রজনী এক আত্মার গল্প



গল্পের নাম রজনী

লেখিকা শারমিন আঁচল নিপা

পর্ব- ১ম পর্ব 

হবু বরের আত্মহত্যার খবরটা আয়েশার কানে আসে বিয়ের আগের দিন রাত চারটায়।  হবু বরের  বন্ধু কল দিয়ে জানায়  তাসকিন আত্মহত্যা করেছে। তাসকিন আয়েশার হবু বর। যার সাথে তার সম্পর্ক ছিল দুই বছরের। একই সঙ্গে দুজন চাকুরি করত। অফিসের কলিগ হওয়ার সুবাদে তাদের পরিচয়টা হয়। সে থেকে সম্পর্ক আর সে সম্পর্কের সূত্র ধরেই প্রণয় হতে যাচ্ছিল কাল।  আয়েশা ভেবেছিল এটা হয়তো সাবিদ মজা করছে। তাই বেশ খামখেয়ালে হাসি দিয়ে বলল

- এমন মজা করা ঠিক না। 

কিন্তু তার সে হাসিটা মলিন করে সাবিদ বলে উঠল 

- ভাবি আমি মজা করছি না। 

আয়েশার মুখটা মলিন হয়ে গেল। কিছুতেই বুঝতে পারছে না তাসকিন কেন আত্মহত্যা করবে৷ এই তো কিছুক্ষণ  আগেই কথা হলো। দুজনে এক সাথে কত স্বপ্ন বুনল। আয়েশার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। তাই নিশ্চিত হওয়ার জন্য তাসকিনের ছোট বোন সনিয়াকে কল দিল। সনিয়াকে পরপর চারবার কল দেওয়ার পরও তুলল না সে৷  আয়েশার ছটফটানি বাড়তে লাগল। তাসকিনকেও কল দিয়ে পাচ্ছিল না। সব মিলিয়ে সে খুব হতাশ হয়ে বসে আছে। মনের মধ্যে নিশ্চয়তা অনিশ্চয়তা  দুটোই কাজ করছে৷ এর মধ্যে তার মা সহুরা বেগম এসে সজোরে কান্না করে দিলেন। মেয়ের পাশে বসে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আহাজারি করতে লাগলেন। আয়েশার এবার বুঝতে বাকি রইল না সাবিদ যা বলেছে সবটা সত্যি। সে দম ধরে বসে রইল। তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না। চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। বুকের যন্ত্রণা  বহুমাত্রা বেড়ে গেলেও সেটা প্রকাশ করতে পারছে না। হাত দুটোতে তাকিয়ে দেখল এখনও মেহেদী রাঙা হয়ে আছে। টুকটুকে লাল হয়েছে মেহেদী। স্বাভাবিক  মৃত্যু হয়তো এত কষ্ট আয়েশাকে দিত না কিন্তু আত্মহত্যার ব্যাপারটা সে মানতে পারছে না। নিজের অজান্তেই দম ধরে বসে ছিল। চোখ দিয়ে পানি বের হওয়া ছাড়া আর কোনো উপক্রম তার মধ্যে পরিলক্ষিত  হলো না। তার মা সহুরা বেগম তার দিকে তাকিয়ে তার অবস্থা দেখে আরও জোরে কেঁদে দিয়ে বলল

- মা রে একটু চিৎকার দিয়ে কান্না কর ভালো লাগবে।

আয়েশা আর কোনো কথা বলতে পারছে না। শুধু হাতের দিকে তাকিয়ে চোখের জল ফেলছিল। 

আস্তে গলায় বলল

- মা আমি আসকিনদের বাসায় যাব। তাকে দেখতে চাই। 

কথাটা বলেই চুপ হয়ে গেল আয়েশা। সহুরা বেগম তাকে ধরে নিয়ে রুম থেকে বের হলেন। আয়েশার বাবা আমজাদ সাহেব স্থির হয়ে তখন সোফায় বসে ছিলেন। নিজের একমাত্র মেয়ের এ অবস্থা যেন মানতে পারছেন না। কী থেকে কী হয়ে যাচ্ছে সেটা তিনি বুঝতে চেয়েও যেন বুঝতে পারছেন না। আয়েশাকে দেখে হুহু করে কেঁদে সহুরা বেগমকে বললেন

- ওকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছ?

- তাসকিনকে একটু দেখে আসুক। আর তো দেখতে পাবে না।

 বলেই কেঁদে দিলেন।আয়েশা তখনও স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তাসকিনদের বাসা খুব একটা দূরে না মিনেট পাঁচেকের পথ। সহুরা বেগম নিজের মেয়েকে নিয়ে বের হলেন। চারপাশটা তখনও বিয়ে বাড়ির আমেজে ঝলমল তবে কেমন জানি ফিকে আর নির্জীব হয়ে আছে। রিকশাও নেই যে রিকশা করে যাবে। সহুরা বেগম আস্তে গলায় বলল

- হেঁটে যেতে পারবে?

আয়েশা শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। চেনা পথটায় হাঁটছে আয়েশা। চোখের সামনে কত স্মৃতি জমে উঠছে তার। কত কিছুই মনে হচ্ছে। এর মধ্যেই মনে হলো কেউ তার পাশ দিয়ে হাঁটছে। পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখল কেউ নেই। আবারও হাঁটতে শুরু করল। মনে হলো কেউ একজন তার হাত ধরেছে কিন্তু পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখল কেউ নেই। মুহূর্তেই হাতের স্পর্শটাও বিলীন হয়ে গেল। এমন কেন মনে হচ্ছে তার সেটা সে বুঝতে পারছে না। মিনেট আট পর দুজনেই উপস্থিত হলো তাসকিনদের বাসায়। সহুরা বেগম সেখানে গিয়ে আয়েশার হাতটা ছেড়ে দিল। চারপাশটায় মানুষ গিজগিজ করছে। বিয়ে বাড়ির হুলুস্থুল  যেন ক্রমশেই মলিন হয়ে আহাজারিতে রুপ নিল। আয়েশা মানুষের ভীড় ঠেলে ভেতরে ঢুকল। তাসকিনের ঘরের দরজাটা খোলা। তাসকিনের লাশটা ঝুলছে। আয়েশা কাঁদতে চেয়েও পারছে না৷ তার চোখে কিছু বিষয় পরিলক্ষিত  হলো। ঝুলন্ত লাশটাকে সে দেখতে লাগল। লাশটার কাছে যেতে চাইলে অনেকে বাঁধা দিল। পুলিশ আসার আগে লাশ ধরা যাবে না তাই। তবুও সে লাশটার একটু কাছে গেল। তাসকিনের পায়ের নখগুলো খেয়াল করল। প্রতিটা নখে ক্রস চিন্হ করে লাল দাগ কাটা। পায়ের গোড়ালিতে কিছু লেখা সেটা আরবি হরফও হতে পারে তবে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে না। পায়ের উপরের অংশে কালো বৃত্ত করা। হাতের দিকে তাকিয়ে দেখল প্রতিটি নখে তীরচিন্হ আঁকা।  হাতের তালুতে কিছু লেখা তবে স্পষ্ট না। হাতের উল্টো পিঠে দুটো বাচ্চার ছবি অংকন করা। তবে মুখ স্পষ্ট না। এবার আয়েশা তাসকিনের মুখের দিকে তাকাল। সাধারণত ঝুলন্ত লাশের মুখ নীচের দিকে ঝুলে থাকে তবে তাসকিনের মুখটা দক্ষিণ দিক বরাবর করা। চোখ গুলো উল্টানো। মনে হচ্ছে কিছু দেখেছিল সে। আয়েশা দেয়ালের দিকটায় তাকাল। তেমন কিছুই তার চোখে পড়ল না। শুধু মনে হয়েছিল একটা বাচ্চার অবয়ব দেয়ালে আছে তবে সেটা কী তার মনের ভুল ধারণা নাকি সত্যি! কান্নার সময় সে পাচ্ছে না এসব লক্ষ্য করে। বারবার মনে হচ্ছে তার হবু বর আত্মহত্যা করেনি। এমন কিছু হয়েছে যেটা সে বা অন্যরা জানে না। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। এর মধ্যেই পুলিশ এসে পড়ল। আয়েশাকে বাইরে যেতে বলল। সে কোনো কথা না বলেই বাইরে গিয়ে পাথরের মতো বসে পড়ল। তার চোখ দিয়ে কোনো জল পড়ছে না। নেই কোনো আহাজারি শুধু এটাই মনে আসছে হাতে পায়ে এসব কী? তার মাথায় এসবেই ঘুরপাক খাচ্ছে। 

লাশটা নামানো হলো। লাশটা নামাতেই আয়েশা দৌড়ে গেল। সেখানে গিয়ে শার্টের বোতমের ফাঁক দিয়ে কী যেন কালো দেখা যাচ্ছে বুকে লক্ষ্য করল। সে শত বাঁধা উপেক্ষা করে ঝাঁপটে পড়ল তাসকিনের উপর। শার্টটা একটু উপরে তুলে বুকটা দেখে নিজেই চমকে গেল। তাসকিনের বুকের বা পাশে একটা ঈগলের ট্যাটু করা। এটা কবে করাল, সে শুধু এটাই ভাবছে। রাতেই তো ভিডিও কলে কথা বলল তখন তো এমন ছিল না। তার মাথা ঘুরপাক খেতে লাগল। এতক্ষণের জামানো কান্না সব একসাথে এসে থুবরে পড়ল। জোরে চিৎকার  দিয়ে তাসকিনের মাথাটা বুকে নিতেই ভয় পেয়ে গেল। মাথার পেছন দিকটায় কোনো গর্তের মতো কিছুতে যেন তার হাত আটকে গেল। সে তাড়াহুড়ো  করে পেছন দিক দেখল।।লক্ষ্য করল পেছন দিকটায় একটা গর্ত।  অথচ তাতে কোনো রক্ত নেই। একটা মানুষের মাথা গর্ত করল তাতে রক্ত থাকবে না এটা কেমন! আর তাসকিন আত্মহত্যা করলে অবশ্যই তার মাথার পেছন দিকটা এমন হত না। এমন সময় আয়েশা সামনের দিকে তাকাল। একটা বাচ্চা যেন হামাগুড়ি দিয়ে যেতে লাগল।

সে জোরে চিৎকার করে উঠল। জোরে জোরে বলতে লাগল এটা স্বাভাবিক  মৃত্যু না। তার কথায় কেউ পাত্তা দিল না। তাকে ধরে তাসকিনের থেকে আলাদা করে বসানো হলো। ভোর ছ'টা বাজে লাশ নিয়ে থানায় গেল পুলিশ। এদিকে আয়েশা শুধু ভাবতে লাগল এটা কখনই স্বাভাবিক  মৃত্যু হতে পারে না। চুপচাপ বসে রইল কতক্ষণ।  পুরো বাড়ি এখন নীরব। সহুরা বেগম আয়েশার কাছে গিয়ে বলল

- বাড়ি চল।

এমন সময় সনিয়া এসে তার  পাশে বসে  কাঁদতে কাঁদতে বলল

- ভাবি তোমার মতো আমারও মনে এমন সন্দেহ লাগছে। ভাইয়া কখনও আত্মহত্যা করতে পারে না। জানো গতকাল একটা ঘটনা আমার সাথেও ঘটেছে। আমি জানি সেটা কেউ বিশ্বাস করবে না। 

আয়েশা নিজেকে শক্ত করলো। তার মাকে দূরে বসতে বলল। সনিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল

- আমাকে বল কী হয়েছিল।

সনিয়া বলা শুরু। সনিয়ার কথা যত শুনছিল ততই আয়েশার বুক কেঁপে উঠছিল।

 গল্পের নাম রজনী

লেখিকা শারমিন আঁচল নিপা

পর্ব- 2 পর্ব ,

সনিয়া বলা শুরু করল। সনিয়ার কথা যত শুনছিল ততই আয়েশার বুক কেঁপে উঠছিল। 

তাসকিনদের বাসায় তিনটে রুম, দুটো বাথরুম। একটা রুমের সাথে এটাচ বাথরুম থাকলেও অন্য রুমগুলোর সাথে কোনো এটাচ বাথরুম নেই। অন্য রুমগুলোর জন্য একটা কমন বাথরুম দেওয়া। কমন বাথরুমটার অবস্থান  তাসকিনের রুমের সাথেই । এটাচ বাথরুম যে রুমে সেখানে সনিয়ার বাবা মা থাকে। আর কমন বাথরুমটা  মূলত বাকি দুই রুমের জন্য। সুতরাং  সনিয়ার রুম থেকে বাথরুমে যেতে হলে তাসকিনের রুম পার হয়ে যেতে হয়।

রাত তখন আড়াইটা।  সনিয়া বাথরুমে যাওয়ার জন্য উঠল। তাসকিনের রুমের দরজাটা তখন খোলা ছিল। তাসকিনের রুম পার হতেই তার মনে হলো কোনো অশরীয় আওয়াজ আসছে রুম থেকে। তাই সে কিছুটা ভয়ে ভয়ে গলা ছাড়িয়ে বলতে লাগল

- ভাইয়া...ভাইয়া....

কিন্তু কোনো উত্তর আসলো না। অনুমতি ছাড়া রুমে প্রবেশ করা উচিত না তাই রুমে আর প্রবেশ করল না। ব্যপারটা তেমন পাত্তাও দিল না। বিয়ে বাড়ি সুতরাং হয়তো কেউ মজা করে এমন আওয়াজ করছে। ছেলেরা সব ছাদে আছে। রাতে তারা সেখানেই থাকবে। মেয়েরা সব সনিয়ার রুমে। তবে সারাদিন এত কাজ করেছে এখন ক্লান্ত হয়ে নাক ডেকে ঘুমুচ্ছে সব। বাইরে এতক্ষণ  গান বাজলেও সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। বাড়িটাতে বেশ ছমছমে পরিবেশ বিরাজ করছে। সে নিজেকে সামলে বাথরুমে প্রবেশ করল। সেখানে ঢুকার পর তার বারবার মনে হচ্ছিল কেউ একজন তার কানে এসে কান্নার আওয়াজ তুলছে। সে ভয় পেতে লাগল। বুকের ভেতরটা তার কেঁপে যেতে লাগল। ভয়ে ভয়ে এদিক ওদিক তাকিয়েও কাউকে পাচ্ছিল না সে। তাড়াহুড়ো করে বাথরুম সেড়ে বাইরে বের হলো। বাইরে বের হতেই তার মনে হলো তাসকিনের রুম থেকে অদ্ভুত  আওয়াজ আসছে। সনিয়া কিছুটা ভীত হয়ে রুমে উঁকি দিল। লক্ষ্য করল তাসকিন মেঝেতে উপুর হয়ে শুয়ে আছে। সনিয়ার বোধগম্য হচ্ছিল না তাসকিন কেন এমন করছে। কিছুটা অনিশ্চয়তা নিয়ে রুমের ভেতর এগুতে নিলেই ধমকা একটা বাতাসে দরজাটা আচমকা লেগে গেল। ফলস্বরুপ নাকে দরজা লেগে খুব ব্যথা পেল সনিয়া। নাকটা চেপে ধরে ড্রইং রুম পার হয়ে নিজের রুমে এগুতে নিলে অদ্ভুত  আরেকটা আওয়াজ আসলো। তার ভয়ে গা ছমছম করতে লাগল। বেশ সাহস করে দরজায় নক দিয়ে বলল

- ভাইয়া... কিছু কী হয়েছে? কিসের শব্দ?

ভেতর থেকে কোনো আওয়াজ আসছে না। বিরক্ত নিয়ে পেছন তাকাতেই সনিয়ার ভয়ে হাত পা কাঁপতে লাগল। কারণ তাসকিন তার পেছনে তাহলে এতক্ষণ  ঘরে কে ছিল? কেই বা উপুর হয়ে শুয়ে ছিল? ভয়ে ঢুক গিলতে লাগল। তাসকিন সনিয়ার ভয়ার্ত চেহারা দেখে হালকা হেসে বলল

- দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কী করছিস?

সনিয়া কিছুটা আমতা আমতা করে বলল

- নাহ মানে এমনিতে। তুমি কোথায় ছিলে এতক্ষণ? 

- কেন ছাদে। কিছু কী হয়েছে?

- নাহ! তেমন কিছু না। আচ্ছা আমি গেলাম। 

সনিয়া ভয়ে ভয়ে রুমের দিকে এগুতে লাগল।।এমন সময় দরজা খোলার আওয়াজ পেল। সে পেছন তাকাল। লক্ষ্য করল তাসকিন দরজা খুলে বের হয়েছে। সনিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল

- কী রে ডাকছিলি কেন? গরমে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মেঝেতেই।

সনিয়া  অবাক হলো। তাসকিনের সামনে গিয়ে বলল

- তুমি রুমে ছিলে?

তাসকিন কপাল কুঁচকে বলল

- তাহলে থাকব কোথায়? 

সনিয়ার তাসকিনকে ভালো করে লক্ষ্য করল। হাতের দিকে তাকাতেই লক্ষ্য করল নখের অগ্রভাগ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে মেঝেতে পড়ছে। বেশ ভয়ে ভয়ে বলে উঠল

- ভাইয়া তোমার নখে কী হয়েছে?

তাসকিন নিজের নখের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বলল

- একটু কেটে গেছিল। যা রুমে যা। 

সনিয়া রুমের দিকে এগুলো। তাসকিন দরজাটা লাগিয়ে দিল।  সনিয়া আবার পেছন এসে দরজার সামনে কৌতুহল নিয়ে দাঁড়াল। ভেতর থেকে কতগুলো অদ্ভুত  আওয়াজ আসছে। কখনও কুকুর, বেড়ালের কান্না,কখনও বাচ্চার কান্না,কখনও ব্যাঙের শব্দ,কখনও বা বাস ট্রাকের হর্ণের শব্দ। তার অবচেতন মনে প্রশ্ন জাগছে শব্দগুলো কিসের? প্রায় অনেকক্ষণ  দাঁড়িয়ে আছে সে। এত শব্দ হচ্ছে তবে আশেপাশের কেউ ঘুম থেকে কেন উঠছে না ।  সনিয়ার ভয়ে গা হাত পা কাঁপতে শুরু করল। প্রায় আধা ঘন্টা যাবত এমন শব্দ আসছে। আচমকা দরজাটা খুলে গেল। সে লক্ষ্য করল তাসকিন শূন্য ভাসছে। তার গলায় দঁড়ি দিয়ে পেঁচানো। তার গা, হাত,পা কাঁপতে শুরু করল। চিৎকার করলেও যেন গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছিল না। তাসকিনের শরীর আপনাআপনি ফ্যানের সাথে ঝুলে গেল। একটা বাচ্চা শুধু হামাগুড়ি দিয়ে বের হতে দেখল সে। তার বুক ভার হয়ে গেল। ভয়ে নিঃশ্বাস নিতে পারছিল না। এমন সময় তার চাচাত বোন তোহা তাকে ধাক্কা দিয়ে বলল

- কী রে সনিয়া কী হয়েছে? এমন করছিস কেন? খারাপ লাগছে নাকি।

সনিয়া ঘুম থেকে আচমকা উঠল। তাহলে কী সে স্বপ্ন দেখছিল! সে হতচকিয়ে উঠে বসল। তোহা সনিয়ার হাত ধরে বলল

- কী রে কাঁপছিস কেন? খারাপ স্বপ্ন দেখেছিস নাকি?

সনিয়া তোহার হাত ধরে ঢুক গিলে বলল

- অনেক খারাপ স্বপ্ন দেখেছি। মনে হয়নি এটা স্বপ্ন। শরীর খারাপ লাগছে অনেক। তাসকিন ভাইয়ার রুমে চল একটু।

- এত রাতে যাওয়া কী ঠিক হবে? উনি তো ভুল বুঝতে পারেন। রাগ ও করতে পারেন। বিরক্তও হতে পারেন।

- প্লিজ চল। ভাইয়াকে না দেখা পর্যন্ত আমার শান্তি লাগবে না। 

তোহা অগত্যা সনিয়ার সাথে যেতে বাধ্য হলো। তাসকিনের রুমটা খোলা ছিল। রুমটায় পর্দাটা সরানো। রুমটার ভেতরে তাকিয়ে দেখল তাসকিনের লাশটা ঝুলছে। তার মানে সনিয়ার এটা স্বপ্ন ছিল না, সত্যি ছিল। সনিয়া আর তোহা জোরে চিৎকার দিয়ে উঠল। নিজের অজান্তেই কাঁদতে লাগল। তখন রাত সাড়ে তিনটে বাজে। তাদের চিৎকার শুনে বাকিরা ঘর থেকে বের হয়ে আসে। সনিয়া কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে বসে পড়ে। এমন সময় তার চোখে পরিলক্ষিত  হলো একটা বাচ্চা হামাগুড়ি দিয়ে যাচ্ছে। সে আরও জোরে কেঁদে উঠল। সে সাথে তোহার দিকে নজর দিয়ে দেখল তোহার মুখ অবয়বে কেমন জানি জালের মতো আবরণ। চোখগুলো কেমন লাল। সে সময়টায় বাকিরা এসে তাসকিনের এ অবস্থা দেখে চমকে উঠে। তাসকিনের বাবা, মা দুজনেই জ্ঞান  হারায়। এখন পর্যন্ত  তাদের জ্ঞান  ফিরে নি। 

সনিয়ার ঘটনাটা শুনার পর থেকে আয়েশার মাথায় এটাই জাগছে এটা কোনো স্বাভাবিক  মৃত্যু না। এ মৃত্যুর পেছনে কোনো রহস্য অবশ্যই আছে। সনিয়া সবটা বলে ততক্ষণে  চুপ হয়ে চোখের জল ফেলছিল। আর আয়েশা পাথরের মতো বসে হাজারটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিল। সবকিছুর উত্তর মেলাতে গেলেও যেন পারছিল না। নিজের অজান্তেই বুক কেঁপে উঠছিল বারবার। সহুরা বেগম আয়েশার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতে লাগল

- চল মা আর কত বসে থাকবি।

আয়েশা মায়ের কথায় তেমন কর্ণপাত করল না। নিজের ভেতরে থাকা প্রশ্নের ঘূর্ণিপাকে তলিয়ে যাচ্ছিল। পাশ ফিরে তাকিয়ে তোহাকে লক্ষ্য করল। তোহার মুখ অবয়ব দেখে আয়েশার বুকটা ছেদ করে উঠল। একে কেন জানি না স্বাভাবিক লাগছে না। তোহার হাতের দিকে তাকাল সে। মুঠো করে কিছু একটা হাতে রেখেছে। সন্দেহ আয়েশার আরও বেড়ে গেল। বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে চারপাশে। কোনো শব্দ নেই। আস্তে আস্তে তোহার কাছে যেতে ঘটে গেল একটা আশ্চর্য  ঘটনা। 

video here for youtube 

 গল্পের নাম রজনী

লেখিকা শারমিন আঁচল নিপা

পর্ব- 3 পর্ব ,

আস্তে আস্তে তোহার কাছে যেতেই ঘটে গেল এক আশ্চর্য  ঘটনা। তোহার মুখটা কেমন জানি কালচে জালের মতো অবয়ব হয়ে গেল। তোহা তার  চোখের দিকে তাকাতেই তার বুক যেন কেঁপে উঠল। কারণ তোহার চোখ গুলোর সাদা অংশ কালো বর্ণ ধারণ করেছে। সে  তোহার দিকে তাকিয়ে নম্র সুরে বলল

- তুমি কে? তোহার মধ্যে তুমি কী অন্য কেউ?

সাথে সাথে তোহার রুপ স্বাভাবিক  হয়ে গেল। তোহা কিছুটা বিস্ময় নিয়ে বলল

- আয়েশা ভাবি কী বলছেন?

আয়েশা যেন হুঁশ ফিরে পেল। নিজেকে সামলে তোহার হাতের দিকে কৌশলে লক্ষ্য করল। তার হাত দুটো কেমন যেন হয়ে আছে। হাতের ভেতর মুঠো করা কিছু কালো বস্তু লক্ষ্য করল সে। তার দম ভারী হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যেই সহুরা বেগম আয়েশাকে ধরে বলল

- কী রে কী হয়েছে তোর? এমন করছিস কেন? 

আয়েশা নিজেকে সামলে বলল

- কিছু না।

সহুরা বেগম আয়েশাকে ধরে ঘর থেকে বের হলেন। তবে আয়েশার মন থেকে তোহার বিষয়টা সরছে না। তাসকিনের মৃত্যু তাকে যতটা না কষ্ট দিচ্ছে তার চেয়ে বেশি কষ্ট দিচ্ছে তাসকিনের মৃত্যু রহস্য কী সেটার প্রশ্ন মেলাতে গিয়ে। সে বাড়ির পথ ধরে হাঁটছে। বিয়ে বাড়িটা নির্জীব হয়ে গেছে৷ আলো জ্বলছে তবে সে আলোতে যেন সবকিছু আরও অন্ধকার হয়ে গেছে।  আনমনে সহুরা বেগমের হাত ধরে সে হেঁটে যাচ্ছে গন্তব্যের দিকে। বুকের ভেতরটা দুমরে মুচরে যাচ্ছে। কান্নাগুলো বৃষ্টি হয়ে নামলে হয়তো ভারী পাথরটা বুক থেকে নামত। তবে কান্না যেন চোখ দিয়ে বের হচ্ছে না। উল্টো কষ্টে তার বুক ফেটে চৌচির। পৃথীবিতে সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক বিষয় হলো কষ্ট গুলো বুকে জমাট বেঁধে থাকা। আয়েশা হুট করে আঁচড়ে পড়ল। তার মনে হলো কেউ একজন তাকে পেছন দিক হতে ধাক্কা দিয়েছে। আঁচড়ে পড়তেই তার চোখ মাটিতে পড়ল।  মাটিতে কালো কালো রক্তের ছোপ।  রক্ত দিয়ে যেন একটা বাচ্চার অবয়ব অঙ্কিত।  চোখের দৃষ্টি সামনে নিতেই একটা বাচ্চাকে দৌড়ে যেতে দেখল। বাচ্চাটার দাঁতগুলো কালো,ঠোঁটগুলো সেলাই করা,গায়ের বিভিন্ন জায়গায় কালো কালো কি যেন অংকন করা। মাথার পেছনের দিকটা গর্তের ন্যায়।  সে এবার বেশ জোরেই চিৎকার দিয়ে উঠল। সহুরা বেগম মেয়ের এমন আচমকা পড়ে  যাওয়া আর চিৎকার শুনে তাড়াহুড়ো  করে তাকে ধরল। তাকে ধরে তুলে দাঁড় করিয়ে হালকা জড়িয়ে ধরে বলল

- কী হয়েছে মা? এমন করে চিৎকার করে উঠলে কেন? শরীর খারাপ লাগছে কী?

আয়েশা চোখ বন্ধ করে সামনের দিকে হাত ইশারা করে বলল

- মা দেখো একটা অদ্ভুত  বাচ্চা। আমার মনে হয় এ বাচ্চাটায় তাসকিনকে মেরে দিয়েছে। তাসকিনের মৃত্যু কোনো স্বাভাবিক  মৃত্যু না। মা তাসকিনকে কোনো আত্মা মেরে দিয়েছে।

আয়েশার এমন ছন্নছাড়া কথা শুনে সহুরা বেগম তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন

- মারে সামনে কিছু নেই দেখ। তুই কী থেকে কী দেখেছিস। বেশি হতাশ হয়ে গেছিস। জোরে জোরে কাঁদ তাহলে ভালো লাগবে। সবার জীবন তো একই গতিতে যায় না। তোর কপালে এটা লেখা ছিল। মারে তুই এমন করিস না। আমার যে কলিজা ফেটে যায়।

মায়ের কথা শুনে আয়েশা সামনে তাকিয়ে দেখল কেউ নেই। নীচে তাকিয়ে দেখল কোনো রক্ত নেই। তাহলে একটু আগে সে কী দেখল। এটা কী তার মতিভ্রম নাকি কল্পনার বিস্তার,নাকি নিছক ভাবনার অভিব্যক্তি। সে নিজেকে সামলালো। মায়ের হাতটা শক্ত করে ধরে বলল

- চলো.... বাসায় চলো।

সহুরা বেগম আয়েশাকে জড়িয়ে ধরে এগুতে লাগল। আয়েশার বুকটা ভেদ করে যেন কোনো ছুরি ঢুকে আটকে গেছে মনে হচ্ছে। সেটার যন্ত্রণা  অনেক প্রখর তবে বুঝতে পারছে না কী করে নিজেকে সামলাবে। এ যন্ত্রণা  থেকে মুক্তি পাবে। তাসকিনকে এভাবে হারাবে সেটা তার ভাবনার বাইরে ছিল। নিজের ভেতরটা পুড়ে ছাই হয়েও যেন দাউদাউ করে জ্বলছে।

বাসায় আসার পর থেকে সারা বাড়ি চুপ হয়ে গেল। থমথমে পরিবেশ। আত্মীয় স্বজন আস্তে আস্তে চলে যেতে লাগল। যেসব অতিথিদের দাওয়াত করা হয়েছিল সবাইকে আবার না করে দেওয়া হলো। আয়েশার ভেতরটা পুড়তেছে শুধু। কেউ কেউ আয়েশাকে পরোক্ষভাবে  নিজের হবু বরের মৃত্যুর জন্য দায়ী করছে। কেউ কেউ অলক্ষী ট্যাগ দিয়ে দিচ্ছে। তাসকিন মরে গিয়েও যেন সবকিছুর জন্য তাকে দায়ী করে দিয়ে গেছে। 

সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামল। সারাদিন পানি ছাড়া কিছুই খায়নি আয়েশা। নিজের রুমের মেঝেতে বসে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে সে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে । খারাপ লাগলেও কাঁদতে না পারার যন্ত্রণায় ভুগছে।  এমন সময় তার খালাত বোন তূর্ণা এসে জানাল তাসকিনকে রাতে কবর দেওয়া হবে। তূর্ণার কথা শুনে তার বুকটা যেন আরও ভার হয়ে গেল। হালকা গলায় বলল

- রিপোর্ট কী বলে?

- আশ্চর্য  হলেও সত্যি যে রিপোর্টে  নাকি আসছে তাসকিন ভাইয়ার হত্যা হার্ট এটাকে হয়েছে। তবে তাসকিন ভাইকে তো ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে। গলায়ও তেমন বিশেষ দঁড়িয় কোনো আঘাত বা চিন্হ পাওয়া যায়নি। বিষয়টা অবিশ্বাস্য হলেও ময়না তদন্তের রিপোর্ট এমন কিছুই বলছে। 

তাসকিনের মৃত্যু স্বাভাবিক  না সেটা আয়েশার এবার দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস হতে লাগল। তূর্ণার হাত ধরে বলল

- আমি তাসকিনকে আরেক নজর দেখতে চাই। আমাকে একটু নিয়ে চল।

- খালা, খালু না করেছিল তোকে বলতে। আর বলেছে যেতে চাইলেও যেন নিয়ে যাওয়া না হয়। তোর মানসিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে। 

- তুই একটু লুকিয়ে আমাকে বের কর প্লিজ। আমি তাসকিনকে শেষ দেখা দেখতে চাই।

আয়েশার আবদারের কাছে তূর্ণা যেন গলে গেল। তাই মৃদু সুরে বলল

- এ দরজাটা লাগিয়ে দে। পেছনের দরজা দিয়ে বের হব আমরা। রাত নয়টায় জানাজা। এখন তো আটটা বাজে সবে। আমরা ৮ টা ৪৫ এ রওনা দিব। আমি এখন খালা খালুকে বলে আসি যে তুই ঘুমিয়ে পড়েছিস আর আমি তোর সাথে ঘুমিয়ে যাব। তারপর দরজা লাগিয়ে দিব। তারা তো ভাববেই আমরা ঘুমিয়ে গেছি। তারপর আমরা মুখ ঢেকে পেছন দরজা দিয়ে বের হয়ে যাব। খালু তো মনে হয় জানাজায় যাবে। তাই বিকল্প রাস্তা ধরে যাব।  যাতে কেউ দেখতে না পারে।

আয়েশা তূর্ণাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল

- আমার জীবনটা কেন এমন হলো রে? আমার তাসকিনকে আমি পাওয়ার আগেই হারিয়ে ফেললাম। কলিজাটা যে ফেটে যাচ্ছে আমার।

- শান্ত হ তুই। এমন করিস না। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য। 

- এত ভালো তো আমি চাইনি।

- শান্ত হ আয়েশা। নিজেকে কনট্রোল কর। 

আয়েশা নিজেকে সামলে নিল। তূর্ণা সহুরা বেগম আর আয়েশার বাবাকে ঘুমের কথা বলে দরজা লাগিয়ে দিল।

রাত তখন ৮ টা ৪৫।  দুজনে কালো উড়না দিয়ে মুখ পেঁচিয়ে বিকল্প রাস্তা দিয়ে হাঁটতে শুরু করল তাসকিনদের বাসায় যাওয়ার জন্য। এ রাস্তা মূলত ছোট গলি হওয়ায় চলাচল কম। এ সময়টায় এ গলিটা বেশ জণশূন্য। আশেপাশে কেউ নেই। গলিটা এমন সরু যে পাশাপাশি  দুজন হেঁটে যাওয়াও মুশকিল। আয়েশা সামনে হাঁটছিল আর তূর্ণা পেছন পেছন হাঁটছিল।  এমন সময় তূর্ণার পা ধরে কেউ একজন হেঁচকা টান দিল। তূর্ণা তাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেল আর আয়েশার কামিজের এক অংশ টেনে ধরল। আয়েশা আচমকা জামায় টান পেয়ে পেছন ফিরল। পেছন ফিরতেই তার শরীর হিম হয়ে যেতে লাগল,

 গল্পের নাম রজনী

লেখিকা শারমিন আঁচল নিপা

পর্ব- 4পর্ব ,

পেছন ফিরতেই তার শরীর হিম হয়ে যেতে লাগল। কারণ তূর্ণা মাটিতে আঁচড়ে পড়ে উপুর হয়ে আছে। তার উপরেই একটা মানব শিশু দাঁড়িয়ে খিলখিল করে হাসছে। ঠোঁটগুলো কাঁটা। উপরের ঠোঁটটা নাকের নীচের চামড়ার সাথে সেলাই করা এবং নীচের ঠোঁটটা থুতুনীর চামড়ার সাথে সেলাই করা। দাঁত গুলো কালো কুঁচকু্চে। ফর্সা চেহারায় কালো দাঁতগুলোকে অনেকটা বেশি বিশ্রি ভাবে পরিলক্ষিত  হচ্ছে। চোখ আছে তবে চোখের পাতা নেই। চোখের ভেতরের অংশ বিপরীত পরিক্রমায় চলছে। অর্থাৎ  কালো লেন্সটা সাদাটে হয়ে আছে আর সাদা অংশটা কালো হয়ে আছে৷ গালের এক পাশে লাল রেখা আঁকা। বাচ্চাটার উচ্চতা ২ ফিটের বেশি হবে না। পা দুটো উল্টো করা। এক হাতে আঙ্গুল গুণে গুণে দশটা হবে। প্রতি দুটো আঙ্গুল জোরা লাগানো। দু হাতে হিসাব অনুপাতে ২০ টা আঙ্গুল। পা জোরা আঙ্গুল বিহীন। শরীরের বিভিন্ন অংশে লাল রেখা টানা। বাচ্চাটার হাসির শব্দ প্রবল হতে লাগল। তূর্ণা মাটিতে পড়ে আর উঠতে পারছে না। দম নিতে তার কষ্ট হচ্ছে। আর এদিকে আয়েশা স্তবির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এটা কী তার কল্পনা নাকি সত্যি সেটার বিস্তার বিবেচনায় ব্যস্ত সে। কী করবে তার বোধগম্য হচ্ছে না। নিজের অজান্তেই চুপ হয়ে গেল। শরীরটা কাঁপছে। হাত, পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। চিৎকার দেবার মতো গলা দিয়ে আওয়াজ তার বের হচ্ছে না। মাথায় তীব্র ব্যথা আঁচ করতে লাগল। এমন সময় তূর্ণা বেশ সাহস করে নিজের হাতটা বাড়িয়ে আয়েশার পা টা টেনে বলল

- আয়েশা আমায় বাঁচা। এ ভার যে সহ্য করা ভীষণ কঠিন। দম নিতে পারছি না। স্তবির হয়ে দাঁড়িয়ে  থাকিস না। বড্ড অস্থির লাগছে। অশান্তি হচ্ছে অনেক।

তূর্ণার ডাকে আয়েশার হুঁশ ফিরল। নিজেকে দ্রূত স্বাভাবিক  করল। হাত পা যদিও কাঁপছে তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে হাতটা বাড়িয়ে বাচ্চাটাকে ধাক্কা দিতে নিল। বাচ্চাটাকে স্পর্শ  করার সাথে সাথে বাচ্চাটা আয়েশার হাত খাঁমচে ধরে আয়েশার হাতেই ঝুলে পড়ল। আয়েশা হাতটা  থেকে বাচ্চাটাকে ছাড়ানোর জন্য বেশ শক্তি খাটাতে লাগল। সে সময়টায় তূর্ণা নিজেকে সামলে উঠে নিল। লক্ষ্য করল আয়েশার হাতে কামড় দিয়ে বাচ্চাটা ঝুলে আছে। তূর্ণা সাহস করে বাচ্চাটাকে টেনে হিঁচড়ে আলাদা করে জোরে ছুরে মেরে আয়েশাকে বলল

Horror video

- সামনের দিকে চল। দৌড় দে।

আয়েশার ভাবান্তর হওয়ার আগেই বেশ উদ্রেগ নিয়ে দৌঁড় লাগাল।  তূর্ণাও পেছন পেছন দৌড়ে যেতে লাগল। বেশ খানিকক্ষণ  দৌড়ে গলির মাথায় আসলো। এখন রাস্তাটা বেশ পরিষ্কার লোক  সমাগম আছে রাস্তায়। দুজনেই হাঁপাতে লাগল। তূর্ণা আয়েশার হাতের দিকে লক্ষ্য করল। রাস্তায় জ্বলে উঠা আলোতে আয়েশার হাতটা বেশ স্পষ্ট হয়ে দেখা যাচ্ছে।।রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। রক্তক্ষরণ ও হচ্ছে। সে আয়েশার হাতটা চেপে ধরতেই আয়েশা আহ্ করে উঠল। এতক্ষণ  তার ব্যথা অনুভব হয়নি। তবে এখন তূর্ণার কিয়ৎ স্পর্শে তার ব্যথা বেশ ভালোই অনুভব  হচ্ছে। চোখ দিয়ে তার পানি গড়িয়ে পড়ছে। আয়েশা উড়নার এক অংশ দাঁত দিয়ে হালকা কেটে তারপর সেটা ফালি করে আয়েশার হাতটা বেঁধে দিয়ে বলল

- তাসকিন ভাইয়ার মৃত্যু স্বাভাবিক  না আয়েশা। কোনো গোলমাল অবশ্যই আছে। বাচ্চাটার সাথে মৃত্যু রহস্য অবশ্যই আছে। আমরা এসব বললে কেউ বিশ্বাস করবে না। বিষয়গুলো রাতের আঁধারেই হয় আবার রাতের আঁধারেই তলিয়ে যায়। 

আয়েশা হালকা দম নিল। হাতের ব্যথাটা প্রবল হলেও সে নিজেকে দমিয়ে নিল। বেশ স্বাভাবিক  সুরেই বলল

- প্রথম থেকেই আমার এ সন্দেহ হচ্ছিল। তাসকিন আমাকে ভালোবাসে সে কেন আত্মহত্যা করবে। সনিয়ার কথা, তারপর তোহার অদ্ভুত  আচরণ আমাকে বেশ রহস্যে তলিয়ে নিয়েছিল। আমি জানি যা হচ্ছে সেটা স্বাভাবিক  না। কিছু তো আছে যেটা আমাদের জানার বাইরে। 

আয়েশার কথা শুনে তূর্ণার মাথায় অনেক কিছুই ঘুরছে। তবে সেটা আয়েশাকে প্রকাশ না করে হালকা গলায় বলল

- ৯ টার উপর বাজে। জানাজা হয়তো শেষ। 

তারপর রাস্তা দিয়ে তাকিয়ে দেখল মানুষ সব দলে দলে গন্তব্যে ফেরার পথে। তূর্ণা মানুষগুলোকে ইশারা করে বলল

- দেখ এরা হয়তো জানাজা শেষে বাড়ি ফিরছে।  

তূর্ণার কথা শুনে আয়েশার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। নিজের ভালোবাসার মানুষটার মুখটা সে আর দেখতে পারল না। বেশ কষ্ট নিয়ে সে তূর্ণাকে বলল

- কবরটা দেখে আসি। আর তো কিছু দেখার সুযোগ পাব না। এতসব ঘটে গেল।  কপালটায় খারাপ আমার।

- মন খারাপ করিস না। রাস্তার মানুষজন গিয়ে নিক। তারপর তুই আর আমি গিয়ে দেখে আসব। ভয় ও লাগছে অনেক। বাসায় ফিরব কী না সেটাও ভাবছি।

তূর্ণার কথা শুনে আয়েশা তার হাতটা চেপে ধরে বলল

- এমন বলিস না। যা হওয়ার হবে আমাকে একটু তার কবরের মাটিতে স্পর্শ করতে দে। আর কিছু চাই না।

তূর্ণা আর কথা বলতে পারল না। ভয়ে তার গা ছমছম করলেও আয়েশার আবেগের কাছে যেন সব হেরে গেল।

তারা দুজন  কিয়ৎক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। লোকের ভীর যখন কমল, রাস্তাটা যখন ফাঁকা হলো ঠিক তখন দুজন হেঁটে কবরের কাছে গেল। তাসকিনের কবরটা তাদের পারিবারিক  কবরস্থানেই দেওয়া হয়েছে। চারদিক থেকে গোলাপ জলের গন্ধ আসছে। সে সাথে শীতল হাওয়া। হালকা হালকা বৃষ্টি কণা পড়ছে।  সবমিলিয়ে পরিবেশটা বেশ শান্ত শীতল।

এদিকে আয়েশার বাবা জানাজা থেকে ফিরে হুহু করে কেঁদে দিল। সহুরা বেগম আয়েশার বাবাকে এভাবে কাঁদতে দেখে আস্তে করে তার কাছে এসে বললেন

- তুমি কান্নাকাটি করো না দয়াকরে। আয়েশা ঘুমুচ্ছে। তোমার কান্নার আওয়াজে ও উঠে কান্না করবে। তুমি চুপ হও।

আয়েশার বাবা চোখের জল মুছতে মুছতে বলল

- কান্না তো সাধে করছি না। তাসকিনের লাশ চেনার উপায় নেই। কেউ কেউ তো বলছে লাশটা বদল হয়ে গেছে এটা তাসকিন না। মুখটা যে পুড়ে রয়েছে। তবে যে হাসপাতালে ময়না তদন্ত করেছে তারা বলেছে লাশটা নেওয়ার কিছুক্ষণ  পর নাকি এমন হয়েছে। জানি না কী হয়েছে। বুকটা ছটফট করছে। মেয়েটা আমার এ যন্ত্রণা  কীভাবে সহ্য করছে জানি না। ভালোই হয়েছে যেতে দেইনি। নাহয় এ লাশটা দেখলে ও আরও সহ্য করতে পারত না। 

সহুরা বেগম ও মুখ চেপে কেঁদে বললেন

- যে মায়ের বুক খালি হয়েছে তাদের যেন কেমন লাগছে আল্লাহ জানেন। 

- তাদের জ্ঞান  এ ফিরছে এই যাচ্ছে। সনিয়া তো চুপ হয়ে গেছে। আয়েশার মতো সেও হয়তো কাঁদতে পারছে না। কী থেকে কী যে হয়ে গেল। জীবনটা এত কঠিন কেন।

সহুরা বেগম নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন

- থাক এবার ঘরে চলো। আয়েশা ঘুমুচ্ছে ঘুমাক। ওর কান পর্যন্ত  আর নিও না। সারাদিন কিছু খায়নি। এমনি ক্লান্ত অনেক। ঘুম না হলে ও আরও অসুস্থ হয়ে যাবে।

আয়েশার বাবা আর কথা বাড়াল না। ঘরে গিয়ে দুজন বসে রইল চুপ হয়ে।

এদিকে তূর্ণা আর আয়েশা পৌঁছে গেল কবরের কাছে। কবরের কাছে যেতেই আয়েশা কোমল স্পর্শ  অনুভব করলো কাঁধে। পেছন ফিরে তাকাতেই দেখল তাসকিন। খানিকটা ভয়ও পাচ্ছিল। তবুও সাহস নিয়ে স্তব্ধ সুরে বলল

- তুমি না মরে গেছো তাহলে কে তুমি?

তাসকিন গলাটা ভার করে বলল

- আমার সাথে যা হয়েছে শুনবে না? আর তুমি ছাড়া আমি কারও সামনে দৃশ্যমান হব না। এমন কি তূর্ণার সামনেও। 

তূর্ণা শুধু কন্ঠস্বরের আওয়াজ পেল। তবে আশেপাশে কাউকে দেখতে পেল না। যদিও তূর্ণা দুজনের কথোপকথোনে বুঝতে পারছে এটা তাসকিন। বেশ অগোছালো গলায় তূর্ণা বলে উঠল

- আপনার সাথে কোনো খারাপ কী হয়েছে? প্লিজ বলুন।

তূর্ণার কথায় তাসকিন বলে উঠল

- আমি মৃত নাকি জীবিত বুঝতে পারছি না। আমার জানাজা হয়েছে নাকি অন্য কারও তাও আমি বুঝতে পারছি না। আমি কারও সামনে দৃশ্যমান হতে পারছি না। একমাত্র আয়েশা আমাকে দেখতেছে। আমার আওয়াজ কারও কানে পৌঁছাচ্ছে না। তোমাদের দুজন ব্যতীত কেউ আমাকে উপলব্ধি  করতে পারছে না। তবে আমার মনে হচ্ছে আমি মরিনি৷ 

আয়েশা তাসকিনের এমন কথা শুনে বেশ অবাক হয়ে বলল

- কী এমন হয়েছিল। আর সে লাশটা কার? আর কে তোমার রুমে ঝুলে ছিল। আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না। এটা আমার কল্পনা নাকি মতিভ্রম সেটা বুঝারও অবকাশ পাচ্ছি না। 

তাসকিন আশ্বস্ত করে বলল আয়েশার সামনে তাসকিনেই আছে আর এটা বাস্তবতা। তারপর নিজের সাথে ঘটে যাওয়া এক ভয়ংকর কাহিনির বর্ণণা দিল। আয়েশা কাহিনিটা শুনে থমকে গেল। গা হিমহিম করছে।  সত্যিই কী এটা সত্য নাকি তার কল্পনা। নাকি আরও গভীর রহস্যে তলিয়ে গেল।

 গল্পের নাম রজনী

লেখিকা শারমিন আঁচল নিপা

পর্ব- 5পর্ব 

নাকি আরও গভীর রহস্যে তলিয়ে গেল। 

তাসকিন সেদিন আয়েশার সাথে কথা বলে ফোনটা রাখল। চুপ হয়ে আনমনে শুয়ে আয়েশার কথা ভেবে চোখটা বন্ধ করল। এমন সময় তার মনে হলো কেউ একজন তাকে ডাকছে। খুব মৃদু মিষ্টি সুরে। কিছুটা অসাবধান হয়েই চোখটা খুলল। দেয়ালে এক নারীর প্রতিবিম্ব ভেসে উঠল। সে কিছুটা বিস্ময় নিয়ে তাকাল। প্রতিবিম্বের উৎস খুঁজতে লাগল। এমন সময় তাসকিনকে কেউ একজন ডাক দিল। লক্ষ্য করল ছাদ থেকে তুষার ডাকছে। সে সরাসরি উঠে ছাদে গেল। সেখানে গিয়ে লক্ষ্য করল বন্ধুরা সবাই বেয়ার এনেছে। তাকে এগিয়ে দিলেও সে না নিয়ে হালকা হেসে বলল

- কাল বিয়ে আজ এসব খাওয়া যাবে না। আয়েশা রাগ করবে।

বন্ধু মহলের সবাই হেসে জবাব দিল

- এখনই তো বউ ভক্ত হয়ে গেলি। 

তাসকিন মৃদু হেসে বলল

- সে নাহয় একটু হলাম। তোরা থাক বড্ড ঘুম পাচ্ছে আমার। 

বলেই চলে আসলো রুমে। আসার সাথে সাথে নিজের মতো একজনকে উপুর হয়ে শুয়ে থাকতে খেয়াল করল। কিছু ভয় নিয়ে জিজ্ঞেস  করল

- তুমি কে?

লোকটা উপুর হওয়া থেকে তাসকিনের দিকে তাকাল। তাসকিনের ভয়টা আরও বেড়ে গেল। এতক্ষণ  মনে হয়েছিল লোকটা নিজের গড়নের। এখন তো মনে হচ্ছে লোকটা তার মতো চেহারার অধিকারি। সে ভয়ে পিছিয়ে গিয়ে বলল

- কে তুমি?

লোকটা খিল খিল করে হেসে কী একটা যেন তাসকিনের দিকে ছুড়ে মারল। তাসকিনের নাকে সাথে সাথে কোনো এক সুঘ্রাণ ভেসে আসলো । তারপর থেকে তার মনে হতে লাগল সে শূন্যে ভাসছে। অদৃশ্য  কেউ। এরপর এত সব ঘটনা তার চোখের সামনে ঘটলেও সে বুঝতে পারছে না এসব কী৷ সেদিন নিজের চোখের সামনেই দেখেছিল তার মতো দেখতে লোকটা গলায় দঁড়ি দিয়ে আছে। একটা বাচ্চা এলোপাতারি দৌড় দিচ্ছে ঘরে। বাচ্চাটা কখনও হাসছে কখনও কাঁদছে৷ বাচ্চাটার লোমহর্ষক  চেহারা যেন তাকে আরও ভীতু করে দিল। এর মধ্যে তোহার আগমণ ঘটেছে কয়েকবার। তোহা এসে কী যেন বিড়বিড় করে রুম থেকে বের হয়ে যেত। ঐ লোকটা গলায় দঁড়ি দেওয়ার পরও সে ঐ লোকটার হাতে পায়ে কী যেন লিখে পানির মতো ছিটিয়ে গিয়েছিল। তোহার এসব আচরণের কারণ বুঝতে পারছিল না তাসকিন। সে ঘটনার পর থেকেই তাসকিন অদৃশ্য।  একবার মনে হচ্ছে সে সত্যি সত্যি বেঁচে নেই আবার মনে হচ্ছে সে বেঁচে আছে। 

তাসকিনের ঘটনাটা তূর্ণা আর আয়েশার জানার পর চুপ হয়ে গেল। এটার সাথে তোহা জড়িত তারা দুজনেই বুঝতে পারছে। কিন্তু তোহার লাভটা কী? তূর্ণা আচমকা বলে উঠল

- এমনও তো হতে পারে তাসকিন ভাইকে তোহা পছন্দ করে তাই কালো জাদু করেছে। যাতে করে বিয়েটা আটকে যায় এবং তাসকিন ভাইও তোহার বশে আসে। 

তূর্ণার কথা শোনে আয়েশা ভাবার্ত গলায় বলল

- এমন কিছু হওয়ার সম্ভবনা নেই। তোহা বিবাহিত আর তোহার স্বামীর সাথে তোহার বিয়ে হয় ৫ বছরের ভালোবাসার পর। তাদের স্বামী ও স্ত্রীর  সম্পর্কে যথেষ্ট মিল মহব্বত রয়েছে। আর তাসকিনকে তোহা নিজের ভাইয়ের মতো দেখে। এমনও হতে পারে তোহার মধ্যে অন্য কেউ আছে যে তোহাকে দিয়ে এসব করাচ্ছে। সে বাচ্চাটার  সাথে কোনো না কোনো রহস্য তো রয়েছেই। 

আয়েশার কথা শোনে তূর্ণা চুপ হয়ে গেল। কী বলবে বুঝতে পারছে না। এ মুহূর্তে  করণীয় কি সেটাও তার বোধগম্য হচ্ছে না। কিছুটা অনিয়শ্চয়তার সহিত বলল 

- তোহাকে লক্ষ্য করলে হয়তো রহস্যের উদঘাটন করতে পারব। তাসকিন ভাইয়া তো অদৃশ্য আপনি নাহয় ওকে লক্ষ্য করুন।

তাসকিন সব আশায় জল ঢেলে জবাব দিল

- আমি তোহার আশে পাশের ঘেষতে পারব না। এ কবরস্থানের  বাইরেও যেতে পারব না। শুধুমাত্র রাতে আয়েশার সামনে দৃশ্যমান হতে পারব। সারাদিন আমি চাইলেও কিছু করতে পারব না। কারণ আমি ঘুমন্ত হয়ে পড়ব হয়তো। সারাদিন কীভাবে কাটবে বলতে পারব না। 

আয়েশা চুপ হয়ে আছে। এখানে বেশিক্ষণ  থাকাও তার জন্য শুভ নয়। কারণ এ রহস্য উদঘাটন তাকে একাই করতে হবে। এ রজনীর/রাতের রহস্য বের করতে তাকে অনেক ভাবতে হবে। তোহার উপর নজর দিতে হবে। এখন কী তাসকিনদের বাসায় যাবে নাকি নিজের বাসায় সেটাই ভাবছে সে। আয়েশার নীরবতা টের পেয়ে তূর্ণা বলে উঠল

- তোর কী হয়েছে আয়েশা। এত চুপচাপ কেন? কিছু বল। 

আয়েশা বেশ নির্জীব গলায় উত্তর দিল

- এখন এখানে আর নয়। চল বাসায় যাই। বাচ্চাটা বারবার আক্রমণ করবে এটা আমি জানি। ঐ বাচ্চাকে ঘিরেই রয়েছে এ রাতের রহস্য। 

তারপর তাসকিনের দিকে তাকিয়ে বলল

- তুমি এখানে থাকো। কালকে আবার দেখা হবে। কিছু হবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে।

বলেই আয়েশা তূর্ণাকে নিয়ে বাসায় আসলো। বাসায় আসার সময় তেমন কোনো ভৌতিক কাহিনি ঘটল না। ঘরে বসে সে হজারটা কথা ভাবতে লাগল।  তোহার সাথে বাচ্চাটার সম্পর্ক কী! তোহাকে কী কেউ বশে নিয়ে এমন করছে নাকি তোহা নিজেই কোনো স্বার্থ হাসিলের জন্য এমন করছে। তোহা তাসকিনের ক্ষতি করতে পারবে সেটা আয়েশা ভাবতে পারছে না৷ যতই চিন্তা করছে ততই সে যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। চিন্তার এক পর্যায়ে সে বেশ কড়া একটা ঘুম দিল। সকালে তার ঘুম ভাঙলো তূর্ণার ছটফটানি ডাকে। সে তাড়াহুড়ো  করে শুয়া থেকে উঠে বসে তূর্ণাকে জিজ্ঞেস  করল

- কী রে কী হয়েছে তোর? এভাবে ডাকছিস কেন? আর এত হাঁপাচ্ছিস কেন? 

তূর্ণা বেশ জোরে জোরে দুইটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল

- তোহা আত্মহত্যা করেছে।

তূর্ণার মুখে এমন কথা শুনে আয়েশা চুপসে গেল। তোহা আত্মহত্যা কেন করবে বুঝতে পারছিল না। বেশ কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস  করল

- আর কিছু শুনেছিস?

- আমি লাশও দেখে এসেছি। তুই ঘুমুচ্ছিলি তাই তোকে ডাক দেইনি। তাসকিন ভাইয়ের ঘরেই আত্মহত্যা করেছে। কেন করেছে কোনো কারণ জানা নেই। 

- লাশ কোথায়?

- পুলিশ নিয়ে গেছে।

আয়েশার দম যেন বন্ধ হয়ে যেতে লাগল। সব আশার আলো একেক একেক করে নিভে যেতে লাগল। তোহাকে নিয়ে যে ভাবনা ছিল তা নিমিষেই যেন মলিন হয়ে গেল। সন্দেহের দৃষ্টি তোহার দিকে থাকলেও সে এখন সন্দেহের তালিকায় মৃত। এ ঘটনার উদঘাটন করতে অবশ্যই তাকে তাসকিনদের বাসায় থাকতে হবে। তবে তার বাবা মা থাকতে দিবে বলে মনে হয় না। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না সে। কোনোরকম নিজেকে সামলে মোবাইলটা নিয়ে সনিয়াকে কল দিয়ে বলল

- আমি রাত ১২ টার পর আসলে আমাকে কী তোমার বাসায় ঢুকাতে পারবে? অনেক প্রয়োজন। 

তারপর ঘটে যাওয়া সব ঘটনা খুলে বলল।

সনিয়া বেশ আশ্চর্য  হলো। তার কাছে যেন সব ঘটনা রূপকথার ভৌতিক গল্প মনে হচ্ছে। তবে এটাই বাস্তবতা। সে হালকা গলায় জবাব দিল

- অবশ্যই পারব। আসার আগে আমাকে কল দিও। আজকে কী আসবে?

- হ্যাঁ আসব।

বলেই কলটা কাটল। সারাদিন বেশ অস্থির অস্থির করতে লাগল। দিন যেন অস্থিরতায় তার কাটছে না। অনেক অস্থিরতা নিয়েই দিনটা পার করল। রাত ১১ টা ৪৫ এ তূর্ণাকে নিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে বের হলো। তারপর তাসকিনদের বাড়ির পথ ধরে হাঁটতে লাগল। গা ছমছম করছিল দুজনের। বারবার মনে হচ্ছিল কেউ একজন পেছনে। এমন সময় আয়েশার মুখ কেউ চেপে ধরল। আয়েশা ওপাশ ফিরে তাকাতেই বরফের মতো হয়ে গেল ভয়ে আর তূর্ণা অসাড় হয়ে যেতে লাগল।

 গল্পের নাম রজনী

লেখিকা শারমিন আঁচল নিপা

পর্ব- 6পর্ব 

সেই বাচ্চাটা আয়েশার মুখ চেপে ধরে গলাটা ঝাপঁটে ধরে ঝুলে আছে। আয়েশা দম নিতে পারছে না। তার দম ভারী হতে লাগল। চোখের কোণে অশ্রু ফোটা পরিলক্ষিত  হলো।  এদিকে তূর্ণা স্তবির হয়ে গেল। কী থেকে কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। আয়েশার ভয়ে বুক কাঁপছে।।শরীরটা তার অসাড় হয়ে যাচ্ছে। বরফের মতো হয়ে হিম হয়ে যাচ্ছে। হাত, পা চাইলেও নড়াতে পারছে না। তবুও সমস্ত শক্তি খাটিয়ে হাতটা উঠিয়ে মুখে চেপে রাখা বাচ্চাটার হাত ধরে সরিয়ে চেঁচিয়ে বলল

- তূর্ণা কিছু একটা কর। এভাবে হিম হয়ে দাঁড়িয়ে  থাকিস না। বাচ্চাটাকে সরা আমার ঘাড়ের উপর থেকে। আমি একা পারছি না।

তূর্ণার যেন সম্ভিত আসলো। বরফ হওয়া শরীরটা আয়েশার কথা শুনে হালকা সচল হতে লাগল। নিজেকে বেশ সামলে বাচ্চাটাকে ধরল। আয়েশাও সমস্ত শক্তি খাটিয়ে বাচ্চাটাকে ধরে দূরে আঁচড়ে ফেলল।  বাচ্চাটা পেছন পেছন গড়িয়ে আসতে লাগল তাদের। আর তারা দুজনও দৌড়াতে লাগল। কোন পথে যাচ্ছে তাদের কোনো খেয়াল নেই। পা দুটো আর চলছে না। দুজনেই হাঁপিয়ে বসে পড়ল। পেছন দিকে খেয়াল করে দেখল বাচ্চাটা আর নেই। নিজেদের মধ্যেই যেন স্বস্তি ফিরে পাচ্ছিল দুজন। আশপাশ তকিয়ে দুজনেই বেশ আশ্চর্য  হলো। এটা কোথায়? তারা এ কোন জায়গায় আসলো! এ জায়গা তো এর আগে আশেপাশে  কখনও দেখে নি। চারপাশে ভাঙা ইটের দেয়াল বিদ্যমান। এর ভেতরে একটা ইটের স্তূপ টিলার মতো হয়ে আছে। 

- আয়েশা এর আগে কি, এমন কিছু কোথাও দেখেছিস? এটা কোন জায়গায় আসলাম আমরা?

- আমিও বুঝতে পারছি না। আমি তো কখনও এ এলাকায় এমন কিছু দেখেনি। ছোট থেকে এ এলাকায় থাকি। 

- নিশ্চয় কোনো ভৌতিক বাড়ি। হয়তো রাতে জেগে উঠে আবার দিনে হাওয়া হয়ে যায়। এমনও হতে পারে এ বাড়িকে ঘিরেই রহস্য আছে। আমরা সবসময় যা দেখি তার আড়ালে অনেক কিছুই হয় যা আমাদের জানা নেই। কী করব বুঝে উঠতে পারছি না। এ দেয়ালের ভেতর কী একবার যাব নাকি উল্টো পথ ধরব।

- ভয় তো লাগছেই। দুজন মেয়ে এমন জায়গায় ভয় লাগারেই কথা। বিপদ আপদ বলে আসে না। তবে এ জায়গাটা যেহেতু হুট করেই গড়ে উঠেছে সুতরাং এখানে লাফাঙ্গা  ছেলে থাকবে না। মাঝে মাঝে ভূতের ভয় থেকে মানুষকে ভয় বেশি হয়। একটু ভেতরে গিয়েই দেখি। হয়তো কিছু ক্লো পাওয়া যাবে।

- তুই বললে যেতে মানা নেই। রহস্যের পেছনে যখন ছুটছি তখন এমন সিদ্ধান্ত  নেওয়া বেমানান না।

দুজনেই দেয়ালের একপাশ দিয়ে ভেতরে ঢুকল। ভেতরে ঢুকতেই জায়গাটার পরিবর্তন  চক্ষুগোচর হলো তাদের। চারপাশ আলোয় ঝলমল করে উঠতে লাগল। ভাঙা সেই ইটের স্তূপ থেকে একটা মহল হয়ে গেল। মনে হচ্ছে কোনো রাজার রাজত্বে তারা দুজন। ঘর থেকে নুপুরের আওয়াজ আসছে। আয়েশার কানে আসতেই সে একটা ঘোরে চলে গেল। নিজেকে সামলে উঠতে পারছে না। দৃষ্টি সামনে রেখে শুধু এগুতো লাগল।  আয়েশার এ পরিবর্তনে তূর্ণা কিছুটা ভীত হয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে তার পেছন পেছন যেতে লাগল। মহলের ভেতরে আয়েশার অনেক তৈল চিত্র দেখে তূর্ণা অবাক হয়ে গেল। সে ভাবতে লাগল তাহলে এ ঘটনার পেছনে আয়েশার কোনো সংযোগ রয়েছে না তো!  এদিকে আয়েশাও চারপাশ খেয়াল করতে লাগল আর বিস্মিত হতে লাগল। সবকিছু তার বেশ চেনা। কিন্তু কেন চেনা তার কারণ সে পাচ্ছে না। এমন সময় একটা বাজ পাখি এসে আয়েশার চুলের এক কোণ টেনে ছিঁড়ে নিয়ে গেল। সাথে সাথে তার মনে হলো কিছু একটা তার ভেতর প্রবেশ করেছে। সে নিস্তেজ হয়ে অসাড় হয়ে গেল। আয়েশাকে মাটিতে পড়ে যেতে দেখে তূর্ণা আয়েশার কাছে গেল দ্রূত। তাকে ধরা মাত্রই সে কটমটিয়ে তাকাল। উঠেই তূর্ণার চুল গুলো টেনে ধরল। তূর্ণার বুঝতে কষ্ট হচ্ছে আয়েশা কেন এমন করছে৷ চিল্লায়ে বলতে লাগল

- আয়েশা কী হয়েছে তোর?  এমন করছিস কেন?

সাথে সাথে আয়েশা চুল ছেড়ে দিল। আয়েশার দেহটা শূন্যে ভাসতে লাগল। তূর্ণার ভয়ে হাত পা কাঁপতে লাগল। আয়েশা শূন্যে ঘূর্ণিপাক  খাচ্ছে আর তূর্ণা আস্তে আস্তে পিছুচ্ছে। তূর্ণা পিছাতে পিছাতে কিছু একটায় ঠেঁকল মনে হয়। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখল তোহা। মৃত তোহাকে জীবিত হয়ে দাঁড়িয়ে  থাকতে দেখে জোরে চিৎকার  করল। তোহা তূর্ণার হাতটা ধরে বলল

- আমি আত্মা। আমি মৃত হলেও সাহায্য করতে চাই। আয়েশার ভেতরে রজনীর আত্মা প্রবেশ করেছে। সে চাইলেও স্বাভাবিক  হতে পারবে না। আমি চাই না আমার মতো কারও জীবন এভাবে শেষ হয়ে যাক৷ আমার মধ্যেও রজনীর আত্মা ছিল কীভাবে যেন তার বশে চলে গিয়েছিলাম। একটা ভুল করার সাথে সাথে আমাকে সে খুন করে ফেলে। তুমি নিজেকে শান্ত করো। আমি তোমাকে পথ বলে দিব যেভাবে, সেভাবে কাজ করবে। 

তূর্ণা দম নিল। ভয়ে গা ছমছম করছে। তোহাকে বিশ্বাস করবে কী না বুঝতে পারছে না। তবুও ক্ষীণ গলায় বলল

- কি ভুল করেছিলে যে তোমার পরিণতি এমন হলো?

- আমার সন্তান হচ্ছিল না। ডাক্তার বলল আমি কোনোদিন মা হব না। এক সাধুর কাছে যাই। মায়ের মন তো কত কিছুই করতে চায়। একটা সন্তানের জন্য মরিয়া হয়ে উঠি। সাধু বলল যদি আমি কোনো পুরুষের বিয়ের আগের রাতে তার নাম  কাগজে  লিখে,তারপর সে নামের পাশে সাধুর নির্দেশ মতো হরফ লিখে পুড়াই তাহলে সে অদৃশ্য  হয়ে যাবে এবং তার পরিবর্তনে আরেকজনের মৃত্যু হবে। তবে তার রূপ অদৃশ্য  ব্যক্তির ন্যায় হবে। সে কে সেটা আমিও বুঝব না। তারপর সে লোকটার হাতে পায়ে কালো কালি দিয়ে তার নির্দেশ দেওয়া হরফ লিখতে হবে। লেখার পর আরও কিছু স্টেপ বলে দিবে সেভাবে আমাকে কাজ করতে হবে।

সাধুর কথা সেদিন শোনার পর থেকে আমার মাথায় শুধু বাজতেছিল কার বিয়ে হবে আর কবে সে সুযোগ কাজে লাগাব। একটা সন্তান যে আমার চাই।  নাহয় এ শূন্য সংসার কখনও পরিপূর্ণ হবে না। দুমাস কেটে গেল। আশে পাশে পরিচিত কারও বিয়ে হলো না। এদিকে আমার মাথায় শুধু সাধুর কথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। হুট করে তাসকিনের বিয়ের দাওয়াত আসে। আমি আর সুযোগটা হাত ছাড়া করেনি। আমি জানতাম তাসকিন অদৃশ্য  হবে তবে সেটা মাত্র দেড়মাসের জন্য কিন্তু সে বেঁচে থাকবে তার পরিবর্তে অপরিচিত এক ব্যাক্তি তার রূপ ধরে মৃত্যু বরণ করবে। আর কাজটা করলে আমার বাচ্চা হবে। আমি নিজেকে সামলাতে পারলাম না। কারণ যেহেতু সে মৃত ব্যক্তিকে আমি চিনব না সুতরাং সে মরে গেলে বা বেঁচে থাকলে আমার কিছু আসবে যাবে না। একটা বাচ্চার জন্য এটুকু করতে আমার বিবেকে বাঁধল না। তাসকিনের বাসায় আসার আগে আমি সাধুর কাছে গেলাম। সমস্ত নিয়ম জেনে আসলাম। নিয়ম অনুযায়ী আমি কাগজে হরফ গুলো লিখলাম  তাতে তাসকিনের নাম লিখে আতর মিশালাম। তারপর সবাই যখন ঘুমিয়ে গেল  তখন রুমের একপাশে বসে কাগজ গুলো পুড়াতে লাগলাম মোমবাতির আলোয় সে সাথে একটা আগরবাতি ধরিয়ে নিলাম। সাধু বলেছিল এ কাজ করার সময় কেউ ঘুম থেকে উঠতে পারবে না। আমিও আপন মনে কাজটা করা শেষ করলাম। কাজটা শেষে ঠিক যেমনটা চাচ্ছিলাম তেমনটায় হলো। তাসকিনের রুপ ধরে অন্য একজন মারা গেল। সনিয়াও একটা ঘোরে চলে গেছিল। কারণ তাকে আমি বিশেষ সুঘ্রাণ দিয়ে বশ করে ফেলেছিলাম। যখন সে সুঘ্রাণের বাইরে যেত তখন সে নিজের মধ্যে স্বাভাবিক  থাকত কিন্তু যখন সে সুঘ্রাণের মধ্যে থাকত তখন সে আমার বশে থাকত।এদিকে কাজ শেষে সে মৃত ব্যাক্তির হাতে পায়ে হরফ গুলো লিখে একটা বিশেষ পানি ছিটিয়ে চলে আসি। সব কিছু নিয়ম মাফিক চলছিল। তবে একটা ভয়ংকর কাজ করে ফেলি। আমাকে সাধু বলেছিল পরদিন যেন কালো কোনো কাপড় দিয়ে তাতে তার নির্দেশ মতো হরফ লিখে আতর মিশিয়ে মোমবাতিতে পুড়াই। কিন্তু আমি ভুলক্রমে আতরের পরিবর্তে গোলাপ জল দিয়ে ফেলি। আর সে ভুলের জন্য সব এলোমেলো হয়ে গেল ঘটে গেল ভয়ংকর এক ঘটনা।

কথাটা বলেই তোহা চুপ হয়ে গেল। তোহার নীরবতা দেখে তূর্ণা ছটফট গলায় বলে উঠল

- কী ঘটনা বলো আমায়।

তোহা  বলা শুরু করল। তূর্ণা যতই শুনছিল ততই তার গা শিউরে উঠছিল।

 গল্পের নাম রজনী

লেখিকা শারমিন আঁচল নিপা

পর্ব- 7পর্ব 

সেদিন তোহা যখন ভুলক্রমে আতরের পরিবর্তে গোলাপজল দিয়ে দেয় সাথে সাথে সে একটা ঝাঁকুনি অনুভব করে। কিছুটা তীক্ষ্ণ  দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে দেখল এক নববধূ দাঁড়িয়ে আছে। তবে তার অবয়ব দেখা গেলেও মুখ স্পষ্ট না। তোহা বুঝতে পারছিল না সে কে! এমন  কিছু হবে সাধু তো বলেনি। সে কিছুটা ভীত সংকিত। কী থেকে কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। হুট করেই ঘরটা কাঁপতে লাগল। মনে হচ্ছিল প্রবল মাত্রায় ভূমিকম্প হচ্ছে। সে নিজেকে সামলাতে পারছে না। বুঝতে পারছিল এটা ভূমিকম্প না। তবে কী হতে চলেছে সেটা তার আয়ত্ত্বের বাইরে। ঠিক এমন সময় তার সামনে একটা বাচ্চা আসলো। বাচ্চাটাকে দেখে সে ভয়ে কাঁপতে লাগল। একটা বাচ্চা এত হিংস্র কী করে হয় সে ভাবতে লাগল। বাচ্চাটার দুই ঠোঁট দুদিকে উল্টিয়ে সেলাই করা। দাঁতগুলো কালো বিভৎস। তোহা ভয়ে কু্ঁকড়ে যেতে লাগল। ভয়ে ভয়ে বলল

- আমি তো এমন চাইনি এটা কিসের বাচ্চা! কীভাবে আসলো!

এমন সময় তোহার কানে নববধূর বিকট হাসি ধেয়ে আসলো। হতচকিয়ে তোহা সামনের দিকে তাকাল। নববধূর রূপ এবং অবয়ব স্পষ্ট হলো নিমিষেই। সে খেয়াল করে দেখল নববধূ দাঁড়িয়ে  আছে তার রূপ ধরে। সে কিছুটা বিলম্বিত সুরে বলে উঠল

- কে তুমি?

নববধূর কান্নার রোল ভেসে আসলো তোহার কানে। তোহার ভয়ে বুক কেঁপে উঠল।  কান্নাটা এত প্রখর যে তার মাথা ধরে যাচ্ছিল। সহ্যের ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে মনে হচ্ছিল। এ শব্দ সে মোটেও সহ্য করতে পারতেছিল না। তাই চেঁচিয়ে বলে উঠল

- কান্না থামাও... কে তুমি? কেন আমার কাজে ব্যাঘাত ঘটাতে এসেছো? কী করেছি তোমার। 

এমন সময় বাচ্চাটা তোহার শরীরে ঝাপঁটে পড়ল। ঘাড়ের এক পাশ কামড়ে ধরল। সে বাচ্চাটাকে জোর খাটিয়ে ধরে দূরে আঁচড়ে ফেলল। ভয়ংকর এ পরিস্থিতি তার মানসিক শক্তি নষ্ট করে দিচ্ছিল। হাত পা কাঁপতে লাগল। গলার সুরটাও কেঁপে উঠল৷ ভয় ভয় গলায় বলে উঠল

- কে তুমি? কী চাও? আর এ বাচ্চাটা কার? কী হলো কথা কেন বলছো না!

নববধূর কন্ঠ সুর থেকে উচ্চারিত হলো

- আমি রজনী।

তোহা বিস্মিত গলায় বলল

- আমার রূপ কেন ধরে আছো? তোমার সাথে কী আমার কোনো সম্পর্ক রয়েছে?

- কোনো সম্পর্ক নেই। তবে তুমি আমাকে আসতে বাধ্য করেছো। তোমার ভুল আমাকে প্রতিশোধের আগুনে জ্বালিয়ে মারছে। তোমার এ ভুলের জন্য আমি আবার জেগে উঠেছি। এতে আমার ভালোই হয়েছে কারণ এ পৃথিবীতে প্রতিশোধ নেওয়ার  একটা সুযোগ আমার হয়েছে। আমি এখন পূর্বপুরুষের থেকে প্রাপ্ত সকল অন্যায়ের প্রতিশোধ নিব। 

- আমি তো তোমার পূর্ব পুরুষ না। আমার কাছে কেন এসেছো? কী এমন অন্যায় তোমার সাথে হয়েছিল আর এ বাচ্চাটা কার?

রজনীর তীব্র কান্নার রোল আবারও তোহার কানে আসলো। তোহা জোর গতিতে চেঁচিয়ে বলল

- তোমার কান্না আমার সহ্য হচ্ছে না।  তুমি কান্না থামাও প্লিজ। আমাকে বলো তোমার সাথে কী হয়েছিল।

রজনী কন্নাটা থামিয়ে বলল

- আমি ছিলাম আরাধান বংশের প্রথম মেয়ে। আমার রূপ ছিল না। কালো কুচকুচে বর্ণের গায়ের রঙ হওয়ায় আমাকে নাম দিয়েছিল রজনী। রজনীর সমার্থক অর্থ রাত। রাতের অন্ধকারের সাথে গায়ের রঙয়ের বেশ সামান্জস্য থাকায় আমাকে এ নাম দেওয়া হয়। আমার বাবা ছিলেন  সবচেয়ে ধনী রাজা। আমি রূপে ছিলাম না তবে গুণে ছিলাম ভরপুর। যুদ্ধবিদ্যা থেকে শুরু করে সকল অশ্রবিদ্যায় মাত্র ষোল বছর বয়সে নিজেকে পারদর্শী  করে তুলি। আমার ভাই বোন না থাকায় উত্তারাধিকার সূত্রে আমিই আমার বাবার রাজ্যের ক্ষমতা পাই একুশ বছর বয়সে। আমার তেজ্বদীপ্ত বুদ্ধিতে রাজ্যের অবস্থা আরও উন্নতি হয়। আমি ছিলাম সে সময়ের প্রথম নারী যে রাজ্য পরিচালনা করত। প্রতিটা যুদ্ধ আমার সুকৌশল দক্ষতায় জয় লাভ হতো। বেশ ভালোই কাটছিল সময়। দেখতে দেখতে চার বছর কেটে যায়। রাজ্যের সম্পদের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে যায়। এবার সবার ইচ্ছা আমি যেন বিয়ে করি। আমার সন্তানেই তাহলে হবে এ রাজ্যের আগামি উত্তরাধিকার।  সবদিক বিবেচনা করে আমি বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিই। 

কয়েক রাজ্য থেকে আমার জন্য রাজকুমার আসতো বিয়ের জন্য তবে তাদের পছন্দের প্রথম তালিকায় আমি কালো হওয়ায় বাদ পড়ে যেতাম। কেন জানি না সে সময়টায় হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। এ হতাশায় আমাকে ভুল সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে এবং বিচক্ষণ চোখকে অন্ধ করে তুলে। 

সে সময়ে তাম্র শাসিত এক রাজার ছেলে নাম সুন্দন আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়। ছেলেটাকে যখন প্রথম দেখেছিলাম আবেগের উত্তাল যৌবনে যেন আমি পিছলে পড়েছিলাম। এত সুন্দর ছেলের গড়ন তার উপর তার সুমিষ্ট কথার ভঙ্গি নিমিষেই আমাকে ভালোবাসার নদীতে ডুবিয়ে দেয়। তাকে পরখ করার প্রয়োজন অনুভব করেনি। কেন সে আমাকে বিয়ে করতে চায় সেটাও আমার মনে আসেনি। বিচক্ষণ  চোখ দিয়ে কোনোকিছু যাচাই না করেই বিয়েতে রাজি হয়ে পড়ি। 

বেশ ধুমধামে আমার সাথে সুন্দনের বিয়ে হয়। সংসারটা আমার বেশ ভালোই কাটছিল। বিয়ের তিনমাসের মাথায় আমি গর্ভবতী হই। সে সুবাধে আমি আমার স্বামী সুন্দনকে রাজ্যের দায়িত্ব পদার্পণ  করি। তারপর থেকে তার খোলস খুলতে থাকে। সে মূলত আমাকে বিয়ে করেছিল রাজ্যের দায়িত্ব পাবার জন্য। সে সাথে তার একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিল নাম কুন্দমালা। তখন আমি সাত মাসের গর্ভবতী ছিলাম। বেশ সুকৌশল অবলম্বন করে  সুন্দন আর কুন্দমালার সম্পর্ক টের পাই। দিনকে দিন সব সহ্যের সীমা অতিক্রম করছিল।  স্বামী ছিল সে,তার উপর তার প্রতি ছিল আমার অগাধ দূর্বলতা সব মিলিয়ে পারছিলাম না সহ্য করতে।  তাই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হই। নিজেকে সামলে নিই। কারণ এভাবে চললে আমারেই ক্ষতি, এ আবেগ আমাকে আরও কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন করবে। তাই চিন্তা করি সুন্দনের হাত থেকে রাজ্যের ক্ষমতা কেড়ে নিতে হবে। এ ক্ষমতার বলেই সে আমার সাথে এত জঘন্য কাজ করছে। আমি মনোবল স্থির করে সুন্দনকে বললাম এখন থেকে এ রাজ্য আমি পরিচালনা করব। যেহেতু তাকে আমি সাময়িক দায়িত্ব দিয়েছিলাম সেহেতু সেটা কেড়ে নিতে আমার সমস্যা হবে না। আমার কথা শুনে সুন্দন কী যেন ভাবলো। তার কথার সুর পাল্টে গেল। আমার প্রতি থাকা রুক্ষ  কন্ঠ ক্রমশেই নরম হয়ে গেল৷ আমাকে বলল সে এমন ভুল আর করবে না। বাচ্চার সাত মাস  চলে এ সময় আমার প্রেসার নিলে দুজনের ক্ষতি হবে।  তাই সে চাচ্ছিল না আমি তাকে ক্ষমতাচ্যুত করি৷ 

তার মোলায়েম কন্ঠে আমি গলে গেলাম। তখন তার গুটির চাল আমি বুঝতে পারিনি। যখন বুঝতে পেরেছিলাম তখন বেশ দেরি হয়ে যায়। তখন আমার নয় মাস চলে। ডেলিভারির আর কিছুদিন বাকি। সুন্দনের আচরণও বেশ সুমিষ্ট। তবে এ সুমিষ্ট আচরণের বাইরে ছিল এক ভয়ংকর রূপ যেটা আমার ভাবনার বাইরে ছিল। সেদিন রাতে আমি চুপ হয়ে বসে ছিলাম পালঙ্কে। সুন্দন এসে জড়িয়ে ধরে আমার কাপলে চুমু টেনে ঘুম পাড়িয়ে দিল। শেষ রাত্রিতে আমার ঘুম ভাঙে। পাশ ফিরে দেখলাম সুন্দন নেই। কী একটা আওয়াজ যেন আসছিল। লক্ষ্য করলাম কারও ফিসফিসের আওয়াজ। আমার বেশ সন্দেহ হলো তার উপর। উঠতে কষ্ট হলেও নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে পালঙ্ক থেকে নামলাম। আস্তে পায়ে ফিসফিসের উৎস খুঁজতে লাগলাম। আওয়াজটা পাশের পরিত্যাক্ত রুম থেকে আসছিল। আমি আস্তে পায়ে সেখানে গেলাম। সেখানে উঁকি দিতেই আমার গায়ের লোম শিউরে উঠল।

 গল্পের নাম রজনী

লেখিকা শারমিন আঁচল নিপা

পর্ব-  পর্ব 

সেখানে উঁকি দিতেই আমার গায়ের লোম শিউরে উঠল। কারণ সুন্দন কুন্দমালাকে শুইয়ে কী যেন বিড়বিড় করছে। কুন্দমালাকে দেখেই মনে হচ্ছিল সে অচেতন। এ অবস্থায় কী হতে চলেছে সেটা আমার ধারণার বাইরে ছিল। সুন্দনের সামনে একটা আলোকবিন্দু জ্বলে উঠল। আলোকবিন্দুটা জ্বলার সাথে সাথে সব যেন নড়ে উঠল। আমি ভীত হয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম। কোন এক গায়েবি আওয়াজ বলে উঠল

- আমাকে তুষ্ট করতে পারলে তোকে আমি সমস্ত ক্ষমতা দিব, তুই শুধু এ রাজ্য না বরং পুরো দুনিয়া এ কালোজাদুর বলে পরিচালনা করতে পারবি৷ সে সাথে পাবি অমরত্ব। 

সুন্দন নম্র গলায় হাত জোর করে বলে উঠল

- প্রভু আমাকে সে পথ বলুন। কী করলে আপনি সন্তুষ্ট হবেন বলুন। আপনার জন্য আমি আমার প্রিয়তমাকে বলি দেওয়ার জন্য হাজির করেছি। এর আগেরবার আপনি বলেছিলেন পৃথিবীতে বর্তমানে যাকে আমি ভালোবাসি তাকে বলি দিলে আপনি তুষ্ট হবেন। অনেক ভাবনার পর মনে হলো আমি কুন্দমালাকে ভালোবাসি অনেক। আর তাকে আপনার জন্য বলি দিতে নিয়ে এসেছি। আমি জানি কুমারী বলি দিলে আপনি তুষ্ট বেশি হবেন। এজন্য কুন্দমালার প্রতি সকল ভালোবাসা বিসর্জন দিয়ে আমি ওকে বলি দিতে নিয়ে এসেছি। এর আগে আমি আমার বাবা, মা কে ও আপনার জন্য বলি দিয়েছি। আপনি বলেছেন মোট পাঁচটি বলি দিতে পারলে আমি সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী হব। আমার চতুর্থ  বলি কে বলুন?

বিকট শব্দে বলে উঠল

- আগে আমার সামনে কুন্দমালাকে বলি দে।  বলি দেওয়ার পর তোর চতুর্থ বলি কে হবে সেটা বলে দিব।

সুন্দন আর কিছু চিন্তা না করেই একটা ধারালো দা দিয়ে কুন্দমালার গলা বরাবর চালিয়ে দিল। গলাটা দ্বিখন্ডিত হয়ে গেল। সে সাথে রক্ত ছিটকে পড়ল। ঘটনা দেখেই আমার বুক কেঁপে উঠল। নিজের মুখ নিজে চেপে ধরলাম। কারণ কী হবে পরিষ্কার বুঝতে না পারলে আমাকে হয়তো পরবর্তীতে আরও বিপদে পড়তে হবে। আমি শক্ত যেমন তেমনি নরম মনের অধিকারী। অপরাধীকে শাস্তি দিতে আমার বুক কাঁপে না। তবে একটা নিরপরাধ  মানুষকে শাস্তি পেতে দেখে আমার বুকটা হুহু করে কেঁদে উঠে। কুন্দমালার এ অবস্থা আমাকে যথেষ্ঠ ব্যহত করেছিল। আর যাইহোক এতে তো কুন্দমালার দোষ ছিল না। সুন্দনকে সে ভালোবাসতো আর সে ভালোবাসার মানুষের হাতে বলি হবে সেটা তো সে জানত না। অদৃষ্ট  বড়ই নিষ্ঠুর। 

আমার বুকের ভেতরটা মুচরে উঠছিল বারবার। এদিকে  সুন্দন কু্ন্দমালার গড়িয়ে যাওয়া রক্ত  একটা মাটির পাত্রে নিয়ে চোখ বন্ধ করে কী যেন পাঠ করল। তারপর রক্তটা আলোকবিন্দু বরাবর ছুরে মারল। ছুরে মারার সাথে সাথে গায়েবি আওয়াজটা পুনরায় বলে উঠল

- তোর এ বলিতে আমি তুষ্ট। তোর চতুর্থ বলি হবে তোর ছেলে সন্তান।

সুন্দন কিছুটা অবাক হয়ে বলল

- আমার তো এখনও সন্তান হয়নি। আমার স্ত্রী  গর্ভবতী তার সন্তান হয়তো হবে। তবে সে সন্তান ছেলে কী না সে টা তো আমি জানি না। যদি আমার ছেলে সন্তান না হয় তাহলে কী আমি ক্ষমতা পাব না?

সন্তান বলি দেওয়ার কথা শুনে আমার বুকটা আরও কেঁপে উঠল। তার উপর সুন্দনের সহজভঙ্গিতে কথা বলাটা আমাকে আরও ব্যহত করল। তার কথায় বুঝা যাচ্ছে সে এ ক্ষমতার জন্য নিজের সন্তান বলি দিতে পিছ পা হবে না৷ আমার হাত পা তখন কাঁপছিল। তবুও নিজেকে সামলে নিচ্ছিলাম। এমন কোনো পদক্ষেপ  নেওয়া যাবে না এখন, যাতে করে আমি বিপদে পড়ি। তাই মনস্থির করে তাদের কথোপকথন  শুনতে লাগলাম। গায়েবি আওয়াজটা বলে উঠল

- তোর স্ত্রী  এর ছেলে সন্তান হবে। আর সে ছেলে সন্তান যেদিন জন্ম নিবে সেদিন তাকে হত্যা করবি। তার ঠোঁট দুপাশে দুদিকে সেলাই করে দিবি। কালো কিছু পাথর দিব সেগুলো তার দাঁতের পাটিতে লাগিয়ে দিবি তারপর গালে আমার নির্দেশ দেওয়া চিন্হগুলো এঁকে মৃত দেহটাকে পানিতে ভাসিয়ে দিবি। 

- আপনি যা বলবেন তাই হবে। এ ক্ষমতার জন্য আমার সন্তান বলি দিতেও আমি পিছ পা হব না। প্রভু আপনার দেখা আমি কবে পাব? আপনাকে কবে সামনাসামনি দেখতে পারব।  আমি যে আপনাকে দেখতে চাই। আপনার দর্শন চাই।

- আমাকে তুই পঞ্চম  বলির পর দেখতে পারবি। যেদিন তোকে আমি সমস্ত ক্ষমতা দিব সে সাথে অমরত্ব  দিব সেদিন।

- আমার পঞ্চম  বলি কে সেটা কী আমাকে জানানো যাবে? দীর্ঘ  তিন বছর আপনার আরাধনা করেছি। আপনার কথা মতো নিজের মা বাবাকে বলি দিয়েছি সে সাথে বলি দিয়েছি নিজের প্রিয়তমাকে। আপনি বলেছেন রজনীকে বিয়ে করতে আমি সেটাও করেছি। আপনি বলছেন আমি যেন আমার সন্তানকে বলি দিই আমি সেটাও করব। তবে এ বলি দেওয়ার কয়দিন পর আমাকে পঞ্চম  বলি দিতে হবে এবং আমি আমার ক্ষমতা পাব। প্রভু দয়াকরে আমাকে বলুন। 

- এত অস্থির হওয়া ঠিক না। তবে এতটুকু তোকে জানিয়ে রাখি। তোর নিকট ক্ষমতা আসতে চলেছে অতি শীঘ্রই। কারণ তোর ছেলেকে বলি দেওয়ার সাতদিন পর তোর স্ত্রী  রজনীকে বলি দিতে হবে। তারপর তোর কাঙ্ক্ষিত  ক্ষমতা তোর হাতে আসবে। সাবধান কাজে যেন কোনো ভুল নাহয়।

- আপনি যা বলবেন তাই হবে। আমাকে শক্তি দিন আমি যেন আপনাকে সন্তুষ্ট  করতে পারি। 

বলার সাথে সাথে আলোকবিন্দুটা মিলিয়ে গেল। সুন্দন কুন্দমালার লাশটা কেটে টুকরো টুকরো করে একটা লাল কাপড়ে পেঁচিয়ে নিল। আমি এসব দেখার পর নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না। তবুও অনেকটা সামলে স্থির হয়ে ঘরে এসে এ সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় খুঁজছিলাম। সুন্দনকে কোনো মতেই দমানো যাবে না। তবে কৌশলে ওর হাত থেকে নিজের সন্তানকে বাঁচাতে হবে। আমি আমার ঘরে এসে এসবেই ভাবতে লাগলাম।  সারা শরীরে আমার অস্থিরতা। এ সমস্যার থেকে মুক্তির উপায় খুঁজছিলাম। ভাবনার শেষ প্রান্তে একটা ফয়সালায় আসে সেটা হলো সুন্দনকে খুন করা। কারণ সুন্দনকে খুন করলেই আমার সন্তান আর আমি মুক্তি পাব। সে সাথে মুক্তি পাবে এ দুনিয়া। আর এখন এ রাজ্যের ক্ষমতা আমার হাতে নেই তাই চাইলেও সুন্দনকে আমি মৃত্যুদন্ড দিতে পারব না। কারণ প্রজারা সুন্দনের আদেশ শুনবে আমার আদেশ শুনবে না। আমি অনেকটা মনস্থির করলাম সুন্দনকে খুন করার জন্য। কিন্তু আমার অদৃষ্টে লেখা ছিল ভিন্ন। সেদিনেই আমার প্রসব ব্যথা শুরু হয় তীব্র হয়ে। আমি ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠি। দাসীরা আমাকে এসে হাত পাখা দিয়ে বাতাস করতে লাগল।  দায় আসলো আমার সন্তান প্রসবে সাহায্য করতে। আমার বুকটা কেঁপে উঠছিল। সন্তান জন্ম দেওয়ার আনন্দের চেয়ে সন্তান বাঁচাবার জন্য চিন্তা মাথায় ঘুরছিল। আমি আমার সবচেয়ে কাছের দাসী সর্ববীরে বললাম

- আমার সন্তান জন্ম হওয়ার সাথে সাথে তাকে নিয়ে পালিয়ে যেও। আমার এ সন্তানকে আমার স্বামী খুন করে দিবে। এ মুহুর্তে  সুন্দনকে মৃত্যুদন্ড বা খুন করার আদেশ দিতে পারছি না। আমার হয়ে তুমি রাজ্যে আদেশ দিলেও সেটা গ্রহণযোগ্য হবে না। আমার সন্তানকে তুমি দয়াকরে লুকিয়ে রেখো।

সর্বরী আমার হাত ধরে বলল

- আমি জানি না রাণীমা আপনি কেন একথা বলছেন। তবে আপনি যা বলবেন আমি তাই করব। আপনার চাওয়ার বাইরে কিছু হবে না। আপনার সন্তানকে আমি আগলে রাখার চেষ্টা করব। সন্তান জন্ম হওয়ার পরপরই আমি তাকে নিয়ে পেছন কপাট দিয়ে পালিয়ে যাব। 

আমি ব্যথায় কুকরাতে লাগলাম। দীর্ঘ ১ ঘন্টা ব্যথার পর আমার কানে আমার ছেলের কান্নার আওয়াজ আসলো। আমি নিস্তেজ হয়ে গেলাম। কিন্তু আমার বাচ্চাটা রক্ষা পেল না সুন্দনের হাত থেকে। আমার ছেলেটাকে সে বলি দিয়ে দিয়েছে সেদিনেই। বাচ্চা জন্ম দেওয়ার পর আমি নড়তে পারছিলাম না। এ মুহুর্তে  নিজের সাথে হওয়া অন্যায়ের শাস্তিও তাকে দিতে পারছিলাম না। আমি জানি সে আমাকে সাতদিন পর বলি দিবে। এর মধ্যে সে আমাকে মারবে না নিজের স্বার্থের জন্যই। এদিকে আমার শরীর ক্লান্ত। সন্তান হারানোর বিয়োগ যন্ত্রণা  আমাকে আরও ক্লান্ত করে ফেলল। অবশেষে আমি না পেরে কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলাম।

 গল্পের নাম রজনী

লেখিকা শারমিন আঁচল নিপা

পর্ব- 9 পর্ব 

আমি চিন্তা করলাম আমাকে বলি দেওয়ার পূর্বেই আমিই আত্মহত্যা করব। তাহলে তার চাওয়া কোনোদিন পূর্ণ হবে না। আমার ভাবনার গতি তীব্র হওয়ার আগেই একটা তলোয়ার নিয়ে পেটে ঢুকিয়ে দিলাম। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে তখন আমার কিছুই হলো না। তলোয়ার আমার পেট ভেদ করলেও কোনো রক্তক্ষরণ  বা ব্যথার সৃষ্টি হলো না। বিস্মিত হয়ে পেট থেকে তলোয়ার বের করলাম দ্রূত। বের করার সাথে সাথে একদম স্বাভাবিক  হয়ে গেলাম। কোনো জখমের চিন্হ আমার পেটে পরিলক্ষিত হলো না। আমি বুঝতে পারছিলাম না এমন কেন হচ্ছে! এর মধ্যে সুন্দনের হাসি কানে ভেসে আসলো। বিকট চিৎকার আর হাসি দিয়ে বলল

- তুমি চাইলেও মরতে পারবে না। তুমি এসব জানার পর আত্মহত্যার পথেই বেছে নিবে, সেটা আমার ভাবনায় ছিল। তাই আত্মহত্যা যেন করতে না পারো সেজন্য তোমাকে এমনভাবে বশ করেছি যে আত্মহত্যার যত চেষ্টায় করো তুমি তাতে সফল হতে  পারবে না। 

সুন্দনের কথাটা শুনে আমার আশার প্রদীপ যেন নিভে গেল হুট করে। কিছুটা স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না। আমাকে সাতদিন পর বলি দিবে আর সে সমস্ত শক্তি পাবে সেটা আমি মানতে পারছিলাম না। নিজের চোখে নিজের সন্তানের খুন দেখেও তার সফলতা আমি কামনা করতে পারছিলাম না মোটেও। চিন্তায় আমার সারা শরীর আরও দু্র্বল হয়ে গেল। উঠার শক্তিটাও আমার হচ্ছিল না। নিজের অজান্তেই হুহু করে কেঁদে উঠছিলাম। আমার সন্তানের মুখ দেখার আগেই আমি তাকে হারিয়েছি। কলিজা ফেটে মরভূমির মতো তপ্ত হয়ে গেছিল। 

টানা ছয়দিন আমি কিছু খাইনি, এক ফোটা পানিও না। এতেও আমার মৃত্যু হয়নি। শুধু শরীরটা দুর্বল হয়েছে। কালকে আমাকে বলি দেওয়া হবে আর সুন্দন পাবে ক্ষমতা। আমি কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না মোটেও। আমার দাসী শিরুমালা আমার পাশে এসে বসে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল

- আপনার এ হাল আমাকে ব্যথিত করছে। আপনার হাতে কী কোনো উপায় নেই এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়ার। আপনি চিন্তা করুন অবশ্যই কোনো পথ আপনি পাবেন। এ জীবনে নাহয় প্রতিশোধ না নিয়েই উপায় বের করলেন। তবে রাজামশাইয়ের উদ্দেশ্য সফল হতে আপনি দিবেন না দয়াকরে। আমি জানি আপনি বিচক্ষণ এবং তীক্ষ্ণ  বু্দ্ধির অধিকারি আপনি চাইলেই এমন কোনো পন্থা অবলম্ববন করতে পারেন যাতে করে রাজা মশাইয়ের নিকৃষ্ট  চাওয়া পূর্ণ না হয়।

আমি কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস  করলাম

- তুমি জানলে কী করে এসব?

- সর্বরী মৃত্যুর আগে আমাকে বলে গেছে। আপনি দয়াকরে কিছু একটা ব্যবস্থা করুন।

শিরুমালার কথায় আমি একটু সাহস পেলাম। অনেকক্ষণ  ভাবলাম কীভাবে এর থেকে মুক্তি আমি পাব। ভাবনার শেষ প্রান্তে গিয়ে ফলাফল আসলো যে আমি তো আত্মহত্যা করতে পারব না তবে কেউ আমাকে খুন করলে নিশ্চয় আমি মৃত্যুবরণ করব। আমি কথাটা ভাবার সাথে সাথে জোর গলায় বলে উঠলাম

- শিরুমালা তলোয়ারটা হাতে নিয়ে আমার গলা থেকে মন্ডুটা আলাদা করে দাও।

শিরুমালা ভয় পেয়ে গেল। ভীত গলায় জবাব দিল

- রাণীমা কী বলছেন এসব? আমি আপনাকে কেন খুন করব?

- এখন এসব চিন্তা করার সময় না। তুমি দয়াকরে তলোয়ার দিয়ে আমাকে শিরচ্ছেদ করো। এটা আমার আদেশ। আমি জানি আদেশ অমান্য করার মতো বেয়াদবি তুমি করবে না। আমি মৃত্যুর পর ওদের প্রতিশোধ নিব। 

শিরুমালা ভয় পাচ্ছিল। তবুও তলোয়ারটা কাঁপা হাতে নিয়ে আমার গলা বরাবর চালিয়ে শিরচ্ছেদ করল। সাথে সাথে আমার মৃত্যু ঘটল। আমার মৃত্যুর পর শিরুমালা এক সাধুকে বলে  আমার আত্মা পুনরায় জাগ্রত করে। আমিও প্রতিশোধের আগুনে জ্বলে উঠি। তবে সে জ্বলন্ত লাভা আমার মধ্যে বেশিদিন ছিল না। সুন্দনের চাওয়া পূরণ হয়নি সেটা ঠিক তবে সে পূর্বের বলির জন্য কিছু ক্ষমতার অধিকারি হয়। ফলে আমার আত্মাকে সে একটা ভাঙা বাড়িতে বন্ধ করে রেখে দেয়। এত বছর আমি সেখানে ধুকে ধুকে মরছিলাম। আজ তোমার একটা ভুলে পুনরায় মুক্তি পেলাম। আমার প্রথম কাজ হলো তাসকিনকে হত্যা করা।  

তোহা রজনীর কথাগুলো শুনে ঘাবড়ে গেল। ভীত কন্ঠে বলল 

- তাসকিনকে হত্যা কেন করতে চাও?

- কারণ এ তাসকিনেই পূর্বজন্মে সুন্দন ছিল।

- তুমি আমার রুপেই কেন ধরেছো বলো?

- আমি যখন যাকে দিয়ে আমার প্রতিশোধ নিব এবং যার শরীরে প্রবেশ করব তখন সে রূপ নিব। এখন আমাকে সাহায্য করো। তাসকিনকে খুন করলেই আমার আর আমার বাচ্চার আত্মা শান্তি পাবে।

তোহা দ্বিমত পোষণ করে বলল

- এটা আমি কখনই পারব না। তাসকিন আমার ছোট ভাইয়ের মতো।

রজনী তোহার কথা শুনে দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠল

- তাসকিনকে খুন করতে সাহায্য না করলে আমি তোমায় খুন করে দিব।  আমার বাচ্চা তোমার দম আটকে দিবে।

বলেই রজনী তোহার গলা চেপে ধরল। দম নিতে তার বড্ড কষ্ট হচ্ছিল। কিছুটা সাহস করে রজনীর হাত ছাড়িয়ে জোরে জোরে দম নিতে লাগল তোহা। হালকা গলায় বলল

- কী করলে তোমার আত্মা শান্তি পাবে? আর মুক্তি পাবে?

- তাসকিনকে খুন করলে। তাসকিনের রক্ত গায়ে মাখলে। 

- কিন্তু পূর্ব জন্মের তাসকিন আর এখনের জন্মের তাসকিনের স্বভাব  চরিত্র চাওয়া একদম ভিন্ন। তাহলে কেন সে শাস্তি পাবে? 

- আমার শুধু তার রক্ত লাগবে আর কিছু না। আমি তার রক্ত দিয়ে গোসল করল। রক্তের সাথে সুগন্ধি  মিশিয়ে গায়ে ঢালব৷ তাহলেই আমি আর আমার বাচ্চা শান্তি পাবে। এ বাসার পেছনে যে বট গাছটা আছে সেখানে একটা প্রদীপ আছে মাটির নীচে পু্ঁতে রাখা। সেটা এনে আমাকে দিতে হবে সটা দিয়ে আমি তাসকিনকে খুন করতে পারব। কোনো আত্মার পক্ষে সে বট গাছের নীচে যাওয়া সম্ভব না। তুমি শুধু আমাকে প্রদীপটা আনতে সাহায্য করো।

তোহা ভীত গলায় বলে উঠল

- আমি কখনই নিজের ছোট ভাইয়ের মৃত্যুতে সাহায্য করতে পারব না। আমার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত  আমি আমার ছোট ভাইকে দিতে পারব না। পূর্ব  জন্মে যাইহোক এজন্মে সে নির্দোষ। পূর্ব জন্ম দিয়ে এ জন্ম বিচার করা ঠিক হবে না। এটা অন্যায়। তুমি যেভাবে বলো আমি সাহায্য করব তবে কাউকে খুন করতে সাহায্য করতে পারব না।

তোহার কথা শুনে রজনীর রাগটা বেড়ে গেল। পরক্ষণেই  তোহাকে শূন্যে তুলে মাটিতে আঁচড়ে ফেলল সে। দৃঢ় কন্ঠে বলল

- তোকেই শেষ করে দিব। আর নাহয় তোর শরীর থেকে আমি মুক্তি পাব না। তোকে শেষ করে তোর শরীর থেকে মুক্তি পেয়ে অন্য কোনো শরীরে ভর করব। যে আমাকে এ কাজে সাহায্য  না করবে তাকেই শেষ করব আমি৷ 

বলেই তোহার গলাটা চেপে ধরল। বাচ্চাটা তোহার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আঁচড় দিয়ে রক্তাক্ত করে দিল তার পুরো শরীর। একটা দঁড়ি এসে তোহার গলা পেঁচিয়ে ধরল। আর সাথে সাথে সে ফ্যানে ঝুলে গেল। তার জিহ্বা গলা দিয়ে বের হয়ে আসলো। চোখ গুলো উল্টে গেল। ছটফট করতে করতে মরে গেল। 

তূর্ণা তোহার বর্ণণা শুনে আরও কাঁপতে লাগল। এদিকে আয়েশার দেহটা শূন্যে ভেসে রয়েছে এখনও। তূর্ণা মৃদু গলায় তোহাকে বলল

- এখন যদি তোহা রজনীকে সাহায্য না করে তাহলে তো সে ও মারা যাবে। আর এ মহলের তৈলচিত্রগুলোতে আয়েশার ছবি কেন? তাহলে কী আয়েশা পূর্ব জন্মে রজনী ছিল?

- এমন কিছু না। আয়েশার সাথে রজনীর কোনো সম্পর্ক নেই। তবে রজনী এখন আয়েশার ভেতর প্রবেশ করেছে আর তার রূপ আয়েশার মতো ধারণ করেছে। সেজন্য তৈলচিত্রগুলোতেও আয়েশার প্রতিচ্ছবি। 

তূর্ণার ভয় আরও বেশি কাজ করতে লাগল। তোহার দিকে তাকিয়ে বলল

- আয়েশারকে বাঁচাবার কী কোনো উপায় নেই। রজনীকে মুক্ত করতে হলে তো তাসকিন ভাইয়ের মৃত্যু ঘটবে এদিকে তাসকিন ভাইকে বাঁচাতে গেলে আয়েশার মৃত্যু ঘটবে৷ এটার থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কী কোনো উপায় নেই?

তোহার কন্ঠ বিমর্ষ  রূপ নিল। অনিশ্চিত  গলায় বলে উঠল

- একটা উপায় আছে তবে সে উপায়ে কার মৃত্যু হবে বলা যায় না। এমনও হতে পারে তাসকিন আয়েশার দুজনের মৃত্যু হতে পারে আবার এমনও হতে পারে যেকোনো একজনের মৃত্যু হতে পারে আবার এমনও হতে পারে দুজনেই জিবীত থাকবে। তবে কাজটা যে করবে তারও মৃত্যু ঝু্ঁকি আছে। এ খেলায় আরও মৃত্যু সংখ্যা বাড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে মৃত্যুর আগে চাইলে শেষ উপায়টা কাজে লাগানো যেতে পারে। তুমি কী পারবে তূর্ণা নিজের জীবন বাজি রেখে কাজটা করতে?

তূর্ণার ভয়ে বুক কাঁপতে লাগল। পৃথিবীর সবাই নিজের জীবনকে বড্ড বেশি ভালোবাসে। তূর্ণাও তার ব্যাতিক্রম না। তবু খানিকটা সাহস সঞ্চয়  করে বলল

- এ রহস্যে যখন ডুবেছি শেষ চেষ্টা করা যেতেই পারে। বলো কী কাজ?

তোহা কিছু বলতে নিবে এমন সময় আয়েশার শরীরটা মেঝেতে পড়ে মেঝে চৌচির হয়ে ভেতেরের দিকে প্রবেশ করল। পুরো মহলটায় জোরে একটা ঝাকুঁনির সৃষ্টি হলো। তূর্ণা টাল সামলাতে না পেরে আঁচড়ে পড়ে গেল। ঠিক এমন সময় তূর্ণার পায়ে একটা টান অনুভব করল। টানটা এতই জোরে হলো যে তূর্ণা মেঝে ভেদ করে একটা সুরঙ্গে চলে গেল। সে বুঝতে পারছে না কোথায় যাচ্ছে।  তবে এটা টের পাচ্ছে ভয়ংকর কিছু তার জন্য অপেক্ষা  করছে।

 গল্পের নাম রজনী

লেখিকা শারমিন আঁচল নিপা

র্ব ১০/শেষ পর্ব

তবে এটা টের পাচ্ছে ভয়ংকর কিছু তার জন্য অপেক্ষা করছে। আচমকা বড় একটা ধাক্কা খেল তূর্ণা। কোনো একটা খাদে সে পড়ে গেল। চার পাশ থেকে বিভৎস দুর্গন্ধ ভেসে আসছে। গন্ধে তূর্ণার পেট ফুলে যাচ্ছে। তোহাকে আশে পাশেও খুঁজে সে পাচ্ছিল না। আর আয়েশা কোথায় আছে সেটা তার জানা নেই। তূর্ণা একা একা বেশ ভয় পাচ্ছিল। চোখটা বন্ধ করতেও ভয় পাচ্ছে আবার তাকিয়ে থাকলেও যেন বুক কাঁপছে। মনে হচ্ছে কোনো অন্ধকার কূপে সে পড়ে গেছে। সন্নিকটে কেউ হয়তো ঘুরপাক খাচ্ছে অনুভব করলেও তার চোখে তা স্পষ্ট হচ্ছে না। এমন সময় জোরালো শব্দ ভেসে আসলো তূর্ণার কানে। আয়েশা তার সামনে দাঁড়িয়ে। তীক্ষ্ণ কর্কশ গলায় বলল - বটগাছের সে প্রদীপটা আমি চাই। তূর্ণা বুঝতে পারছে আয়েশার ভেতরে রজনীর আত্মা। কিছুটা ভীত সংকিত সে। এ মুহূর্তে রজনীর কথা না শুনলে হয়তো তার ও প্রাণ যাবে। কিছুটা ভীত গলায় বলল - বটগাছটা কোথায় আমার তো জানা নেই। রজনী হাতটা ইশারা করে পেছন দিকে দেখাল। পেছনের দিকে খানিক দূরে একটা বড় প্রকান্ড বট গাছ দাঁড়িয়ে। তূর্ণা ভয়ে ভয়ে বলল - প্রদীপ টা কোথায় পাব? কর্কশ কন্ঠে উত্তর আসলো - বটগাছের বড় শিকরের শেষ প্রান্তের মাটির নীচে পুঁতে রাখা আছে সে প্রদীপ। তূর্ণা কিছু বুঝে উঠার আগেই রজনীর কথামতো সেই বটগাছের কাছে পৌঁছে গেল। চারপাশ থেকে কতশত কান্নার আওয়াজ তূর্ণার কানে ভেসে আসছে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তূর্ণার ভয়ে বুক কেঁপে উঠছিল। হার্টবিটের স্পন্দন দ্বিগুণ থেকে দ্বিগুণ হতে লাগল। কোনো রকমে সমস্ত সাহস সঞ্চালন করে বটগাছের নীচ থেকে মাটি খুঁড়ে প্রদীপটা বের করল। প্রদীপটা হাতে নিতেই তূর্ণার শরীরটা কেঁপে উঠল। সমস্ত শরীর নাড়া দিয়ে উঠল। চোখ মুখ যেন তার ঝলসে উঠল। আন্ধকার জায়গাটায় আচমকা সূর্যের রশ্নির আগমণ ঘটল। সূর্যের রশ্নি এসে তার মুখে পড়ল । রশ্নির লাভা এতটায় প্রখর যে সে জ্বলে যাচ্ছে। মাথার টাল সামলাতে সে পারছে না। কী হতে কী হচ্ছে সেটা তার অন্তরায়। মাথাটা চরম মাত্রায় ঘুরে গেল। হাত থেকে প্রদীপটা পড়ে গেল। সে সাথে সেও হুঁশ হারাল। এদিকে প্রদীপটা পড়ে যাওয়ার সাথে সাথে মাটিতে একটা বলয় সৃষ্টি হলো। বলয়টা কিছুক্ষণ স্থির থেকে গতিশীল হলো। বলয়ের ঠিক মধ্যবিন্দু থেকে একটা তীব্র আলোক রশ্নি বের হয়ে আসলো। সেখান থেকে তাসকিনের অবয়বের মতো একজন বেরিয়ে আসলো। এ অবয়বটায় হলো সুন্দন। যে তার মায়াবলে নিজেকে এ প্রদীপে আবদ্ধ করেছিল। যেদিন এ প্রদীপ মুক্ত হবে সেদিন সে মুক্তি পাবে। এদিকে আয়েশার ভতেরে উপস্থিত রজনীর চোখে মুখে ফুটে উঠল প্রতিশোধের লাভা। বাচ্চাটাও ভয়ংকর বিভৎস রূপ নিল। চার পাশ অন্ধকারে ছেয়ে গেল। মনে হচ্ছে চন্দ্রগ্রহণ হচ্ছে। এসময়টার অপেক্ষায় ছিল রজনী। আজকে লড়াই হবে দু পক্ষের, এক পক্ষ লড়াই করবে নিজের সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে অন্য পক্ষ লড়াই করবে নিজের বিলীন হয়ে যাওয়া অস্তিত্ব পুনরায় ফিরে পেতে। তূর্ণার মাথা ব্যথা করতে লাগল। হালকা করে চোখটা খুলল। আধো আধো আলোতে সে আয়েশা আর তাসকিনকে দেখল। আয়েশার পরনে লাল বেমারসি শাড়ি। গা ভর্তি রাজকীয় গহনা। তাসকিনের শরীরে রয়েছে রাজাদের সেই ঐতিহ্যবাহী পোশাক। তূর্ণা বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে। আয়েশা তাসকিনের দিকে এগিয়ে যেতেই তাসকিন আয়েশাকে ধরে জোরে উপরে তুলে নীচে থেঁতলে ফেলল। আয়েশার শরীর চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল। পরক্ষণেই সব স্বাভাবিক হয়ে গেল। আয়েশা পুনরায় আগের রূপে আসলো। তাসকিনের দিকে এগিয়ে যেতেই কাটার মতো কিছু একটায় আটকে পড়ে তার শরীর ক্ষত বিক্ষত হতে লাগল। তাসকিন তীব্র কন্ঠে বলে উঠল - পূর্বজন্মেও তোর জন্য আমার অমরত্ব হাসিলে ব্যাঘাত ঘটেছে এ জন্মে প্রদীপ থেকে মুক্তি পেয়েও তোর সম্মুখীন হতে হয়েছে। পূর্বজন্মে হয়ে যাওয়া সকল অন্যায়ের শাস্তি আমি তোকে দিব। আয়েশা কর্কশ কন্ঠে বলে উঠল - পূর্বজন্ম আমার কোল থেকে আমার সন্তান কে কেড়ে নিয়েছো। আমার জীবনটা অকালে শেষ করতে হয়েছে। আমার আত্মাটা জব্দ ছিল বহু বছর। এ জন্মে তোমার শিরশ্ছেদ করে সে রক্ত দিয়ে গোসল করে নিজের সাথে এবং আমার সন্তানের সাথে ঘটে যাওয়া সকল অন্যায়ের প্রতিশোধ নিব। বলতেই আয়েশার চারপাশে যে কাঁটাগুলো ছিল সেগুলো ধরে দূরে আঁচড়ে ফেলল। বাচ্চাটা তাসকিনের ঘাড়ে এসে কামড়ে ধরল। আয়েশা নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে কী যেন বিড়বিড় করছিল। এমন সময় তার হাতে একটা তলোয়ার উপস্থিত হলো। সে তলোয়ারটা নিয়ে তাসকিনের দিকে এগিয়ে গেল। তাসকিনের কাছে যেতেই সে আয়েশার হাত থেকে তলোয়ারটা নিয়ে বাচ্চাটাকে ধরে দূরে ফেলে দিল। আর আয়েশাকে তলোয়ারের আঘাত করতে লাগল। যখনই তলোয়ারটা আয়েশার গলা বরাবর চালাতে চাইল ঠিক তখনই আয়েশা তলোয়ারের ধারালো অংশটা হাত দিয়ে চেপে ধরল। আয়েশার হাত কেটে, রক্ত নীচে গড়িয়ে পড়ল। চারদিক ভূমিকম্পের মতো কম্পিত হতে লাগল। তূর্ণা শুধু নীরব দর্শক হয়ে সব দেখছিল। আয়েশার শক্তি যেন সব বিলীন হয়ে যেতে লাগল। চন্দ্রগ্রহণের শেষ সময়ে যদি তাসকিনের শিরশ্ছেদ না করতে পারে তাহলে প্রতিশোধ নেওয়া আর হবে না। আয়েশার ভেতরে থাকা রজনী নিজেকে যতই বাঁচাতে চাচ্ছিল ততই বিলীন হওয়ার বেড়াজালে আটকে যাচ্ছিল। এদিকে তাসকিন বেঁচে গেলে সুন্দনের আচরণ তার মধ্যে আবার জেগে উঠবে। সে পুনরায় কালুজাদুবিদ্যা দিয়ে নিজেকে অমর করতে চাইবে। আর তার অমরত্বের জন্য আরও শত শত মানুষের বলি হবে। আয়েশার দম ভারী হতে লাগল। তীব্র কন্ঠে তূর্ণার দিকে তাকিয়ে বলল - তূর্ণা আমি রজনী। আমাকে সাহায্য করো। এ যুদ্ধে আমার শিরশ্ছেদ হলে আয়েশার মৃত্যু ঘটবে। আমি জানি তুমি এরকমটা চাও না। তূর্ণার শরীর হিম হয়ে যেতে লাগল। রজনীকে সাহায্য না করলে সে আয়েশাকে হারাবে আর রজনীকে সাহায্য করলে তাসকিনকে হারাবে। একেই বলে উভয় সংকটে পড়া। সে কাকে বাঁচবে বুঝে উঠতে পারছে না। পাশেই রজনীর বাচ্চাটা থুবরে পড়ে আছে। তূর্ণার ভাবান্তর হওয়ার আগেই রজনী বলে উঠল - দয়াকরে আমাকে সাহায্য করো। ভয় নেই আমি এ যুদ্ধে জয়ী হলে তাসকিনের কিছু হবে না। শুধু তার মধ্যে থাকা সুন্দনের আত্মার বিনাশ হবে। তাসকিনও এ চরম অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে। তূর্ণা আর চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকো না। আমাকে বিশ্বাস করো। চন্দ্রগ্রহণের শেষ সময়ে তাসকিনের শিরশ্ছেদ করলে সুন্দনের বিনাশ হবে৷ সময় চলে গেল আর সুযোগ পাব না। দয়াকরে তাসকিনকে একটু ধরো। তোমার পাশেই ধারলো তলোয়ার পড়ে আছে সেটা দিয়ে তাসকিনকে আঘাত করো। সময় নষ্ট করো না। তূর্ণা নিজেকে সামলে নিল। তেমন কিছু ভাবার সময় সে পাচ্ছে না। আয়েশাকে তার বাঁচাতে হবে। তলোয়ার টা হাতে নিয়ে তাসকিনের হাত বরাবর আঘাত করল। হাতে আঘাত করতেই তাসকিনের হাত থেকে তলোয়ারটা পড়ে গেল। আয়েশা তলোয়ারটা তুলল। চারদিকে অন্ধকার ছেয়ে গেছে। চন্দ্র গ্রহণের শেষ সময় শুরু হয়েছে। ভূমির কম্পন বাড়তে লাগে। বিদঘুটে আওয়াজ চারপাশ থেকে আসতে লাগল। তূর্ণার মথাটা আবারও ঘুরে গেল। সে মাটিতে পড়ে গেল। আর আয়েশা তলোয়ারটা দিয়ে তাসকিনের গলা বরাবর আঘাত করল। তাসকিনের গলা দ্বিখণ্ডিত হয়ে ছিটকে পড়ল। রক্ত এসে আয়েশার শরীর লেপ্টে গেল। চন্দ্রগ্রহণের ইতি ঘটল। পাশে পড়ে থাকা বাচ্চাটা মিলিয়ে গেল। আয়েশাও মাটিতে নিস্তেজ হয়ে পড়ে গেল। তার ভেতর থেকে যেন কিছু একটা বের হয়ে আসলো। চারপাশ বেশ আলোকিত। তূর্ণা আর আয়েশার মাথাটা ঝিমঝিম করছে। কোনো রকম চোখটা মেলে দেখল তারা মাটিতে শুয়ে আছে। ভালো করে খেয়াল করে দেখল তাসকিনদের বাসার পাশের রাস্তায় শুয়ে রয়েছে। তাসকিন পাশে বসে আছে। আয়েশা তাসকিনের দিকে তাকাতেই যেন স্বস্তি পেল। শুয়া থেকে উঠে বলল - তুমি বেঁচে আছো? তাসকিন মাথা ঝাঁকিয়ে বলল - এখনও বেঁচে আছি। তবে যা ধকল গেছে মনে হয় এটার রেশ বছর খানেক থাকবে। বাড়ির সবাই মৃত তাসকিনকে জিবীত দেখে কী করবে কে জানে। তূর্ণা পাশে বসেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তার মানে সব ঠিক আছে। কিন্তু তোহা? তোহার কথা মনে হতেই তূর্ণা বলে উঠল - তোহা কী বেঁচে আছে? তাসকিন মৃদু সুরে উত্তর দিল - তোহার ভুল তোহাকে চিরবিদায় নিতে সাহায্য করেছে। সে বেঁচে নেই আর ফিরেও আসবে না। তারা তিনজনেই উঠে দাঁড়াল। তাসকিনের বাঁচার বিষয়টা আশেপাশের মানুষের কাছে যেন একটা রহস্য বয়ে আনল। প্রায় মাস খানেন তাসকিনকে নিয়ে হৈচৈ ঘটল। তারপর আস্তে আস্তে সব ঠিক ও হয়ে গেল। কেটে গেল তিনমাস। আজকে তাসকিনের সাথে আয়েশার বিয়ে পূর্ণ হলো। তূর্ণার মন থেকে ঘটনার রেশ এখনও যায়নি। মাঝে মাঝে সে ঘটনা মনে করলে যেন তার বুক কেঁপে উঠে। কেটে গেল আরও দু মাস। রাত তখন তিনটা আয়েশার চোখেমুখে ভয়ার্ত ছাপ নিয়ে উঠে বসল। তাসকিন আয়েশাকে উঠতে দেখে তাকে ধরে বলল - কী হয়েছে? আয়েশা দম নিয়ে বলল - সে বাচ্চাটাকে স্বপ্ন দেখেছি। তাসকিন মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল - কিছু হবে না ঘুমাও। আয়েশা নিজেকে সামলে শুয়ে পড়ল।।তবে তার অস্থিরতা কেন জানি কমছিল না। রাত পার হয়ে সকাল হলো। সকাল বেলায় রান্না ঘরে যেতেই সে মাথা ঘুরে পড়ে গেল। তাসকিন আয়েশাকে পাজাকোলা করে ঘরে এনে শুয়ালো। ডাক্তার এসে চেক আপ করে জানাল আয়েশা মা হতে চলেছে। আয়েশা কথাটা শুনেও খুশি হতে পারছিল না। তার মলিন মুখের আড়ালে একটায় কথা কানে বাজছে তাহলে কী স্বপ্নটা সত্যি হতে চলল? বাচ্চাটা কী আবার আসতে চলল। রজনীর সমাপ্তি হয়েও কী আবার শুরু হলো? তাসকিনের কথায় আয়েশার ভাবনায় ছেদ পড়ল। তাসকিন বলে উঠল - এত মলিন মুখে কী ভাবছো? আয়েশা সাবলীল কন্ঠে জবাব দিল - হয়তো যেখানে ঘটনার সমাপ্তি হয় সেখান থেকেই নতুন ঘটনার শুরু হয়। আয়েশার কথার মানে তাসকিন বুঝে উঠতে পারে নি৷ পুনরায় বলল - কী হয়েছে? - কিছু না। সবসময় ভাবনার আড়ালেই কিছু কথা রেখে দেওয়া ভালো। আচ্ছা ঘটনার কী পুনরাবৃত্তি ঘটবে নাকি সমাপ্তি হবে এ রজনীর অসমাপ্ত কাহিনি।





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ