরক্ষণেই চোখটা বন্ধ করে সাথে সাথে খুললাম। ঘরের দেয়ালে একটা ছায়া লক্ষ্য করলাম। বুঝতে পারলাম ছায়াটা কোনো মানব শরীরের। আমি ছায়াটার উৎস খুঁজে বের করার জন্য পেছনে তাকাতেই স্তব্ধ হয়ে গেলাম।
কারণ পেছনে সন্ধি দাঁড়ানো। তার এক কোলে একটা বিভৎস বাচ্চা পুতুল আরেক কোলে একটা সুন্দর তুলতুলে বাচ্চা পুতুল। সন্ধির চোখ দিয়ে তখন অজোরে রক্ত পড়ছিল। আমি ভয়ে সন্ধিকে উদ্দেশ্য করে বললাম
- এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে আছ কেন? তোমার এ হাল কে করল?
সন্ধি তখন হুংকার দিয়েও নীরব হয়ে গেল। তারপর আমার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো।চোখটা দিয়ে তখন প্রবল বেগে রক্ত পড়ছিল। অসহায় ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল
- আমার বাচ্চা নষ্ট করার জন্য সাহায্য করতে তোকে কে সাহস দিয়েছে বল।
আমি আমতা আমতা করে বললাম
- এটা তো তোমার ভালোর জন্য করা হচ্ছে। তুমি তো তোমার বাচ্চার পরিচয় ঠিক করে দিতে পারছো না। কে এ বাচ্চার বাবা কিছুই বলতে পারছো না। আর তুমিও তো চাও এ বাচ্চার জন্ম না হোক।তবে তোমাকে এত বিভৎস লাগছে কেন?
সন্ধি কোনো কথা না বলে আমার দিকে তার বিভৎস পুতুলটা ঢিল মেরে বলল
- আমার বাচ্চার কোনো ক্ষতি করতে চাইলে প্রাণে মেরে ফেলব। সাতদিন পর তুই ডাক্তারের কাছে যাবি না। বাচ্চার কোনো ক্ষতি আমি চাই না। এমনিতেও বাচ্চাকে মারতে পারবি না। তবে আমি চাই না আমার বাচ্চাকে নিয়ে কোনো ঝামেলা হোক। ওকে আসতে দে। ওর আসার পথে বারবার বাঁধা দিবি না। তাহলে সেটা কারোর জন্য হিতকর হবে না। আমার কথা না শোনলে সবাইকে মরতে হবে।
সন্ধির ঢিল মারা বিবৎস পুতুলটা ততক্ষণে আমার পাশে পড়ে ছিল। আমি সন্ধির কথা শোনে হালকা গলায় বললাম
- সন্ধি তুমি এরকম হলে কি করে এত রাতেই বা আসলে কি করে?
সন্ধি কোনো উত্তর দিল না। দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল। আর আমার পাশে পরে থাকা সন্ধির বিভৎস পুতুলটা হুট করে বিভৎস জ্যান্ত বাচ্চা হয়ে গেল। আমার দিকে হামাগুড়ি দিয়ে আসতে লাগল। আমি পিছুতে লাগলাম। বাচ্চাটাও আমার পেছনে পেছনে আসতে লাগল। আমি ভয়ে মাটিতে পড়ে গেলাম। বাচ্চাটা এবার আমার কাছে এসে আমার নাক মুখ খাঁমচে ধরলো। আমি তখন দম নিতে পারছিলাম না। শরীরটা বেশ কাঁপুনি দিয়ে উঠল। মনে হচ্ছিল আমি মারা যাব।
এমন সময় ঘরের বাতিটা জ্বলে উঠল। চারদিক আরও আলোকিত হলো। পুতুলটাও অদৃশ্য হয়ে গেল। সবকিছু একদম স্বাভাবিক হয়ে গেল।আমি নীচ থেকে ভয়ে ভয়ে খাটের উপর উঠলাম। এখনো আমার গা টা শিউরে উঠছে তন্দ্রা।
আমি হাসিবের কথা শোনে কিছুক্ষণ চুপ হয়ে রইলাম। ঘটনা ভিন্ন ভিন্ন হলেও সবার সাথেই এমন হচ্ছে।কেন হচ্ছে এটা যেন আমার বুঝার অন্তরায়।বিষয়টাকে এড়িয়ে যেতে চাইলেও আমি এড়িয়ে যেতে পারছিলাম না। কারণ সন্ধিও বলছে তার সাথে এমন হচ্ছে আমার সাথে এমন রহস্যময় ঘটনা ঘটে যাচ্ছে আর আজকে হাসিবের সাথে। আমার কাছে কেন জানি না মনে হচ্ছে বিষয়গুলোতে কোনো যোগসূত্র আছে।তবুও আমি হাসিবকে নীরবতার অবসান ঘটিয়ে বললাম
- দেখো হাসিব তুমি হয়তো সন্ধির বিষয় নিয়ে একটু বেশি ভাবছো তাই এমন দেখতেছ। সন্ধি আমার পাশেই আছে। আর একটু আগেও ছিল৷ তুমি নিশ্চিত কোনো স্বপ্ন দেখেছো নাহয় কল্পনায় এসব ভেবেছ। এসব ঘটনার কোনো বিজ্ঞান সম্মত অস্তিত্বও নেই।
- তন্দ্রা আমি যথেষ্ট ম্যাচুউর। স্বপ্ন আর বাস্তবের ফারাক আমি বুঝি। স্বপ্ন হলে আমার মুখে আঁচড়ের দাগ থাকত না। পুতুলটা আমার মুখে খাঁমচে ধরেছিল সে দাগটা এখনো আমার মুখে স্পষ্ট ভেসে আছে৷ নিশ্চয় সন্ধির এ বিষয়টার পেছনে কোনো রহস্যময় অধ্যায় আছে।
হাসিবের কথাটা ফেলে দেওয়ার মতো ছিল না। ভালোই বুঝতে পারছিলাম আমার সাথে যা ঘটছে হাসিবের সাথেও তেমনটা ঘটছে। তবে এ বিজ্ঞানের যুগে এসবের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে৷ তাই হাসিবের কথায় তাল না মিলিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বললাম
- আচ্ছা ঠিক আছে এবার ঘুমাও। পরেরটা পরে ভাবা যাবে। যা হয়েছে ভুলে যাও। সাতদিন পরে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে এটাই মাথায় রাখো। আমি রাখলাম।
কথা শেষে ফোনটা কাটতে গিয়ে খেয়াল করলাম সাড়ে তিনটে বাজে। ফোনটা রাখতে গিয়ে সন্ধির দিকে তাকাতেই দেখলাম সন্ধি বিছানায় নেই। সন্ধির জায়গাটা শূন্য দেখে পাশ ফিরে তাকাতেই ভয় পেয়ে গেলাম৷ কারণ একটু আগে হাসিব যেভাবে বলেছিল সন্ধি ঠিক সেভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সন্ধির এক কোলে একটা বিভৎস পুতুল আরেক কোলে একটা সুন্দর পুতুল। হাসিবের ঘটনার সাথে সব মিলে যাচ্ছে।ঘরের ড্রিম লাইটটা বন্ধ হয়ে গেল। মেঘহীন আকাশে বজ্রপাতের প্রবল শব্দ হয়ে বৃষ্টি নামতে লাগল। ঘরের দরজাটা শব্দ হয়ে লাগতে শুরু করল। হাসিব যা বলেছে পুনরায় সে ঘটনা মাত্র হলো আমার সাথে। হাসিবের মতো আমিও খেয়াল করলাম আমি মেঝেতে পড়ে আছি। তাড়াহুড়ো করে মেঝে থেকে উঠে দাঁড়ালাম। বিছানার কাছে যেতে খেয়াল করলাম সন্ধি বিভোর ঘুমে আচ্ছন্ন। তাহলে একটু আগে কাকে দেখলাম? আমি কোনো শব্দ না করেই চুপচাপ শুয়ে পড়লাম। মুখে অসম্ভব জ্বলুনি হচ্ছিল আমার। জ্বলাটা প্রবল ভাবে উপলব্ধি করছিলাম। তাই মোবাইলে ফ্ল্যাশ লাইটটা জ্বালিয়ে আয়নার সামনে যাওয়ার জন্য খাট থেকে নীচে নামতেই মনে হলো কেউ একজন আমার পায়ে আঁকড়ে ধরেছে। আমি আলোটা পায়ের কাছে ধরতেই খেয়াল করলাম লম্বা লম্বা নখ বিশিষ্ট একটা হাত আমার পা কে আঁকড়ে ধরেছে। আমি পা টা সাহস করে কোনো মতে ছাড়িয়ে খাটে পা টা উঠিয়ে সন্ধির দিকে তাকাতেই সন্ধি উঠে বসে বলল
- কি রে কি হয়েছে তোর?
আমি ভয়ে তখন কম্পিত হয়ে যেতে লাগলাম। ভয়ে ভয়ে সন্ধির দিকে আলোটা ধরতেই আরও ভয় পেয়ে গেলাম। সন্ধির চেহারাটা পুড়ে গেছে মনে হচ্ছে।সন্ধির শরীর থেকে বিচ্ছিরি একটা গন্ধ আসছে।আমি ভয়ে চিৎকার দিতে চেয়েও চিৎকার করতে পারছিলাম না। এমন সময় সন্ধি আমার হাতটা চেপে ধরল। আমার প্রাণটা যায় যায় অবস্থা।গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছিল না। চারদিকে তখন অন্ধকার এখনো ভোরের আলো ফুটেনি।মনে হচ্ছে এ রাত আর শেষ হবে না। ভয়ে ভয়ে চোখটা বন্ধ করে খিঁচ মেরে রইলাম। খানিক্ষন পর সায়রা আপুর কন্ঠ স্বর শোনে মাথাটা উঠালাম। সায়রা আপু আমাকে ধরে বলল
- কী রে তন্দ্রা তুই এভাবে নীচের দিকে তাকিয়ে বসে ছিলি কেন? আর এরকম অদ্ভূত শব্দ করছিলি কেন?
আমি আপুর দিকে তাকাতেই খেয়াল করলাম সন্ধি আপুর পাশে বসে আছে। আমার গলাটা তখন শুকিয়ে খরা পরে গেছিল। কিছু বলতে পারছিলাম না। আপু আমার অবস্থা দেখে সন্ধিকে বলল পানি আনতে। সন্ধি আমাকে পানি এনে দিল। আমি চটপট পানিটা খেলাম। এখন মনে হচ্ছে একটু শান্তি লাগছে। আমি আপুকে বললাম
- জানি না কি হয়েছিল। হয়তো দুঃস্বপ্ন দেখেছি।
আপু আমার কথা শোনে সন্ধির দিকে তাকিয়ে বলল
- তোকে কত করে বললাম তন্দ্রার সাথে গিয়ে ঘুমা ও একা একা ভয় পাবে। নাহ তুই আমার সাথেই ঘুমাবি৷ এখন দেখেছিস ও কতটা ভয় পেয়েছে স্বপ্ন দেখে।
আপুর কথা শোনে কিছুটা অবাক হলাম। তার মানে সন্ধি আপুর রুমে আপুর সাথে ঘুমিয়েছে। অবাক চোখে আপুর দিকে তাকিয়ে বললাম
- সন্ধি তোমার সাথে ছিল?
- হ্যাঁ তুই ঘুমানোর কিছুক্ষণ পর গিয়ে বলল ওর ভালো লাগছে না আমার সাথে ঘুমাবে।আমি তো সন্ধিকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ভোরবেলা তোর রুম থকে তোর অদ্ভূত শব্দে রুমে এসে দেখলাম তুই নীচের দিকে তাকিয়ে বসে আছিস।
আপুর কথাটা শোনে দ্বিতীয় বারের মতো অবাক হয়ে গেলাম। একটু আগে আমার পাশে কে ছিল সেটা ভেবেই ভয়ে আঁৎকে উঠছিলাম। তবুও আপুকে কিছু বুঝতে না দিয়ে হালকা সুরে বললাম
- দুঃস্বপ্ন দেখেছি। আচ্ছা যাও আমি ফ্রেশ হয়ে আসতেছি।
বলেই আমি চারপাশ তাকালাম। ততক্ষণে চারপাশ আলোকিত হয়ে গেল।আপু আর সন্ধি কথা না বাড়িয়ে চলে গেল। রাতের ঘটনাটা বারবার আমার মনে নাড়া দিতে লাগল। আমি নিজেকে ফ্রেশ করে হাসিবকে কল দিয়ে সবটা বললাম। হাসিব আমার সবটা কথা শোনে একটা চাঞ্চল্যকর কথা বলল। যা শোনে আমি আরও ভয় পেয়ে গেলাম।
গল্পের নাম রাজমহল
লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব-5
যা শোনে আমি আবারও ভয় পেয়ে গেলাম।কারণ হাসিব বললো সে আমাকে রাত তিনটা বাজে কল দিয়ে এমন কিছুই বলেনি। কথাটা শোনে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম মনে হচ্ছে। আমার স্পষ্ট মনে আছে কলটা হাসিবের নম্বর থেকে এসেছে। আর আমিতো হাসিবের কন্ঠ চিনতে ভুল করব না। দুই বছরের সম্পর্ক আমাদের। ভালোবাসা বুঝার আগেই সম্পর্ক হয়েছিল অল্প বয়সে। মনে মনে ভাবতে লাগলাম হয়তো হাসিব ভাবছে আমি ভয় বেশি পেয়েছি তাই এমন মিথ্যা কথা বলছে। আমি হাসিবকে হালকা ধমক দিয়ে বললাম
- তুমি সত্যি কথা বলো।
- আরে তন্দ্রা মিথ্যা বলতে কেন যাব। সত্যিই আমি তোমাকে কল দিইনি। এমন কিছুই আমার সাথে ঘটেনি। তুমি তোমার মোবাইল চ্যাক করলেই তো হয়।
আমি হাসিবের কথা শোনে পাল্টা জবাব না দিয়ে কলটা কেটে দিয়ে কল লিস্টে গেলাম। কল লিস্টে গিয়ে দেখলাম রাত তিনটেয় যে কলটা এসেছে সেটা হাসিবের নম্বর থেকে না। বিস্ময়টা বাড়তে লাগল আমার। কারণ হাসিবের নামটায় স্ক্রিনে ভেসে উঠেছিল তখন। তাহলে এখন অন্য নম্বর হলো কি করে। হাত কাঁপতে লাগল আমার। কাঁপা কাঁপা হাতে নম্বরটায় কল দিলাম। ওপাশ থেকে মেয়েলি সুরে বলছে
"আপনি যে নম্বরে কল করেছেন এ নম্বরের কোনো অস্তিত্ব নেই"
বিষয়টা আমাকে বেশ ভাবাতে লাগল। আমি কল ডিউরেশনটা খেয়াল করে দেখলাম আধা ঘন্টা কথা হয়েছে। ভাবতে লাগলাম যে নম্বরের অস্তিত্ব নেই সে নম্বরে আমি এত কথা কি করে বললাম আর সেটা যদি হাসিব নাহয় তাহলে কার সাথেই বা কথা বললাম।বলেই নম্বটার দিকে তাকাতেই লক্ষ্য করলাম মোবাইলটা আপনাআপনি চলছে।আমি মোবাইলটা টাচ করতে চাইলেও সেটা কাজ করছে না। মোবাইলটা আপন গতিতে চলছে।নম্বরটা ডিলেট বাটনে লেগে ডিলেটও হয় আপনাআপনি। ডিলেট হওয়ার সাথে সাথে মোবাইলটা আপনাআপনি চলা বন্ধ হয়ে যায়। ভয়ে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যেতে লাগল। হাতটা কাঁপতে কাঁপতে মোবাইলটা নীচে পড়ে গেল। নীচে পড়তেই সন্ধি ঘরে প্রবেশ করে বলল
- আরে আরে আপু মোবাইলটা পড়ে গেল তো।
বলেই মোবাইলটা মেঝে থেকে তুলল। সন্ধি মোবাইলটা হাতে নিয়ে বলল
- আপু তুই তো মোবাইলের স্ক্রিনটা ভেঙ্গে দিলি।
সন্ধির কথায় মোবাইলটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম স্ক্রিনটা ভেঙ্গে চৌচির হয়ে গেছে। সন্ধি স্ক্রিনটায় হাত দিয়ে স্পর্শ করার সাথে সাথে স্ক্রিনটা অলৌকিক ভাবে ঠিক হয়ে গেল। আমি বিষয়টা দেখে অবাক হয়ে গেলাম। সেই সাথে সন্ধিও চমকে গেল। সন্ধি আমার দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল
- আপু এটা কি করে সম্ভব? আমার হাতের স্পর্শে স্ক্রিনটা ঠিক হয়ে গেল কি করে?
এতটাই বিস্মিত হয়েছিলাম যে সন্ধির কথায় জবাব দিতে পারছিলাম না। হা করে মোবাইলটার দিকে তাকিয়ে শুধু দেখতে লাগলাম।সন্ধিও আমার নীরবতা দেখে চুপ হয়ে মোবাইলটা শুধু এপাশ ওপাশ করে দেখতে লাগল। বিষয়টাতে এবার গরমিল আছে মনে হলো। মনে হচ্ছে কড়া একটা রহস্য আছে যেটা আমি আর সন্ধি কেউ এই উদঘাটন করতে পারছি না। তবে বিষয়টা কি? রহস্যটা কি আদৌ বের করতে পারব। এসব প্রশ্ন মনে ঘুরতে লাগল আমার। দুজনের নীরবতায় ঘরটা তখন পিনপনা নিস্তবতা বিরাজ করছে। নিস্তবতার অবসান ঘটলো সায়রা আপুর চিৎকারে। আমি আর সন্ধি সায়রা আপুর আচমকা চিৎকারে ভয় পেয়ে গেলাম। দুজনেই দৌঁড় লাগালাম সায়রা আপুর রুমের দিকে। সায়রা আপুর রুমে গিয়ে দেখলাম আপু মেঝেতে পড়ে আছে। উঠার চেষ্টা করছে তবে উঠতে পারছে না। আমি আর সন্ধি আপুকে কোনো রকম ধরে খাটে উঠালাম। বুঝতে পারলাম আপু পায়ে ব্যথা পেয়েছে। আপুকে বসিয়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চাইলে আপু বলল
- পা টা মচকে গিয়েছে হয়তো। ডাক্তারকে কল দেওয়ার দরকার নেই।তুই শুধু রসুন তেল গরম করে আন। পায়ে মালিশ করলেই ঠিক হয়ে যাবে।
আমি সন্ধিকে আপুর পাশে বসিয়ে রসুন তেল গরম করতে গেলাম। রান্না ঘরে গিয়ে কড়াইয়ে তেল নিয়ে চুলা জ্বালিয়ে দিলাম। তেলটা হালকা গরম হতেই খোসা ছাড়ানো রসুন গুলো ছাড়তেই তেলটা লাল হয়ে গেল। মনে হচ্ছে রক্ত টগবগ করে ফুটছে। ভয়ে হাত পা কাঁপছিল। মাথাটাও ঝিমঝিম করছিল। এমন সময় রান্না ঘরের জানালা দিয়ে একটা বরফ শীতল বাতাস এসে আমার গায়ে লাগতেই আমি চোখটা বন্ধ করে ফেললাম। সাথে সাথেই আমার সামনে কিছুর উপস্থিতি টের পেলাম। আমি চোখটা খুলে দেখলাম কেউ নেই। ভয়ে ভয়ে তেলের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তেলটাও স্বাভাবিক। একটু আগের যে লাল হয়ে গেছিল সেটা আর নেই। ভাবতে লাগলাম এটা আমার মানসিক সমস্যা নাকি বাস্তব। কেন যে এমন হচ্ছে তা বুঝতে না পেরে একের পর এক প্রশ্ন মনে জাগছে। নিজের ভেতরেই যেন এক অস্থিরতা ঝড় তুলছে। দমাতে চাইলেও সেটা দমাতে পারছিলাম না৷ এমন সময় মনে হলো কেউ একজন পিঠে হাত রেখেছে। ভয়ে ভয়ে পেছনে তাকাতেই খেয়াল করলাম সন্ধি। সন্ধিকে দেখে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললাম
- কি হয়েছে?
সন্ধি আমার কথার জবাব না দিয়ে চুলাটা বন্ধ করে বলল
- রসুন পুড়া গন্ধে চারপাশ মুহুমুহু করছে আর তুই হাবলির মতো দাঁড়িয়ে কি ভাবছিস?
আমি সন্ধির কথায় নিজেকে ভাবনার জগৎ থেকে বের করে কড়াইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম রসুন পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে। আমি কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে বললাম
- জানি না কি হচ্ছে? কেন হচ্ছে এসব। তোর আর আমার জীবনে এ কোন কালো অধ্যায় নেমে আসলো। একের পর এক অসহনীয় অবাস্তব ঘটনা চোখের সামনে ঘটছে যার কোনো ভিত্তি নেই। কেনই বা এসব হচ্ছে। পাগল হয়ে গেলাম নাকি বুঝতে পারছি না।
সন্ধিও আমার কথায় কেঁদে দিয়ে বলল
- তোর এতেই এমন লাগছে। চিন্তা কর আমার কেমন লাগছে। আমার পেটে বাচ্চা কি করে আসলো আমি জানি না। সারাদিন পেটে হালকা নড়াচড়া উপলব্ধি করি। কেমন যে লাগে আমার সেটা তো আমিও বলে বুঝাতে পারব না। তুই ভবছিস আমি কারও সাথে সম্পর্ক করে আবেগে কিছু করে এমন দশা করেছি। কিন্তু তোকে কীভাবে বুঝাব আমি এমন কিছুই করিনি। এত কঠিন শাস্তি কেন পাচ্ছি জানি না।
আমি সন্ধির কথা শোনে সন্ধিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম। এমন সময় সায়রা আপুর তীক্ষ্ণ কন্ঠে আমরা স্বাভাবিক হয়ে চোখ মুছে সায়রা আপুর দিকে তাকিয়ে দুজনেই অবাক হয়ে গেলাম।সায়রা আপুর হাতে বাজারের ব্যাগ। আর আপু সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সন্ধি আপুর দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলল
- আপু তুমি এখানে?
আপু রাগ রাগ চোখ করে চোখগুলো বড় বড় করে বলল
- তো কোথায় থাকব? আর তোরা রান্না ঘরে এসে এভাবে কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে?
আমি বিস্মিত হয়ে চোখগুলো কপালে তুলে বললাম
- আমি তো এসেছিলাম তোমার জন্য রসুন তেল গরম করতে। তোমার পা মালিশ করার জন্য।
আপু বিরক্ত গলায় জবাব দিল
- পাগল হয়ে গেছিস তুই? আমার পা মালিশ করবি কেন হুট করে?
- না আপু কিছুক্ষণ আগে তুমি তো পড়ে গিয়ে ব্যাথা পেলে পায়ে। তাই রসুন তেল গরম করতে বললে আমি সেটা গরম করছিলাম। এমন সময় রসুন পুড়ে গন্ধ বের হচ্ছিল তাই সন্ধি এসে চুলা বন্ধ করলো।
আমার কথা শোনে আপুর রাগটা যেন বেড়ে গেল। আপুর মুখ দেখে মনে হচ্ছে আমি কোনো আষাঢ়ে গল্প করছি। রাগী কন্ঠে কপালটা কুচকে চার পাঁচটা ভাজ তুলে বলল
- আমি পড়ে গেলাম কখন? কিসব হাবিজাবি বলছিস? আমি বের হয়েছিলাম বাজার করতে। কিছু পথ এগুতে মনে হলো পার্সটা ফেলে এসেছি তাই পার্স নিতে ঘরে ঢুকলাম আর রান্না ঘর থেকে কান্নার আওয়ার পেয়ে ঢুকে দেখলাম তোরা কাঁদছিস। আর এখন কিসব আবোল তাবোল বলছিস। আর রসুন তেল গরম কি চুলাতেই করেছিস কড়াই ছাড়া?
আপুর কথা শোনে সন্ধি বিস্মিয়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠল
- মানে?
আপু সন্ধির মানে উত্তরটা শোনে কপালটা একবার সমান্তরালভাবে আবার লম্বভাবে ভাঁজ করে বলল
- মানে চুলাতে কড়াই নেই। রসুন তেল গরমটা কোথায় করলি?
আপুর কথা শোনে সন্ধি আর আমি পেছন ফিরে চুলায় তাকিয়ে একদম স্তব্ধ হয়ে গেলাম। কারণ চুলাটা একদম খালি। তাহলে একটু আগে আমাদের সাথে যা ঘটলো সেটা কি কোনো মতিভ্রম। আমি চুলার দিকে তাকিয়ে হা হয়েই রইলাম। সন্ধি আপুকে হালকা ঢুক গিলতে গিলতে বলল
- জানি না কড়াই কোথায় গেল।
সন্ধির কথা শোনে আপু আরও রেগে গেল। রেগে গিয়ে হালকা আওয়াজ তুলে ধমক দিয়ে বলল
- বলি তোরা কি পাগল হয়ে গেলি নাকি৷ মুখে যা আসছে বলে যাচ্ছিস। সাত পাঁচ দিয়ে আমাকে আর বুঝাতে হবে না। নিশ্চিত তোরা ঝগড়া করেছিস। ঝগড়া করে মিটমাট করে একে অপরকে ধরে কাঁদছিলি। আমাকে এভাবে আসতে দেখে ভয়ে এসব আষাঢ়ে গল্প বানিয়ে বলছিস। হয়েছে হয়েছে আর এসব হাবিজাবি বলে আমার মাথা খেতে হবে না। ঘরে গিয়ে পড়তে বস। আমি বাজারে গেলাম। এর মধ্যে আর ঝগড়া করলে একদম এসে উত্তম মধ্যম দিব জানতে পারলে। যা ঘরে যা।
আমি আর সন্ধি আপুর কথার কোনো জবাব দিলাম না। মাথা নত করে দুজনেই ঘরে চলে আসলাম। ঘরে এসে সন্ধি আর আমি শুধু ভাবতে লাগলাম এসব কি হচ্ছে আমাদের সাথে কেন হচ্ছে। খানিকক্ষণ পর আপু আসলো পা টা হেঁচরে হেঁচরে।আমি আর সন্ধি গিয়ে আপুকে ধরে বললাম
- কি হয়ছে পায়ে?
আপুকে জিজ্ঞেস করার পরও ভাবতে লাগলাম এটা কি মতিভ্রম নাকি বাস্তব। ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করার পর দেখলাম এটা আপু আর পায়ে ব্যাথা পেয়েছে।আপু আস্তে করে আমাদের কথার জবাবে বলল
- হুট করে রিকশা থেকে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেলাম হালকা।তেমন কিছুই হয়নি তোরা ঘরে যা।
আমি আর সন্ধি আপুকে শুইয়ে দিয়ে ঘরে আসলাম। ভাবতে লাগলাম গতকাল আমার সাথে ঐসব হওয়ার আগে আমার কল্পনায় কেউ একজন বলেছিল এসব হয়েছে। আজকে আপু পায়ে ব্যাথা পাওয়ার আগে আপু ব্যথা পাওয়ার বিষয়টা চোখে ভাসল। সবকিছু আগে আমাদের চোখে ভাসছে তারপর বাস্তবে হচ্ছে।এমন কেন হচ্ছে এটার উত্তর মিলাতে পারছিলাম না। কাঙ্ক্ষিত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা নিয়েই পার করলাম কিছুদিন।
আজকে সন্ধিকে নিয়ে হাসপাতাল যাওয়ার পালা। সকাল সকাল উঠে নিজেকে প্রস্তুত করলাম। সন্ধিকে সাহস দিলাম। হাসিবকে কল দিলাম আসার জন্য। হাসিব আর সন্ধিকে নিয়ে হাসপাতালে গেলাম ডাক্তার রাহনুমা পারভীনের কাছে। উনি সবকিছু দেখে সব ফরমালিটি শেষ করে সন্ধিকে নিয়ে গেল গর্ভপাতের জন্য। সন্ধিকে নিয়ে গিয়ে আধ ঘন্টা পর তড়িঘড়ি করে আসলো। উনার অবস্থা দেখে আমি আর হাসিব দুজনেই বেশ ভয় পেয়ে গেলাম।
গল্পের নাম রাজমহল
লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব-6
[নোট- যারা গর্ভবতী তাদের এ পর্ব পড়ার দরকার নেই। এতে মানসিক প্রভাব পড়তে পারে।]
উনার অবস্থা দেখে আমি আর হাসিব দুজনেই বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। কারণ উনার সারামুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছিল। অদ্ভূত একটা ভয় উনার চেহারায় প্রকাশ পাচ্ছিল। আমাদেরকে ডেকে চেম্বারে আসতে বললেন। তাই আমরা দুজন ডাক্তার রাহনুমার সাথে চেম্বারে ঢুকলাম। চেম্বারে ঢুকে চেয়ারটা টেনে আমি আর হাসিব বসলাম। উনার অবস্থা এতটাই বিমর্ষ ছিল যে আমরা কেউ বুঝতে পারছিলাম না কি হয়েছে উনার। শুধু অপলক দৃষ্টিতে উনাকে দেখছিলাম।ডাক্তার রাহনুমা টেবিলে রাখা পানির গ্লাসটা নিয়ে গদগদ করে পানি খেল। তারপর হালকা নিঃশ্বাস ছেড়ে আমাদের দিকে তাকাল। উনার চোখ দেখে মনে হচ্ছে উনি বিশেষ কিছু বলবেন। আমরাও নিজেদের মধ্যে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম সবটা শোনার জন্য। উনি উনার মুখের ঘামটা বক্সে রাখা টিস্যু টেনে নিয়ে মুছতে মুছতে বলল
- আপনাদের আমি যা বলতে যাব এটার যদিও কোনো ভিত্তি নেই বিজ্ঞানে। তবে আজকে তেমন কিছুরেই অস্তিত্ব পেয়েছি৷
আমি মনে মনে ধারণা করলাম নিশ্চয় সন্ধির ব্যাপারে কিছু বলবে ডাক্তার রাহনুমা। তাই চমকানোর কথা থাকলেও খুব একটা চমকালাম না। শান্ত আর মোলায়েম কন্ঠে বললাম
- আপনি বলুন কি হয়েছে।
ডাক্তার রাহনুমা পুনরায় একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিল। তারপর পরক্ষণেই নিঃশ্বাসটা ছেড়ে দিয়ে বলল
- আপনার বোন সন্ধিকে আমি গর্ভপাতের জন্য একটু আগে নিয়ে গেছিলাম সেটা তো জানেনেই।
- হ্যাঁ সেটা তো জানি কিন্তু কী হয়েছে?
ডাক্তার রাহনুমা ঘামটা মুছার পর ঘামযুক্ত টিস্যুটা টেবিলে রেখে বলল
- গর্ভপাতের জন্য স্বাভাবিক ভাবে তাকে অজ্ঞান করা হলো। তারপর গর্ভপাতের প্রয়োজনীয় সব জিনিস নিয়ে গর্ভপাত শুরু করতে চাচ্ছিলাম। তবে আশ্চর্য জনক হলেও এটাই সত্যি যে আমি যত বারেই সন্ধির গর্ভপাত শুরু করতে যাচ্ছিলাম ততবারই পেট থেকে এক অদ্ভুত আওয়াজ আসা শুরু করল। বিষয়টাকে আমি পাত্তা না দিয়ে পুনরায় কাজ করতে গেলাম। তবে পুনরায় সে আওয়াজ পেলাম। শুধু আমি না আমার সহকর্মীরাও একই আওয়াজ পেয়েছে। বাচ্চার কান্নার বিভৎস আওয়াজ। আমি বিষয়টা পর্যবেক্ষণ করার জন্য সন্ধিকে নিয়ে গেলাম আল্ট্রা রুমে। সেখানে গিয়ে সন্ধির আল্ট্রা করে চমকে গেলাম। যেখানে আগের রিপোর্ট গুলো সাক্ষ্য দেয় যে সন্ধি জমজ বাচ্চার মা হবে সেখানে আজকের আল্ট্রাতে দেখাচ্ছে সন্ধির পেটে একটা বাচ্চা। বিষয়টা আমাকে বেশ ভাবিয়ে তুলে। সন্ধিকে নিয়ে পুনরায় গেলাম গর্ভপাতের জন্য। তবে এবার যখন গর্ভপাত করতে যাব এমন সময় সন্ধির পা টা আমার বুক বরাবর একটা লাথি মারে। আমি ছিটকে পড়ি। আমাকে আমার সহকর্মীরা কোনোরকমে তুলে বসায়। আমি উঠে সন্ধির কাছে গিয়ে খেয়াল করলাম সন্ধির জ্ঞান ফিরেনি এখনো। ভাবতে লাগলাম অজ্ঞান অবস্থায় একটা মানুষ কি করে লাথি মারতে পারে। তবে এটা বুঝতে পারলাম সন্ধির পেটের বাচ্চা কোনো স্বাভাবিক বাচ্চা না। আমি আমার সহকর্মীকে যেতে বলে আপনাদের কাছে আসলাম। আমার কাছে বিষয়টা স্বাভাববিক লাগছে না। যেহেতু আমার সাথে এমন ঘটনা ঘটেছে আশাকরি আপনাদের সাথে এমন কিছু ঘটেছে। যদি ঘটে থাকে তাহলে সত্যিটা বলুন।
আমি আর হাসিব দুজনেই ডাক্তার রাহনুমার কথায় নড়েচড়ে বসলাম।এবার আমাদের উভয়ের ভেতরে ভয়টা বেশি কাজ করতে লাগল। ভয়ে ভেতরটা কাঁপতে লাগল। ভয়ের প্রকাশটা যেন মুখ দিয়ে ঘাম বেয়ে বের হচ্ছে। মিনেট পাঁচেক দুজনেই বেশ নীরব ছিলাম। নীরবতা কাটিয়ে ডাক্তার রাহনুমাকে বললাম
- সত্যি বলতে সন্ধির প্র্যাগনেন্সির বিষয়টা নিয়ে আমরাও বেশ ভয়ে আছি। সন্ধি বিবাহিত না। এর আগে আপনার কাছে বিষয়টা লুকিয়েছি কারণ মানসম্মানের ভয়ে ছিলাম।সন্ধি কীভাবে প্র্যাগনেন্ট হয়েছে সেটা আমাদেরও জানার অন্তরায় রয়েছে।সন্ধির ভাষ্যমতে সে কোনো ছেলের সাথে এমন কিছু করেনি যে প্র্যাগনেন্ট হবে৷ আর সন্ধি পড়ে গার্লস স্কুলে।স্কুলে যায় আমার সাথে আসেও আমার সাথে। ওর কোনো মোবাইল নেই যে কোনো ছেলের সাথে প্রেম করবে। আর লুকিয়ে ব্যবহার করলে অবশ্যই আমার চক্ষুগোচর হত কারণ আমি সন্ধির সাথে ঘুমাই। ঐরকম কোনো আভাস পায়নি যে প্রেম করে। তবুও ভেবেছিলাম হয়তো আমাদের আড়ালে কিছু করেছে কিন্তু সে ভয়ে বলছে না কিছু।বারবার জিজ্ঞেস করার পরও সে তার কথায় অটল ছিল যে কারও সাথে কিছু করেনি। কি করব বুঝতে না পেরে গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত নিলাম। পাশে বসে থাকা ছেলেটা আমার বয়ফ্রেন্ড হাসিব। সন্ধির বাচ্চার বাবা কে, সেটা জানি না তাই ওকে সন্ধির স্বামী সাজিয়ে আপনার কাছে নিয়ে আসি।
বুঝতে পারি নি কেন এমন হলো ওর। প্র্যাগনেন্সি কিট নিয়ে কৌতুহল বশত ওর টেস্ট করায় আর পজিটিভ আসে। সেদিনের রাত থেকেই এমন অদ্ভূত ঘটনাগুলো শুরু হয়। এখানে আসার আগেও অনেক অদ্ভূত ঘটনা ঘটেছে। বিষয়টা এড়িয়ে যেতে চাইলেও পারিনি। বারবার মনের ভুল মনে হলেও সেটা মনের ভুল ছিল না হয়তো। আজকে আপনার কথায় নিশ্চিত হলাম এটা কোনো স্বাভাবিক বিষয় না অবশ্যই এ বিষয়টাতে গভীর রহস্য রয়েছে। তবে সেটা কি আমরা কেউ জানি না। একের পর এক কাহিনি রহস্যটাকে আরও পরিষ্কারের পরিবর্তে ঘোলাটে করে দিচ্ছে। এ অবস্থা থেকে মুক্তি বা পরিত্রাণের উপায় জানা নেই। ভেবেছিলাম সন্ধির গর্ভপাতের পর বিষয়টা স্বাভাবিক হবে তবে এখন বুঝতে পারছি সন্ধির গর্ভপাত করাটা সহজ হবে না। অলৌকিক কোনো শক্তি সবকিছুতে বাঁধা দিচ্ছে। হয়তো কোনো উদ্দেশ্য আছে তবে কি সেই উদ্দেশ্য জানা নেই। কি করলে জানতে পারব সেটাও জানি না। এখন আমরা নিরুপায়।
আমার কথা শোনে ডাক্তার রাহনুমা নির্বাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল বেশ কিছুক্ষণ হয়তো তারও জানা নেই কি করবে এসময়। বেশ কিছুক্ষণ নিস্তব আর নীরব ছিল চেম্বারটা। দরজার খটখট আওয়াজে নীরবতার অবসান ঘটে। ওপাশ থেকে হাসপাতালের কেউ একজন ডাক্তার রাহনুমাকে ডাকছে। দরজাটা খুলে আসতে বলল ডাক্তার রাহনুমা। লক্ষ্য করলাম একজন নার্স এসেছে। বয়স আনুমানিক ৪০-৪৫ হবে। মধ্য বয়স্কা মহিলা। কাঁচা চুলের ভিড়ে কয়েকটা পাকা চুলের ভাঁজের জন্যই মূলত এ বয়সটা অনুমান করতে পেরেছি। জানতে পারলাম নার্সের নাম আবিদা। আবিদা এসে হালকা কন্ঠে ডাক্তার রাহনুমাকে কিছু বলতে চাচ্ছিল। তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে উনার মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হচ্ছিল না।মানে উনার মুখ নড়ছিল ঠিকেই তবে সে মুখ দিয়ে কথার আওয়াজটা আমাদের কান পর্যন্ত আসছে না।ডাক্তার রাহনুমা আবিদাকে পাশে থাকা টুলটা দেখিয়ে বলল
- আপনি আগে এ টুলটায় বসে দম নিন।তারপর বলুন কী হয়েছে। তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই। এতে আপনার শারিরীক অবনতি হতে পারে। মুখে বলতে না পারলে লিখে বলুন। তবে শান্ত হয়ে নিন আগে।
আবিদা ডাক্তার রাহনুমার কথা শোনে হালকা দম নিতে লাগল বসে বসে। তারপর ডাক্তার রাহনুমার দিকে তাকিয়ে বলল
- ম্যাম আপনি একটু আগে যার গর্ভপাত করাতে চেয়েছিলাম।মেয়েটার নামটা যেন কি?
বলেই আটকে গেল আবিদা।হয়তো নামটা মনে করার চেষ্টা করছে। আবিদার প্রশ্নের জবাবে ডাক্তার রাহনুমা বলল
- আপনি কি সন্ধির কথা বলছেন?
ডাক্তার রাহনুমার কথা শোনে আবিদা চট করে উত্তর দিল
- হ্যাঁ সন্ধির কথা বলছি।
- কেন কী হয়েছে আবার।
- ম্যাম ঐ মেয়েটার সাথে কোনো অলৌকিক শক্তি আছে নিশ্চয়। কিছুক্ষণ আগে আপনার সাথে যা ঘটেছে সেটা তো জানেন।তবে মাত্র যা ঘটেছে সেটা দেখার পর থেকে আমি স্বাভাবিক হতে পারছি না। আমার ভেতরটা ভয়ে কেঁপে উঠছে আর বারবার ঐ দৃশ্যটা চোখে ভেসে আসছে।
ডাক্তার রাহনুমা কিছুটা অবাক হলো সেই সাথে আমি আর হাসিবও।ডাক্তার রাহনুমা অবাক চোখে তাকিয়ে বলল
- কেন আবার কী হয়েছে?
আবিদা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল
- আমি আপনার কথায় মেয়েটাকে কেবিনে নিয়ে যাই।ঐখানে শুইয়ে বের হওয়ার জন্য কেবিনের দরজার সামনে আসতেই একটা ছায়া খেয়াল করলাম। মনে হলো কেবিনে ঐ মেয়েটা ব্যতীত আরও কেউ আছে।তাই আমি পেছনে ফিরলাম। কিন্তু সেখানে কেউ ছিল না। আমি আবার সামনে ফিরলে একই ছায়া লক্ষ্য করলাম।এবারও পেছনে ফিরে দেখলাম কেউ নেই। আমি আবার সামনে ফিরে পুনরায় ছায়াটা দেখলাম।তবে এবার আর পেছন ফিরলাম না। মনে হলো এবার পেছন ফিরলে দেখব পেছনটায় শূন্যতা বিরাজ করছে। তাই আমি বের হওয়ার জন্য এক পা বাড়াতেই বিকট একটা আওয়াজ কানে আসলো। আমি আওয়াজটার উৎস খুঁজতে গেলে মনে হলো আওয়াজটা পেছন থেকে এসেছে। ভেতরে ভেতরে হালকা ভয়ে নিয়ে পেছনে তাকাতেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল আমার।কারণ সন্ধি মেয়েটার পেটা টা ফাঁটতে শুরু করল।ফাঁটা চৌচির পেট থেকে গড়গড়িয়ে রক্ত পড়তে লাগল।
তারপর সে পেট থেকে একটি নবজাতক শিশু বের হলো। নবজাতক ছেলে নাকি মেয়ে আমি বুঝতে পারি নি। কারন সারা শরীর পুড়ে ছিল। বিচ্ছিরি মরা পঁচা গন্ধ নাকে আসতে লাগল। মরা গন্ধে আমার পেটটা ফুলে ফেঁপে যাচ্ছিল মনে হচ্ছিল। নবজাতক শিশুটি প্রথমে পেটের উপর বসে ছিল আর খিলখিল করে হাসছিল৷ বিভৎস হয়ে হাসছিল। আমার হার্টবিট যেন এটা দেখার পর ক্রমে ক্রমে দ্রূত হচ্ছিল। দৌঁড়ে আসতে চেয়েছিলাম তবে পারছিলাম না। পা টা যেন মেঝেতে আটকে গেল। খিলখিল করে বাচ্চাটা হেসে বলল আমাকে আসার পথে বাঁধা দিলে সেটা কারও জন্য হিতকর হবে না। আমি আসব আবার আসব। বলেই বাচ্চাটা আবার পেটে ভেতর ঢুকে গেল। আর পেটটাও স্বাভাবিক আগের মতো হয়ে গেল। মনে মনে ভাবতে লাগলাম এটা আমি কি দেখলাম স্বপ্ন নাকি বাস্তব।ভয়ে ভয়ে সন্ধির কাছে গেলাম। সন্ধি অচেতন অবস্থায় পড়ে ছিল। ভাবতে ভাবতে এটা আমার কাল্পনিক চিন্তা। তাই নিজেকে সামলিয়ে আসতে লাগলাম। তবে আমার চোখ গেল সন্ধির পেটে রক্তের লাল দাগে। আমি পেটের কাছে যেতেই খেয়াল করলাম সন্ধির পেটের দিকে জামাটায় রক্তের লাল দাগ লেগে আছে। আমি কাঁপা কাঁপা হাতে জামাটা উপরে তুলে আরও অবাক হলাম কারণ জামাটায় লাল দাগ থাকলেও পেটে কোনো ক্ষত ছিল না। তবে আমি বুঝতে পারছিলাম এতে কোনো গোলমেল আছে। তাই সন্ধিকে ঐভাবে শুইয়ে রেখে সরাসরি চলে আসলাম আপনার কাছে।
কথাটা শোনার পর আমার যেন দম বন্ধ বন্ধ লাগছে। হালকা শ্বাসকষ্ট অনুভব করতে লাগলাম। হাসিব আমাকে শক্ত করে ধরে বলল
- শান্ত করো নিজেকে।
হাসিবের কথায় নিজের মধ্যে একটা ভরসা পেলাম। নিজেকে শান্ত করে নিলাম। এর মধ্যে ডাক্তার রাহনুমা আবিদাকে বলল
- চলো তো আমার সাথে দেখে আসি ব্যাপারটা।
বলেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন চেয়ার থেকে। তারপর আমাদের নিয়ে এগুতে লাগলেন সন্ধির কেবিনের দিকে। এগুতে এগুতে আমরা সন্ধির কেবিনে পৌঁছালাম। সন্ধির কেবিনে ঢুকে সবাই আতঙ্কিত হয়ে গেলাম।
গল্পের নাম রাজমহল
লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব-7
সন্ধির কেবিনে ঢুকে সবাই আতঙ্কিত হয়ে গেলাম।
কারণ কেবিনটা একদম অন্ধকারে আচ্ছন্ন ছিল। তবে বাহিরটা ঠিকেই আলোকিত ছিল।কেবিনের দরজার সামনে যেতেই মনে হলো আকাশটায় কোনো কালো বলয় এসে সূর্যটাকে গ্রাস করছে।নিমিষেই কেবিনের মতো চারদিক অন্ধকারে আচ্ছন্ন হতে লাগল। চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম সবাই যে যার মতো যে কাজে ছিল সে কাজে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে পুরো হাসপাতালটা স্থির হয়ে গেছে আমরা চারজন ব্যতীত। আমার নিঃশ্বাসটা ক্রমে ভারী হতে লাগল। নাক দিয়ে যেন গরম নিঃশ্বাস বের হতে লাগল।হাসিব আমার অবস্থা দেখে আমার দুই বাহুতে জোরে ধরে রাখল। আবিদা ডাক্তার রাহনুমাকে বলল
- ম্যাম হঠাৎ করে হাসপাতালের এ অবস্থা কেন হলো। চারপাশ আন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে। ক্রমশেই অন্ধকারটা বাড়তে লাগল। এখন কী করব ম্যাম।
ডাক্তার রাহনুমাও ভয় পাচ্ছিল সেটা তার ঘন ঘন নিঃশ্বাসের শব্দে বুঝা যাচ্ছিল।ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিতে নিতে উনি আবিদাকে বললেন
- জানি না কী হচ্ছে এসব। তবে মনে হচ্ছে কোনো অস্বাভাবিক কিছু ঘটবে। আমার জীবনে এই প্রথম এরকম ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছি। আমাদের উচিত তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া না করে দাঁড়িয়ে থাকা। আপাতত সবাই চুপচাপ থাকো। আর দেখতে থাকো কী হয়। কিছু করতে গেলে হিতে বিপরীত হবে। তখন নিজেদের রক্ষা করাটাও দুর্লভ হয়ে যাবে। তাই চুপ করে সবটা দেখে যাওয়ায় শ্রেয়।
ডাক্তার রাহনুমার কথা অনুযায়ী আমরা কেউ কোনো কথা বাড়ালাম না। উনার কথা মতো চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা দেখার জন্য।তখন আমি পেছন ফিরে হাসপাতালের করিডোরের গ্রিলের ফাঁক দিয়ে আকাশপানে তাকালাম।আমি লক্ষ্য করলাম কালো বলয়টা তখন সূর্যকে অর্ধেক গ্রাস করে ফেলেছে ইতোমধ্যে। আস্তে আস্তে বাকি অংশও গ্রাস করতে লাগল। অদ্ভূত এক পরিস্থিতির দ্বার প্রান্তে এসে দাঁড়িয়ে আছি। যার শেষ কোথায় কেউ জানি না। শুধু জানি কিছু একটা হতে চলেছে।
কালো বলয়টা সূর্যকে যতই গ্রাস করছিল ততই চারদিকে ক্রমশ অন্ধকার বাড়তে লাগল। অন্ধকারে চারপাশটা বিদঘুটে হয়ে যেতে লাগল। আস্তে আস্তে বলয়টা পুরো সূর্যকে গ্রাস করে ফেলল সেই সাথে নিকষ কালো অন্ধকার চারপাশে নেমে এলো। শুধু মাত্র সবার ঘন ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ কানে আসছিল তবে কে কোথায় আছে কিছুই দেখছিলাম না। আমবস্যা রাতে কখনো বের হয়নি যদিও তবে আমার কাছে মনে হচ্ছে এখনের অন্ধকার আমাবস্যার রাতের অন্ধকারকেও হার মানাবে।
সবাই চুপচাপ। হাসপালালটা যেন একটা কালো রাজ্যে পরিণত হয়ে গেল। এর মধ্যে সন্ধির কেবিনে একটা আলোক বিন্দু সৃষ্টি হলো। নিকষ অন্ধকারে আলোক বিন্দুটা চকচক করতেছিল। চারিদকে আলোকবিন্দুটা ঘুরপাক খাচ্ছিল। ঘুরপাক খেতে খেতে বিন্দুটা সন্ধির মুখে পড়ল। সন্ধির মুখে পড়ার সাথে সাথে আমরা চমকে গেলাম। কারণ সেটা সন্ধির মুখ ছিল না। অন্য কোনো নারীর মুখ অবয়ব ছিল। দাঁতে দাঁত কামড়ি দিয়ে সবাই দেখতে লাগলাম পুরো বিষয়টা কী হতে যাচ্ছে।
এদিকে আমার দম যেন আটকে যেতে লাগল।শরীরটা বেশ নিস্তেজ নিস্তেজ লাগছিল। ডাক্তার রাহনুমা ফিসফিস গলায় বলল
- সন্ধির বিষয়টাতে প্যারানরমাল কোনো রহস্য আছে মনে হচ্ছে। তবে রহস্যভেদ করা এত সহজ কাজ হবে না। আপাতত সবাই নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বিষয়টা পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। মনোবল আর শক্তিটাই আসল। মনোবল নষ্ট হয় এমন কোনো কিছু করবেন না কেউ।অবশ্যই আলোর পথ দেখব তবে সেটা সময়সাপেক্ষ।
ডাক্তার রাহনুমার কথা শোনে মনে মনে একটু ভরসা পাচ্ছিলাম। অপরদিকে আলোকবিন্দুটা সন্ধির মুখ থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে নামতে নামতে পেটের কাছে আসলো। পেটের কাছে আসতেই সন্ধির পেটের কাপড়ে আবিদার বর্ণণাকৃত রক্তের দাগগুলে চকচক করতে লাগল।
এরপর আলোক বিন্দুটা সন্ধির পেটের উপর ঘুরপাক খেতে লাগল। ঘুরপাক খেতে খেতে সন্ধির নাভি বরাবর আসলো। আর সন্ধির নাভির দিকটা ফেটে যেতে লাগল। এসব দেখে আমার মাথাটা আরও ঝিমঝিম করতে লাগল। আবিদা ঠিক যেমন বর্ণণা দিয়েছিল ঠিক তেমনভাবেই সন্ধির পেট ভেদ করে একটা নবজাতক শিশু বের হলো। বিভৎস পুড়া এক নবজাতক শিশু। পঁচা গন্ধে যেন পুরু কেবিন মুহু মুহু করতে লাগল। অসহনীয় কষ্ট হচ্ছিল। তবুও নাকটা চেপে দেখতে লাগলাম সবটা। নবজাতক শিশুটা খিল খিল করে হাসতে হাসতে বলল
- আমি আসতে চাই। আমার প্রতিশোধের জন্য আমাকে আসতে হবেই।
বলেই আবার পেটে ঢুকে গেল। চারপাশ আবার আলোকিত হতে শুরু করল। কালো বলয়টা সূর্যের উপর থেকে সরে যেতে লাগল। আস্তে আস্তে সবটা পরিষ্কার হয়ে আলোকিত হলো। আশে পাশের মানুষগুলো স্থির থেকে গতিশীল হতে লাগল। আমাদের সাথে যা ঘটেছে সেটা তাদের অন্তরালে রয়ে গেল। সবটা আলোকিত হওয়ার পর আমরা সন্ধির কাছে গেলাম। সন্ধির দিকে তাকিয়ে দেখলাম সন্ধি তার নিজের চেহারাতেই আছে একটু আগে অন্য যে চেহারাটা বা অবয়বটা দেখেছিলাম সেটা এখন নেই। খেয়াল করলাম সন্ধির পেটের দিকের কাপড়ে রক্তের লাল দাগ লেগে আছে। কাঁপা কাঁপা হাতে ডাক্তার রাহনুমা কাপড়টা তুলল। কাপড়টা তুলার পর লক্ষ্য করলাম সন্ধির পেটে কোনো ক্ষত নেই। সবাই যেন চমকে উঠলাম। বিষয়টাতে আমার মনটা আরও বিষন্ন হয়ে গেল।
তবে সেই সাথে আরেকটি বিষয় পরিলক্ষিত হলো। খেয়াল করলাম সন্ধির পেট ফুলে গেছে।সন্ধির পেট দেখে এবার মনে হচ্ছে সে গর্ভবতী। এখন সন্ধিকে বাড়িতে নিয়ে গেলে সায়রা আপুকে কি জবাব দিব এটা ভেবে মনটা আরও বেশি হতাশ হতে লাগল।ডাক্তার রাহনুমা সন্ধির মাথায় ধরার সাথে সাথে সন্ধির চোখ গুলো কাঁপতে লাগল। বুঝতে পারছিলাম সন্ধির জ্ঞান ফিরবে। সন্ধি চোখটা খুলে ডাক্তার রাহনুমার দিকে তাকিয়ে আবার চোখটা বন্ধ করে দিল। ডাক্তার রাহনুমা এবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল
- ওর জ্ঞান ফিরতে আরও কিছুক্ষণ সময় লাগবে৷ সে পর্যন্ত আপনাদের অপেক্ষা করতে হবে। জ্ঞান ফিরলে রোগীকে বাসায় নিয়ে যেতে পারবেন। আপনাদের রোগীর চিকিৎসা আমি করতে পারব না।কারণ এ রোগীর সাথে প্যারানরমাল বিষয় জড়িয়ে আছে। যার চিকিৎসা আমার জানা নেই। এমন কেউ পরিচিত নেই যে এসব নিয়ে কাজ করে। থাকলে হয়তো সাহায্য করতে পারতাম। তবে আমিও যেহেতু এ বিষয়টাতে জড়িয়ে গেছি সেহেতু আমার জীবনেও এর প্রভাব পড়তে পারে। আপাতত আমি কিছুই করতে পারছি না। আপনার মোবাইল নম্বরটা দিয়ে যাবেন কখনো কোনো উপায় পেলে সাহায্য করব। আর আমার সাথে তেমন কিছু হলেও জানাব। আপনারা এমন কাউকে খুঁজুন যে এ বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা করে বা জানে। এতেই আপনাদের ভালো হবে। আমার কাছে এমন কোনো চিকিৎসা নেই যে ওকে করব।
কথাগুলো বলে ডাক্তার রাহনুমা আবিদার দিকে তাকিয়ে বলল
- তুমি ওকে কাপড়টা পাল্টে দাও। আর হাসপতালের অন্য স্টাফ যেন বিষয়টা জানতে না পারে। তাহলে আমার চাকুরি এবং তোমার চাকুরির উপর প্রভাব পড়তে পারে৷ সেই সাথে হাসপাতালের উপরও প্রভাব পড়তে পারে। তাই বিষয়টা গোপন রাখবে।
আবিদা দীর্ঘ দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল
- আমি একা ওর কাপড় পাল্টাতে পারব না ম্যাম।আমার বেশ ভয় করছে।
আবিদার কথা শোনে ডাক্তার রাহনুমা ধমক দিয়ে বলল
- দরজা লাগাতে হবে না শুধু পর্দা টেনে হাসপাতালের কাপড় পাল্টে ওর পরনে যা ছিল সেগুলো পড়িয়ে দাও। এত ভয়ের কিছু নেই।
আবিদা হাঁপাতে লাগল আর ঢুক গিলতে লাগল।আবিদার ভয় দেখে আমি চাপা গলায় বললাম
- আমি আপনার সাথে থাকব। আপনি চিন্তা করবেন না। ভয়ের কিছু নেই। আমার বোন তো ও।যা কিছুই হোক আমাকে ওর পাশে থাকতে হবে। এছাড়া তো কোনো উপায় নেই।
আবিদা আমার কথা শোনে একটা ভরসা পেল। হালকা দম নিয়ে বলল
- না মানে আমার তো ভয় লাগছে বিষয়টাতে তাই আর কী।
ডাক্তার রাহনুমা আমার কথা শোনে জবাব দিল
- আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি আবিদার সাথে কাজ সেরে আমার কাছে আসবেন। বাকি কথা চেম্বারে বলব। এসব বিষয় খোলামেলা বলা উচিত না।
বলেই উনি হাসিবকে নিয়ে উনার চেম্বারের দিকে রওনা দিলেন।
অপর দিকে আমি আর মিসেস আবিদা মিলে সন্ধির কাপড় পাল্টে দিলাম। তারপর ডাক্তার রাহনুমার কাছে গেলাম। ডাক্তার রাহনুমা আমাকে দেখে চেয়ারটা ইশারা করে বসতে বলল। আমি চেয়ারটা টেনে বসলাম।তারপর উনি একটা কাগজ বাড়িয়ে দিয়ে বললেন
- আপনার বোনের বিষয়টা নিয়ে তো আাপাতত কিছু করতে পারছি না। এ কাগজে আমার পারসোনাল নম্বর আছে কোনো সমস্যা হলে কল দিবেন। আর আমি আপনার ফ্রেন্ডের কাছ থেকে আপনার নম্বরটা নিয়ে নিয়েছি কোনো সাহায্য করতে পারলে করব অবশ্যই। বিকেল দিকে রোগীকে নিয়ে যেতে পারবেন। মানসিক মনোবল রাখবেন। আর বিষয়টা আপনার বড় বোনকে খোলাসা করে বলে দিন। যেহেতু সন্ধির পেটের আকার বৃদ্ধি পেয়েছে সেহেতু আপনার বোনের কাছে বিষয়টা গোপন রাখলে আরও বেশি ঝামেলা হতে পারে। তাই বড়দের জানিয়ে দেওয়াই ভালো হবে।
আমি ডাক্তার রাহনুমার জবাবটা মাথা নেড়ে দিলাম। তারপর হাসিবকে নিয়ে চেম্বার থেকে বের হয়ে সন্ধির কেবিনে সন্ধির জ্ঞান ফেরার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। বিকেল চারটায় সন্ধির জ্ঞান ফিরল। জ্ঞান ফেরার সাথে সাথে সে উঠে বসল। চারপাশ একটু চোখ বুলিয়ে বলল
- আপু এখানে কী করে আসলাম রে আমি?
আমি হতবাক গলার জবাব দিলাম
- তোকে গর্ভপাত করাতে এনেছিলাম ভুলে গেছিস?
- না.... তা তো ভুলিনি। তবে আমার স্পষ্ট মনে আছে আমাকে যখন ডাক্তার গর্ভপাতের জন্য রুমে ঢুকিয়েছিল তখন কেউ একজন রুম থেকে বের করে অন্য কোথায়ও নিয়ে গেছিল।
আমি সন্ধির কথা শোনে একটু আশ্চর্য হয়ে জাবাব দিলাম
- মানে?
- হ্যাঁ সত্যি বলছি। আমি তো এতক্ষণ এ জগতে ছিলাম না মনে হচ্ছে। আমি তো ছিলাম অন্য একটা জায়গায় অন্য একটা জগতে।
আমি সন্ধিকে ধমক দিয়ে বললাম
- হেয়ালি রেখে খুলে বল কী হয়েছে?
সন্ধি মাথায় হাতটা চেপে ধরে বলল
গল্পের নাম রাজমহল
লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব- ৮
সন্ধি মাথায় হাতটা চেপে বলল
- জানি না কোথায় গিয়েছিলাম। তবে মনে হয়েছিল সব বাস্তবে হচ্ছে আমার সাথে। মনে হচ্ছিল সেটা আমি ছিলাম না আমার ভেতরে অন্য কেউ ছিল। কেন জানি না সে জায়গায় অসম্ভব মায়া কাজ করছিল। সবকিছু বেশ চেনা চেনা লাগছিল। অদ্ভূত রকমের টান অনুভব করছিলাম।
আমি অস্থির গলায় সন্ধির কথা থামিয়ে বললাম
- এত ভূমিকা রেখে কী হয়েছে বল।
পাশ থেকে হাসিব আমার কাঁধে হাত রেখে আমাকে হালকা গলায় বলল
- তুমি একটু স্থির হও। ওকে ওর মতো করে বলতে দাও। ও এখন ওর মধ্যে নেই। চাইলেও সে তোমার কথা মতো সব একটানে বলবে না। ওকে বাঁধা দিও না।
হাসিবের কথা শোনে কিছুটা আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম
- মানে?
হাসিব আমাকে তার চোখ দিয়ে সন্ধির চোখের দিকে ঈশারা করে বলল
- ওর চোখ দেখলেই সবটা বুঝতে পারবে।
আমি তড়িঘড়ি করে সন্ধির চোখে তাকিয়ে চমকে গেলাম। কারণ তার চোখ গুলো ধূসর হয়ে আছে। কি যেন সে বিড়বিড় করছে। নিজের মধ্যে সাহস সঞ্চার করে সন্ধির হাতে হাত রেখে বললাম
- কী হয়েছে বল। কী বিড়বিড় করছিস?
আমার স্পর্শে যেন সন্ধির গা টা কেঁপে উঠল। হালকা কেঁপে উঠে আমাকে বলল
- হ্যাঁ বলছি তো। তাহলে শোন আমাকে যখন গর্ভপাত করাতে ওটি রুমে নিয়ে গেল। তার কিছুক্ষণ পর আমাকে অজ্ঞান করা হলো। ঠিক তখন মনে হলো কেউ একজন আমাকে ওটি রুম থেকে বের করে নিল। আমি ওটি রুম থেকে বের হয়ে এমন জায়গায় আসলাম যেটা নিস্তব ছিল আর সবুজে ঘেরা। চারপাশে গাছে ঘেরা এক সবুজ রাস্তা। সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল একটা পালকি। আমি রাস্তার পাশে তখন নব বধু সাজে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আশেপাশে অনেক মানুষ ছিল। তারা দাসীর মতো আমার শাড়ি গয়না ঠিক করে দিচ্ছিল। চুল ঠিক করে দিচ্ছিল। তালের কারুকাজ খচিত পাখা দিয়ে আমায় বাতাস করতেছিল। আমি খুব স্বাভাবিক ভাবে সব দেখতে লাগলাম।
এর মধ্যেই হুট করে আমার কানে আসলো ঢোলের আওয়ায়। এত বিকট আওয়াজ কি বলব। আমি কান চেপে রাখলাম। তার মধ্যে আস্তে আস্তে ঢোলের আওয়াজটা প্রখর হতে হতে আমার সামনে এসে থেমে গেল। কেউ একজন সেখান থেকে এসে আমাকে ঈশারা দিয়ে বলল পালকিতে উঠতে।
আমিও কেমন জানি আনমনে হয়ে গেলাম। মনে হচ্ছিল আমি আমার মাঝে ছিলাম না। অন্য একজন আমাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। আমি তাদের কথায় পালকিতে উঠলাম। আরেরেরের.... বলে পালকি কাধেঁ তুলে যেতে লাগলো। পালকির সামনের কাপড়টা সরিয়ে বাইরের দিকে তাকালাম।দিনের প্রথম রোদটা যেন আমার মুখে এসে লেপ্টে গেল। পালকি হনহনিয়ে যেতে লাগল সেই সাথে রোদটাও আমার সাথে যেতে লাগল। অদ্ভুত অনুভূতি অদ্ভুত মায়ার টান অনুভব করছিলাম। বাইরের সবুজ গাছ পার করে মনে হচ্ছে অচেনা এক গন্তব্যে যাচ্ছি। পালকিতে বসে বুঝতে পারছিলাম না সে গন্তব্য কোথায় ছিল তবে সেটা যে সুখের গন্তব্য ছিল সেটা আমার মনের অনুভূতিতে টের পাচ্ছিলাম। হনহনিয়ে পালকি যেতে যেতে ভর দুপুর হলো। পালকির লোক গুলো পালকিটা থামিয়ে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিল।ঠিক তখন এক সুন্দর ঘোড়ার গাড়ি আমার পালকির সামনে এসে দাঁড়াল। সেই গাড়ির উপরে তাকিয়ে দেখলাম এক সুন্দর সুদর্শন যুবক বসে আছে কারুকাজখচিত জামা পড়ে। মনে হচ্ছিল সে কোনো রাজ্যের রাজা।তবে সে যুবককে দেখে মনে হয়েছিল আমি তাকে অনেক ভালোবাসি আর তার সাথে আমার সদ্য বিয়ে হয়েছে। কেন এমনটা মনে হয়েছিল জানি না। আমি যুবকের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। যুবক ঘোড়ার গাড়ি থেকে নেমে আমার সামনে এসে হাঁটু ঘেরে বসে বলল
- তোমার কি লাগবে বলো? আর কি আহার করবে বলো। পালকিতে বসে আহার করবে নাকি বের হবে একটু।
উনার কথা শোনে একটু লজ্জা পেলাম আমি৷ লজ্জায় মাথা নত করে বললাম
- আপনার চাওয়াই আমার চাওয়া।
তখন উনি হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল
- আমার চাওয়া তো তোমাকে নিয়ে একটু জঙ্গলটা ঘুরব। যেহেতু তুমি আমার সহধর্মিণী তোমাকে নিয়ে একটু ঘুরতে পারলে আমার বেশ ভালো লাগবে।
উনার কথায় পুনরায় লজ্জা পেলাম। বুঝতে পারছিলাম এ লোকটার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। কী থেকে কী ঘটছে সেটা আমার মনের অজান্তেই যেন সব টের পাচ্ছিলাম। আমি উনার কথার জবাব না দিয়ে হাতটা বাড়িয়ে উনার হাতে রেখে বললাম
- চলুন তাহলে আপনার চাওয়া পূরণ করা যাক।
বলেই উনার হাত ধরে পালকিতে থেকে নামলাম। উনি আমার হাতটা শক্ত করে ধরে বলল চলো সামনে এগুনো যাক। আমি আর উনি একটু সামনে এগুলাম। কিছুক্ষণ চারপাশ ঘোরার পর কয়েকজন এসে আমাদের গাছতলায় মাদুর পেতে দিল। আমি আর উনি বসলাম। সামনে বেশ মজাদার মিষ্টান্ন ভান্ডার রাখা ছিল। উনি আমাকে সেখান থেকে মিষ্টি নিয়ে মুখে তুলে দিল। আমিও খেলাম। এরপর উনি আমার দিকে তাকিয়ে বলল
- তোমাকে আজকে বেশ সুন্দর লাগছে। মনে হচ্ছে একটা পুতুল তুমি। তোমার গর্ভেই আসবে আমার উত্তরাধিকার।
আমি উনার কথা শোনে অপলক দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। পরক্ষণেই হালকা লজ্জা পেয়ে উনার চোখ থেকে চোখটা নামিয়ে নীচের দিকে তাকালাম।উনি আমার থুতুনিটা ধরে উপরের দিকে তুলল। আমি লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেললাম।পরক্ষণেই আবার চোখটা খুলে উনার দিকে তাকালাম। মনের মধ্যে এক ভালোবাসার অনুভূতি বিরাজ করছিল। ভালোবাসার মতাল হাওয়া যেন সারা শরীরে বইছিল। উনি আমার অবস্থা দেখে মুচকি হেসে বললেন
- এত লজ্জা পাওয়ার মতো কিছু হয়নি প্রিয়তম। এবার পালকিতে গিয়ে বসো আবার যাত্রা শুরু হবে।
আমাকে ধরে উনি পালকিতে বসালেন তারপর আবার ঘোড়ার গাড়িতে গিয়ে উনি বসলেন। পালকি পুনরায় আরেরেরেরেরে....করে চলতে শুরু করল। হনহন করে পালকি চলছে। পড়ন্ত বিকালের রোদটা আমার সাথে গড়িয়ে গড়িয়ে চলছে।দিন পেরিয়ে রাত নামল। চারপাশে লন্ঠন জ্বালানো শুরু হলো। যাত্রাপথ লন্ঠনের আলোতে আলোকিত হলো।
দীর্ঘ যাত্রা পেরিয়ে গভীর রাতে পৌঁছালাম একটা বিরাট বড় বাড়িতে। বাড়িটা আর কোথাও ছিল না আমরা যেখানে থাকি সেখানেই ছিল তবে বাড়ির আশপাশটা আরও বড় আর বাড়িটা আরও কারুকাজ খচিত সুন্দর ছিল। আমি বাড়ির সামনে যেতেই একজন মহিলা এসে আমাকে নামাল। তিনি আমাকে বরণ করে ঘরে তুলল। সবাই আমাকে আমার নামে ডাকছে না৷ কেউ আমাকে সন্ধি বলছে না সবাই আমাকে জার্নিভা বলে সম্বোধন করছে। আমাকে বরণ শেষে আমাকে বসানো হলো একটা পালঙ্কে।
আমি আস্তে করে পালঙ্ক থেকে নামলাম। একটু সামনে গিয়ে একটা আয়না দেখতে পেলাম। খুব ইচ্ছা হচ্ছিল নিজের প্রতিচ্ছবিটা আয়নাতে দেখি। নিজের প্রতিচ্ছবি আয়নাতে দেখার জন্য যখন আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম তখনেই চমকে গেলাম। কারণ আমার রুপে আমি ছিলাম না৷ আমার চেহারাটা পুরো বদলে গিয়ে অন্য একটা নারীর রূপ ধারণ করেছিল। এমন সময় পেছনে কেউ একজনের অস্তিত্ব অনুভব করলাম৷ পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম সেই যুবক দাঁড়িয়ে আছে। জানতে পারলাম সে এ মহলের রাজা। যার নাম মেহেদীরাজ।
উনি আমার কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। অসম্ভব ভালোবাসায় সাগরে যেন আমি ডুবে গেলাম। দেখতে দেখতে সেখানে অনেক সময় পার করলাম৷ আমার গর্ভে সন্তান আসলো। সারা রাজমহল আমার সন্তানের খবরে খুশির জোয়ারে ভাসছে।
কিছুদিন পর একজন মহিলা এসে আমার পেটে চেপে পরীক্ষা করতে লাগল। মহিলাটা এমন ভাবে পেট চেপেছিল যে আমি ব্যাথা পেয়ে লাথি মারি। তারপর কি হয়েছিল আমি জানি না। উঠে দেখলাম আমি এখানে।
সন্ধির কথা শোনে আমি ভাবতে লাগলাম ডাক্তার রাহনুমা বলেছিল সন্ধি লাথি মেরেছে তার উপর সন্ধির চেহারাও পরিবর্তন হয়েছে। তার মানে সন্ধি এমন কোনো জগতে গিয়েছিল সেটা আমাদের অন্তরালে ছিল। সন্ধি সে জগতে সে মহিলাকে লাথি দেয় আর এ জগতে লাথিটা পরে ডাক্তার রাহনুমার শরীর বরাবর। সে জগতে সন্ধির চেহারা পরিবর্তন হয় আর এ জগতেও সন্ধির চেহারা পরিবর্তন হয়েছে। তার মানে সন্ধি কল্পনায় অন্য কোনো জগতে চলে যাচ্ছে বাস্তবেও তার প্রতিফলন হচ্ছে।
আমি সন্ধির দিকে তাকিয়ে দেখলাম সন্ধির চোখ স্বাভাবিক হয়ে গেছে। তবে সে ভয় পেয়ে আছে। আমি সন্ধিকে হালকা হাতে ধরে বললাম
- ভয় পাস না। কোনো না কোনো উপায় তো পাব। এবার আস্তে করে উঠে চল। বাড়ি যেতে হবে।
সন্ধি আমার কথা শোনে হালকা কেঁদে দিয়ে বলল
- আমার পেটটা এত বড় হয়েছে এখন বাড়ি গেলে তো সায়রা আপু বকবে। আমি যাব না।
আমি সন্ধিকে ভরসা দিয়ে বললাম
- চিন্তা করিস না আমি সায়রা আপুকে সবটা বুঝিয়ে বলব। এবার চল তো।
বলেই সন্ধি আর হাসিবকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে একটা সি এন জি নিলাম।সি এন জি টা গন্তব্যের দিকে যেতে লাগল। আর আমি আনমনে বসে ভাবতে লাগলাম সায়রা আপুকে কীভাবে বিষয়টা বুঝাব। এসব ভেবে মনটা অস্থির হচ্ছিল তবুও নিজেকে স্থির করে নিচ্ছিলাম। ততক্ষণে সি এন জি বাসার সামনে এসে থামল। সিন এন জি থেকে নেমে বাসার সামনে অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু ভয় পেয়ে গেলাম। ভবলাম সায়রা আপুর কিছু হয়নি তো। এসব ভেবে ভেবে সন্ধি আর হাসিবকে নিয়ে ভয়ে ভয়ে বাসার ভেতর ঢুকতেই গা টা শিউরে উঠল।
গল্পের নাম রাজমহল
লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব- 9
এসব ভেবে ভেবে সন্ধি আর হাসিবকে নিয়ে ভয়ে ভয়ে বাসার ভেতর ঢুকতেই গা টা শিউরে উঠল। কারণ উঠানে একটা খাটিয়া পড়ে আছে। পাশেই গরম পানি করা হচ্ছে। গোসলের জন্য নির্ধারণ করা জায়গাটা চারপাশে কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হচ্ছে। খাটিয়াটা দেখে ভেতরটা কেঁপে উঠে মনে হলো সায়রা আপুর কিছু হয়নি তো। সায়রা আপু বেঁচে আছে তো। এসব ভেবেই মনটা ব্যাকুল হয়ে যেতে লাগল। কষ্টে বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছিল। অজানা এক আতঙ্কে যেন অন্তরটা বারবার কেঁপে উঠছিল।
অপরদিকে এ মুহুর্তে সন্ধিকে সবাই দেখলে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাবে। এত কষ্টের মধ্যেও মনটাকে শান্ত করে সন্ধির দিকে তাকালাম। সন্ধি জীর্ণশীর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এখনো কেউ সন্ধিকে দেখেনি৷ তবে কেউ একজন যদি সন্ধিকে দেখে তাহলে হাজারটা প্রশ্নের তীর উঠবে সন্ধির উপর৷ তাই সন্ধিকে হালকা গলায় বললাম উড়না দিয়ে পেট টা ভালো করে ঢাকতে তারপর হাসিবকে ঈশারা করলাম সন্ধিকে নিয়ে গেস্ট রুমে বসাতে। হাসিব বেশ কয়েকবার আমাদের বাসায় এসেছে তাই সন্ধিকে সঠিক জায়গায় নিয়ে যেতে তার সমস্যা হবে না। হাসিব সন্ধিকে নিয়ে সামনের দরজা দিয়ে যেতে চাইলে আমি তাকে আটকে দিয়ে বললাম
- সন্ধিকে নিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে যাও। সামনের দরজায় অনেকেই আছে। সবাই জটলা পাকিয়ে কিছু একটা দেখছে।জানিনা কী হয়েছে। সবাই কেন এভাবে জটলা পাকিয়ে আছে তাও জানি না।সায়রা আপুর কিছু হলো না তো।
বলতেই আমার চোখ দিয়ে অনর্গল পানি পড়তে লাগল। হাসিব আমাকে কি স্বাত্ত্বণা দিবে সে ভাষা খুঁজে পাচ্ছিল না হয়তো তাই চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর সন্ধিকে ধরে পেছনের দরজার দিকে এগুতে নিলে সন্ধি আমার হাতটা ধরে কান্না করে বলল
- আপুই আমাকে তোর সাথে নিয়ে যা। সায়রা আপুর কিছু হলো কিনা আমি দেখব।
আমি সন্ধির কথা শোনে নিজের ভেঙ্গে যাওয়া মনটাকে গড়ে নিয়ে বললাম
- এখন তুই গেলে হাজারটা সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। তুই বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে গিয়ে হাসিবের সাথে গেস্ট রুমে বস। সায়রা আপুর কিছু হয়নি। শুধু শুধু চিন্তা করিস না। আমি বাকিটা দেখছি।
বলেই হাসিবকে বললাম সন্ধিকে নিয়ে যেতে। হাসিব সন্ধিকে নিয়ে গেল। আর এদিকে আমি বাড়ির সম্মুখ দরজার দিকে এগুতে লাগলাম। গুটিকয়েক মানুষ সেখানে ভীর করে ছিল। যতই এগুচ্ছিলাম ততই মনে প্রশ্ন জাগছে আপু বেঁচে আছে তো। আপুর মুখটা দেখতে পারব তো৷ আমার বুকের স্পন্দন জোরে জোরে প্রতিধ্বনি তুলছিল। পা যেন ভয়ে সামনের দিকে এগুচ্ছিল না। বারবার থেমে পড়ছিলাম। চল্লিশ কদম রাস্তাটা মনে হচ্ছে চল্লিশ কিলোমিটার রাস্তা। এটুকু রাস্তা পার হওয়া যে এত কষ্ট সেটা আজকের আগে জানা ছিল না। নিজেকে শান্ত করে মনে সাহস জুগিয়ে সামনের মানুষগুলো সরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই কলিজাটা কেঁপে উঠল, একটা মানুষকে সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা দেখে।
মনের অজান্তে বলে উঠলাম আস্তে করে, আমার সায়রা আপু আমাদের ছেড়ে চলে গেল না তো। এসব ভেবে ভেবে সামনে এগিয়ে কাপড়টা কাঁপা কাঁপা হাতে সরাতে নিলেই একটা কান্নার চিৎকার আমার কানে আসলো। আমি কাঁপড় টা না সরিয়ে কান্নার স্বরটা ভালো করে লক্ষ্য করলাম। খেয়াল করলাম সায়রা আপুর কন্ঠস্বর। আপুর কন্ঠস্বরের উৎসটা খুঁজার চেষ্টা করলাম। বুঝতে পারছিলাম পাশের রুমে আপু কাঁদছে। মনে বেশ প্রশান্তি লাগল যে আপুর কিছু হয়নি। তবুও না দেখা পর্যন্ত ভেতরে শান্তি লাগবে না। দৌঁড় লাগালাম পাশের রুম বরাবর। পাশের রুমে গিয়ে দেখলাম আপু খাটে হেলান দিয়ে কাঁদতেছে জোরে জোরে।
আপুকে দেখে শান্তি পেলেও ভেতরে একটা প্রশ্ন জাগল ঐ লাশটা তাহলে কার? মনের ভেতর যেন প্রশ্নের তুলপাড় শুরু হলো। নিজেকে সামলে নিয়ে আবার গেলাম সেই জায়গায়। গিয়ে সাদা কাফনটা কাঁপা কাঁপা হাতে উঠালাম। উঠিয়ে মুখটা দেখে শরীরটা শিউরে উঠল।এত বিভৎসভাবে কাউকে মারতে পারে জানা ছিল না। মাথার চারপাশ এভ্রোথেভ্রো হয়ে রক্ত জমাট বেঁধে লাল হয়ে আছে। ঘাড়ের কাছে শক্ত শক্ত গোলা হয়ে যেন রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে।সারা শরীরে কাটা ছিড়ার শেষ নেই।এসব দেখে লাশটা বেশিক্ষণ দেখার সাহস হলো না। তবে লাশটা দেখে একেবারের জন্য স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম।লাশটা আর কারও ছিল না আমার বোনের স্বামী অনিক ভাইয়ার ছিল। যে কিনা ব্যবসায়ের কাজে বাইরে ছিল।
সারা শরীরে যেন গায়ের লোম কাঁটা দিয়ে উঠল। রুম থেকে ক্ষণে ক্ষণে আপুর চিৎকারের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল।আপুকে কি বলে স্বাত্ত্বণা দিব সে ভাষা আমার নেই। এক যুগ প্রেমের পর অনেক বাঁধা পেরিয়ে আপুর সাথে অনিক ভাইয়ার বিয়ে হয়েছে। আর সে বিয়ের সংসার তিনমাসের বেশি করতে পারল না। কলিজাটা যেন ভেদ করে কোনো বান বের হয়ে যাচ্ছিল। এতটা কষ্ট হচ্ছিল সেটা বর্ণণা করার ভাষা নেই।
নিজের মধ্যে থাকা সকল শক্তি যেন হারিয়ে ফেলছিলাম। বেশ অস্বস্থি হচ্ছিল। অনিক ভাইয়ার লাশটাও চোখে ভাসছিল। এত বিভৎস ভাবে মৃত্যু কীভাবে হলো জানি না। ঠাঁই চুপ হয়ে বসে রইলাম। আশে পাশের সবার থেকে জানতে পারলাম ভাইয়ার এক্সিডেন্টে মৃত্যু হয়েছে। কথাটা শোনে ভেতরে গভীর একটা প্রশ্নের চড়াও দিল। সন্ধির বাবাও এক্সিডেন্টে মারা যায়,আমার বাবা, মা ও এক্সিডেন্টে মারা যায় আর আজকে অনিক ভাইয়াও মারা গেল। বিষয়টা হয়তো সবার কাছে স্বাভাবিক লাগতে পারে যে এক্সিডেন্ট তো অস্বাভাবিক কিছু না। তবে একই জায়গায় তিনজনের মৃত্যু কি করে সম্ভব। তার উপর সন্ধির মায়ের মৃত্যু এক্সিডেন্টে না হলেও সেই জায়গায় মৃত্যু হয়েছে। সন্ধির মাকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার সময় সেই জায়গায় সন্ধির জন্ম হয় আর সন্ধির মায়ের মৃত্যু হয়। এটার সাথে অবশ্যই কোনো যোগসূত্র আছে বলে আমার মনে হয়।
নিজের ভেতরটা এসব ভেবে ভেঙ্গে যেতে লাগল। এমন সময় আপু পাশের রুম থকে চিল্লায়ে এসে ভইয়ার লশটাকে জড়িয়ে ধরে বিলাপ করে কাঁদতে লাগল। প্রতিবেশীরা আপুকে ভাইয়ার কাছ থেকে ছাড়িয়ে পাশের রুমে নিয়ে গেল। ভইয়ার বাড়ির সবাই এসেছে। সবাই চাচ্ছে লাশটা কাফন পড়িয়ে তাদের বাড়ি নিয়ে কবর দিতে। তবে আপু বিলাপ করে বলছে আমার অনিককে আমার কাছ থেকে নিয়ে যেও না।
এদিকে ভাইয়ার লাশ ধরাধরি করে গোসল করাতে নিয়ে গেল। গোসল শেষে সাদা কাফনে মুড়িয়ে ভইয়াকে নিয়ে যাচ্ছে তাদের বাড়ি। আর আপুকে বাসায় রেখে যাচ্ছে। আমি শুধু অপলক দৃষ্টিতে সবটা তাকিয়ে দেখছি। মনের অজান্তে শুধু ভাবতে লাগলাম। কী হচ্ছে এসব। কেনই বা এমন হচ্ছে। আস্তে আস্তে মানুষ কমতে কমতে বাড়িটা শূন্য হয়ে গেল।আপু পাশের রুমে বসে কাঁদছে। আমি আপুর রুমে না গিয়ে সন্ধি আর হাসিবের কাছে গেলাম।লক্ষ্য করলাম তার স্বাভাবিক আছে।
তাদের নিয়ে আপুর রুমের দিকে এগুলাম।যতই এগুচ্ছিলাম ততই মনে হচ্ছিল আপুকে কি এ সময় নতুন করে কষ্ট দেওয়া ঠিক হচ্ছে। তবে এত ভেবেও তার কোনো উত্তর পাচ্ছিলাম না।নিজেকে খুব অপারগ মনে হচ্ছে। আপুর রুমের দিকে যতই এগুচ্ছিলাম ততই অজানা আতঙ্ক মনে বিরাজ করছিল। অসহায়ের মতো হাসিব আর সন্ধিকে নিয়ে আপুর সামনে গেলাম। আপু তখন ফ্লোরে বসে খাটে মাথা গুজে কাঁদছিল। আমি আস্তে করে আপুর পাশে বসে আপুকে স্পর্শ করতেই আপু আমাকে ধরে জড়িয়ে কাঁদতে লাগল। আপু যখন আমাকে জড়িয়ে কাঁদছিল তখন আপুর চোখ গেল সন্ধির দিকে। আপু সন্ধিকে দেখে হুট করে কান্না থামিয়ে নিস্তব হয়ে গেল। অবাক দৃষ্টিতে একবার আমার দিকে আরেকবার সন্ধি আর হাসিবের দিকে তাকাচ্ছিল। কিছুক্ষণ নীরব থেকে আকস্মিকভাবে বলে উঠল
- সন্ধির কী হয়েছে এরকম পেট ফুলা কেন?
আমরা আপুর প্রশ্নের জবাবে সবাই চুপ ছিলাম। কোনো উত্তর যেন মুখ দিয়ে বের হচ্ছিল না। আপু পুনরায় আমাদের বলল
- কী হলো? সন্ধির কী হয়েছে বলছিস না কেন?
আপুর কথা শোনে সন্ধি জোরে কান্না করে বসলো। সন্ধির কান্না দেখে আপু অবাক হয়ে সন্ধিকে দেখতে লাগল। কিছুটা বিস্মিত হয়ে বিস্ময়ের সুরে বলল
- কী হয়েছে বলবি তো।
আমি আপুর কথা শোনে নিজেকে সামলে নিয়ে সন্ধিকে কান্না থামাতে বলে আপুকে সব কাহিনি খুলে বললাম। আপুও নির্বাক চোখে সব তাকিয়ে শোনল। তারপর সজোরে চিৎকার দিয়ে আমাকে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল
- এ কোন কালো ছায়ার কবলে পড়লাম। একটু ও কি আশার আলো দেখব না।
আমি আপুকে ধরে জোরে কান্না করে দিলাম।আপুও কাঁদছে,সন্ধিও কাঁদছে। ঘরটায় যেন আমাদের কান্নার হাহাকার বইতে লাগল। আমাদের কান্নার মাঝে বাঁধা দিল আপুর মোবাইলের রিংটন। কোনো এক অচেনা নম্বর থেকে আপুকে কেউ কল দিয়েছে। স্বামীর শোকে কাতর আপু তবুও কাঁপা হাতে কলটা ধরে হ্যালো বলতেই অজ্ঞান হয়ে গেল।
আপুর আকস্মিক অজ্ঞান হওয়াতে আমরা ভয় পেয়ে গেলাম। সবাই মিলে আপুকে পানির ঝাঁপটা দিতে লাগলাম। পানির ঝাঁপটায় আপুর চোখ মুখ ঠোঁট কাঁপতে কাঁপতে জ্ঞান ফিরল। আপুর জ্ঞান ফেরার পর আপুকে হালকা গলায় জিজ্ঞেস করলাম
- কে কল দিয়েছিল?
তারপর আপু যা বলল তা শোনে আমাদের চোখ কপালে উঠে গেল।
গল্পের নাম : রাজমহল
লেখিকা- : শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব- 10
তারপর আপু যা বলল তা শোনে আমাদের চোখ কপালে উঠে গেল। কারণ আপু বলল যে আপুর শ্বশুড় বাড়ির এক পরিচিত লোক কল দিয়েছে। আর উনি বলছেন যে ভাইয়াকে কবর দেওয়ার সময় যখন লাশ নামাতে যাবে তখন দেখে ভাইয়ার লাশ খাটিয়াতে নেই। লাশটা উধাও হয়ে গেছে। সবাই এ বিষয়টা নিয়ে বেশ চিন্তিত। হুট করে লাশটা কীভাবে উধাও হলো সেটাও কেউ বলতে পারছে না।
আপু কথা গুলো বলে জোরে জোরে দম নিচ্ছল। আপুর কথা গুলো শোনে বেশ অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল। তবুও বিশ্বাস করতে বাধ্য হলাম। কারণ এ কয়েকদিন যা হচ্ছে তারপর এসব অবিশ্বাস্য বিষয় বেশ বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। আমি আপুকে ছটফট গলায় বললাম
- ভাইয়ার লাশ কোথায় গেল তাহলে?
আপু নিরাশ কন্ঠে কান্নাজড়িত গলায় জবাব দিল
- জানি না কী হচ্ছে এসব আর কেনই বা এমন হচ্ছে।
বলেই আপু হেঁচকি তুলে তুলে কাঁদতে লাগল। আপুর কান্না দেখে আমার ভেতরের হাহাকার বাড়তে লাগল। কী হতে চলেছে কিছুই বুঝতেছি না। কেনই বা এমন হচ্ছে তার কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। বিষয়টা যতই সামনের দিকে এগুচ্ছে ততই সব ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে। সন্ধি আপুর কান্নার আওয়াজে ধপাস করে বসে পড়ল। বসে ঘরের সিলিং এর দিকে তাকিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠল। সন্ধির আচমকা চিৎকারে বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। এদিকে সন্ধি চিৎকার দিয়ে দুহাত দিয়ে চোখ ঢেকে ফেলল।সন্ধির আচমকা চিৎকারে আমারা কেঁপে উঠে সন্ধির দিকে তাকালাম। সন্ধির কাঁধে হাত রেখে সন্ধির মাথাটা তুলে জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে৷ সন্ধি কোনোরূপ কথা না বলে চোখ নীচে নামিয়ে হাতটা উপরের দিকে ঈশারা করে দেখাল। সবাই উপরের দিকে তাকিয়ে ভয়ে চুপসে গেলাম।কারণ অনিক ভাইয়ার লাশ উপরের সিলিং এ ঝুলছে। বড় আপু দেখে বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে লাগল। আপুর কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল বারবার। আমার হাত পা কেঁপে অবশ হয়ে যাচ্ছিল। হার্টবিট প্রবল বেগে বড়তে লাগল। চারদিক নীরব। সবাই শুধু উপরের দিকে হা করে তাকিয়ে রইলাম। কী করব সবকিছু যেন গুলিয়ে যাচ্ছিল ।পিনপনা নীরবতা বিরাজ করছে।হুট করে অনিক ভাইয়ার লাশটা উপর থেকে আঁচড়ে পড়ে দু ভাগ হয়ে গেল। কোমরে থেকে নীচের দিকে একভাগ আর কোমর থেকে উপরের দিকে আরেক ভাগ।
সারা শরীরের লোম কাঁটা দিয়ে উঠল। এসব দেখার মতো ধৈর্য কুলাচ্ছে না তবুও দেখতে হচ্ছে অসহায়ের মতো।নিজের ভেতরেই অম্ভব খারাপ লাগছে। সায়রা আপু এসব দেখে চিৎকার দিয়ে পুনরায় অজ্ঞান হয়ে গেল। সন্ধি নীচের দিকে দম ধরে তাকিয়ে আছে। এদিকে আমার হাত পা কাঁপতে লাগল। হাসিব আমাকে শক্ত করে ধরে রাখল। নিজের ভেতরে অজানা আতঙ্ক বিরাজ করতে লাগল।কী করব এসব ভেবে মন উদাস হচ্ছিল।
অপরদিকে লাশটা পুনরায় জোরা লেগে গেল। তারপর আবার শূন্যে ভেসে উধাও হয়ে গেল। সবকিছু কেন জানি অবাস্তব মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এটা আমার মতিভ্রম এটা আমার কল্পনা তবে বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ায় মনে হচ্ছে যে আমি কোনো অন্ধকার জগতে আছি। যে জগতের যতই গভীরে যাচ্ছি ততই ধোয়াশা আর অন্ধকারে নিমগ্ন হচ্ছি।
তবুও নিজেকে সাহস করে স্থির করলাম। তারপর পানি এনে সায়রা আপুর মুখে ঝাঁপটা দিলাম। বেশ কিছুক্ষণ পর আপুর জ্ঞান ফিরল। তবে আপু স্তব্ধ হয়ে গেছিল পুরো। এদিকে সন্ধিও একদম স্তব্ধ হয়ে স্থির হয়ে বসে রইল। আমি চুপ করে বসে উপায় খুঁজছিলাম কী করা যায়।
সারাটাদিন এসব অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে পার করলাম। কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সবদিক দিয়ে ধোয়াশা ছিল। জানালার পাশে বসে আনমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে এসব ভাবতে লাগলাম। এমন সময় মনে হলো আকাশে কোনো সংখ্যার আগমণ ঘটল।আকাশের প্রথম সংখ্যাটি ছিল ২৭ তারপর ৯। বুঝতে পারছিলাম না হুট করে এমন কেন দেখলাম। এ সংখ্যা গুলো কিসের চিন্হ বহন করছে। এ সংখ্যাগুলো দ্বারা কী বুঝানো হচ্ছে। হতভম্ব হয়ে শুধু ভাবতে লাগলাম।
কিছু সময় পর টেবিলে বসে ডায়রি নিয়ে বসলাম। মন চাচ্ছে কিছু একটা ডায়রিতে লিখি। তাই আজকের তারিখটা দিয়ে ডায়রিতে লিখতে যেতেই মনে হলো যে তারিখের প্রথম টাতে কত তারিখ আজকে সে সংখ্যা লিখেছি তারপরের টায় মাসের সংখ্যা লিখেছি। যদি এরকম করে বিবেচনা করা যায় তাহলে ভাবতে পারি যে ঐ আকাশে দেওয়া প্রথম সংখ্যা তারিখ বুঝিয়েছে মানে ২৭ তারিখ। আর দ্বিতীয় সংখ্যাটা বুঝিয়েছে কত মাস মানে ৯ মাস৷ মূল তারিখটা দাঁড়ায় ২৭ সেপ্টেম্ব। তার মানে আর একমাস পর ২৭ সেপ্টেম্বর আসতেছে।
মনে মনে ভাবতে লাগলাম এ সংখ্যা দ্বারা কী বুঝানো হয়েছে। আমাকে কী কোনো ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। এসব ভাবতে ভাবতে খেয়াল করলাম সন্ধি পাশে দাঁড়িয়ে আছে।সন্ধির দিকে তাকিয়ে দেখলাম আমার দিকে নিষ্পাপ চোখে তাকিয়ে আছে। বেশ সুন্দর করে সেজেছে ও। হুট করে সাজলো কেন সেটাও একটা রহস্যের বিষয়। চুলে খোপা কেরেছে। খোপা করে আবার বেলী ফুলের মালাও দিয়েছে৷ ফুল গুলোর গন্ধ বেশ প্রখর। বারবার আমার নাকের ডগায় যেন ফুলগুলোর গন্ধ ভাসতে লাগল। এমন সময় সন্ধির ঘাড়ের দিকে চোখ গেল সেখানে স্পষ্ট লেখা ২৭/৯। বুঝতে পারছিলাম না এ লেখা দ্বারা কী বুঝানো হচ্ছে। সন্ধির দিকে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে বললাম
- কী হয়েছে তোর হুট করে এভাবে সাজলি কেন?
সন্ধি হালকা হেসে পরক্ষণে চেহারাটা গম্ভীর করে বলল
- ইচ্ছা হয়েছে। জানিস আপু আমাদের বাড়ির পেছনে বেলী ফুল গাছটায় এত ফুল ফুটেছে কী বলব। ঐখানের ফুলের গন্ধ যেন আমাকে আকুল করে টেনে নিয়ে গেছে। ফুলগুলো এতই সুন্দর যে খোপা করে মালা গেথে পড়ে ফেললাম।
সন্ধির কথা শোনে কিছুটা চমকালাম। কারণ আমাদের বাড়ির পেছনে কোনো বেলী ফুল গাছ ছিল না। সন্ধি বেলী ফুল গাছ কোথায় পেল বেশ ভাবাল আমায়।আর সন্ধির এলোমেলো কথাগুলোও আমাকে বেশ চিন্তিত করে তুলল। আমি চেয়ার থেকে উঠে সন্ধিকে কিছু না বলে রুম থেকে বের হয়ে পাশের রুমে উঁকি দিয়ে দেখলাম হাসিব ঘুমাচ্ছে।তাই হাসিবকে ডাক দিয়ে বিরক্ত না করে একাই চলে গেলাম বাড়ির পেছনটায়।
বাড়ির পেছনে গিয়ে প্রথমেই আমার চোখ গেল বেলী ফুল গাছটায়। কিন্তু এ গাছটা তো আগে ছিল না।
সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে আমি বেলী ফুল গাছটার কাছে যেতেই তার সুগ্রাণে যেন আমার মাথাটা ঝিমঝিম করছিল। কেন জানি না মনে হচ্ছিল ফুলগুলো আমাকে ডাকছিল তার কাছে যাওয়ার জন্য। আমি ব্যাকুল হয়ে গাছটার আরও কাছে গেলাম। কাছে যেতেই সবচেয়ে সুন্দর চকচকে ফুল আমার চোখে পড়ল। ফুলটা চোখে পড়ার পর হাতটা নিশপিশ করছিল তুলার জন্য। দেরি না করেই ফুলটা তুলতেই একটা বিষয় লক্ষ্য করে থমকে গেলাম।
গল্পের নাম : রাজমহল
লেখিকা- : শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব- 11
দেরি না করেই ফুলটা তুলতেই একটা বিষয় লক্ষ্য করে থমকে গেলাম। লক্ষ্য করলাম ফুলটা তুলার সাথে সাথে ফুলের বোটা থেকে একটা আলোর রশ্নি বের হলো। আলোক রশ্নিটা একটা গোলাকার বৃত্তের ন্যায় ধারণ করলো। তারপর তার মাঝখানে একটা সুরঙ্গের মতো কিছু একটা তৈরী হলো। সেখানে কিছু জমাট বাঁধা পানি বলকের মতো উপরের দিকে উঠে ছাতার মতো ছড়িয়ে আবার নীচের দিকে পড়ে গেল। সে পরিশিষ্ট পানি থেকে এক নববধুর সাজে একটা মেয়ে বেরিয়ে আসলো।
মেয়েটাকে প্রথমে দেখেই চমকে গিয়েছিলাম কারণ এ মেয়ের মুখ অবয়বটায় হাসপাতালে সন্ধির মুখে ছিল। মেয়েটা আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। পেটের ফুলা দেখেই মনে হচ্ছে মেয়েটা প্র্যাগনেন্ট। মনে মনে ভাবতে লাগলাম এ কী আমার কল্পনা নাকি মতিভ্রম। বিষয়টা বুঝার জন্য কিছুক্ষণ চুপ হয়ে রইলাম। এর মধ্যেই মেয়েটার দিকে খেয়াল করে দেখলাম তার চোখ থেকে আষাঢ়ের মেঘ বয়ে চলছে। চোখের পানি দেখে নিজের মনে তার প্রতি একটা মায়া তৈরী হলো। চুপ থাকতে চেয়েও চুপ থাকতে পারছিলাম না। হুট করে বলেই ফেললাম
- তুমি কে? এখানে এসেছো কী করে? আর কাঁদছই বা কেন?
মেয়েটা আমার কথা শোনে আরও কান্নার আওয়াজ তুলল। আওয়াজটা কেন জানি বেশ অস্বস্তিকর লাগছিল আমার কাছে। কানটা চেপে ধরে বললাম
- কী হয়েছে বলবে তো? চুপ করে আছো কেন? আর এভাবে কান্না করলে বেশ অস্বস্তি লাগে। কে তুমি বলো?
মেয়েটা আমার কথা শোনে চোখটা হাত দিয়ে মুছতে মুছতে নিজেকে বেশ স্বাভাবিক করে বলল
- আমি রাণী জার্নিভা। রাজা মেহেদীরাজের সর্বকনিষ্ঠ স্ত্রী।
বলেই মেয়েটা চুপ হয়ে গেল।জার্নিভা নামটা শোনতেই সন্ধির কাহিনিটা মনে পড়ে গেল। সেও বলেছিল সে যেখানে গিয়েছিল সেখানে সবাই তাকে জার্নিভা বলে ডেকেছিল। তার মানে এ মেয়েটার জন্য আমাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ছে।আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে মেয়েটাকে বললাম
- কী চাও তুমি ? তোমার জন্য আমাদের জীবনে এত কালো ছায়া নেমে এসেছে। তোমার জন্য আজকে আমাদের পরিবারের কালো অধ্যায়ের সূচণা হয়ে আর সমাপ্তি হচ্ছে না।
জার্নিভা কিছুক্ষণ চুপ থেকে গম্ভীর গলায় বলল
- আমি প্রতিশোধ নিতে চাই। আমি তোমাকে এটাই বলতে এসেছি যে সন্ধির গর্ভের বাচ্চাটা আমার।যাকে এ পৃথিবীতে আসার পর মেরে ফেলা হয়েছিল।
সে আবার সন্ধির গর্ভ থেকে জন্ম নিয়ে তার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিবে। আমি চাই আমার বাচ্চার কোনো ক্ষতি না হোক।পূর্বে কাউকে কিছু করতে পারেনি তবে এবার যদি তাকে আসতে কেউ বাঁধা দেয় তাহলে কাউকে ছাড়ব না।
- কাউকে ছাড়ব না মানে কী? কী ক্ষতি করেছি আমরা? কেন আমাদের সাথে এমন করছো তুমি? আর কাকে শাস্তি দিতে চাও? কিসের প্রতিশোধ নিতে চাও।আমরা তো কোনো দোষ করিনি।
- দোষটা তোমাদের পূর্বপুরুষদের যারা আমার সোনা বাচ্চাটাকে মেরেছে। এখন আমার এ বাচ্চাটা এসে এ বংশ ধ্বংস করে দিবে। পুরোপুরি নিঃশ্বেষ করে দিবে। কেউ আটকাতে পারবে না এ প্রতিশোধের খেলা থেকে।
- প্রতিশোধটা কিসের জন্য নিতে চাচ্ছ তুমি? কী করেছিল আমার পূর্বপুরুষ কেনই বা তারা তোমার বাচ্চাকে মেরে ফেলেছিল? কী হয়েছিল আমাকে খুলে বলো। কোনো সাহায্য করতে পারলে করব। তবে তার আগে আমাকে সবটা জানতে হবে। না জেনে কাউকে সাহায্য করা সম্ভব না। আমি চাই তুমি তোমার প্রতিশোধ নিতে সক্ষম হও। বলো কী হয়েছিল সেদিন।
জার্নিভা আমার কথাটা শোনে একটু আবেগী হয়ে জিজ্ঞেস করলো
- সত্যিই কি তুমি আমাকে সাহায্য করতে চাও?
- মিথ্যা কেন বলব?সত্যিই করতে চাই। বলো তুমি কী হয়েছিল সেদিন, যার জন্য তুমি এখনো অতৃপ্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ?
- তাহলে শোনো। তোমাদের বাড়িটা এখন যেখানে এককালে সেখানে ছিল রাজা মেহেদীরাজের রাজমহল। মেহেদীরাজের বংশধররা আমার মৃত্যুর পর এ বাড়ি ত্যাগ করে চলে যায়। আমাকে একশ বছরের জন্য এ বেলী ফুল গাছটায় আটকে রেখে যায়।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম
- তার মানে ঘটনাটা একশ বছর আগের?
- হ্যাঁ একশ বছর আগের। সময়ের পরিক্রমায় মেহেদীরাজের সকল বংশধররা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। তোমাদের বংশটা হচ্ছে রাজা মেহেদীরাজের বংশধর। এ জায়গাটাও সময়ের পরিক্রমায় পরিত্যাক্ত হয়ে পড়ে। একশ বছর পর আমার আত্না মুক্তি পায়। আর এ জায়গাটায় আমি অতৃপ্ত হয়ে ঘুরি ফিরি আর মেহেদীরাজের বংশধরদের অপেক্ষা করি। একটা সময় পর তোমার বাবা এ জায়গাটা কিনে নেয়।আমার বিচরণ এ জায়গায় ছিল বলে এ জায়গা যে দেখাশোনা করে সে এ জায়গাটা কমদামে বিক্রি করে দেয়। তোমার বাবা এ জায়গায় একটা বাড়ি করে যার নাম দেয় রাজমহল। বাড়ি করার সাথে সাথে আমার শক্তি বৃদ্ধি পায়।
তোমাদের বাড়ির পেছনের দিকে দেখবে একটা বকুল ফুল গাছ আছে। এক ভর সন্ধ্যায় সন্ধি সেখানে গিয়েছিল। দিন টা ছিল সেদিন যেদিন আমি জানতে পেরেছিলাম আমার কোল আলো করে একটা সন্তান আসবে। আর সন্ধির বয়সও ছিল একদম কম। আমিও পনের বছরে মা হয়েছিলাম তাই আমার বাচ্চাটা জন্ম দেওয়ার জন্য একটি পনের বছর বয়সী মেয়ে দরকার ছিল। যেহেতু সন্ধির বয়স পনের ছিল সেহেতু সন্ধি সেখানে যাওয়ায় আমি আমার সুযোগ কাজে লাগায়।তাই সেদিনেই সন্ধির গর্ভে আমার বাচ্চা আসে।
- কিন্তু কী হয়েছিল তোমার আর তোমার সন্তানের সাথে আমাকে খুলে বলো। কী প্রতিশোধ নিতে চাও সেটাও বলো।
- তাহলে শোনো অনেক আশা নিয়ে রাজা মেহেদীরাজকে বিয়ে করেছিলাম। আমি ছিলাম রাজা মেহেদীরাজের সর্বকনিষ্ঠ স্ত্রী। এর আগে উনার আরও তিনটে স্ত্রী ছিল তবে তারা কোনো উত্তরাধিকার দিতে পারেনি রাজা মেহেদীরাজকে। তাই আমাকে মূলত বিয়ে করেছিল উত্তরাধিকার পাবার আশায়। বিয়ের পর বছর ঘোরার আগেই আমি জানতে পারি যে আমি মা হতে চলেছি। চারদিক বেশ আনন্দ মুখর পরিবেশ। সারা রাজ্য তখন খুশির জোয়ারে ভাসছিল। এক দায়কে আনা হয় আমার পরীক্ষা করার জন্য। দায় আমার পরীক্ষা করে জানায় যে আমি দুই বাচ্চার মা হতে চলেছি। আস্তে আস্তে সময় যায়। এভাবে দুমাস কেটে যায়। আবারও দায়কে আনা হয় পরখ করার জন্য। এবার দায় জানায় যে আমার পেটে একটা বাচ্চায় হবে।
আমি অবাক হয়ে জার্নিভার কথা শোনে বললাম
- এজন্যই কি সন্ধির প্রথম রিপোর্টে জমজ বাচ্চা হবে বলেছিল আর দ্বিতীয় রিপোর্টে বলেছে জমজ বাচ্চা হবে না।
- হ্যাঁ এজন্যই।
- তাহলে আমি ঐরকম কেন দেখলাম যেখানে একটা বাচ্চা ভালো ছিল আরেকটা বাচ্চা দেখতে খারাপ। আমি তো ভেবেছিলাম সন্ধির পেটে শুভ অশুভ দুটো বাচ্চায় আছে এর ব্যাখা কি বলো? কেন এমনটা দেখেছিলাম।
- এর ব্যাখা হলো যখন বলা হয়েছিল যে আমার দুটো বাচ্চা হবে তখন একজন সাধক বলেছিল একটা বাচ্চা ভালো সবকিছুর প্রতীক হবে অপর বাচ্চা খারাপ সবকিছুর প্রতীক হবে। এ নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় ছিলাম। কিন্তু পরে তো প্রমান হয় যে আমার গর্ভে একটা বাচ্চায় হবে। পূর্বে দায় পরখ করতে ভুল করেছিল।
- ওহ আচ্ছা তাই বলো। তারপর কি হয়েছিল বলো।
- তারপর সময় যেতে থাকে আমার সন্তান আমার গর্ভে বড় হতে থাকে। আমার সন্তান আমার পেটে খেলা করতে থাকে। আমি তার প্রতিটা স্পন্দন যেন শোনতে পারতাম। অনুভব করতে পারতাম তাকে। সে অদ্ভুত অনুভূতি প্রকাশ করার মতো না। রাজার বড় বউ গুলোও আমাকে বেশ আদর যত্ন করত এজন্য যে আমার গর্ভে বংশধর আসতে চলেছে৷ খুব সুখের সময় কাটিয়েছিলাম। কিন্তু সে সুখটা বেশিদিন টিকেনি।
বলেই জার্নিভা চুপ হয়ে গেল।আমি অস্থির গলায় বললাম
- কেন কী হয়েছিল? অন্য রাণীরা কি কোনো ষড়যন্ত্র করেছিল।
জার্নিভা দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল
- নাহ অন্য রাণীরা আমাকে তাদের বোনের মতো আদর করতো। তারা কিছুই করেনি।
- তাহলে?
- সময় পার হয়ে আস্তে আস্তে বাচ্চা হওয়ার তারিখ আসলো। ইচ্ছা ছিল আমার ছেলে বাচ্চা হলে নাম রাখব রিদয়রাজ আর মেয়ে হলে নাম রাখব রিদি।সেদিন ছিল পূর্নিমার রাত আমার প্রসব ব্যাথা শুরু হয়। তাড়াহুড়ো করে দায় আনা হয়। অনেকক্ষণ প্রসব ব্যাথা সহ্যের পর আমার কানে বাচ্চার কান্না আসে। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি।
বাচ্চা হওয়ার সাথে সাথে সবাই আতঙ্কিত হয়ে বলতে থাকে এ বচ্চা অশুভ। মেহেদীরাজের কাছে সংবাদটা পৌঁছালে সেও আমার বাচ্চাটাকে খুন করার আদেশ দেয়। আমার কোল থেকে সেদিন আমার কলিজাটা কেড়ে নিয়ে আমার বাচ্চাটাকে মাথা আলাদা করে খুন করা হয়। কিছুক্ষণ পর আদেশ আসে আমাকে খুন করার। অপরাধ একটায় আমি অশুভ বাচ্চা গর্ভে ধারণ করে রাজার বংশকে কলঙ্কিত করেছি। সেদিন আমাকে টেনে হিচঁরে নিয়ে যায় আর আমার বাচ্চার মতো আমারও গলা আলাদা করে দেওয়া হয়। সেদিনের পর থেকেই আমার আত্না অতৃপ্ত হয়ে রাজবাড়িতে ঘুরতে থাকে। রাজা মেহেদীরাজের আদেশে এক সাধক আমায় বন্ধী করে এ বেলী ফুল গাছটার নীচে আটকে রাখে একশ বছরের জন্য। তারপর রাজা মেহেদীরাজ এ মহল পরিত্যাক্ত করে নতুন মহলে উঠে। একশ বছর পর আমার আত্না মুক্তি পায়। তবে প্রতিশোধের আগুন এখনো আমার মন থেকে যায়নি।
বলেই জার্নিভা চুপ হয়ে গেল। জার্নিভার কথা গুলো শোনে আমার চোখে যেন সব ঘটনা ভাসছিল। বুকটা কেঁপে উঠেছিল এসব ভেবে। তবে মনে প্রশ্ন জাগল জার্নিভার বাচ্চাকে কেন অশুভ বলল? তাই হালকা গলায় জার্নিভাকে বললাম
- কিন্তু তোমার বাচ্চাকে অশুভ বলার কারণ কী ছিল?
তারপর জার্নিভা যা বলল তা শোনে বুকটা কেঁপে উঠল।
গল্পের নাম : রাজমহল
লেখিকা- : শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব- 12
তারপর জার্নিভা যা বলল তা শোনে বুকটা কেঁপে উঠল। কারণ জার্নিভা বলল
- আমার বাচ্চাটা পরিপূর্ণ ছিল না।
আমি জার্নিভার কথা শোনে কিছুটা অবাক হয়ে বললাম
-পরিপূর্ণ ছিল না মানে? সে কি দেখতে কোনো জানোয়ার বা জীবের মতো ছিল?
জার্নিভার চোখের জল তখন গড়গড়িয়ে পড়তে লাগল। হালকা সুরে বলল
- সে দেখতে অনেক সুন্দর ছিল।
তখন মৃদুমন্দ বাতাস চারদিকে বইতেছিল। হালকা হালকা শীতের শিহরণ লাগতে লাগল। মনে হচ্ছে জার্নিভার শীতল চোখের পানি যেন শীতলতাময় শিহরণ জাগাচ্ছে চারদিকে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে জার্নিভার কথায় অবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম
- তাহলে কি সমস্যা ছিল?
জার্নিভা কান্নার ভাঙ্গা ভাঙ্গা আওয়াজ তুলে বলল
- আমার বাচ্চাটা ছিল তৃতীয় লিঙ্গের। সে ছেলেও ছিল না মেয়েও না। তার দোষ হলো সে কেন এভাবে জন্ম নিল। এরকম বাচ্চা জন্ম হওয়াতে রাজ বংশ নাকি কলঙ্কিত হয়েছে।
- তার মানে তোমার বাচ্চাটা হিজরা ছিল?
- হ্যাঁ। কিন্তু এতে তার দোষ কোথায় ছিল বলো? তার জন্মের উপর কি তার কোনো হাত ছিল? ওকে সে সমাজ স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে নি। তাকে সবাই অশুভ বলা শুরু করল। কোনো দোষ না থাকা সত্ত্বেও আমার বাচ্চাটাকে মরতে হয়েছে। এখনের সমাজও তো তৃতীয় লিঙ্গে যারা আছে তাদের সম্মান দেয় না। কিন্তু তাদের দোষটা কোথায়? তারা কি ইচ্ছা করে এমন হয়? এতটা নির্দয় আচরণ তাদের সাথে কেন করা হয়? এ সমাজ তো তাদের সাথে তাদের জন্ম দাত্রী মায়েদেরও ছাড়ে না। প্রবল ঘৃণা ছুড়ে দেয় তাদের প্রতি। কিন্তু কেন এই বৈষম্য বা ঘৃনা তাদের সহ্য করতে হবে বলো তো? দোষটা কোথায় তাদের?
জার্নিভার কথা শোনে আমি নির্বাক। সত্যিই তো এ সমাজ কেন তাদের এত হেয় করে। আর অবহেলা তো এখন থেকে শুরু না শুরু সেই গোড়া থেকে। সমাজ সবদিক দিয়ে আপডেট হলেও কেন জানি না এ দিক দিয়ে এখনো কারও দৃষ্টিভঙ্গি বদলায় নি। আমরা হিজরা বলতে বুঝি হাতে তালি দিয়ে "এ টাকা দে" এ কথা বলবে। কিন্তু কখনো কি তাদের মনের কষ্টটা বুঝার চেষ্টা করেছি। বাসে ট্রামে হিজরা দেখলেই কেমন যেন আমাদের নাক শিটকানো আসে। তারা তাদের পরিবার থেকে শুরু করে সব জায়গায় কেমন যেন অবহেলিত। তাদের চোখে পানি দেখা যায় না অথচ তাদের মুখে কিছু অশ্লীল বুলি শোনে আমরা তাদের মহাপাপী খেতাব দিয়ে ফেলি। কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে তো তারা যে কষ্ট সহ্য করে সে কষ্টের আশপাশে আমরা যাই না। দোষটা কি তাদের? তাদের এমন হয়ে জন্ম হওয়ার পেছনে দায়ী কি তারা? তবে কেন এত বৈষম্য? কেন এত অবহেলা?
প্রশ্নগুলো যেন বারবার মনে বিদ্ধ করছিল। তবে একটা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য জার্নিভার এতগুলো প্রাণ নেওয়া ঠিক হবে না। জার্নিভাকে যে করেই হোক আটকাতে হবে। তাই জার্নিভাকে হালকা সুরে বললাম
- আমি জানি তুমি যে দিকের জন্য প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছ সেটা সমাজের একটা ব্যাধি। আমরা চাইলেও সেটা একদিনে পরিবর্তন করতে পারব না। একশ বছর আগে তোমার সন্তানের সাথে যা হয়েছে সেটা সত্যিই অন্যায় হয়েছে। তবে তার জন্য তো আমরা কেউ দায়ী না। যারা তোমার সন্তানকে হত্যা করেছে সে মানুষগুলো অনেক আগেই মৃত। এখন তো প্রতিশোধ নেওয়ার কোনো কারণ দেখছি না। আমরা তো আর তোমার সন্তানের মৃত্যুর জন্য দায়ী নয়।
জার্নিভা আমার কথা শোনে গম্ভীর গলায় জবাব দিল
- এ বংশধর আমি শেষ করেই ছাড়ব। আমার সন্তানের মৃত্যুর প্রতিশোধ এভাবেই আমি নিব। কেউ আমাকে আটকাতে পারবে না।
- কিন্তু এ বংশধর তো দায়ী না। দায়ী যারা ছিল তারা মৃত। তাদের শাস্তি কেন তুমি আমাদের দিবে? এটা তো অন্যায়। দয়াকরে অন্যায় করা বন্ধ করো। এ প্রতিশোধ নেওয়া বন্ধ করো।
কথাগুলো বলতে বলতেই জার্নিভা আমার গলাটা চেপে ধরে বলল
- আমার প্রতিশোধ নেওয়াতে কেউ আটকাতে পারবে না।
ততক্ষণে আমার দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। হালকা কাশি আসতে লাগল। কাশি দিতে দিতে জার্নিভাকে ধরতে নিব ঠিক এ মুহুর্তে জার্নিভা অদৃশ্য হয়ে গেল। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম সে নেই। কোনো রকম গলায় হাত দিয়ে গলায় হাত বুলিয়ে হালকা কাশি দিয়ে ঘরে আসলাম। ঘরে ঢুকে খেয়াল করলাম সন্ধি খাটে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে।
আমিও কোনো কথা না বলে সন্ধির পাশে গিয়ে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। বাইরে তাকাতেই চোখটা একটা জায়গায় আটকে গিয়ে থমকে গেল সে সাথে বুকটাও কেঁপে গেল।
গল্পের নাম : রাজমহল
লেখিকা- : শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব- 13
বাইরে তাকাতেই একটা বিষয় দেখে চোখটা থেমে গেল সে সাথে বুকটা কেঁপে উঠল। লক্ষ্য করলাম অনিক ভাইয়ার লাশটা শূন্যে ভেসে প্রচন্ডরকমভাবে ঘুরছে। সারা শরীর থেকে রক্ত যেন শূন্য থেকে চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। আকাশটা একবার আলোকময় একবার অন্ধকারময় হচ্ছে। আলো অন্ধকারের খেলায় যেন বেশ ধাঁধায় পড়ে গেলাম। অবাক চোখে অনিক ভাইয়ার লাশের ঘূর্ণণ দেখতে লাগলাম সে সাথে বুকের স্পন্দন বাড়তে লাগল। হুট করেই লাশটা মাটিতে আঁচড়ে পড়ল। মাটিটা যেন ফেটে ছাইয়ের মতো চারপাশে উড়তে লাগল। আর লাশটাও মাটির নীচে গায়েব হয়ে গেল। উড়ে যাওয়া ছাইয়ের মতো মাটিগুলো বেশ ধলা পাকিয়ে এক গোলকের তৈরী করল। গোলকটা ফুটে গিয়ে বাতাসে চারপাশ ঘুরে এক বৃত্তের তৈরী হলো। সে বৃত্ত থেকে আচমকা কিছু একটা যেন আমার চোখে এসে পড়ল। চোখটায় হালকা জ্বলুনি দিল আর আমি বাধ্য হয়ে চোখটা বন্ধ করে ফেললাম। খানিকক্ষণ চোখ বন্ধ করার পর চোখের জ্বলুনি ভাবটা কমে গেল। আমি চোখটা মেলতেই চমকে গেলাম। কারণ এটা তো অন্য একটা জায়গায় এসে পৌঁছেছি। চারপাশে শুধু ঢোলের শব্দ। সামনে তাকাতেই খেয়াল করলাম সন্ধি দাঁড়িয়ে আছে তার সাথে এক লোক। মনে হচ্ছে সে এই রাজা মেহেদীরাজ। উনার দিক থেকে মুখ সরিয়ে পরক্ষণে সন্ধির দিকে তাকিয়ে অবাক হলাম কারণ সন্ধি পুনরায় জার্নিভার রুপ ধারণ করেছে। বড় পেট নিয়ে সামনে হাঁটতে যেন তার বেশ কষ্ট হচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর জার্নিভা পেটে হাত দিয়ে বসে পড়ল। জোরে একটা চিৎকার দিল। রাজা মেহেদীরাজ জার্নিভার অবস্থা থেকে সেখানে থাকা একজনকে বলে উঠল
- দীপক তাড়াতাড়ি দায় আনার ব্যবস্থা করো আমার সন্তান আসার সময় হয়েছে।
বুঝতে পারলাম সেই লোকটার নাম দীপক। মেহেদীরাজের কথা শোনে দীপক দৌঁড়ে গেল। এদিকে জার্নিভা ব্যথায় কাতরাতে লাগল। মেহেদীরাজ দাসীদের হুকুম দিল অন্দর মহলে জার্নিভাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। দাসীরা জার্নিভাকে অন্দর মহলে নিয়ে গেল। অন্দর মহলের বাইরে থেকে জার্নিভার চিৎকার শোনা যাচ্ছিল শুধু। এর মধ্যে দীপক দায়কে নিয়ে হাজির হলো। দায় তাড়াহুড়ো করে জার্নিভার রুমে ঢুকল। বাইরে থেকে শুধু জার্নিভার চিৎকার শোনা যাচ্ছিল। সারা রাত পার হলো জার্নিভার চিৎকারে। ভোরের আলো ফোটার ঠিক আগ মুহুর্তে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ ভেসে আসলো। বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শোনে যেন আমার বুকটা ধক করে উঠল।মনে হলো পাশেই বাচ্চা কান্না করছে। আমার চোখটা বুজে এলো। টেনে টেনে চোখটা খুলে অবাক হয়ে গেলাম। পাশে সন্ধি শুয়ে আছে আর তার পাশেই বাচ্চা চিৎকার দিচ্ছে। তার মানে এতক্ষণে সন্ধি বাচ্চা প্রসব করেছে আর আমি এক মায়ায় ডুবে ছিলাম। এর মধ্যেই সায়রা আপু দৌঁড়ে এসে বলতে লাগল
- বাচ্চার আওয়াজ কোথায় শোনা যাচ্ছে রে?
বলেই সন্ধির দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল
- তার মানে সন্ধির বাচ্চা হয়ে গেছে?
বলেই সন্ধির পাশে আসলো। আমি আর সায়রা আপু দুজনেই বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে গেলাম। বিভৎস এক বাচ্চা জন্ম দিয়েছে সন্ধি। বাচ্চাটা দেখেই আমার মনে প্রশ্ন জাগল এটা কি সত্যিই জার্নিভার বাচ্চা? জার্নিভা তো বলেছিল তার বাচ্চা অনেক ফুটফুটে ছিল তবে এ বাচ্চাটা অনেক ভয়ংকর দেখতে কেন?দেখলেই যেন ভয়ে গায়ের লোম কাঁটা দিয়ে উঠছে আর শরীর হিম হয়ে যাচ্ছে।বাচ্চার দু ঠোঁট ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। সন্ধি পাশেই অজ্ঞানের মতো শুয়ে আছে। এদিকে আমি আর সায়রা আপু ভয়ে আঁৎকে উঠছি বারবার।
খানিক সময় পর বাচ্চাটা আপুর হাত কামড়ে ধরল। আপু ভয়ে বাচ্চাটাকে সরাতে নিলে বাচ্চাটা যেন আপুকে আরও আঁকড়ে ধরল। আমিও বাচ্চাটাকে কোনরকম ধরে টান দিলাম। বাচ্চাটা আপুর হাতে মাংস খুবলে নিয়ে আসলো। এমন অবস্থায় দেখে আমি বাচ্চাটাকে জোরে ফিকা মারি। বাচ্চাটা দূরে মেঝেতে গিয়ে পড়ে খিল খিল করে হাসতে থাকে। সেই সাথে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করল। ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে বাচ্চাটা দেখতে সুন্দর হয়ে যায় অর্থাৎ আলোর সংস্পর্শে বাচ্চাটার রূপ পরিবর্তন হয়ে যায়। বাচ্চাটার এ রূপটা যেন বেশ মায়াময়। বাচ্চাটার এ রূপটা দেখে কিছুটা স্তম্ভিত হয়ে যাই। আপুর হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আপুর হাত থেকে রক্ত পড়ছে। কিছু অংশ মাংস উঠে এসেছে। আপুর হাতটা ধরে কোনো রকমে ব্যান্ডেজ করলাম। বাচ্চাটাকে নিয়ে বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম। একটু আগে বাচ্চাটার যে হিংস্রতা খেয়াল করলাম বাচ্চাটা যদি আর কিছুক্ষণ এমন অবস্থায় থাকত তাহলে সবার প্রাণ যেত। তবে এখন বাচ্চাটা বেশ শান্ত হয়ে আছে। এতটায় মায়া ভরা যে মেঝে থেকে তুলতে বাধ্য হলাম। তবে এখন আশ্চর্যজনক হলে সত্যি যে বাচ্চাটা তেমন কিছুই করল না। বাচ্চাটাকে নিয়ে শুইয়ে দিলাম। তবে মনের ভেতর হাজারটা প্রশ্ন জাগতে শুরু করল। সন্ধির দিকে তাকিয়ে দেখলাম ওর এখনো জ্ঞান ফিরেনি। সন্ধির মুখে কয়েকবার পানির ঝাঁপটা দেওয়ার পরও সন্ধির জ্ঞান ফিরল না। অপর দিকে হাসিবের কথা ভাবতে লাগলাম সে তো পাশের রুমে ছিল তাহলে সে কোথায় এখন? পাশের রুমে গিয়ে হাসিবকে পেলাম না।সারা বাড়িতে হাসিবকে খুঁজে পেলাম না।হাসিব কোথায় গেল বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম।
অপরদিকে আমি বাচ্চাটাকে নিয়েও চিন্তায় পড়ে গেলাম। অজানা কিছু প্রশ্ন মনে বিদ্ধ করতে লাগল। দৌঁড়ে গেলাম বেলী ফুল গাছটার পাশে। মনে হলো এখানে জার্নিভাকে ডাক দিলে ও আসবে। তাই মনে মনে ওকে ডাকতে লাগলাম। আমার বিশ্বাসটা সত্যি হলো। জার্নিভা হাজির হলো। জার্নিভা আসার সাথে সাথে জিজ্ঞেস করলাম
- হাসিব কোথায় আছে? ওকে কোথায় গায়েব করেছ তুমি? আর তুমি তো বলেছিলে তোমার বাচ্চা অনেক সুন্দর ছিল। তবে কেন সে রাতে এত হিংস্র কাজ করল। এর কারণ কি?
তারপর জার্নিভা যা বলল তা শোনে বুকটা কেঁপে উঠল। কারণ এক কাহিনির অবসান ঘটাতে গিয়ে অন্য এক বিভৎস কাহিনির সূচণা হয়েছে।
গল্পের নাম : রাজমহল
লেখিকা- : শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব- 14
তারপর জার্নিভা যা বলল তা শোনে বুকটা কেঁপে উঠল। কারণ এক কাহিনির অবসান ঘটাতে গিয়ে অন্য এক বিভৎস কাহিনির সূচণা হয়েছে। জার্নিভা বলল
- সন্ধির গর্ভে শুধু আমার বাচ্চা ছিল না।
কথাটা শোনে কিঞ্চিৎ বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম
- মানে?
- হ্যাঁ সন্ধি যে গাছটার নীচে গিয়েছিল সেখানে একটা শয়তানও ছিল। সেদিন সন্ধির গর্ভে আমার বাচ্চা প্রবেশের সাথে সাথে সেই শয়তানের বাচ্চাও প্রবেশ করেছে। দুটো বাচ্চার সংমিশ্রণে একটি বাচ্চা তৈরী হয়েছে। রাতে বাচ্চাটা শয়তানের ন্যায় আচরণ করবে। আর দিনে আমার প্রতিশোধ নিবে।
কথাটা শোনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম
- এ ধ্বংসলীলা থেকে বাঁচার কী কোনো উপায় নেই? এ শয়তানের বাচ্চার হাত থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?
জার্নিভা অট্ট হেসে বলল
- এ উপায় তো বলব না আমি। কারণ এ শয়তানের বাচ্চাটা আমার কাজকে আরও সহজ করে দিবে।
- কিন্তু জার্নিভা সে তো শুধু তার মৃত্যু লিলা আমাদের মাঝে সীমাবদ্ধ রাখবে না। সে তো এ মৃত্যুর খেলা সবার সাথে খেলবে। আর আমার তো মনে হয় এ বাচ্চাটা বড় হওয়ার সাথে সাথে তার শক্তিও বাড়বে এবং সে আরও ভয়ংকর হয়ে উঠবে। কেন সামান্য প্রতিশোধের জন্য এতগুলো মানুষের প্রাণ দিতে হবে বলো? কিছু একটা করো।
জার্নিভা চোখগুলো বড় বড় করে রাগী কন্ঠে বলল
- সামান্য প্রতিশোধ মানে? মায়ের কোল থেকে সন্তান কেড়ে নেওয়ার কষ্ট তুমি বুঝো?
- মা হয়নি সে কষ্ট পুরোপুরি বুঝা সম্ভব না তবে একটু হলেও তোমার কষ্টটা উপলব্ধি করতে পারছি । তবে তুমি যাদের উপর আজকে প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছ তারা নির্দোষ তুমি সেটা মানো বা না মানো। ধরো তোমার বাচ্চাকে কেউ খুন করেছে কিন্তু তুমি জানতে পারলে তাদের পূর্বপুরুষ দোষ করেছে বলে তোমার বাচ্চাকে খুন হতে হয়েছে। তোমার তখন কেমন লাগবে? তোমার এ প্রতিশোধটাও তো অনেক মায়ের বুক খালি করবে। যারা বিনা দোষে সন্তান হারা হবে। তাদের কষ্ট তো নিশ্চয় তোমার বুঝার কথা। তোমার সন্তানের সাথে যা হয়েছে সেটা সত্যিই অন্যায় হয়েছে। তবে যারা এ অন্যায়টা করেছে তারা তো মৃত। আর এখন তোমার সন্তান পুনরায় জন্ম দিতে গিয়ে একটা শয়তানের সন্তান ও জন্ম হয়েছে। শয়তানের সন্তানটা কতটা হিংস্র সেটা রাতের হালকা দৃশ্য দেখেই বুঝতে পেরেছি। সে যে কত জনের প্রাণ নিবে বলা যায় না। কত মায়ের বুক বিনা দোষে খালি হবে। এর দায় কে নিবে জার্নিভা?
জার্নিভা এবার আমার কথা শোনে চুপ। কোনোরূপ কথা না বলে অদৃশ্য হয়ে গেল সে। অস্থির গলায় জার্নিভাকে ডাক দিলাম সে আর আসলো না। নিরাশ হয়ে ঘরে গিয়ে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। খেয়াল করলাম সিলিং ফ্যানের সাথে হাসিবের লাশটা ঝুলছে। প্রিয় মানুষটাকে এভাবে দেখতে হবে বুঝতে পারিনি। জোরে চিৎকার দিয়ে কাঁদতে চেয়েও কাঁদতে পারছিলাম না। চোখ দিয়ে আপনাআপনি পানি পড়ছে। নিজের জীবনটায় বিষাক্ত মনে হচ্ছে এবার। খুব সাহস করে হাসিবের লাশটা ধরতে যেতেই লাশটা উধাও হয়ে গেল। কী হচ্ছে এগুলো ভাবতেই শরীরটা কেমন জানি হিম হয়ে যাচ্ছে। দিনকে দিন মানসিক শক্তিও যেন হারিয়ে ফেলছি। হাসিবের সাথে কী হয়েছে জানি না। তবে ভেতরটা যেন দুভাগ হয়ে চৌচির হয়ে গেছে ওকে এভাবে দেখে। যতই মানসিকভাবে শক্ত হতে চাচ্ছি ততই যেন ভেঙ্গে পড়ছি।
নিজেকে সামলে নিয়ে সায়রা আপুর রুমে গেলাম। সায়রা আপু আমার কান্না দেখেই বলে উঠল
- হাসিবকেও ওরা মেরে দিল রে তন্দ্রা। অনিকের মতো হাসিব ও নেই।
বুঝতে আর বাকি রইল না আপুও হাসিবের লাশটা দেখেছে। আপুর কথাটা শোনে মনে থাকা সকল কান্না যেন বের হয়ে আসলো। দুজনেই দুজনকে ধরে কাঁদতে লাগলাম। কি যে সময় পার করছি সেটা শুধু আমরা বুঝছি। কোনোরকমে শুধু খাচ্ছি আর সময়গুলো পার করছি আতঙ্ক নিয়ে। জানি না এ সময়ের শেষ কোথায়। কোথায় গিয়ে ঠেকবে এ মৃত্যুর খেলা।
আপুকে ধরে কিছুক্ষণ কাঁদতে পেরে যেন মনটা হালকা লাগছে। কান্না বন্ধ করে দুজনেই চুপ হয়ে বসে রইলাম। এর মধ্যে আপু বলে উঠল
- তন্দ্রা এটা ঠিক আমাদের সময় খারাপ যাচ্ছে তবে এ সময়টায় যদি আমরা নিজেরা ভেঙ্গে পড়ি তাহলে কখনো আলোর মুখ দেখব না। প্রত্যেক জিনিসের যেমন সৃষ্টি আছে তেমনি ধ্বংস ও আছে৷ এ বাড়িটার মধ্যেই সকল রহস্য লুকিয়ে আছে। এ বাড়ির কোথাও না কোথাও এর উত্তর পেয়ে যাব। কীভাবে এর শেষ হবে অবশ্যই জানব।
আপুর কথা শোনে একটু মনটা প্রশস্ত হলো। শত কষ্টের মধ্যেও যেন একটু শান্ত হলো মনটা। মনে হচ্ছে মরভূমির মতো খা খা রোদের পর এক পশলা বৃষ্টি বয়ে গেছে। বসা থেকে হুট করে শুয়ে আপুর কোলে মাথাটা রেখে বললাম
- কোনো উপায় তো পাচ্ছি না আপু। যেখানেই যাচ্ছি সেখানেই শুধু ধোঁয়াশা দেখতে পাচ্ছি। এত ধোঁয়াশার ভিড়ে সঠিক পথ খুঁজে পাওয়া যে কঠিন আপু। আর এ বাড়িটা নতুন। আর আগের রাজমহলটা এটার নীচেই চাপা পড়ে আছে। এমন তো না যে এ বাড়িতে খু্ঁজলে কোনো কিছু পাব। এখানে সারা ঘর খু্ঁজলেও তো কিছু পাব বলে মনে হয় না।
আপু আমার কথা শোনে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল
- এ বাড়িতে কিছু পাব না এটা আমিও নিশ্চিত। তবে ঐ বেলী ফুল গাছটার জন্ম হুট করে হয়েছে। অবশ্যই সেখানে কিছু না কিছু পাব। সন্ধির গর্ভে বাচ্চা এসেছে যে স্থান থেকে সেখানেও কোনো না কোনো সমাধান পাব। অনেক সময় দেখার বাইরেও একটা অদেখা রয়ে যায়। দেখতে চাইলেও যেন আমরা দেখতে পারি না অনেক কিছু। আমাদের গভীর ভাবে সে অদেখা গুলোকে দেখে সঠিক পথ খুঁজে বের করতে হবে।
আপুর কথা শোনে মনটাকে শক্ত করে নিলাম। আপু আর আমি উঠে হালকা নাস্তা করে নিলাম। পাশের রুমে বাচ্চাটা শুয়ে আছে আর তার পাশে সন্ধি এখনো অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে। আপু আর আমি বাসাটা গুছিয়ে নিলাম। মনের জোর নিয়ে সব কাজ করতেছি। কারণ এখন মনকে শক্ত রাখা জরুরি।বাসাট গুছানোর মূল কারণ হলো নিজেকে সুস্থ স্বাভাবিক রাখতে হলে আশেপাশের পরিবেশটাও স্বাভাবিক রাখা জরুরি। এ কয়দিনে বাসাটা ভূতুরে বাসায় পরিণত হয়েছে যা আমাদের মনকে আরও নিরাশ করে তুলছে। সারাদিন পার করলাম এভাবে। সন্ধ্যা হতেই শুরু হলো বাচ্চাটার রূপ বদলানো। বাচ্চাটা আস্তে আস্তে ভয়ংকর হতে লাগল। এতটায় ভয়ংকর রূপ ধারণ করল যে বাচ্চাটাকে দেখে দম বন্ধ হয়ে আসছিল। বাচ্চাটা শুয়া থেকে গড়িয়ে খাট থেকে নীচে পড়ল তারপর গড়িয়ে গড়িয়ে আমাদের দিকে আসতে নিল। আমি আর সায়রা আপু ভয়ে পেছন যেতে লাগলাম যতই, বাচ্চাটা ততই গড়িয়ে গড়িয়ে এগুতে লাগল। একটা সময় পর বাচ্চাটা এসে আমাদের দুজনের পায়ে ঝাঁপটে ধরল। আমি আর আপু ভয়ে কাঁপতে লাগলাম। এতটাই ভয় পাচ্ছিলাম যে নিজের কানে নিজের হার্টবিটের শব্দ শোনতে পারছিলাম। তবুও সাহস করে কাঁপা কাঁপা হাতে বাচ্চাটাকে ধরে টানতে লাগলাম। এমন সময় অনিক ভাই আর হাসিবের মৃত দেহটা সামনে এসে ঘুরতে লাগল। চারদিকে নিকষ অন্ধকারে ছেয়ে আছে সব। লাশ দুটো আর বাচ্চাটাকে ছাড়া যেন কিছুই দেখতে পারছি না। বাচ্চাটাকে টেনে হিঁচড়ে পা থেকে কোনোরকমে ছাড়িয়ে দূরে যেতেই এক ভয়ংকর পরিস্থিতির শিকার হলাম।
গল্পের নাম : রাজমহল
লেখিকা- : শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব- ১5/অন্তিম পর্ব
বাচ্চাটাকে টেনে হিঁচড়ে পা থেকে কোনোরকমে ছাড়িয়ে দূরে যেতেই এক ভয়ংকর পরিস্থিতির শিকার হলাম। অনিক ভাই আর হাসিবের লাশটা পর্যায়ক্রমে ঘুরতে লাগল শূন্যে। বাচ্চাটার বিভৎস হাসি চারদিকে বাজতে লাগল। এমন সময় ঘরটা হালকা আলোকিত হলো। মনে মনে একটু স্বস্তি পাচ্ছিলাম একটু আলোর আভা পেয়ে। তবে সন্ধিকে উঠে আসতে দেখে ভয় পেয়ে গেলাম। লক্ষ্য করলাম ক্রমে ক্রমে সন্ধির চেহারাটা বিভৎস হতে চলেছে। চারদিকে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। নিজেকে বেশ স্বাভাবিক করতে চেয়েও পারছিলাম না। সন্ধিও এবার ভয়ংকর রূপ ধারণ করল। সন্ধি হাসিব আর অনিক ভাইয়ের লাশটা নিয়ে চোখ দিয়ে ইশারা করে উপর থেকে নীচে আঁচড়ে ফেলল। সাথে সাথে লাশগুলো দুটো ভাগ হয়ে গেল। একদিকে মাথা ঝুলছে অপরদিকে বাকি অংশ। মাথাটা শূন্যে উঠে ঘুরছে আর চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে। ঘূর্ণনের গতি বাড়ার সাথে রক্তও প্রবল বেগে বাড়তে লাগল। চারদিকে রক্ত যেন ছিটকে ছিটকে পড়ছে। এদিকে বাচ্চাটাও খিল খিল করে অদ্ভুত ভাবে হাসছে। বাচ্চাটার হাসিতে যেন পুরো ঘর কাঁপছে।
সন্ধি এদিকে ভয়ানক রূপ নিয়ে আমাদের সামনে এগিয়ে আসছে। এদিকেও বাচ্চাটাও গড়িয়ে গড়িয়ে আসছে। আমরা পিছুতে নিলাম। তারা এগুতে লাগল। পিছুতে পিছুতে হাসিব আর অনিক ভাইয়ের মাথাবিহীন শরীরে পা আটকে তাদের উপরেই পড়ে গেলাম। মাথাবিহীন লাশের হাত পা গুলো আমাদের ঝাঁপটে ধরল। শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি। চারদিকে বাচ্চার খিলখিল হাসি সন্ধির ভায়ানক রূপ আর মাথাবিহীন লাশের ঝাঁপটে ধরায় যেন দম আটকে যাচ্ছিল। এর মধ্যে বাচ্চাটা এসে আমার বুকের উপর উঠে বসল। দম নিতে যেন এবার আরও কষ্ট হচ্ছিল। আর এদিকে সন্ধি তার বিভৎস চেহারা নিয়ে আপুর গলা চেপে ধরল। অনিক ভাই আর হাসিবের মাথাটা ততক্ষণে আরও জোরে ঘুরতে লাগল।
চারদিকে এতই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি বর্ণণা করা দুষ্কর। বাচ্চাটা আমার বুকের উপর উঠে আমার মুখে হাত দিয়ে আঁচড় কাটতে লাগল। তার মুখের ভেতর থেকে গড়গড়িয়ে রক্ত পড়তে লাগল।আমার সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল। হাসিবের মাথাবিহীন শরীরের হাতগুলো আমাকে ততক্ষণে ঝাঁপটে ধরে নিস্তেজ করে ফেলল। অপরদিকে সায়রা আপুরও একই হাল। সন্ধি আপুর গলাটা চেপে এমন ভাবেই ধরল যে আপুর মুখ থেকে গড়গড়িয়ে রক্ত পড়তে লাগল। মনে হলো আপু শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। তবুও সন্ধি আপুর গলাটা ছাড়ল না। আপুর গলাটা সন্ধির হাতের চাপে দুভাগ হয়ে গেল। আর এদিকে আমিও নিস্তেজ হয়ে যেতে লাগলাম। চোখে ঝাপসা দেখতে লাগলাম। জীবনের শেষ প্রহরটা গুণতে লাগলাম।
এমন সময় মনে হলো চোখে একটু আলোর ঝলক এসে পড়ল। আলোর ক্ষুদ্র রেখায় চোখটা ঝাঁঝিয়ে উঠছে৷ মনে হলো শরীরে বেশ শক্তি পাচ্ছি। বাচ্চাটাও আস্তে আস্তে আমার উপর থেকে সরে গেল। চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম শূন্য হয়ে আছে। সায়রা আপু,সন্ধি,বাচ্চাটা,মাথাবিহীন হাসিব আর অনিক ভাইয়ার লাশটাও নেই। আমি মেঝেতে শুয়ে হালকা চোখে তাকিয়ে দেখলাম জার্নিভা আমার সামনে। কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম
- বাকিরা কোথায়? তারা কী মারা গেছে? তোমার একটা প্রতিশোধের জন্য হাসিবের মায়ের বুক খালি হলো,অনিক ভাইয়ার মায়ের বুক খালি হলো। সায়রা আপুর জীবন গেল,সন্ধিও মারা গেল। ওরা তো তোমার কোনো ক্ষতি করে নি। তাহলে তাদেরকে এত শাস্তি কেন পেতে হলো?
কথাটা শোনে জার্নিভা চুপ হয়ে থাকল কিছুক্ষণ তারপর বলল
- সত্যিই এটা আমার অন্যায় হয়েছে। যা হয়েছে মোটেও উচিত হয়নি। একজনের দোষের ভার অন্যজনের উপর চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হয়নি। আমাকে ক্ষমা করো। কাহিনির ইতি টেনে দিলাম। ঐ বাচ্চাটা আর আসবে না। ঐ বাচ্চাটা ধ্বংস হয়ে গেছে।
জার্নিভা আরও কিছু বলতে নিবে এমন সময় আমি চিৎকার করে চেঁচিয়ে বললাম
- এখন ক্ষমা চেয়ে লাভ কী বলো? যা যাওয়ার সে তো চলেই গেছে। আমার প্রিয়জনকে তো আর ফিরে পাব না।তাদের তো আমি হারিয়ে ফেলেছি। আমাকে বাঁচিয়ে রেখে লাভ কী? আমাকেও মেরে ফেলো।
বলেই জোরে জোরে চিৎকার করতে লাগলাম। বুকটা যেন ফেটে যাচ্ছিল। কান্না কান্না চোখে তাকিয়ে দেখলাম জার্নিভা উধাও হয়ে গেছে। তার মানে আমি আমার প্রিয়জনগুলোকে আর ফিরে পাব না। কলিজাটা দুইভাগ হয়ে চৌচির হয়ে গেল মনে হচ্ছে। এতটা কষ্ট হচ্ছে বলে বুঝানো সম্ভব না। কান্নাটা আরও প্রবল হতে লাগল। আরও জোরে চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম। নিঃশব্দ চিৎকারটা যেন এবার স্বশব্দে হলো। এমন সময় মনে হলো কেউ একজন আমাকে ধাক্কাচ্ছে বেশ জোরে সোরে। আমি কোনো রকমে চোখটা মেলে অবাক হয়ে গেলাম। সন্ধি আমার পাশে বসে আছে। আমি শুয়া থেকে তড়িঘড়ি করে উঠলাম। চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম সব স্বাভাবিক। সন্ধি আমার অবস্থা দেখে বলল
- আপু কী হয়েছে তোর? আর এভাবে তাকিয়ে কী দেখছিস?
আমি সন্ধির কথার ভ্রুক্ষেপ না করে পাল্টা প্রশ্ন করে বললাম
- কিছুই হয়নি। প্র্যাগনেন্সি কিট টা কোথায়?
- কেন বালিশের নীচেই তো।
-বের করতো দেখি।
সন্ধি আমার কথা শোনে বালিশের নীচে থেকে কিট টা বের করে হাত দিয়ে চোখের সামনে ধরে বলল
- এই যে কিটটা। আমি কি এখন টেস্ট করাব?
সন্ধির কথা শোনে বুঝতে পারলাম মনের উদ্ভট চিন্তা থেকে ঘুমানোর পর আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি। কিন্তু স্বপ্নটা পুরোই বাস্তবিক মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছে এটা বাস্তব কোনো ঘটনা ইতোমধ্যে আমার সাথে ঘটেছে।আমি হালকা একটা দম নিলাম। এর মধ্যেই সন্ধি আমার বাহুতে ধাক্কা দিয়ে বলল
- আমি কি পরীক্ষা করাব এখন?
আমি সন্ধির মাথায় জোরে একটা থাপ্পড় বসিয়ে বললাম
- আপুর কিট আপুর ঘরে রেখে আয়। এত পাকনামি করতে হবে না। বয়স কত তোর এখনেই এত পাকনামি করছিস। যা রেখে আয়।
সন্ধি আমার কথা শোনে চোখটা নীচে নামিয়ে আপুর রুমের দিকে যেতে লাগল। আর এদিকে আমি চারপাশ তাকিয়ে দেখলাম সব স্বাভাবিক কোনো অস্বাভাবিকতার চিন্হ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। স্বপ্নের কথা মনে হয়ে এখনো আমার শরীর কাঁপছে। কাঁপা কাঁপা হাতে হাসিবকে কল দিলাম। কিছুক্ষণ কথা বললাম। হাসিব ও ঠিক আছে। চারপাশ আলোকিত হতে লাগল। সন্ধি আমার থাপ্পর খাওয়ার পর এখনো মুখ গোমরা করে আছে। মনে মনে ভাবলাম থাকুক মুখ গোমরা করে। যে স্বপ্ন দেখেছি তারপর এমন অদ্ভুত মনের ইচ্ছা পূরণ করার কোনো শখ নেই। এদিকে আপু নাস্তা খাওয়ার জন্য ডাকতে লাগল। দৌঁড়ে গেলাম খাবার টেবিলে। আপুর মুখে হাসির রেখা দেখে বুঝতে পারলাম আপু প্র্যাগনেন্ট। নতুন অতিথি আসতে চলেছে আমাদের ঘরে।
নাস্তা শেষে রুমে এসে বাইরে তাকাতেই চমকে গেলাম বেলী ফুল গাছটা দেখে। এ গাছটা তো এখানে ছিল না। তাহলে আসলো কী করে? তার মানে ঐটা আমার স্বপ্ন ছিল না বাস্তব কোনো ঘটনা ছিল? ভাবতেই গা শিউরে উঠল।আর কিছু বলার সাহস হচ্ছে না কাউকে।চুপ করে রইলাম। মনে মনে ভাবলাম হোক এটা আমার স্বপ্ন বা বাস্তব সব ঠিক হয়ে গেছে এটাই বেশি। এর মধ্যে কলিং বেল বাজতে লাগল। দরজা খুলতেই খেয়াল করলাম অনিক ভাই এসেছে। দীর্ঘ একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলাম। জানি না ঘটনাটা বাস্তব ছিল নাকি স্বপ্ন।শুধু মনে মনে চাচ্ছিলাম এমন ঘটনা বাস্তব তো দূরে থাকে স্বপ্নেও যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
সেদিনের পর থেকে তৃতীয় লিঙ্গে যারা আছে তাদের কখনো অসম্মান করে কথা বলেনি। তাদের কষ্টটা উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছি।আজকে সাতমাস পর আমাদের #রাজমহলটা নতুন সাজে সাজল। কারণ আমাদের ঘরে একটা পিচ্চি এসেছে। পিচ্চিটাকে নিয়ে আদর করছিলাম। এমন সময় কিছু হিজরার আগমনে আপু আকস্মিক ভয় পেয়ে যায়। আমি আপুর হাতটা ধরে বললাম ওরা শুধু শুধু কিছু করবে না আমি ওদের চিনি। আমার চেনা ওরা। বেশ কয়েকবার রাস্তাঘাটে দেখাও হয়েছে।কিছু টাকা থাকলে ওদের দিয়ে দাও। হিজরা গুলো এসে আমাকে দেখে মুচকি হেসে বলল
- খালামনি হয়ে গেছিস তো এবার মিষ্টি খাওয়া।
আমি হালকা হেসে বললাম
- কেন খাওয়াব না অবশ্যই খাওয়াব।
বলে কিছু মিষ্টি নিয়ে দিলাম। তারা মিষ্টি খেল।তারপর আপু টাকা দিল। তারা টাকাগুলো নিয়ে আপুর মেয়েকে দিয়ে বলল মা টাকে কিছু কিনে দিস আমরা এ টাকা নিব না বলেই চলে গেল। সন্ধি আমার পাশেই বসে আপুর মেয়েকে আদর করতে লাগল। আমি আলোকিত রাজমহলের ছাদে উঠতেই জার্নিভাকে দেখে থমকে গেলাম। জার্নিভা আমার দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে উধাও হয়ে গেল।
ভাবতে লাগলাম সত্যিই কী সেটা আমার স্বপ্ন ছিল নাকি সত্যি। বিষয়টা বেশ দ্বিধায় ফেলে দেয় আমাকে মাঝে মাঝে। কত রহস্যই না ঘেরা এ #রাজমহলে।
0 মন্তব্যসমূহ