গহনা- শারমিন আঁচল নিপা




গল্পের নাম গহনা

পর্ব - ১

লেখিকা শারমিন আঁচল নিপা

নেক কষ্টে একটা বাড়ি কিনেছি এক মাস হলো। আমার নতুন বাড়ির মেঝে খুঁড়ে একটা ভয়ংকর  নারীদেহের লা/শ আবিষ্কার করা হলো আজকে। অল্প বয়স্ক নারী। বেনারসি শাড়ি পরা। গা ভর্তি গহনা। আর লা/শটাও একদম তাজা ছিল। মনে হচ্ছিল আজকেই খু/ন করা হয়েছে। রক্তের দাগ যেন এখনও মুছেনি। তবে মুখটা একদম পুড়ানো৷ হয়তো এসিড দিয়ে পুড়িয়েছে যাতে করে চেনা না যায়। আমি আমার স্বামী পিয়াসকে বললাম দ্রূত পুলিশে কল দেওয়ার জন্য। কিন্তু সে গহনার লোভে পড়ে আমাকে বলল

"মিরা আমরা যদি পুলিশকে কল দিই আমরা ফেঁসে যাব। এ বাসায় আমরা উঠেছি মাত্র একমাস হবে৷ এক মাস আগে পুঁতা লাশ সাধারণত পচে গলে যাওয়ার কথা। কিন্তু এখানে দেখো একদম তাজা৷ আর সবচেয়ে বড়ো কথা দেখো প্রতিটা গহনা হলমার্ক করা। আমরা যদি এ গহনা গুলো বিক্রি করি তাহলে অনেক টাকার মালিক হয়ে যাব। আমাদের এ ভাঙা বাড়িতে থাকতে হবে না৷"

আমার স্বামী পিয়াসের বয়স ৩২। সে ছোটোখাট কাজ করে৷ দিনে আনে দিনে খায় বলা যায়। নিজের বাপের ভিটা থেকে প্রাপ্ত কিছু টাকা দিয়ে এ বাড়িটা বেশ স্বস্তায় কিনে৷ যারা এ বাড়িতে থাকত তারা সবাই দেশের বাইরে স্যটল। এখানে বাড়িটা পড়ে ছিল৷ অযত্নে পড়ে থেকে এ বাড়িটা প্রায় ভাঙ্গন দশা। পিয়াস সে বাড়িটা অল্প দামে কিনে মাথা গুজার ঠাঁই করে আমাদের। পিয়াসের বাবা মারা যায় জন্মের পূর্বে আর মা মারা যায় জন্মের ১ মাস পর। বেশ অবহেলায় কষ্টে বড়ো হয়েছে সে। আমিও অনাথ। মামীর বাড়ির লাথি উষ্ঠা খেয়ে বড়ো হয়েছি। এ বাড়িটাতে উঠার পর পরই বেশ কিছু ভাঙা জায়গা পিয়াস নিজেই ঠিক করে৷ এ বাড়িটার পাশেই পড়ে থাকা একটা ভাঙা ঘর ছিল৷ পিয়াস এ ঘরটাকে রান্না ঘর হিসেবে ব্যবহার করার জন্য মাটি খুঁড়ে সবটা ঠিক করতে নিয়েছিল৷ আর সেখান থেকেই লাশের সূত্রপাত। বাড়িটা নির্জন জায়গায়। আশেপাশে গ্রাম থাকলেও কোলাহল কম৷ বাড়ির বেশ দূরে দূরে ঘর৷ কিছুটা ভুতুরে হলেও এ একমাসে আমরা কোনো ভুতুরে কান্ড হতে দেখিনি। 

বাড়ির লোকেশন খাগড়াছড়ির ভেতরের দিকে। তিন লক্ষ্য টাকায় নাহয় এত বড়ো বাড়ি মিলত না। পিয়াস এ বাড়ির খবর জেনেছিল একটা হোটেলে বসে খেতে খেতে৷  দুজন ব্যক্তির মধ্যে এ বাড়ি নিয়ে কথা চলছিল৷ সেখান থেকেই পিয়াস জানতে পারে। পরবর্তীতে লোকটির সাথে কথা বলে বাড়িটি দেখে যায়৷ এত সস্তায় জমিই মিলে না সে জায়গায় ভাঙা বাড়ি মিলেছে এটা আমাদের কাছে ছিল সোনায় সোহাগা। 

যাইহোক প্রসঙ্গে আসি। আমি পিয়াসকে বারবার বলতে লাগলাম।  সে যেটা করছে এটা ঠিক না৷ হয়তো যারা বাড়িটা বিক্রি করেছে তারাই খু/ন করে রেখে গেছে৷ আর লা/শ টা বেশ ভয়ংকর। এ লা/শ আমারা কোথায় লুকাব? কিন্তু পিয়াস লোভে পড়ে গেল। সে আমাকে চুপ করিয়ে দিয়ে বলল

"আপাতত গহনাগুলো সব খুলে রাখব। আর লা/শটাকে আমাদের রুমের মধ্যে নিয়ে রাখব। এদিকে কেউ আমাদের চিনে না। আর আশেপাশের বাড়িগুলোও বেশ দূরে। রাত গহীন হলে এখানে কাউকে পাওয়া যায় না। আমি রাতে গিয়ে লা/শটাকে কোনো গহীন জঙ্গলে নিয়ে পুড়িয়ে দিয়ে আসব। আপাতত গহনাগুলো সব পরিষ্কার করতে হবে। রক্ত লেগে আছে। 

আমার মনটা একদম সায় দিচ্ছে না৷ এটা স্বাভাবিক  কোনো লা/শ হতে পারে না। এত তা/জা লাশ একমাসের আগেরও হবে না। হয়তো কেউ রাতে এখানে পুঁতে দিয়ে গেছে৷ কিন্তু এটা যদি দুই একদিনের মধ্যে পুঁতে দিয়ে থাকে তাহলে তো মাটি ঝুরঝুরা থাকত। অনেক কিছুই মনে ঘুরছে আমার। পিয়াস গহনা গুলো খুলা নিয়ে ব্যস্ত। আমি ভাবতে ভাবতেই সে গহনাগুলো খুলে ফেলল। 

বাইরে থেকে মাগরিবের আযানের ধ্বনি শুনা যাচ্ছে। এ এলাকায় মুসলিম কম হওয়ায় মুসল্লিদের আনাগোনা কম। মাগরিবের আযান পড়াতে গাছপালার সন্নিবেশ বেশি থাকায় চারদিক অন্ধকার হয়ে গেছে। কারেন্ট একদম থাকে না বললেই চলে। মোমবাতি দিয়েই চলতে হয় বেশি৷ এখনও কারেন্ট নেই। আমি বাইরে থেকে ঘরে গিয়ে মোমাবাতি জ্বালালাম। মোমবাতি জ্বালাতে জ্বালাতেই পিয়াস মৃতদেহটাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসে বেনারসি শাড়ি দিয়ে ভালো করে মুড়িয়ে নিল। এরপর ঘরের এক কোণে রেখে দিয়ে বলল

" এখানে থাকুক। একটু রাত হলে আমি ফেলে দিয়ে আসব। আমি গহনা গুলো ধুয়ে নিয়ে আসি।"

এই বলে সে ওয়াশরুমে চলে গেল গহনা ধুতে। অন্ধকারেই সে গহনা ধুতে গেল৷ বাইরে মেঘের গর্জন। বৃষ্টি নামবে মনে হচ্ছে। ঘরটা যেন দুলতেছে। ভাঙা ঘরটা কোনোরকম ঠিক করে থাকা। বৃষ্টি নামলে টিনের চাল দিয়ে পানি পড়বে এটা বুঝতেই পারছি।  বলতে না বলতেই বৃষ্টি নেমে গেল। টিনের চালের বিভিন্ন জায়গায় ফুটা। আমি সেসব জায়গাগুলোর নীচে বাটি দিয়ে দিলাম। মোমবাতিটাকেও এমন একটা জায়গায় রাখলাম যাতে করে নিভে না যায়। তবে শেষ রক্ষা আর হলো না। ধমকা একটা বাতাসে মোমবাতিটা নিভে গেল। ম্যাচটা আমার কোমরেই ছিল। আমি ম্যাচটা নিয়ে মোমবাতিটা জ্বালিয়ে ভয়ে চুপসে গেলাম। কারণ...

{new story }

গল্পের নাম গহনা

পর্ব - 2

লেখিকা শারমিন আঁচল নিপা

কারণ পুরো ঘর রক্তে চুপসে গেছে। উপরের টিন থেকে পানি লাশটায় পড়েছে প্রথম এরপর লাশ থেকে রক্ত পুরো মেঝেতে ছড়িয়ে গেছে। ভয়ে শরীর কাটা দিয়ে আসছে। কোনোভাবেই এটা একমাস আগের লাশ না। একমাস আগের লা/শ থেকে কখনও রক্ত বের হবে না।  আমি পিয়াসকে ডাকতে লাগলাম। গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছে না আমার। তারপরও জোর খাটিয়ে পিয়াসকে ডাক দিলাম। পিয়াস ওয়াশরুম থেকে বের হলো। তার পকেটে মোবাইলের টর্চ জ্বলতেছে। বেশ বিরক্ত গলায় আমাকে বলল

"মোবাইলের চার্জ চলে যাবে এর মধ্যে যদি গহনা গুলো না ধুই তাহলে তো বিপদের পড়ে যাব। কারেন্ট কখন আসে তার কোনো ঠিক নেই। এদিকের কাজ শেষ করে লা/শটাকেও তো গুম করতে হবে। এভাবে ডাকলে হয় বলো।"

আমি পিয়াসের এরকম ব্যবহারে একদম চমকে উঠলাম। টাকার কাছে সে যেন একদম বন্দি হয়ে গেছে৷ সে আমার ভয়টা বুঝছে না। আমার খারাপ লাগাটাও বুঝছে না। সে শুধু দেখছে টাকা। একটা মানুষ যেন টাকার জন্য অমানুষ হয়ে গেল। কীভাবে এত অধঃপতন হলো তার সেটাই ভাবছি আমি। আমি ভয় গলায় জাবাব দিলাম

"পুরো মেঝে লা/শটার রক্তে ভেসে যাচ্ছে।।দরজার বাইরে গেলে আমরায় বিপদে পড়ব। পিয়াস তুমি লোভে ডুবে গেছো।"

পিয়াস আমার কথা শুনে মেঝেতে তাকিয়ে আমাকে বলল 

"তুমি কাপড় দিয়ে রক্ত গুলো তুলে বালতিতে নাও। আমি গহনাগুলো ধুয়ে আসি।"

আমি ভয়ে ভয়ে উত্তর দিলাম

" এ কাজ আমি পারব না। আমার ভীষণ ভয় লাগছে। আমার টাকা পয়সা লাগবে না। শান্তিতে বাঁচতে পারলেই হলো।"

পিয়াস আমার কথা শুনে রেগে গেল। সে রেগে গিয়ে জবাব দিল

"তোমার টাকা পয়সা না লাগলেও আমার লাগবে। নিজেকে কী মনে করতেছো। টাকা ছাড়া দুনিয়ায় শান্তি হয় না। যা বলছি করো।"

কথাগুলো বলেই সে আবার ওয়াশরুমে চলে গেল। আমি ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে একটা পাতলা কাপড় নিয়ে রক্তগুলো তুলে বালতিতে নিতে লাগলাম। হাতে ছোপ ছোপ রক্ত। গা ঘিনঘিন করছে। তবুও কাজটা করতে হচ্ছে। আমার ভেতরে ভয়ে কেঁপে উঠছে বারবার। লা/শটার পেট বরাবর টিনের থেকে চুইয়ে চুইয়ে পানির ফুটা পড়ছে৷ সেজন্য সেটার উপর একটা বাটি দিয়ে দিলাম। তারপর চারপাশ মুছতে লাগলাম। বাইরে বৃষ্টিটা কমেছে ততক্ষণে। আকাশটা একটু স্বচ্ছ মনে হচ্ছে৷ আমি কাপড় নিয়ে রক্তগুলো বালতিতে তুলছি। মেঝেটা অনেকটা পরিষ্কার করে ফেলেছি। এবার লা/শের আশপাশটা পরিষ্কার করব। সেজন্য কাপড় নিয়ে লাশের পাশে মুছতে গিয়ে ঠান্ডা কিছু অনুভূত হলো। বরফের মতো ঠান্ডা। আমি হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলাম লা/শের হাতটা আমাকে চেপে ধরেছে। তার হাতে একটা আংকটি। লা/শটা কীভাবে জীবিত হলো ভেবেই আমার শরীর কাঁপতে লাগল। আমি পুনরায় জোরে চিৎকার  দিলাম। চিৎকার শুনে পিয়াস আবারও ছুটে এসে বলল

"তোমার জন্য ভালো করে কাজেই করতে পারছি না। যাইহোক আবার কী হয়েছে?"

আমি চোখ দুটো বন্ধ করে উত্তর দিলাম

"লা/শটা আমার হাত টা ধরে রেখেছে। এটা কোনো সাধারণ লা/শ না। প্লিজ এখনেই কিছু একটা করো।"

পিয়াস বিরক্তি নিয়ে আমার পাশে এসে বলল

"হাত তোমার ঠিকই আছে। এমনিতে এসব ন্যাকামি নেওয়া যাচ্ছে না। কাজটা কোনোরকম শেষ হয়েছে। এই দেখো কত সোনা। মিনিমাম ৪০-৫০ ভরি হবে। আমাদের আর ভাঙা বাড়িতে থাকতে হবে না৷ শহরে গিয়ে বড়ো বাসা নিব। তুমি এখানেই থাকো আমি লাশটাকে আগে গুম করে দিয়ে আসি।"

আমি পিয়াসের কথায় আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম সব স্বাভাবিক। লা/শটার হাত কাপড়ের ভেতরেই। তাট মানে এটা আমার মনের মতিভ্রম। পিয়াস লা/শটাকে কাপড় দিয়ে ভালো করে বাঁধল। তারপর  পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে নিয়ে একটা স্যুটকেসে ঢুকালো। হিংস্র লাগছে পিয়াসকে। স্যুটকেসে জায়গা নিচ্ছে না তাই লা/শটার হাড়গোড় ভেঙে কোনোরকম ঢুকালো। এরপর সেটা কাঁধে নিয়ে ঘর থেকে বের হলো। গহনা গুলো ঘরেই রেখে গেল। 

আমি একা ঘরে বসে আছি। পিয়াস বের হয়ে গিয়েছে। কখন আসে তার কোনো হদিশ নেই। 

এদিকে পিয়াস যখন লাশটাকে নিয়ে হাঁটছিল। তার বারবার মনে হচ্ছে কেউ একজন তার পাশে হাঁটছে। ভয়ে ভয়ে পাশে তাকিয়েও সে কাউকে দেখতে পেল না। কিছুদূর হেঁটে লক্ষ্য করলো সামনে একটা খাদের মতো আছে। তবে নির্দিষ্ট দূরত্ব বুঝা যাচ্ছে না। সে সামনের দিকে লক্ষ্য করে হাঁটতেছে। হঠাৎ কারও উপস্থিতি টের পেয়ে পেছনে তাকিয়ে চমকে উঠল। 

এদিকে আমি খাটের কোণে বসে আছি। হঠাৎ  দরজা খুলার আওয়াজ পেলাম। আমি দরজার সামনে গিয়ে লক্ষ্য করলাম পিয়াস। সে আমাকে তড়িঘড়ি করে বলল পানি দিতে। আমি তাকে পানি দিলাম। পানিটা খেয়ে সে একটু লম্বা নিঃশ্বাস টেনে বলল

"তুমি ঠিকই বলেছিলে সেটা কোনো সাধারণ লা/শ না। আজকে যা হলো আমার সাথে। বেঁচে আছি এই অনেক৷ গহনা গুলো কোথায়? আমাকে দাও।"

এই বলে ঘর থেকে গহনা গুলো নিজ হাতে নিল। তারপর হালকা গলায় বলল

"লা/শটা কার ছিল জানো?" 

আমি কিছুটা স্তম্ভিত গলায় বললাম

"কার? আর লাশটা কোথায় রেখে আসছো?"

পিয়াস ঢুক গিলতে গিলতে বলল

"লাশটাকে কষ্ট করে আমি খাদে ফেলে দিয়ে এসেছি। তবে লাশটার আত্মা আমাকে ছাড়বে কি'না জানিনা। অভিশপ্ত হয়ে গেছে সব। এ গহনা গুলোই সব নষ্টের মূল।"

আমি কেঁদে দিলাম। কাঁদতে কাঁদতে উত্তর দিলাম

"আগেই বলেছিলাম অতি লোভ ভালো না। এ গহনাগুলো আমাদের দরকার নাই। তুমি শুনলে না। এখন কী করবে বলো। এ পাপ থেকে নিজেকে কীভাবে বাঁচাবে৷ আর লা/শটা কার?"

পিয়াস ঢুক গিলে কিছু বলতে নিবে। এমন সময় দরজার দিয়ে একটা অদ্ভুত  বাচ্চা প্রবেশ করল। বাচ্চাটা...

গল্পের নাম গহনা

পর্ব - 3

লেখিকা শারমিন আঁচল নিপা

বাচ্চাটা অস্বাভাবিক  রকমের ফর্সা। আমাদের দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হাসছে। দাঁত দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে। ভয়ে শরীর হিম হয়ে যাচ্ছে।  হার্ট এটাক করার উপক্রম। এবার বাচ্চাটি ভয়ংকর সুরে হাসতে লাগল। এ হাসিটা আরও বেশি ভয়ে ফেলে দিচ্ছে আমাদের। ভয়টা কাটতে না কাটতেই বাচ্চাটি হাসতে হাসতেই আবার মিলিয়ে গেল। 

পিয়াস কাঁদতে কাঁদতে বলল

"পাপের গড়া পূর্ণ করতে এত বড়ো লোভ করেছিলাম। জানিনা আর কী আছে কপালে। ঐ লাশ/টা একটা স্বনামধন্য পরিবারের মেয়ের। ঢাকার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আতিক চৌধুরির একমাত্র মেয়ে রুনা চৌধুরির। ওদের টাকা পয়সা কোনো কিছুর অভাব নেই। রুনা মেয়েটা ছোটো থেকে তুখোড় মেধাবী ছিল। কলেজেরেই এক মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেকে সে ভালোবাসত। ছেলেটির নাম তীব্র। তীব্রও কলেজ টপার ছিল। মূলত পড়াশোনা নিয়ে কথা বলতে বলতেই তাদের মধ্যে একটা সুসম্পর্ক তৈরী হয়। আর সে সুসম্পর্কটা রূপ নেয় ভালোবাসায়। তীব্র সবসময় ভয়ে থাকত এটা নিয়ে যে, সাধারণ ঘরের ছেলে সে, তার সাথে রুনার বাবা রুনাকে বিয়ে দিবে না হয়তো। তবে রুনাকে ভীষণ ভালোবাসে তীব্র। এ আশঙ্কা যেন তাকে কুড়ে কুড়ে খেত। সে চাইত সারাজীবনের জন্য রুনা তার হোক। 

দেখতে দেখতেই পার হয়ে গেল চারটি বছর। দুজনেই ভার্সিটির গন্ডি পার হয়েছে। তীব্র প্রায় সময় ডিপ্রেশনে থাকত। কারণ তার কোনো ভালো চাকুরি হচ্ছে না। এত এত সার্টিফিকেট , এত ভালো রেজাল্ট কিছুই যেন কাজে দিচ্ছে না। অথচ কত স্বপ্ন ছিল বাবা মায়ের জন্য ঘর করবে। অনেক বড়ো চাকুরি করে দেশ বিদেশে ঘুরবে। রুনাকে বিয়ে করবে। রুনাকে তার বাবা যেভাবে রেখেছে সেভাবেই সে রাখবে। কিন্তু কোনো স্বপ্নই তার পূরণ হচ্ছে না। সব স্বপ্ন এসে বাঁধা দিচ্ছে একটা জায়গাতেই আর সেটা হলো চাকুরি। রুনা অনেকবার তীব্রকে বলেছে তার বাবার কোম্পানিতে জয়েন হতে। সে রেফার করে দিবে। তবে তার আত্নসম্মানের সাথে বিষয়টি সাংঘর্ষিক।। এদিকে রুনার একের পর এক বিয়ের প্রস্তাব আসছে। অন্য দিকে তীব্র এর কোনো চাকুরি হচ্ছে না। সব মিলিয়ে রুনাও মলিন হয়ে যেতে লাগল৷  মনে হচ্ছে তীব্রর সাথে এবার এ বিষয় নিয়ে কথা বলা জরুরি। তাই তীব্রর সাথে একদিন একটা খোলা জায়গায় বসল। বেশির ভাগ সময় তারা খোলা জায়গায় বসে।  কারণ এতে তীব্রর খরচ হয় না। এ মুহূর্তে তীব্রর নিকট ১০০ টাকা খরচ করাও অনেক কঠিন। একটা পার্কের বেঞ্চিতে বসে আছে তারা।৷ উপরে নীল আকাশ, সামনে লেক। তাদের কথোপকথন হওয়া উচিত ছিল রোমান্টিক তবে সেটা না হয়ে কথাগুলো হলো তিক্ততায় ভরা। রুনা তীব্রকে জিজ্ঞেস  করল,

" তোমার কাছে তো আমি আগে তাই না তীব্র? আমি যদি আগে হই তাহলে কেন তুমি বাবার অফিসে জয়েন করতেছো না? এতে বাবা তোমার কাছাকাছি হবে আর তোমার প্রতি সুধারণাও আসতে পারে। আর সবচেয়ে বড়ো বিষয় তোমারও একটা ইনকাম সোর্স হলো। আমিও বাবাকে তোমার কথাটা বলতে পারলাম। এভাবে যদি আমরা বসে থাকি তাহলে আমাদের জীবনে কিছু হবে না। আমার কথা না শুনলে তোমার এ বেকারত্ব তোমাকে গ্রাস করে নিবে। আর একদিন আমিই তোমার জীবন থেকে সরে যাব। বাবাকে আমি কী বলব? তুমি বেকার তাই তো? এটা কী কোনো পরিচয়? আমি পড়েছি জ্বালায়। এজন্য নিজের স্ট্যাটাসের সাথে মিলিয়ে প্রেম করতে হয়। তীব্র তোমাকে শেষ বারের মতো বলছি হয় বাবার অফিসে জয়েন করো নাহয় কোনো ভালো চাকুরি নিয়ে বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসো। না হয় আমি অন্য কোথাও বিয়ে করে ফেলব।"

রুনার কথা গুলো তীব্রকে বেশ আঘাত করল। সে কিছুটা রেগে গেল। রেগে গিয়ে  বলে উঠল

"আমি তোমার জন্য আমার আত্মসম্মান বিক্রি করতে পারব না। আমি তোমার বাবার গোলাম হতে পারব না। এত ভালো রেজাল্ট নিয়ে, কলেজ টপার হয়ে এখন আমাকে রেফারে চাকুরিতে ঢুকতে হবে? তোমার যদি বিয়ে করার হয় করে ফেলো অন্য কাউকে। আমি কি জোর করে তোমার সাথে প্রেমে গিয়েছি? তুমি আমায় ভালোবেসেছিলে। আর ব্যক্তিত্ব দেখেই তুমি প্রেমে পড়েছিলে। আর এখন সে ব্যক্তিত্ব আমি বিসর্জন দিতে পারব না।"

কথাগুলো বলে তীব্র চুপ হয়ে গেল। তার কপাল থেকে বিন্দু বিন্দু ঘাম বেয়ে পড়ছে। বেশ কষ্ট পেয়েছে বুঝায় যাচ্ছে৷  কিন্তু রুনা তাতে ভ্রূক্ষেপ করল না। তার কাছে এখন তীব্রর এ একঘেয়েমি ভালো লাগছে না। কারণ তীব্র তাকে উপেক্ষা করছে এটাই তার মনে হচ্ছে। সে কিছুটা রাগান্বিত গলায় বলে উঠল

"তোমার এ ইগোই তোমার থেকে আমাকে আলাদা করে দিল। যে ব্যক্তিত্ব দেখাতে গিয়ে বাপ, মায়ের মুখে ভাত তুলে দিতে পারতেছো না, নিজের প্রেমিকাকে বিয়ে করতে পারতেছো না। সে ব্যক্তিত্বকে আমি থুথু মারি। একটা সয়ম আমি তোমার ব্যক্তিত্ব দেখে ভালোবেসেছিলাম৷ আজকে তোমার ব্যক্তিত্বকেই আমি ঘৃনা করছি। আমি বিয়ে করে নিব। আর চাই না তোমার ভালোবাসা, তোমার বউ হতে।  টাকার বিছানায় ঘুমালে আর সারাদিন মজ,মাস্তিতে মেতে থাকলে তুমি একটা তীব্র কেন? হাজারটা তীব্রকে আমি ভুলে যেতে পারি।"

কথাগুলো বলে রুনা চলে গেল।।তীব্র নিজের চুল নিজে টানতে লাগল।।জীবনের সমস্তটা দিয়ে সে পড়াশোনা করেছে।  ভালো রেজাল্ট করেছে। আর সে সবকিছুই তার জীবনের সুখের বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পড়ালেখা না করলে রিকশা চালিয়ে খেতে পারত। এখন সেটাও পারছে না চক্ষুলজ্জার কারণে। বাবা মায়ের স্বপ্ন তো দূরে থাক, নিজের স্বপ্নের নাগালেই সে যেতে পারছে না।  এসব ভেবে নিজের কপালে দুই হাতের মুষ্টি দিয়ে সে আঘাত করতে লাগল। আঘাত করতে করতে ক্লান্ত হয়ে একটা সময় থেমে গেল। 

সেখান থেকে উঠে সে তার বাড়িতে ফিরে আসলো। রুনার প্রতি তার ভীষণ ভালোবাসা আছে তবে রুনার এ কথাগুলো সে নিতে পারছে না। মনের গহীনে আত্মহননের অনেক কিছুই ঘুরছে। তবে সাহস করে সেটাও পারছে না। 

দিন কাটতে লাগল। তীব্রর ডিপ্রেশন আরও বাড়তে লাগল। রুনাকে তার ভীষণ মনে পড়তে লাগল। নিজের আত্মসম্মানের জন্য সে রুনাকে কলও দিচ্ছে না। তবে তাকে ভুলে থাকতেও সে পারছে না। আজকে নিজের সাথে যুদ্ধ করে পারল না। নিজের তথাকথিত আত্মসম্মানকে বিলিয়ে দিয়েই সে রুনাকে  কল করল। আর ওপাশ থেকে শুনা গেল অবাক করা কিছু বিষয়। এ অবস্থায় সে কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না.....

গল্পের নাম গহনা

পর্ব - 4

লেখিকা শারমিন আঁচল নিপা

তীব্র জানতে পারল আজকে রুনার বিয়ে। রুনা অবশ্য তীব্রর উপর জেদ করে বিয়েটা করছিল। তবে তীব্র কল দেওয়াতে রুনার সকল জেদ পানি হয়ে যায়। রাগের বরফটা গলতে শুরু করে।  সে তীব্রকে বলে উঠল

"আমি তোমাকেই চাই। এ বিয়ে ভাঙা সম্ভব না। তবে আমি তো পালিয়ে আসতে পারব। তুমি আজকেও আত্মসম্মানের কথা তুলে আমাকে ফিরিয়ে দিবে? নাকি আমাকে নিয়ে যাবে এখান থেকে? আজকে তোমার একটা সিদ্ধান্তই আমার জীবনের মোড় ঘুরাতে পারে। হয় আজকেই আমি তোমার সাথে পালিয়ে বিয়ে করব নাহয় বাবার পছন্দমতো ছেলে বিয়ে করব। তুমি জানাও তুমি কী করবে?"

তীব্র তখন এক নিঃশ্বাসে বলল

"আমি তোমাকে চাই। তুমি কোথায় থাকবে বলো আমি সেখানেই আসব।"

রুনা যেন খুশিতে আত্মহারা। তীব্র তার কথাটা মেনে নিয়ে এভাবে বিয়েতে রাজি হবে চিন্তাও করতে পারে নি। সে খুশির কান্নায় ভেসে গেল। ভাঙা গলায় উত্তর দিল

"আমি এখন পার্লারে সাজতেছি। আমি সাজ শেষ করে গাড়ি করে তোমার কাছে চলে আসব। তুমি তোমার সাথে রেহান আর জোবানকে রেখো। তাদের বিয়ের সাক্ষী বানাতে হবে। এরপর আমরা  দূরে কোথাও বাসা ভাড়া নিয়ে থাকব৷ বাবা যখন মেনে নিবে তখন ফিরে আসব। এক মাস চলার জন্য এক লাখ টাকা আমি সাথে করে নিয়ে আসব। তুমি একদম চিন্তা করো না৷ সময়ের সাথে সাথে সব সুন্দর হয়ে যাবে। রাতে বিয়ের আয়োজন।  আমি এখান থেকে সন্ধ্যার পর বের হব৷ একটা বোরকা পরে বের হব৷ তোমরা একটা নিরিবিলি জায়গায় থেকো।"

তীব্র রুনার সব কথা মেনে নিল। সে রুনার কথা মতো জোবান আর রেহানকে সাথে নিয়ে রমনা পার্কের এক কোণে অপেক্ষা  করছে। তীব্র জানে রুনার এ নিঁখোজ হওয়াটা অনেক বেশি প্রভাব ফেলবে। রুনার বাবা যদি জানে তীব্রর সাথে রুনা পালিয়েছে তাহলে রুনাকে কিছু করবে না তবে তীব্রকে ঠিকই খুন করে ফেলবে৷ তবে ভালোবাসার কাছে এখন সবকিছুই তুচ্ছ মনে হচ্ছে। অপেক্ষার প্রহর যেন তীব্রর কাটছে না। রুনাকে বারবার কল দিচ্ছে না। রুনা কল তুলছে না। বিরক্তও হচ্ছে আবার টেনশনও করছে৷ কলে না পেয়ে একের পর এক মেসেজ দিতে লাগল। কিন্তু রুনার কোনো পাত্তায় পাওয়া যাচ্ছে না। হঠাৎ  করে কেউ একজন তীব্রর হাত ধরে ফেলল। তীব্র পাশ ফিরিয়ে লক্ষ্য করল একটা বোরকা আর নিকাব পরা মেয়ে। রুনাকে চিনতে তীব্রর একদম কষ্ট হয়নি। রুনার চোখ দুটো তার বড্ড চেনা। সে কিছুটা রাগ দেখিয়ে বলল

"রুনা তুমি কী সবসময় মজা নাও। এ সিরিয়াস মোমেন্টেও তুমি মজা করছো।  ইচ্ছা করে কল তুলছো না আমাকে টেনশন দিতে তাইতো? আমি কতটা চিন্তা করছিলাম তুমি জানো?"

রুনা তীব্রকে ধরে বলল

"আমি সরি। একদম বুঝতে পারি নি। তবে ঢাকায় থাকা আমাদের জন্য বিপদজনক। আমাদের ঢাকা ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে বিয়ে করা দরকার। ঢাকায় বিয়ে করলে কোনো কোনো ভাবে বাবা আমাদের কাছে পৌঁছে যাবে। 

ঠিক তখন রেহান বলে উঠল

" একটা কাজ করি। তোরা সবাই আমার নানুবাড়ি চল। নানুরা সবাই বিদেশে স্যটল। বাড়িটা এভাবেই পড়ে আছে। আমরা মাঝে সাঝে যাই। বাঙলো বাড়ি নানুদের ঐটা। পাহাড়ের মাঝখানে করেছে।"

এরপর  তারা সবাই রেহানের কথায় একমত হলাম। সেদিনেই একটা  গাড়ি করে রওনা দিল তারা। রুনা বোরকা নিকাব খুলেনি। কারণ যে কেউ তাকে চিনে ফেলতে পারে। তাই বোরকা পরে থাকায় সবচেয়ে উত্তম বুদ্ধি ছিল। সে সাথে রুনা  তার মোবাইলটাও ঢাকায় ফেলে রেখে গিয়েছিল। যাতে করে সবাই মনে করে সে ঢাকাতেই আছে। ট্র্যাক করলেও যেন লোকেশন ঢাকাতেই দেখায়। 

তাদের গাড়ি রওনা দেয় খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে৷ সেদিন রাত, পার হয়ে প্রায় ১৭ ঘন্টা লাগল তাদের খাগড়াছড়িতে পৌঁছাতে। ঠিক এ জায়গায়টাতেই তারা আসে। আর এটা রেহানের নানু বাড়ি। তারা পৌঁছায় ঠিক বিকেল ৫ টার দিকে৷ এখানে পৌঁছে রুনা তার বোরকা খুলে। তীব্র রুনাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়। এত সুন্দর লাগছে তাকে। বেনারসি শাড়ি পরা সে সাথে গা ভর্তি গহনা। সব মিলিয়ে তাকে যেন পরীর মতো লাগছে। ঠিক যেন একটা লাল পরী। রেহান আর জোবানও রুনার দিকে হা করে তাকিয়ে রইল। রুনা সবসময় অগোছালো হয়ে থাকত। আজকে তাকে এত পরিপাটি দেখে দুজনের চোখই যেন ছানাবড়া। জোবান মুগ্ধ কণ্ঠে বলল

"দোস্ত তোকে অনেক সুন্দর লাগতেছে৷ এ গহনা গুলো কী সোনার?"

রুনা হেসে বলল

"একদম খাটি সোনা। এখানে ১২০ ভরি গহনা আছে। বাবার একমাত্র মেয়ে বলে কথা। আমি তো পার্লারে সব গহনা নিয়ে গিয়েছিলাম সাজার জন্য। সেখান থেকে রেডি হয়ে চলে আসি। সাথে শুধু এক লাখ টাকা নিয়ে আসি। গহনার কথা বলিনি কারণ তীব্র এটাতে রাজি হত না। তবে আমি নিয়ে এসেছি সেফটির জন্য। যাইহোক আমি একটু ফ্রেশ হয়ে গহনা খুলে রাখছি। কাল বিয়ের সময় মন চাইলে পরব নাহয় এগুলো এভাবেই রেখে দিব। সবগুলো গহনা মায়ের। অনেক স্মৃতি মিশে আছে।"

রুনা কথাগুলো শেষ করে গহনা গুলো খুলে বিয়ের উড়নায় মুড়ে নিল। এরপর ফ্রেশ হয়ে ঘরে এসে বসল। রাতে চারজন মিলে একসাথে খাবার কিনে আনল। একসাথে খেল। বেশ মজা করেই তাদের সময় কাটতেছিল। তবে বিপত্তি ঘটে মধ্যরাতে। এলাকার একজন এ বাড়িতে আলো দেখে জানতে পারে রেহান এবং তার বন্ধুরা এসেছে। আর একটি মেয়েকে ভাগিয়ে নিয়ে এসেছে। এবং তারা এটাও জানতে পারে মেয়েটির সাথে ১০০ ভরি গহনা আছে। এটা জানার পর সে লোকটি আরও কয়েকজন লোক নিয়ে এ বাড়িতে ডাকাতি করতে আসে। আর এসেই তারা প্রথমে রুনার গলায় ছুরি ধরে। ছুরি ধরে ক্ষ্যান্ত হয়নি। বরং তারা রুনাকে খুন করে ফেলল। 

ঘটনা এতটুকু শুনে তোমার হয়তো মনে হতে পারে এখানে ডাকাতদের করা ভুলে রুনার আত্মা এখানে আটকা পড়েছে। কিন্তু তা' না। সঠিক ঘটনা হলো। রেহান আর জোবান মিলেই ডাকাত দলের সাথে যোগাযোগ  করে এ গহনাগুলোর জন্য। তাদের টার্গেট ছিল ডাকতরা গহনা চুরি করে নিয়ে যাবে তারপর তাদের মাঝে সমানভাবে ভাগ হবে৷ তবে এ পরিকল্পনায় তীব্র জড়িত ছিল না। এদিকে ডাকাত দল এসে পরিস্তিতির সাথে সামলে উঠতে না পেরে রুনাকে খুন করে দেয়। খুন করার উদ্দেশ্য যদিও তাদের ছিল না৷ রেহান আর জোবান তখন ডাকাতদের বলে উঠল

"আমরা তো রুনাকে খুন করতে বলিনি। শুধু বলেছি গহান চুরি করতে। খুন কেন করলেন?"

তীব্র এ কথাটা শুনার পর বুঝতে পারে রুনার খু'নের সাথে তারা জড়িত। তাই রাগে ক্ষোভে তাদের কিছু বলতে গেলে জোবান তাকে ধরে ঠান্ডা করে। এরপর তাকে বুঝায় সে যদি এখন রাগের মাথায় কিছু করে এতে তার ক্ষতিই হবে লাভ না। খুনের দায়ে পুলিশ তাকেও ধরবে৷ কিন্তু সে যদি তাদের সাথে হাত মিলিয়ে রুনার লাশটাকে পুঁতে ফেলে। মুখ বন্ধ রাখে তাহলে কোটি টাকার গহনায় তারও ভাগ আসবে। তার বাবার স্বপ্ন পূরণ হবে৷ রুনা তো আর ফিরে আসবে না। যা হবার তা তো হয়েই গিয়েছে। এখন তাকে সিদ্ধান্ত  নিতে বলে সে কী করবে। 

জোবানের কথায় তীব্রও লোভে পড়ে গেল। তার আত্মসম্মান সামান্য কয়টা গহনার কাছে বিক্রি হয়ে গেল। এরপর তারা রুনাকে নিয়ে যে জায়গায়  আমরা লাশটা পেয়েছি সে জায়গায় পুঁতে দিয়েছিল। তুমি জানো এটা কবের ঘটনা?

এ প্রশ্নের প্রতিউত্তরে আমি পিয়াসকে প্রশ্ন করতে যাব, এমন সময় আমার বুক কাঁপতে লাগল একটা বিষয় লক্ষ্য করে। তা হলো....

{adult story click here }

গল্পের নাম গহনা

পর্ব - ৫/শেষ পর্ব

লেখিকা শারমিন আঁচল নিপা


আমি লক্ষ্য করলাম পিয়াসের হাতে মেয়েদের সোনার আংকটি। সেই আংকটিটা যেটা আমি মৃত লাশটায় দেখেছিলাম৷ বেশ ভয় লাগতে শুরু করল। বুঝতে পারলাম এটা পিয়াস না। তাহলে কে?  আমি নিজের মধ্যে সাহস জুগিয়ে জিজ্ঞেস  করলাম

"তুমি কে? তুমি আমার পিয়াস না? কে তুমি?"

একটি মেয়েলী হাসি ভেসে আসলো। হাসতেই হাসতেই পিয়াসের বেশ ধরা মানুষটা হঠাৎ  করে মুখ পুড়া লাশ হয়ে গেল, যেটা পিয়াস নিয়ে গিয়েছিল খাদে ফেলতে। আমি জোরে চিৎকার  করে বললাম

"তুমি কে? কি চাও? আমার পিয়াস কোথায়?"

মেয়েটা উচ্চ স্বরে হাসলো। হেসে উত্তর দিল

"আমি কে সেটা তো তোমাকে এতক্ষণ  বললাম। আমি রুনা চৌধুরি। আমার পুড়া মুখের আড়ালে আসল রূপটা দেখতে চাও? "

আমি চিৎকার করে উত্তর দিলাম

"আমি কিছুই দেখতে চাই না। আমি জানতে চাই পিয়াস কোথায়? আমি আমার পিয়াসকে ফিরে পেতে চাই৷ তুমি আমার পিয়াসকে ফিরিয়ে দাও। এ ভয়ংকর পরিস্থিতি থেকে আমি মুক্তি চাই৷"

রুনা আমার কথা শুনে আবারও অট্ট হাসলো। অট্ট হেসে বলল

"লোভের ফল ভালো হয় না। লোভ করলে কর্মফল পেতেই হবে৷ পিয়াস লোভ করেছিল।  আমি শুধু লোভের ফলটা দিয়েছি। আমাকে খাদে ফেলতে গিয়েছিল না? আমিই তাকে খাদে ফেলে দিয়েছি। ৩০ বছর যাবত আমি এখানে পুড়ে পুড়ে মরছি। ৩০ টা বছর আমার আত্মা এখানে পড়ে আছে। 

কেন জানো? আমাকে মৃত্যুর পর ওরা ছেড়ে দেয় নি। বরং আমার লাশটা দিয়ে কালো জাদু করেছিল। যার জন্য আমার শরীরে শয়তানের বাস। এ জীবন থেকে আমি মুক্তি পেতাম যদি সত্যিই কেউ আমার লাশটা উদ্ধার করে এ পাপ থেকে মুক্ত করত। কালোজাদুর কবল থেকে আমার শরীরটা রক্ষা করত। এই যে হাতের আংকটিটা দেখছো না? এটার মধ্যে আমার আত্মাকে কালোজাদু করে শয়তান রুপে বন্দি করে রেখেছে।

সে শয়তানেই এখানে শিকার ধরে আনে৷ আর যেই এখানে এসে আমার লাশটা পায় সেই গহনার লোভে পড়ে যায়। আর সাথে সাথে সেও শয়তানের শিকার হয়ে যায়। পিয়াস প্রথম না৷ এরকরম অনেকে এখানে এসেছে আর সবার একই পরিণতি হয়েছে। আমার ভালেবাসাও এ গহনার কাছে বিক্রি হয়ে গিয়েছিল।  আমার গহনায় আমার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল? আমার বাবা কেমন আছে জানি না। এ শয়তানের আত্মা আমার লাশে বহন করতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আমি কাউকে মারতে চাই না। তবে যখনই কেউ আমার গহনার লোভে পড়ে তখনই সে শয়তানের শিকার হয়ে যায়। এই যে তোমার সাথে আমি ভালো করে কথা বলছি এটা হলো আমার স্বত্ত্বা তবে এটা বেশিক্ষণ থাকবে না কিছুক্ষণ  পরেই বিলীন হয়ে যাবে। সাথে সাথে শয়তান হয়ে ফিরে আসবে।

সেদিন আমাকে খু/ন করে  গহনা গুলো নিয়ে রেহান,জোবান আর আমার ভালোবাসার তীব্র  পালিয়ে যেতে নিয়েছিল। তবে জোবান কালোজাদুতে খুব আসক্ত ছিল। সে চেয়েছিল আমার লাশটা বলিদান করে শক্তির অধিকারী হতে আর সেটাই তাদের কাল হয়ে দাঁড়ায়। আমার দেহে প্রবেশ করে শয়তান আর সে শয়তান রক্ত চুষা। তিন  মাসে একবার তার রক্ত খেতে হয়। আর সে রক্তের নেশার জন্যই তাদের তিনজনকে মেরে দেয়।  

তারা তো মরে যায়। তবে প্রতি তিন মাসে এত রক্তের চাহিদার পূরণ তো করতে হবে৷ শয়তানের খাবার জোগানের  জন্যই এ ফাঁদ ফেলা হয়। শিকার ধরে আনার জন্য অল্প দামে বাড়ি বিক্রি করে। আর সে শিকারও ফাঁদে পা দিয়ে আমার লাশটা পর্যন্ত পৌঁছায়। আফসোস এ ৩০ বছরে এতগুলো মানুষ আসলো,  সবগুলো মানুষেই ছিল লোভী। আর লোভের ফল তো রক্ত দিয়েই দিতে হবে। পিয়াস বেঁচে আছে কি'না জানি না। তবে তোমাকে আমি মারতে চাই না। কারণ তুমি নির্লোভী এবং তোমার চেহারার সাথে আমার হুবুহু মিল আছে। তুমি আমার দিকে তাকিয়ে দেখো।"

আমি ভয়ে ভয়ে রুনার দিকে তাকালাম। সত্যিই অবিকল আমার মতো একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি কিছু বলার আগেই সে বলে উঠল

"প্রতিটা খারাপ কিছুর মধ্যে ভালো কিছু থাকে৷ তেমনি আমার ভেতরে থাকা শয়তানের বাস ২১ ঘন্টা আর আমার ভেতরে ভালো জিনের বাস ৩ ঘন্টা। আমার কাছে আর ১৫ মিনিট সময় আছে। এরপর আমার ভেতরে থাকা শয়তানটা জেগে উঠবে৷ শুনো একামাত্র তুমিই আমার গহনার প্রতি লোভ করো নি। তাই শয়তান তোমাকে সহজে শিকার করতে পারবে না। আগে তোমাকে গহনার লোভে ফেলবে তারপর রক্ত চুষে খাবে। আর এমনিতে তোমার শরীর বন্ধ করা আছে। কারণ তুমি শরীর বন্ধের দোয়া পড়ো সকাল সন্ধ্যা। তাই শয়তান সরাসরি তোমাকে গ্রাস করতে পারবে না। প্রথমে তোমাকে লোভে ফেলবে তারপর গ্রাস করবে। তোমার নিজেকে বাঁচানোর একটা উপায় আমি বলে দিচ্ছি। প্লিজ কাজটা করো। এতে তুমি যেমন মুক্তি পাবে সাথে আমিও মুক্তি পাব। আর বেশি সময় নেই। তুমি বলো আমাকে সাহায্য  করতে চাও?"

আমি কান্না করতে করতে উত্তর দিলাম

"আমি পিয়াসকেও চাই।"

"আমার মুক্তি মিললে পিয়াসও ফিরে আসতে পারে। পিয়াসের রক্ত এখনও চুষা হয়নি। কারণ আমার ভেতরে থাকা ভালো জিনটা জেগে উঠেছে। পিয়াসের দেহটা সে ঘরটাতেই আছে  যেখানে আমার লাশ পাওয়া গেছে৷ এখন তুমি জলধি বলো আমাকে সাহায্য  করতে চাও কি'না?"

আমি এক বাক্যে বলে উঠলাম 

"হ্যা করতে চাই। কী করতে হবে বলো?"

"আমরা শরীর ৫ মিনিটের মধ্যে নিস্তেজ হয়ে যাবে। এরপর ১০ মিনিটের মধ্যে শয়তানটা জেগে উঠবে৷ জেগে উঠেই সে পিয়াসের রক্ত চুষবে।  আর তোমাকে যে করেই হোক লোভের ফাঁদে ফেলবে। তোমার কাজ হবে আমার শরীর নিস্তেজ হওয়ার সাথে সাথে আমার হাত থেকে আংকটিটা খুলে ফেলা। আংকটিটা খুলতে চায়বে না। তুমি যে করেই হোক খুলবে। এ আংকটি টা খুলে আংটিটা ভেঙে ভেতরের লেখা গুলো বিসমিল্লাহ  বলে পুড়িয়ে দিবে।  আর গহনা গুলোও মাটিতে পুঁতে ফেলবে৷ এতে আমার শরীরটা শয়তান মুক্ত হবে৷ এরপর আমার লাশটাকে স্বাভাবিক  ভাবে দাফন করে চলে যাবে। এতে আমি অভিশপ্ত  জীবন থেকে মুক্তি পাব। আর এখানের মৃত্যু খেলাও বন্ধ হবে। "

কথাটা শেষ করতেই রুনা ঢলে পড়ল। আমি আর সময় নষ্ট করলাম না। আংকটিটা খুলার চেষ্টা করলাম৷ কিন্তু কোনোভাবেই আংকটিটা খুলছে না। এদিকে হাতে সময় খুব কম। আমি আংকটিটা খুলতে না পেরে ছুড়ি দিয়ে আঙ্গুলটায় কেটে ফেললাম। ততক্ষণে রুনার শরীরে শয়তান জেগে উঠেছে। সে আমার হাত থেকে রুনার কাটা আঙ্গুলটা নিতে আমার ঘাড়ে খামচি দিয়ে ধরল। আমি কোনোরকম খামচি ছুটিয়ে আংকটি টা ভাঙতে রান্না করে গেলাম। রুনার শরীরটা আমার পেছন পেছন আসলো। রেগে আমার দিকে তেড়ে আসলো। আমার গলা চেপে ধরে বলল

"আংকটিটা দে আমায়, নাহয় তোকে খুন করে ফেলব। আমি রান্না করার ছুড়ি দিয়ে তাকে আঘাত করলাম। এরপর রান্না ঘরের শিলপাটা দিয়ে মাথায় আঘাত করলাম। শয়তান মাটিতে পরে গেল। মাটিতে পরে আমার পা ঘামচি দিয়ে ধরল। পায়ে ভীষণ যন্ত্রণা  হলেও আমি সেটা সহ্য করে নিলাম। শিলপাটা  দিয়ে আংকটিটা ভেঙে দিলাম।  আংকটির ভেতর থেকে একটা কাগজ বেরিয়ে আসলো যেখানে আরবিতে কিছু লেখা।  

শয়তানটা এবার আমার পা ছেড়ে দিয়ে পিয়াসের কাছে যেতে লাগল। পিয়াসের কাছে গিয়ে তার রক্ত চুষবে। আমি এদিক দিয়ে ম্যাচ খুঁজতে লাগলাম৷ কোথাও ম্যাচ পাচ্ছিলাম না।  এদিকে শয়তানটা পিয়াসের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। আমি যদি ম্যাচটা না পাই তাহলে শয়তানটা পিয়াসের রক্ত চুষে খেয়ে ফেলবে। আমি  পাগলের মতো ম্যাচ খুঁজতে লাগলাম। অবশেষে ম্যাচটা পেলাম আমি। আমি ম্যাচটা নিয়ে আগুন জ্বালাতে চেষ্টা করেও পারছিলাম না। এদিকে  শয়তানটা পিয়াসের দিকে ছুটে যাচ্ছে ধীর গতিতে।  আমি রান্না ঘরে দেরি না করে পিয়াসের লাশের কাছে গেলাম। শয়তানটা  পিয়াসের লাশের কাছে ধীর গতিতে গিয়ে রক্ত চুষতে নিল। আমি পাগলের মতো গিয়ে রুনার শরীরটাকে টানতে লাগলাম। শরীরের শক্তি দিয়ে কুলাতে পারছি না। রক্ত চুষে ফেললে পিয়াসকে বাঁচানো সম্ভব না। কেনোভাবেই আমি পেরে উঠতে পারছিলাম না। পাশেই  ঘরের ভাঙা টিন ছিল। তা দিয়ে মাথা বরাবর আঘাত করলাম। সে কিছুক্ষণের জন্য স্থির হয়ে গেল। এ সুযোগে আমি পিয়াসের শরীরটা একটু দূরে সরিয়ে নিতে লাগলাম। রুনার শরীরটা  স্থির থেকে আবারও নড়ে উঠে আমার পায়ে খামচি দিয়ে ধরল। আমি দোয়া দূরদ পড়তে লাগলাম৷ এরপর ম্যাচটা নিয়ে অনবরত আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু জ্বলছে না। হুট করে মনে হলো আমি তো বিসমিল্লাহ  বলিনি। মনে হওয়ার সাথে সাথে আমি বিসমিল্লাহ বলে ম্যাচটা জ্বালাতে নিলাম। এবার জ্বলে উঠল। সাথে সাথে আগুন দিয়ে কাগজটা পুড়িয়ে ফেললাম। 

কাগজ পুড়ানোর সাথে সাথে রুনার শরীরটা ছটফট করতে করতে স্থির হয়ে গেল। পিয়াসের জ্ঞান  ফিরেছে। আমি পিয়াসকে বললাম আমার সাদা শাড়িটা আনতে৷ পিয়াস  ঘর থেকে সাদা শাড়িটা আনল। যদিও পিয়াস এসবের কিছুই বুঝছে না।   সাদা শাড়িটা আনার পর আমি সেটা দিয়ে রুনার শরীরটা ভালো করে মুড়িয়ে নিলাম। এরপর দাফন করে দিলাম। সাথে গহনাগুলোও পুঁতে দিলাম৷ বাতাসে একটা আওয়াজ পেলাম সেটা হলো

" আমার আত্মাকে মুক্তি দেওয়ার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। তোমরা এখান থেকে চলে যাও। আর ফিরে এসো না এখানে। "

আমি আর পিয়াস কোনোদিকে তাকালাম না। বাইরে থেকে আযানের শব্দ শুনা যাচ্ছে। আমরা আল্লাহুআকবার বলে রওনা দিলাম। এরপর দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে বাস স্টেশনে আসলাম। ততক্ষণে আলো ফুটে গেছে। আমরা এক বোতল পানি নিয়ে মুখটা ধুয়ে বাসে উঠলাম। বাসটা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলো।

আসার পথে পিয়াসকে সবটা খুলে বললাম। পিয়াস তখন বলল

" লাশটা নেওয়ার সময় আমি একটা স্পর্শ পেয়ে তাকালাল। তখন রুনাকে দেখি৷ এরপর রুনা আমাকে আঘাত করে। কখন জ্ঞান  হারায় জানি না৷ "

এসব কথোপকথনের মাঝেই পিয়াস আর আমার যাত্রা শেষ হয়। ঢাকায় আসার একমাস পর মনে হলো আমি তো রুনার সকল কিছু দাফন করলেও কাটা আঙ্গুল টা দাফন করিনি। এটা মনে হতেই কেমন জানি লাগছিল।  তবুও এটা ভেবে শান্তি পাচ্ছিলাম আমাদের সাথে কোনো অঘটন ঘটছে না। 

এভাবেই পিয়াস দম্পত্তির গল্প শেষ হলেও। গল্পের শুরু হয় এখান থেকে।  পিয়াস দম্পত্তি চলে আসলেও রুনার কাটা আঙ্গুল ঠিকেই জীবিত হয়ে নড়ছিল। আর এখান থেকেই দেখা যায় ৩ মাস পর আরেকটা দম্পত্তি সেখানে বাড়ি কিনে যায়। আর সেখান থেকেই গল্পের শুরু হয়৷ এ গল্পের শেষ নাই। পর্যায়ক্রমে এটা চলতেই থাকবে৷ শয়তান কখনও একবারে ধ্বংস হয় না। কোনো না কোনোরূপে ফিরে আসে। শুধু শিকার টা পরিবর্তন  হয়।  

সমাপ্ত


চুরি, বিশ্বাসঘাতকতা আর অপ্রত্যাশিত প্রেমের মোড়ে বাঁক নেওয়া এক আবেগঘন 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ