গল্পের নাম অন্ধকারে_এক_চিলতে_আলো
লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব-১ পর্ব
আমার বাবাকে নিজের মায়ের হাতে খুন হতে দেখেছি। আমার বয়সটা সেদিন অল্প ছিল। সাত বছরের ছোট্ট একটা মেয়ে ছিলাম। চুপচাপ ছিলাম খুব। ছোট বেলা থকেই বাবা মায়ের মধ্যে ঝগড়া চলত। মা পরকিয়ায় আসক্ত ছিল। আর বাবা সেটা মেনে নিতে পারত না। মাকে বারবার বললে মা উল্টো বাবার সাথে ঝামেলা শুরু করে দিত। মায়ের পরকিয়ার মূল কারণ ছিল টাকা। মা খুব উচ্চাভিলাষী ছিল। বাবার স্বল্প আয়ে মায়ের মনটা সবসময় ফিকে হয়ে যেত। বাড়তি টাকার জোগান দেওয়া বাবার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই মা একের পর এক পরকিয়া করত টাকার জন্য। বাবা মাকে কিছু বললেই মায়ের মুখে একটা কথায় আসত
- কিছু দেওয়ার তো মুরোদ নেই শুধু বড় বড় কথা। আমি যা ইচ্ছা তাই করব তোমার তাতে কী?
এসব নিয়ে মা আর বাবার মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া চলত। প্রতিদিন বাসায় কোনো না কোনো আংকেল আসত। আমার জন্য চকলেট আইসক্রিম নিয়ে আসত। আমি ছোট ছিলাম বুঝতাম না। তবে এখন বুঝতে পারি ছোট বেলায় যাদের আমি আংকেল বলে ডাকতাম তারা সত্যিকার অর্থে কে ছিল।
সেদিন ছিল আমার জন্মদিন। আমি ঘরে বসে বাবা আসার অপেক্ষা করছিলাম। বাবা একটা সময় আসেও, এসেই মাকে একটা চড় কষিয়ে দেয় আর বলে
- নষ্টামির মাত্রা এতই বেড়ে গেছে যে এখন মানুষ পর্যন্ত আমার কাছে তোমাকে নিয়ে যা তা বলে। আর তুমি আমার বন্ধুর সাথে নষ্টামি করছো? আমি যা পারি তোমাকে সব দেওয়ার চেষ্টা করি। আর সে তুমি কী না আমারেই বন্ধুর সাথে ছিঃ,ছিঃ।
মা ছিল বেপোরোয়া। পাল্টা জবাবে বলল
- কী এমন দাও তুমি। আমার যা ইচ্ছা আমি করব। তোমার বন্ধু তোমার অফিসের মালিক আর তুমি সাধারণ কর্মচারী ভুলে যেও না। আমার সাথে ঝামেলা করলে চাকুরীতে টান পড়বে তোমার।
বাবার বিষয়টা মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। কারণ চাকুরিটা বাবার প্রয়োজন ছিল। চাকুরী চলে গেলে দাদা,দাদীর কাছে টাকা পাঠাতে পারবে না। সেদিন বাবা বিষয়টা জেনেও নিজের বুকে পাথর চাপা দিয়ে নীরবে সবটা সহ্য করে। আর আমি চুপচাপ ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে এসব শুনতে থাকি। আমার জন্মদিন সেটা এত ঝগড়ার মধ্যে ভুলে যাই। চুপচাপ দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ কাঁদতে থাকি। তারপর ঘরে গিয়ে শুয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে যাই।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে বাবা আর মায়ের চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজে। আমি ঘুম থেকে উঠেই বাবা মায়ের কাছে যাই। দুজনেই বেশ ঝগড়া করছে।বাবা মায়ের শরীরে হাত তুলছে আর মা বাবার শরীরে। দুজনেই বেশ দস্তাদস্তি করতে লাগল। একটা পর্যায়ে দরজার কলিং বেল বাজলো। মা দৌঁড়ে দরজা খুলল। বাবার বন্ধু হাসান সাহেব এসেছেন। যার সাথে মায়ের পরকিয়া চলছে আর যার অফিসে বাবা কাজ করে।হাসান সাহেব আসতেই বাবা তার কলারটা ধরে বলল
- নিজের বন্ধুর বুকে ছুরি মারতে তোর বিবেকে বাঁধল না?
হাসান সাহেব কলারটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন
- আমার কলার ধরেছিস তোর এত বড় সাহস? তোর মতো কাপুরুষের তো বিয়ে করায় ঠিক হয়নি। নিজের বউয়ের শখ আল্লাদ পূরণ করতে পারিস না আর আসছিস আমাকে যা তা বলতে। তোর বন্ধু বলেই তো তোর হয়ে তোর বউয়ের মনের ইচ্ছা পূরণ করছি।
কথাট শুনেই বাবা রেগে গেল। বাবা রেগে গিয়ে হাসান সাহেবকে মারতে নিলেই মা এসে বাবাকে গলা চেপে ধরে বলল
- প্রতদিন তোর সাথে অশান্তি একদম ভালো লাগছে না। আজকে একেবারেই তোকে শেষ করে দেবো।
তারপর হাসান সাহেবকে বলল
- ওর হাত পা ধরো।
হাসান সাহেবও মায়ের কথায় বাবার হাত পা চেপে ধরল। আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না। একদম স্থির আর স্তবির হয়ে গেছিলাম। চুপ করে সবটা দেখতে লাগলাম। চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল। মুখ দিয়েও কথা বের হচ্ছিল না। মা বাবার গলাটা চেপেই ধরে রেখেছে। আর আমার বাবা ছটফট করছে। বাবার গলা দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসলো। একটা পর্যায়ে বাবা ছটফট বন্ধ করে দিল। হ্যাঁ আমার বাবা মারা গেছে।
বাবার লাশটা কী করেছিল জানি না। তবে সেদিনের ঘটনার পর থেকে আমরা সেই বাসা ছেড়ে অন্য বাসায় চলে যাই। বাবাকে আর দেখতে পারিনি। বাবার লাশ কোথায় ছিল বা লাশটা দাফন করা হয়েছিল কী না তাও জানি না। এখনও মাঝে মাঝে বাবার মুখের অবয়বটা ভেসে আসে চোখে।বাবার ছটফটানির দৃশ্যটা এখনও চোখে ভাসলে মনটা অস্থির হয়ে যায়। আর সবচেয়ে বড় কষ্ট এটাই এত অন্যায়ের পরও আমার মা বেশ রমরমা জীবনযাপন করছে। বাবা মারা যাওয়ার পর যেন মা আরও সুন্দর হয়ে গেছে। সে সাথে মায়ের পরকিয়ার সঙ্গীও বাড়তে লাগল। আগে একজন আসত।আর এখন অনেকজন আসে। ছোট থেকেই মায়ের এসব দেখে বড় হয়েছি আমি।
মায়ের জীবনটা মায়ের মতো করে সে নিজে সাজিয়ে নিয়েছিল। তবে আমার সে নরকে দম বন্ধ হয়ে যেতে লাগল। মাকে ভয়ে কিছু বলতে পারতাম না।আর আত্নহত্যা সেটা তো একটা নিছক কল্পনা কেবল।চাইলেও আত্নহত্যা করার সাহস ছিল না। তবুও যেভাবে জীবন যাচ্ছিল নিজেকে সামলে নিয়েছিলাম। তবে আমার বয়স যখন বারো হয় তখন আমার জীবনে সবচেয়ে বড় নরক নেমে আসে। মায়ের খুব কাছের একজন সেদিন বাসায় এসেছিল। মা তার সাথে রুমে বেশ অন্তরঙ্গতার সহিত শুয়ে ছিল। দুজনেই তখন মদের নেশায় ডুবে আছে। আমি তখন ডাইনিং টেবিলে পানি খতে যাই। পানি খেয়ে আসার সময় দরজাটা খোলা থাকার দরুণ আমার চোখ পড়ে লোকটার চোখে। আর মায়ের সাথে এভাবে দেখে লজ্জায় কষ্টে আমার ভেতরটা ফেটে যায়। আমি তাড়াহুড়ো করে চোখটা নামিয়ে নিজের রুমে চলে আসি। লোকটা আমাকে দেখে মাকে কী বলেছিল জানি না। আমি রুমে এসে খাটে হেলান দিয়ে কাঁদতে লাগলাম। আর ভাবতে লাগলাম কবে এ নরক থেকে বের হতে পারব।
এসব ভাবতে ভাবতেই যখন চোখটা বন্ধ হয়ে আসে ঠিক তখন নাকে একটা বিশ্রি গন্ধ আসতে লাগল। বুঝতে পারছিলাম মদের গন্ধ। এ গন্ধটা আমার সহ্য না হলেও এ গন্ধের সাথে আমি পরিচিত। কারণ মা প্রায়ই এটা খায়। ভেবেছি মা হয়তো পাশে এসেছে। তাই চোখটা খুললাম। চোখটা খুলতেই আমার বুকটা কেঁপে উঠল একি! এটা তো মায়ের পাশের লোকটা আমার দিকে হিংস্র হয়ে তাকিয়ে আছে। চোখে মুখে লালসার ছায়া ভেসে উঠছে।আমি উনাকে দেখে নড়েচড়ে বসলাম। উনার থেকে একটু দূরে গিয়ে বললাম
- আপনি আমার রুমে কেন?
- মামনি তুমি তো আমার মেয়ের মতো তোমাকে একটু আদর করে দিয়ে যেতে এসেছি। আমার কাছে এসো সোনা মা আমার।
কতটা ঘৃনিত ছিল সে চাহনি। লোভী চোখে তাকিয়ে মা ডাকছে। আমি সেদিন বলিষ্ঠ গলায় বলে উঠলাম
- আপনি আমার রুম থেকে যান বলছি।
কিন্তু লোকটা আমার কথার পাত্তা না দিয়ে আমার হাতটা টেনে ধরে তার কাছে এনে বলল
- যেতে তো আসেনি মামনি। তোমার মা কে তোমার জন্য এক লাখ দেবো বলেছি। তোমাকে রেখে কী করে যাই বলো। তোমার শরীরের গন্ধ যে পাগল করে দিচ্ছে আমায়।
বয়স অল্প হলেও উনার কথার মানে আমি বুঝতে পেরেছিলাম। আর আমার মা টাকার জন্য নিজের মেয়েকেও ভোগের পন্য বানাতে দ্বিধা করলো না। আমি নিজেকে সামলে নিয়ে লোকটা থেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলে লোকটা আমাকে ঝাঁপটে ধরে। আমার অস্বস্থির পরিমাণ বেড়ে যায়। জোরে একটা চিৎকার করে উঠি। পাশের রুম থেকে মা ছুটে আসে। ভেবেছি মা হয়তো আমাকে কষ্ট পেতে দিবে না। তবে আমার ভাবনাটা মিথ্যা প্রমাণিত হলো তখন যখন মা এসে বলল
- একদম চেঁচাবে না। আংকেল যা বলে করো। প্রথম একটু কষ্ট হবে। পরে ঠিক হয়ে যাবে।
মায়ের কথার প্রতিবাদ করে বললাম
- মা আমি এসব পারব না। আমাকে মাফ করো। দয়াকরে এত কষ্টে ফেলো না।।তুমি যা মন চায় করেছো আমি নীরবে সহ্য করেছি কখনো তোমাকে কিছু বলি নি। তবে আজকে আমার সাথে এত বড় অন্যায় করো না। আমাকে মুক্তি দাও দয়াকরে।
আমার এমন কথা শুনে লোকটা মাকে উদ্দেশ্য করে বলল
- তোমার মেয়ে এভাবে চেঁচালে চলবে নাকি।
- আরে চিন্তা করো না। ওকে একটু মদ খাইয়ে দিচ্ছি ঠিক হয়ে যাবে ডার্লিং।
বলেই মা আমার পাশে এসে মদের বোতলটা নিয়ে জোর করে মুখ চেপে খাওয়ায়ে দিল। আর লোকটা আমার শরীরের উপর হামলে পড়ল। আর মা আমাকে রেখে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। লোকটা আমার শরীরটাকে খুবলে খুবলে খেতে লাগল। পুরুষ মানুষ সে যে কতটা ভয়ানক সেদিন বুঝতে পেরেছি। মা মা ডেকে ডেকে আমার শরীরটাকে খুবলে খেয়েছে। আমি ব্যথায় কাঁতরাতে কাঁতরাতে নিস্তেজ হয়ে গেলাম।
সকাল বেলা উঠেই দেখলাম আমার শরীরে কোনো কাপড় নেই। বিছানায় রক্তে মেখে আছে। পেটে ভীষণ ব্যথা হচ্ছে। মাথাটা বেশ ঝিমুচ্ছে। সারা শরীরে নীল নীল দাগ ছোপ ছোপ হয়ে গেছে। কষ্টে বুকটা ফেটে গিয়েছিল সেদিন। নিজের অসহায়ত্বের মাত্রাটা টের পেয়েছিলাম। নিজের মা এমন করবে সেটা আশা করি নি। মায়েরা নাকি সন্তানের জন্য সব করতে পারে৷ তবে আমার মা সে যে এমন করবে বুঝতে পারিনি। বিছানায় শুয়েই কাঁদতে লাগলাম।
সেদিনেই যদি আমার যন্ত্রণার পরিসমাপ্তি ঘটত তাহলে হয়তো স্বস্থি মিলত। যন্ত্রণার শুরুই ছিল সেদিন। কাঁদতে কাঁদতে স্তবির হয়ে গেলাম। মা আমার রূমে আসলো। মাকে দেখে ঘৃনায় বুকটা ফেটে যেতে লাগল। মা এসে আমার উলঙ্গ শরীরটা ঢেকে দিয়ে যা বলল তা শুনে রিতীমতো আমার শরীরটা কাঁপতে লাগল। কারণ মা বলল-
গল্পের নাম : অন্ধকারে_এক_চিলতে_আলো
লেখিকা-: শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব-2 পর্ব
কারণ মা বলল-
- আজকে রাতে তোমার বিয়ে। রাতে প্রস্তুত থেকো।
মায়ের কথা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম। মনে হলো এটা আমার মা না ডাইনি। একে তো এত নোংরা একটা কাজ করেছে তার উপর এমন কথা বলতে উনার বিবেকে বাঁধল না। আমি মায়ের কথার জবাবে চিৎকার করে বলে উঠলাম
- তুমি কী আমার মা? কোনো মা তো তার সন্তানকে এত কষ্টের মধ্যে ফেলে না। আমাকে দয়া করো মা। আমি তোমার মেয়ে। এ বয়সে তুমি আমাকে কার সাথে বিয়ে দিবে? অল্প বয়স আমার। মা গো এ কষ্টে আমাকে ফেলো না।
- আমি যা বলব তাই হবে। আর শুন এতদিন তোকে বলেনি কারণ বলার প্রয়োজন মনে করিনি। আজকে বলছি আমি তোর মা না। তোর মা অন্যজন ছিল। আমার তো কোনো সন্তানেই নেই। সন্তান দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই।
আমি উনার মেয়ে না? মা এটা কী বলল। মায়ের কথাটা শুনে আমার বুকটা কম্পন দিয়ে উঠল। আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম
- এসব কী বলছো মা? তুমি আমার মা না হলে কে আমার মা?
- আমার আগে তোর বাবার আরেক বউ ছিল। তোর জন্মের পর মারা গেছে। তুই আমার সৎ মেয়ে। আমি তোর সৎ মা। এতদিন বলেনি কারণ বলার মতো কোনো কারণ ছিল না। তুই ও কোনো ঝামেলা করিসনি তাই দয়া দেখিয়ে এসেছি। এখন আজকে তোর বিয়ে সেটা মাথায় রাখ। বয়স অল্প তো কী হয়েছে। তোর শরীর ঠিক থাকলেই হবে। বিয়ে কী আর বয়স দিয়ে হয় না। বিয়ে হয় শরীর দিয়ে। একদম চুপচাপ থাকবি। যা বলব তাই করবি।
- এতদিন তোমার কাজে মনে হত তুমি আমার মা না। আজকে তোমার কথায় তা প্রমাণ হলো। মা আমার বয়সটা অল্প। তবে ছোট থেকে তোমার নোংরামো দেখে বড় হতে হতে অনেক কিছু শিখেছি। আমি তোমার মেয়ে না তবে একটা মানুষ। মানবিক দিক ভেবে হলেও আমার সাথে এমন করো না। আর আমার মতো পিচ্চি মেয়েকে কে বা বিয়ে করবে।
- কেন কাল যে আংকেলটা তোর কাছে ছিল। সে তোকে পছন্দ করেছে। তোকে বিয়ে করলে আমাকে পাঁচ লাখ টাকা দিবে৷ সুতরাং আমার কথার নড়চড় হবে না।
মায়ের কথা শুনে... মা না ডাইনি হবে সে। তার কথা শুনে আমার বুকটা কেঁপে উঠল। সে নোংরা লোকটা নাকি আমার স্বামী হবে। অন্য কেউ হলে হয়তো মানতে পারতাম। মনে আশা নিয়ে থাকতে পারতাম যে ভালো কিছু ও হতে পারে জীবনে। এ নরক থেকে বের হতে পারব। কিন্তু সে আশার আলোও নিভে গেল। সামান্য পাঁচ লাখ টাকার জন্য আমার সাথে নোংরামো করল। আমার বুক ফেটে কান্না আসলো। কান্না জড়িত কন্ঠে অসহায় সুরে বললাম
- দয়াকরে এমন কাজ করো না। ঐ লোকটা একটা বাজে লোক। আমি পারব না উনাকে বিয়ে করতে। তার উপর তোমার সাথে ঐ লোকটার বাজে সম্পর্ক। আপন মা হও বা সৎ মা। মা তো তুমি। নিজের মায়ের যে লোকের সাথে বাজে সম্পর্ক তাকে বিয়ে করতে কীভাবে বলছো?বিয়ে করাতে চাচ্ছ বিয়ে করাও তবে অন্য কারও সাথে।
মা আমার চুলের মুঠি ধরে বলল
- বেশি বেড়ে গেছিস তাই না? তোকে যা বলব তাই করতে হবে। যা এবার গোসল করে নে।
বলেই মা চুলের মুঠিটা টেনে আমাকে আঁচরে ফেলে রুম থেকে চলে গেল।
আমি বসে বসে কাঁদতে লাগলাম। সারা শরীর ব্যথায় নীল হয়ে গেছে। শুয়া থেকে উঠতেই পারছিলাম না। নিজেকে সামলে নিয়ে গোসল করে নিলাম। তারপর নিজেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে কাঁদতে লাগলাম । আমার নাম আলো হলেও আমার জীবনটা আধাঁরে ডুবে রয়েছে। আমি জানি না কবে সে আধাঁর গুচিয়ে এক চিলতে আলোর খুঁজ পাব। আয়নার সামনে দাঁড়িয়েই আমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলাম। ঠিক তখন আমার মা এসে আমার দিকে খাবার বাড়িয়ে দিয়ে বলল
- খেয়ে নে। আর এসব ন্যাকামি কান্না বাদ দে।
আমি মায়ের কথা শুনে মায়ের পায়ে ঝাঁপটে ধরলাম। নিজেকে এত অসহায় এর আগে আমার কখনও লাগে নি। বাচ্চা একটা মেয়ে যার স্কুলের গন্ডি পার হওয়ার কথা ছিল সে আজকে নিজেকে হায়ানার হাত থেকে বাঁচাতে মায়ের পায়ে ঝাঁপটে ধরেছে। আমার মা আমার হাত থেকে নিজের পা ছাড়িয়ে নিয়ে বুক বরাবর একটা লাথি দিয়ে বলল
- বলেছি তো একদম ন্যাকা কান্না করবি না। খাবার দিয়ে গেলাম খেয়ে নে।
বলেই আমার মা চলে গেল। আমি মেঝেতে পরে কাঁদতে লাগলাম। কিছুক্ষণ কেঁদে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আবারও নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে লাগলাম। নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে আবার বিড়বিড় করে বললাম আমি বাঁচতে চাই বলেই কাঁদতে লাগলাম। কাঁদতে কাঁদতে আমার শরীর নেতিয়ে পড়ল। শ্বাস প্রশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসতে লাগল। এসময় মরে গেলে হয়তো আমার জন্য সবচেয়ে ভালো হত। তবে আমি সেটাও পারছি না। কারণ এত সাহস আমার নেই। শরীরটা বেশ ক্লান্ত। সারা রাত অনেক কষ্ট হয়েছে। নিজের মনের মৃত্যু তো সে সাত বছর বয়সেই হয়েছে। এখন শুধু শরীরটা পড়ে রয়েছে। এ শরীরটার জন্য খেয়ে পড়ে বেঁচে আছি। পুরোপুরি শেষ করার সাহস ও পাচ্ছি না। ক্লান্ত শরীর নিয়ে বসে খাবারটা হাতে নিয়ে মুখে দিলাম। এ নরকের খাবার আমার গলা দিয়ে নামছে না। এখান থেকে পালাবার ও কোনো উপায় নেই। আর পালিয়ে যাবই বা কোথায়।
সারাটাদিন কাঁদতে কাঁদতে পার করলাম। সন্ধ্যায় ঐ লোকটা আসলো। এসে আমার কাছে বসে মাকে বলল
- ওকে শাড়ি পড়াও নি কেন? শাড়ি পড়িয়ে নিয়ে এসো। আর কাজী আসছে। কাজীকে অনেক টাকা দিতে হয়েছে বিয়ের জন্য। আগে থেকে সব স্যাটেল করে রেখেছি। কাজী আসতে আসতে শাড়ি পড়িয়ে নিয়ে এসো।
আরে ডার্লিং চিন্তা করো না এখনি নিয়ে আসছি। মায়ের কথাটা শুনে ঘৃনায় বমি আসতে লাগল। যতই হোক আমি উনার মেয়ে আর আমাকেই বিয়ে দিচ্ছে তার প্রেমিকের সঙ্গে আবার আমার সামনেই বলা হচ্ছে ডার্লিং। কতটা নোংরা সম্পর্কে আমি জড়াচ্ছি। মনে মনে বলতে লাগলাম আল্লাহ গো এ নরক থেকে কবে মুক্তি পাব। আমার সহায় হও। মা আমার পাশে এসে আমার হাতটা টেনে ধরে ঘরে নিয়ে গেল। জোর করে শাড়ি পড়িয়ে দিল। কিছুক্ষণ পর কাজী আসলো। সাথে আরও দুজন লোক।বুঝতে পারলাম তারা বিয়ের সাক্ষী। তাদেরও ভাড়া করে এনেছে। কাজীও কেমন সামান্য টাকার জন্য আমার মতো মেয়েকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে পড়াচ্ছে। কাজী যখন বিয়ে পড়ানো শুরু করলো তখন বুকটা আমার ফেটে যেতে লাগল। কলিজা দুভাগ হয়ে যেতে লাগল। কাজী হুট করে বলল
- কবুল বলো।
আমি কাজীর কথার কোনো উত্তর দিলাম না। চুপ হয়ে রইলাম। বারবার কাজী বলারও পরও আমি নিশ্চুপ। আমার নীরবতা দেখে মা চুল টেনে ধরল। বেদরম মার মারতে লাগল। শরীরের যন্ত্রণা এত প্রখর হলো যে আমি কবুল বলতে বাধ্য হলাম। ঘৃনিত হলেও সত্য যে সেদিন আমার মায়ের প্রেমিকের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়।
বিয়ের পর লোকটা আমাকে নিয়ে আসে তার বাসায়। বড় একটা বাসা। দুতলা করা। বাসায় কেউ নেই আমি আর লোকটা ছাড়া। বাসায় এনেই আমার উপর হামলে পড়ে। অসহ্য যন্ত্রণার চিৎকার যেন তার কানে পৌঁছাল ও না। দিনের পর দিন এরকম যন্ত্রণা সহ্য করতে হচ্ছে৷ প্রতিনিয়ত কষ্ট পেতে হচ্ছে। মাঝে মাঝে মা আসে এ বাসায়, এসে ঐ লেকটার সাথে বেশ অন্তরঙ্গ হয়ে থাকে। কতটা ঘৃনিত সম্পর্কে আমি আছি যেখানে মেয়ের স্বামীর সাথে মা থাকে। ভাবতেই গা টা ঘিনঘিন করতে থাকে। এরকম ঘৃনিত সম্পর্কের এক বছর পর মাত্র তের বছর বয়সে আমি মা হতে চলি। কিন্তু আমার বাচ্চাটাকে খুন করে আমাকে চিরতরে মা হওয়ার পথ বন্ধ করে দেয় আমার ডাইনি মা আর ঐ লোকটা। কারণ তারা তো আমাকে ভোগের পন্য ভাবে। মাতৃত্ব হারানোর কষ্ট একটা মেয়ের জন্য কতটা প্রখর সেটা আমি জানি। তাও সেটা উপলব্ধি করেছিলাম মাত্র তের বছর বয়সে। আমার বয়সী মেয়েরা হেসে খেলে জীবন যাপন করে। আর আমি বাস্তবতার কষাঘাতে পড়ে মরছি৷ সারাদিন শুধু কষ্ট হয় আমার। আমার এ নরক জীবন থেকে হয়তো কখনো মুক্তি মিলবে না। কবে আমি মুক্ত আকাশে ডানা মেলে উড়তে পারব জানি না। এ নরক যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছি না। কিন্তু প্রতিনিয়তই আমাকে এ নরক যন্ত্রণা সহ্য করতে হচ্ছে।
যন্ত্রণার আগুনে আরও এক বছর পুড়ে ১৪ তে পা রাখলাম। এ অল্প বয়সে কতটুকু কষ্ট সহ্য করেছি সেটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। রোজ রোজ লেকটার অত্যাচার শারীরিক যন্ত্রণা পাওয়া ছিল রোজকার রুটিন। জানি না এ জীবন থেকে আমি মুক্তি পাব কিনা। অন্ধকারে এ চিলতে আলোর দেখা কী আমার জীবনে মিলবে? কি হলো মিলবে বলো?
কথাগুলে আলো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিচ্ছবিকে বলছিল। আলোর কথা বলার কোনো সঙ্গী নেই। এ বাসায় একা একাই থাকে। মাঝে মাঝে লোকটা আসে বাজার করে দিয়ে যায় আর নিজের মতো করে ভোগ করে চলে যায়। বাকিটা সময় আলো একাই থাকে। আর বেশির ভাগ সময় আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিচ্ছবির সাথে কথা বলে। আজকেও তার ব্যতিক্রম হলো না। আজকে তার ১৪ তম জন্মদিনে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া কালো অধ্যায়ের বর্ণণা করছিল আলো। আর জিজ্ঞেস করছিল নিজের প্রতিচ্ছবিকে এটা যে, অন্ধকারে এক চিলতে আলোর দেখা কী তার জীবনে মিলবে না? প্রশ্নটা বেশ কয়েকবার আয়নাকে করলো।এমন সময় আলো দরজা খোলার আওয়াজ পেল। আলোর আর বুঝতে বাকি রইল না ঐ লোকটা এসেছে৷ আলো ভয়ে কুকড়ে যেতে লাগল। কারণ আজকের দিনে অন্তত যন্ত্রণা সহ্য করতে সে চায় না। তাই নিজেকে সামলে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে অবাক হয়ে গেল।
গল্পের নাম : অন্ধকারে_এক_চিলতে_আলো
লেখিকা-: শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব-3 পর্ব
গল্পের নাম : অন্ধকারে_এক_চিলতে_আলো
লেখিকা-: শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব-4 পর্ব
বসার মিনেট দুয়েক পরেই ভয়ে কেঁপে উঠল একটা আওয়াজ পেয়ে। বিকট একটা হাসির আওয়াজ রাস্তার পাশের গাছের আড়াল থেকে আসছে। আলো আঁচমকা হাসির আওয়াজটা পেয়ে কেঁপে গিয়ে বুকে থুথু দিয়ে গাছের আড়ালে নজর দিয়ে দেখতে লাগল বিষয়টা কী। আলোর নজর সেখানে পড়তেই খানিকটা অবাক হলো। একটা মেয়ে আর ছেলে কত অবাধে মেলামেশা করছে। মেয়েটা সিগারেট টেনে ধোয়া উড়াচ্ছে ছেলেটাও সাথে সাথে ধোয়া উড়াচ্ছে। সে সাথে মেয়েটা স্বেচ্ছায় সব বিলিয়ে দিচ্ছে।।দেখে মনে হচ্ছে বেশ বড় ঘরের মেয়ে।
" শহরের অলিগলিতে এমন অনেক ছেলেমেয়েকেই দেখা যায় যারা ব্যক্তি স্বাধীনতার নাম করে অশালীন হয়ে ঘুরে বেড়ায়। নারী স্বাধীনতা মানে তো এই না যে কোনো ছেলের সাথে বসে অবাধে মিলতে হবে। সিগারেট খেতে হবে। রাত বিরাতে নিজেকে বিলিয়ে দিতে হবে। নারী স্বাধীনতা মানে এই যে সমাজে ভালো কাজ গুলোতে পুরুষের সাথে তাল মিলিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া।সাবলম্বী হওয়া। আজকাল অনেক নারীরায় নারী স্বাধীনতা বলতে নেতিবাচক টায় গ্রহণ করে। "
আলো বিষয়টা লক্ষ্য করার পর সেখানে বসার সাহস পেল না। নেশায় ডুবে থাকা দুটো ছেলে মেয়ের কাছে থাকতেও আলোর বিবেকবোধ নাড়া দিচ্ছে। কখন তারা মানুষ থেকে হায়ানার রুপ নেয় বলা যায় না। কারণ নেশা যেকোনো মানুষের মস্তিস্ক বিকৃতি ঘটাতে সক্ষম।তাই আলো আস্তে করে উঠে সামনের দিকে আগালো। আগাতে আগাতে অভার ব্রিজটার নীচে আসতেই আলো দ্বিতীয় বারের মতো কেঁপে উঠল একটা মেয়ে আর ছেলেকে অভার ব্রিজের নীচের জায়গায় অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায় দেখে। তারা আলোকে দেখেই সেখান থেকে উঠে সামনের দিকে যেতে লাগল। আলো বেশ ভালোই বুঝতে পারল টাকার বিনিময়ে দেওয়া নেওয়া চলছে তাদের। আলোর এবার ভয় হতে শুরু করল। কখন জানি কোন হায়েনা এসে আলোকে খুবলে খায়। এ অন্ধকার শহরের গলিতে একটা যুবতী মেয়ের একা চলাফেরা বেশ আশঙ্কাজনক। আলো যতই সামনের দিকে হাঁটতে লাগল ততই আলোর ভেতরটা কম্পিত হতে লাগল। অনিশ্চিত পথ বরাবর আলো হাঁটছে। আলো জানে না এ অন্ধকার কবে ঘুচবে। রাতের অন্ধকার হয়তো কিছুক্ষণ পর ঘুচে যাবে কিন্তু জীবনের অন্ধকার কবে ঘুচবে। ভাবতে ভাবতে সামনের দিকে আগাল। আলোর চোখ পড়ল একটা মেয়ের দিকে। লক্ষ্য করল মেয়েটা হাতে রেশমি লাল চুরি পড়েছে। কপালে বড় টিপ। চুলগুলো খোপা করা। পরনে পাতলা জরজেট শাড়ি আর স্লিভলেস ব্লাউজ। ঠোঁটে কড়া করে লিপস্টিক দেওয়া। কতক্ষণ পরপর কল ধরছে আর কার সাথে যেন কথা বলছে। আলো এক কোণে দাঁড়িয়ে মেয়েটাকে অবলোকন করতে লাগল। মেয়েটা কল কেটে আবার মুখের সাজগোজ হাত দিয়ে দেখছে। মাঝে মাঝে শাড়ি ঠিক করছে। এমন সময় একটা গাড়ি এসে থামল মেয়েটার সামনে। গাড়ি থেকে বেশ হ্যান্ডসাম ভদ্রলোক বের হয়ে আসলেন। বয়স আনুমানিক ৩০-৩৫ হবে। এসেই মেয়েটার হাত ধরে গাড়িতে তুললেন।
আলো বুঝতে পারলো মেয়েটা এতক্ষণ এ লোকটার সাথেই কথা বলছিল।
"শহরের অন্ধকার গলিতে কতশত অন্ধকার ঘটনা রয়েছে সেটা অন্ধকার পথে না হাঁটলে হয়তো দেখা যেত না। দিনের বেলা যারা মস্ত অফিসের সাহেব রাতের বেলায় তারা কোনো কোনো পতিতালয়ের মেয়ের খদ্দের। দিনের বেলা তারা নারী অধিকার নিয়ে চিল্লায়৷ নারী সম্মান নিয়ে চিল্লায়। রাতের বেলায় তারা নারীর সম্মান ধুলোয় লুটায়। এ হলো আজকের ভদ্র সমাজের দিন আর রাতের কাহিনি।"
আলো যতই দেখছে ততই অবাক হচ্ছে। আলো এবার সামনের দিকে আগাল। কিছু দূর যেতেই আলোর পিছু নিল এক লোক। আলো তা বুঝতে পেরে জোরে হাঁটতে লাগল। লোকটাও হাঁটতে লাগল জোরে। আর পেছন থেকে জোরে জোরে বলতে লাগল
- আরে যাও কোথাও।এদিকে এসো। ভয় পাওয়ার কী আছে। দুইশো বাড়িয়ে দিব। একদম পুষিয়ে দিব।সুন্দরী এদিকে এসো।
আলো এবার দৌঁড় লাগাল। কারণ নিজেকে আর ভোগের পন্য বানাতে আলোর ইচ্ছা হচ্ছে না। আলোর পেছন পেছন লোকটাও দৌঁড়াতে লাগল। দৌঁড়ানোর এক পর্যায়ে লোকটা আলোকে ধরে ফেলল। আলো নিজেকে ছাড়াবার বেশ চেষ্টা করছিল।তবে পারছিল না। যতই ছাড়ানোর চেষ্টা করছিল লোকটা ততই আলোর এক হাত চেপে ধরছিল। আলোর পেটের দিক,কোমরের দিকে হাত দিতে লাগল।আলোর এবার অস্বস্থি হতে লাগল। ভাবলো নিজের সম্মান পুনরায় বিসর্জন দেওয়ার থেকে মরে যাওয়া শ্রেয়। তবে এ হায়ানার হাত থেকে ছুটতে পারলে হয়তো মরার চেষ্টা করতে পারবে।ছুটতে না পারলে তো তাও করা যাবে না। কী করবে বুঝতে পারছে না। এদিকে লোকটা দস্তাদস্তি করেই যাচ্ছে।।দস্তাদস্তির এক পর্যায়ে আলো লোকটার চোখ বরাবর আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিল। আলোর হাতে রক্ত মেখে একাকার।লোকটা আলোকে ছেড়ে চোখটা চেপে ধরল।আর আলো সে সুযোগে দৌঁড় লাগাল।
দৌঁড়ানোর এক পর্যায়ে আলো হাঁপিয়ে গেল। লক্ষ্য করলো একটা পার্কে এসে পৌঁছেছে। আলোর তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে।।সারা শরীরে ঘাম দিচ্ছে। শরীরটা নিস্তেজ হয়ে যেন অসাড় হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যেই পার্কের রমরমা দৃশ্য আলোর চোখে পড়ল। টাকার বিনিময়ে চলছে শরীর দেওয়া নেওয়ার খেলা। আলো বুঝতে পারলো এখানে থাকাও আলোর জন্য বিপদ জনক।আলো নিজের রক্ত মাখা হাতটা কাপড়ে মুছে সামনের দিকে দৌঁড়াতে লাগল। আলো জানে না এ পথের শেষ কোথায়।।কোথায় যাবে সে। শুধু জানে অন্ধকারে এক চিলতে আলোর দেখা মিলতেও পারে। প্রায় আধাঘন্টা দৌঁড়ানোর পর আলো রাস্তায় হোঁচট খেয়ে পড়ল। এবার আলো আরও চমকালো। কারণ সে লক্ষ্য করল সোডিয়াম আলোর নীচে দাঁড়িয়ে আছে অনেক সুদর্শন পুরুষ। সেখানে আবার কিছু কিছু নারী এসে তাদের থেকে একজনকে পছন্দ করে গাড়িতে তুলছে। আলো এবার হাজার কষ্টে থেকেও মনে মনে বিকৃত হাসলো। এ সমাজে শুধু মেয়েরায় ভোগের পন্য না ছেলেরাও ভোগের পন্য। টাকার জন্য তারাও এসব কাজে নামতে বাধ্য হয়। আলো নিজেকে সামলালো।
শহরের অলিগলিতে যতই আলো ছুটছে ততই একেকটা কাহিনি আলোর সামনে পড়ছে। দিনের শহর আর রাতের শহরের মধ্যে কত তফাৎ। অন্ধকার ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে রাতের শহরটা হয়ে যায় অন্ধকারে মোড়ানো নষ্ট গলি। আর আলো ফুটার সাথে সাথে শহরটা হয়ে যায় কর্ম ব্যস্তময় প্রাণ চঞ্চল আর সজীব।
আলোর পানির পিপাসাটা বাড়তে লাগল। আলো নিজেকে সামলে নিয়ে সামনের দিকে এগুতে লাগল। আলোর পা টা আর চলছে না। ক্ষুধায় পেট জ্বলে যাচ্ছে। শরীরে কোনো শক্তি পাচ্ছে না। তবুও কষ্ট করে সামনের দিকে এগুচ্ছে। এগুতে এগুতে একটা গাছের সামনে এসে হেলান দিয়ে বসলো। চোখটা বুজে আসছে আলো। এমন সময় আলো একটা লাঠির স্পর্শ পেল। আচমকা এমন লাঠির স্পর্শ পেয়ে আলো চোখটা মেলে দেখল পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। আলোকে চোখ খুলতে দেখেই জিজ্ঞেস করল
- এখানে কী?
- নাহ তেমন কিছু না স্যার।
- বাসা কোথায়?
- সামনেই।
- তাহলে এখানে কী? রাস্তায় নেমেছিস নষ্টামি করতে নাকি?
- মুখ সামলে কথা বলুন।
- মুখ সামলাবো কেন? এত রাতে রাস্তায় বসে আছি কিছু বুঝি না ভাবছিস। চল থানায় চল।
- আমাকে থানায় নিবেন না স্যার। আপনি যা ভাবছেন আমি তা না।
লোকটা মুচকি হেসে বলল
- তুই বললে তোকে কিছুই করব না। আমাকে একটু খুশি করলেই হবে।
পুলিশটার কথা শুনে আলোর বুকটা কেঁপে উঠল। এদের হাতে নাকি নিরাপত্তার দায়ভার। অথচ এদের থেকে নিরাপদ থাকাটা সবার আগে জরুরী।এরা তো নিরাপত্তা দেওয়ার নামে নিরাপদ মানুষটাকে বিপদে ফেলে। তবে পুলিশ সমাজে এর ব্যতিক্রম ও আছে যারা নিরাপত্তা দিতে তৎপর। তবে তার পরিমাণ সংখ্যালঘু। আলো পুলিশটার কথা শুনে কিছু না বলেই তৎক্ষনাৎ উঠে দৌঁড় দিল। পুলিশটা পিছু নিলেও আলো নিজেকে বাঁচাতে সক্ষম হলো।
আলো দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে কোথায় এসে পৌঁছেছে সে নিজেও জানে না। এ রাস্তায় কোনো সোডিয়াম আলো ও নেই। পুরো রাস্তাটা বিদঘুটে অন্ধকার।এ অন্ধকারটায় আলোর ভয়ের কারণ।অন্ধকারটা এতই প্রখর যে আলো শুধু নিজের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পারছে এছাড়া কোনো আওয়াজ বা কিছু দেখতে পারছে না। আলোর মাথাটা প্রচুর রকমে ঝিমাতে লাগল। তার চোখ গুলো বন্ধ হয়ে যেতে লাগল। মাথায় অসহ্য ব্যথা সে সাথে পেটের ক্ষুধা। সব মিলিয়ে আলো ক্লান্ত। অন্ধকারে শুধু হেঁটেই যাচ্ছে সে। নীলার কথা মনে পড়ছে তার। জানে না সে নীলা কোথায় আছে। সে কী পেরেছে এসব মোকাবেলা করতে। নাকি সে এতক্ষণে কারও খাদক হয়ে গেছে৷ কথাটা মনে আসতেই আলোর হার্টবিট বেড়ে কম্পন দিতে লাগল। নীলার জন্য খুব মন খারাপ লাগতে লাগল আলোর। কারণ নীলার সাথে থাকলে হয়তো চলার পথটা আরও মসৃন হতো। সামনের দিকে এ অন্ধকারে কোথায় যাচ্ছে জানে না সে। কোথায় থেকে যেন কুকুরের কান্না আসছে। কুকুরের কান্নাটা আলোর বেশ অসহ্য লাগছে৷ সারাশরীর অবশ হয়ে যেতে লাগল। চোখ গুলো শত চেষ্টার পরও খুলতে পারছিল না। একটা সময় মাটিতে নেতিয়ে পড়ল।
অনেক্ষণ পর চোখটা যখন খুলল তখন ভোরের আলো, তার চোখে পড়ল। সে চোখটা খুলে আশপাশ তাকাল। একটা পরিপাটি রুমে সে শুয়ে আছে। আলো বুঝতে পারছে না সে কোথায়। আলো কিছুটা অবাক হয়ে উঠতে নিলেই কেউ একজন পেছন থেকে আলোর মুখটা চেপে ধরল। আলোর ভেতরটা কম্পিত হলো।।ভাবতে লাগল সে কী আবার কোনো নোংরা লোকের পাল্লায় পড়ল। ভাবতে ভাবতেই আলো পেছন ফিরে তাকাতেই ভয়টা তার আরও বেড়ে গেল।
গল্পের নাম : অন্ধকারে_এক_চিলতে_আলো
লেখিকা-: শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব-5 পর্ব
ভাবতে ভাবতেই আলো পেছন ফিরে তাকাতেই ভয়টা তার আরও বেড়ে গেল। আলো খেয়াল করল একটা ছেলে তার মুখটা চেপে ধরেছে। ছেলেটার মাথায় ঝাঁকরা কুকড়া চুল। গালে খুচা খুচা দাঁড়ি। গায়ের রঙ শ্যাম বর্ণ। নাক বুচাও বলা যায় না আবার খাড়াও বলা যায় না৷ দুয়ের মাঝে বলতে হবে। চোখ গুলো একটু বড় বড়। ছেলেটাকে দেখে আলোর আশার আলো যেন নিভে গেল। বুঝতে পারল সে আরেকটা হায়েনার কবলে পড়েছে। আলো তার চোখের দিকে তাকাল। কিন্তু একটা হায়েনার চোখ এত নিষ্পাপ কেন মনে হচ্ছে। কেন জানি না এ ছেলেটাকে আলো হায়েনা ভাবতে পারছে না। কেননা একটা হায়েনার চাহুনি তো এত সুন্দর হতে পারে না। সে অপলক দৃষ্টিতে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুখে চেপে ধরা ছেলেটার হাতটা নিজের হাত দিয়ে ছুটাতে চাইতে নিলেই ছেলেটা হাতটা ছেড়ে দিয়ে নিজের আঙ্গুল দিয়ে ঠোঁট চেপে আলোকে ইশারা দিয়ে বলল
- চিৎকার চেঁচামেচি করবেন না দয়াকরে। মা বিষয়টা অন্যভাবে নিতে পারে। আমি আপনার কোনো ক্ষতি করব না। রাস্তায় আপনি পড়ে ছিলেন। আপনাকে সেখান থেকে তুলে বাসায় এনেছি। মাকে বলেছি আপনি আমার বন্ধুর বোন। এখানে হোস্টেলে থেকে পড়েন। হুট করে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন আর আমার বন্ধু গ্রামে তাই আপনাকে আমার বাসায় নিয়ে এসেছি। আমার মা অনেক কড়া মানুষ। আপনি যদি বিষয়টা না বুঝে আমাকে ভুল বুঝে চিৎকার করে বসেন তাহলে মা ভুল বুঝবে। আমি আপনার কোনো ক্ষতি করব না। এসেছিলাম আপনার জ্ঞান ফিরেছে কী না দেখতে। কারণ গতকাল ডাক্তার দেখে বলল যেকোনো সময় আপনার জ্ঞান ফিরতে পারে। রাতে অনেকবার দেখে গিয়েছি। সকালে এসে দেখলাম আপনার জ্ঞান ফিরেছে। মনে হলো আপনি চেঁচিয়ে উঠবেন। তাই মুখটা চেপে ধরেছি। দয়া করে চেঁচাবেন না।
বলেই ছেলেটা আলোর কাছ থেকে একটু দূরে গিয়ে বসলো। আলো হালকা দম নিতে লাগল। সে সাথে ঢুক গিলতে লাগল। একটু স্বস্তি যেন আলো পেল। সে মৃদু গলায় ছেলেটাকে জবাব দিল
- আপনার এ উপকারের কথা ভুলব না।আপনি যা বলবেন আমি আপনার মা কে তাই বলব। কিন্তু আমাকে একটা সাহায্য করবেন দয়াকরে। আর আপনার নাম কী?
ছেলেটা মুচকি হেসে বলল
- আমার নাম তানভীর। সবে অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ছি। টুকিটাকি গান করা আমার শখ। সে সাথে আঁকাআঁকির একটা বদঅভ্যাস আছে। দুই ভাই আমার। বড় ভাই বিদেশে থাকে। সেখানেই পড়াশোনা করছে। আর আমি বাংলাদেশে। বাবা মারা গেছেন সে ছোট্ট বেলায়। এরপর থেকে মায়ের হাতে মানুষ। বাবার বিশাল ব্যবস্যা আর আমাদের মানুষ করার দায়িত্বটা মায়ের হাতেই পড়ে। মা খুব কঠিন আবার খুব নরম ও বলতে পারেন। বাবার মৃত্যুর পর মা কঠোর পরিশ্রম করে আমাদের ব্যবস্যাটা বাড়ায়। আর আমাদের মানুষ করে। এ পরিবারে সবকিছু মায়ের কথায় চলে। গতকাল একটা কনসার্টে গিয়েছিলাম। ফেরার সময় গাড়ির আলোতে লক্ষ্য করলাম কী যেন রাস্তায় পড়ে আছে। একটু ভয় ও লাগছিল কারণ অনেকে বলে রাস্তাটা ভুতূরে রাস্তা।মায়াবী আত্মারা নাকি সে রাস্তায় হেঁটে বেড়ায়। ভেবেছিলাম কোনো আত্মা হবেন তবে মনে সাহস নিয়ে নেমে দেখলাম আপনি আমার মতো রক্তে মাংসে গড়া মানুষ। এভাবে এত রাতে ঐ রাস্তায় ফেলে আসতে মন সায় দিল না। তাই সাথে করে নিয়ে এসেছি। মাকে কী বলব বুঝতে পারছিলাম না তাই ঐরকম বলেছি। আরও কিছু বলা লাগবে? আপনি আরও প্রশ্ন করার আগেই সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিলাম।
আলো শুধু অপলক নয়নে তানভীরের দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটা কতটা সাবলীল হয়ে এক নিঃশ্বাসে সব বলে যাচ্ছে। আলোর মনে হচ্ছে তানভীরকে সে যুগ যুগান্তর ধরে চেনে। আলোকে পলকহীনভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে তানভীর দীর্ঘ নিঃশ্বাস টেনে বলল
- কী হয়েছে কী ভাবছেন? গড়গড় করে কথা বলে যাচ্ছি। আপনি কোনো কথা কেন বলেছেন না? কথা শেষ করে বসে আছি আর আপনি আমার দিকে তাকিয়ে কী দেখছেন? নাকি আমার দিকে তাকিয়ে অন্য কাউকে ভাবছেন?
আলো মৃদু গলায় জবাব দিল
- তেমন কিছু না। আপনি বেশ সাবলীল ভাবে কথা বলছিলেন সেটাই শুনছিলাম। ধন্যবাদ আমাকে সাহায্য করার জন্য।
- ধন্যবাদ দিতে হবে না৷ আচ্ছা আপনি ঐ রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলেন কেন? আর আপনার শরীরেও টুকিটাকি আঘাতের চিন্হ আছে। ছিনতাই কারীর কবলে পড়েছিলেন?
আলো তানভীরের এ প্রশ্নের জাবাব কী দিবে বুঝতে পারছে না। তানভীরকে কী সে তার জীবনের সব বলে দিবে নাকি লুকাবে। তার মনে হলো সে যদি তানভীরকে তার কালো অধ্যায়ের কথা বলে তাহলে তানভীরও তার সুযোগ নিতে পারে। তানভীরকে বুঝতে দেওয়া যাবে সে অসহায়। ঘুরিয়ে পেচিয়ে অন্য উত্তর দিবে। আলো হালকা কাশি দিয়ে বলল
- নাহ ছিনতাইকারীর হাতে পড়েনি। বাসা থেকে পালিয়ে এসেছি।
তানভীর গাল দুটো ফুলিয়ে মুখে সবটা বাতাস ঢুকিয়ে পরক্ষণে তা ছেড়ে দিয়ে বলল
- বাসা থেকে পালিয়ে এসেছেন মানে?
- আমার বাবা আমাকে বিয়ে দিতে চেয়েছিল।ছেলেটা একদম ভালো না। জোর করে বিয়ে দিতে চেয়েছিল আর কী।ছেলে আমার থেকে পঁচিশ বছরের বড়। আমার সবে ষোল।( বয়সটা দুই বছর আলো লুকালো কারণ তার মনে হলো সে কমবয়সী সেটা তানভীরকে বললে তানভীর বিষয়টা মিথ্যা মনে করতে পারে) অল্প বয়স তার উপর বিয়ের চাপ নিতে পারছিলাম না। বিয়েতে মোটেও রাজি ছিলাম না। তাই রাজি করানোর জন্য বাবা গায়ে হাত তুলে। আর তার জন্যই শরীরে আঘাতের চিন্হ। গতকাল রাতে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল তাই বাসা থেকে পালিয়ে চলে এসেছিলাম। কখন যে জ্ঞান হারালাম খেয়ালেই নেই।
তানভীর অবাক হয়ে বলল
- তাই বলে বাসা থেকে পালাবেন। এত সাহস আপনার?
- আমার মতো পরিস্থিতিতে পড়লে বুঝতেন। আর আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি।
- তাহলে তার সাথে পালাতেন। একা পালাতে গেলেন কেন?
- সে তো এ দেশে নেই। সে ও আপনার ভাইয়ের মতো বিদেশ থাকে। তাই বাধ্য হয়ে একা পালিয়েছি। আপনি দয়াকরে আমাকে একটা থাকার ব্যবস্থা করে দিবেন।
- বেশ মুশকিলে ফেললেন। মাকে কী বলব বুঝতে পারছি না। মা কে তো বলেছিলাম আপনি এখান থেকে সুস্থ হলে চলে যাবেন। চিন্তায় পড়ে গেলাম আপনার কথা শুনে। দেখা যাক কিছু করতে পারি কিনা।
আলো হাতটা জোর করে তানভীরের দিকে তাকিয়ে বলল
- দয়াকরে রাজি করাবেন। আমি জানি আপনি পারবেন। তারপর আমার প্রেমিক চলে আসলে আপনি যা চান তাই দেবো।
- লোভ দেখাচ্ছেন আমাকে?
আলো নিজের জিভে নিজের দাঁত দিয়ে কামড় দিয়ে বলল
- আরে লোভ দেখাব কেন। সত্যি বলছি।
- তাহলে ঘুষ দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
- ঘুষ কেন হবে? সেটা আমি খুশি হয়ে দেবো। আর খুশি হয়ে কিছু দেওয়াকে ঘুষ না হাদিয়া বলে। বুঝছেন?
- বুঝলাম। সাহায্যটা করতাম না যদি সুযোগ্য পাত্রের সাথে আপনার বিয়ে ঠিক হওয়ার পর পালিয়ে আসতেন। যেহেতু বলেছেন পাত্র ভালো না আর পরিবারও আপনাকে সাপোর্ট করছে না তাই যেভাবে হোক মাকে বুঝিয়ে এখানে থাকার ব্যবস্থা করব। তবে আমি যা বলি তাই করবেন। নাহয় মাকে ম্যানেজ করা কষ্ট হয়ে যাবে।
আলো মাথাটা নেড়ে বলল
- আপনি যা বলবেন তাই করব।
কথাটা বলা শেষ করতে না করতেই তানভীরের মা জাহানারা সুফিয়া রুমে প্রবেশ করলেন। জাহানারা সুফিয়া প্রবেশ করার সাথে সাথে তানভীর একদম চুপ হয়ে গেল। আলো লক্ষ্য করল মহিলাটা দেখতে অনেক সুন্দরী। তাকে দেখেই মনে হচ্ছে অনেক সতেজ। চেহারায় বয়সের কোনো ছাপ নেই। এত বড় বড় দুটো ছেলে আছে উনাকে দেখে কেউ বলবে না। উনার মুখের এক কোণে হাসির বিন্দু পরিলক্ষিত করলো আলো।।সে ভাবতে লাগল তানভীর উনাকে কেন এত ভয় পায়। দেখে মনেই হচ্ছে না উনার মধ্যে কোনো রাগ আছে। আলো পরক্ষণে ভাবলো উনি কতটা ভালো স্বামী মারা যাবার পর নিজের সন্তান নিয়েই বাকিটা জীবন কাটিয়েছে৷ অথচ আলোর মা নিজের স্বামীকে নিজে খুন করেছে। পৃথিবীতে নেতিবাচক দিকের বাইরে এসব ইতিবাচক দিক আছে বলেই হয়তো পৃথিবীটা এখনও সুন্দর,এখনও টিকে আছে। আলোর ভাবনার বিচ্যুতি ঘটল জাহানারা সুফিয়ার ডাকে। উনি নরম সুরে বললেন
- কী অবস্থা এখন? আর শরীর কেমন লাগছে?
আলো মৃদু সুরে জবাব দিল
- অনেক ভালো লাগছে এখন।
- নাস্তা কী কেউ দিয়ে গেছে?
আলো মাথা নেড়ে না বলল। জাহানারা সুফিয়া তানভীরের দিকে কটু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
- নাস্তা দিতে বলো নি কাউকে কেন?
- মা মাত্রই জ্ঞান ফিরল ওর।
- নাস্তা দিতে বলো। আর আমি অফিসে যাচ্ছি। সে আমাদের অতিথি খালাকে বলবে যত্নের ত্রুটি যেন নাহয়। আর ওর ভাই কী গ্রাম থেকে ফিরেছে?
তানভীর ঢুক গিলতে গিলতে বলল
- নাহ,মা ফেরে নি।
- আচ্ছা আমি গেলাম। ফিরলে আমাকে জানিও।
কথাটা বলে রুম থেকে বের হতে নিয়েও আবার রুমে ঢুকে আলোর দিকে তাকিয়ে বলল
- তুমি কোন স্কুলে পড়ো বা কলেজে? আর নাম কী তোমার?
আলো মৃদু গলায় জবাব দিল
- আমার নাম আলো।
জাহানারা সুফিয়া কিছুটা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
- তানভীর বলল তোমার নাম তরী। তুমি বলছো আলো।
মায়ের এমন প্রশ্নে তানভীরও কিছুটা বিভ্রত হয়ে গেল। ভাবতে লাগল ধরা পড়ে যাবে না তো। এর মধ্যেই আলো চট করে জবাব দিল
- আমাকে বাসায় সবাই আলো নামে ডাকে আর স্কুলের সবাই তরী নামে ডাকে।
- ওহ! তাই বলো। কোন স্কুলে পড়ো? আর কোন হোস্টেলে থাকতে?
আলো এবার ঢুক গিলতে লাগল। ভাবতে লাগল কী জবাব দিবে। ধরা পড়ে যাবার উপক্রম। তানভীরও বেশ দুটানায় পড়ে গেল। বুঝতে পারছিল না এর উত্তর কী দিবে? দুজনের মাথায় যেন বাজ পড়ল। আর ধরা পড়ে যাওয়ার একটা আশঙ্কা অনুভব করল। ঠিক এ মুহূর্তে...
গল্পের নাম : অন্ধকারে_এক_চিলতে_আলো
লেখিকা-: শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব-6 পর্ব
দুজনের মাথায় যেন বাজ পড়ল। আর ধরা পড়ে যাওয়ার একটা আশঙ্কা অনুভব করল। ঠিক এ মুহূর্তে তানভীর চট করে চপল গলায় বলে উঠল
- ও তো মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজে পড়ে। এবার দশম শ্রেণীতে।
তানভীরের কথায় সুর মিলিয়ে আলো বলে উঠল
- জি আন্টি ভাইয়া ঠিক বলেছেন।
জাহানারা সুফিয়া কোনো উত্তর না দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ রইল৷ তারপর হালকা গলায় বলল
- আলো নিজের যত্ন নিও। আর নাস্তা দিলে খেয়ে নিও। খারাপ লাগলে আমাকে কল করো। ওহ! তোমার মোবাইল নম্বর তো আমার কাছে নেই। মোবাইল নম্বরটা দাও।
আলো যতই জাহানারা সুফিয়ার সাথে কথা বলছিল ততই কথার জটিলতায় জড়িয়ে যাচ্ছিল। আলো বুঝতে পারছিল না কী বলবে। কারণ তার কোনো মোবাইল নেই। তবুও কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে ভয় ভয় গলায় বলল
- আমার তো কোনো মোবাইল নেই।
জাহানারা সুফিয়া কিছুটা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
- মোবাইল নেই তাহলে বাড়িতে যোগাযোগ করো কী দিয়ে। তুমি তো আর পরিবারের সাথে থাকো না।
এবারও আলো উনার কথা শুনে ভয়ে চুপসে গেল। যে কথারেই জবাব দিচ্ছে সে কাথারেই কোনো না কোনো কিন্তু রয়ে যাচ্ছে। এখন বুঝতে পারছে সে তানভীর কেন তার মাকে এত ভয় পায়। আলো একদম চুপচাপ। আলোর নীরবতা দেখে জাহানারা সুফিয়া আলোকে ডেকে বলল
- কী ব্যপার চুপচাপ কেন? বেশি খারাপ লাগছে নাকি?
আলো মাথাটা নাড়িয়ে বলল
- নাহ! তেমন খারাপ লাগছে না। আমি তো আমার ভাইয়ের সাথে থাকি। ভাইয়ার ফোন দিয়েই মা,বাবার সাথে কথা বলতাম। তাই আমার কোনো মোবাইল নেই।
-ওহ আচ্ছা। তোমার ভাইয়ের নাম যেন কী?
আলো চট করে বলে উঠল
- ছোটন।
আলোর জবাবে তানভীর হতবাক। সে জিহ্বায় নিজের দাঁত দিয়ে কামড় দিয়ে মাথায় হাত দিল। আলো তানভীরের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল তানভীর তার মাকে অন্য নাম বলেছে। আলো ও এবার ভয় পেতে লাগল। জাহানারা সুফিয়াকে যতটা নীরব এবং সরল বাইরে থেকে বুঝা যাচ্ছিল তিনি তার ঠিক বিপরীত। প্রতিটা কথা তিনি পর্যবেক্ষণ করছেন বিচক্ষণ ভাবে। আর সে জন্যই তিনি মেয়ে হয়েও একজন সফল ব্যবসায়ী। এর মধ্যেই উনি বলে উঠলেন
- তাহলে শায়ান কে?
তারপর তানভীরের দিকে তাকিয়ে বললেন
- তুমি তো বলেছিলে ও শায়ানের বোন। তাহলে ছোটন কে? তানভীর তোমার কথার সাথে আলোর কথায় বেশ অসামান্জস্য রয়েছে। কী হয়েছে আমাকে সঠিক করে বলো তো।
তানভীর তার মায়ের কথার জবাব কী দিবে বুঝতে পারছিল না। সবকিছুই যেন তালগোল পাকাতে লাগল। মাথাটাও তার এত কথার প্যাঁচে ঘুরাতে লাগল। ধরা পড়ে যাওয়ার একটা ভয় কাজ করছে। আর ধরা পড়লে কী হবে সেটা ভেবেও তার মাথা ব্যথা করতে লাগল। এদিকে আলো জাহানারা সুফিয়ার কথা শুনে পাশ থেকে মৃদু কন্ঠে বলে উঠল
- আমরা সবাই শায়ান ভাইকে ছোটন বলে ডাকি। তানভীর ভাইয়া ভুল কিছু বলেনি আন্টি।
জাহানারা সুফিয়া এবার সন্দেহদৃষ্টি ত্যাগ করে তানভীরের দিক থেকে চোখ সরিয়ে আলোর দিকে তাকিয়ে বলল
- যাক ভালো। সত্যি বলতে তানভীর বেশ অগোছাল।ওর কথায় আর কাজে কোনো মিল নেই। তুমি আবার আমার কথায় মনে কিছু নিও না। এর আগে ও এমন কতগুলো কাজ করেছে যেটাতে আমি বিরক্ত। আর বিরক্তের বশবর্তী এবং তার বোকামির শিকার বেশ কয়েকবার হয়েছি বলেই ওকে এত প্রশ্ন করা।
কথাগুলো বলে উনি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল
- অলরেডি আটটা বেজে গেছে। এখন অফিস যেতে হবে। বাকি কথা সন্ধ্যার পর হবে। কোনো অসুবিধা হলে বাসার ফোন দিয়ে আমাকে কল দিও অথবা তানভীরকে বলো। আমি গেলাম।
আলো লাজুক একটা হাসি দিয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে বলল
- আচ্ছা ঠিক আছে আন্টি। আপনি চিন্তা করবেন না। আমি ঠিক আছি।
জাহানারা সুফিয়া আর দাঁড়াল না সোজা ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
আর আলো ভাবতে লাগল এর আগে কী তানভীর কোনো মেয়েকে এনে এ বাসায় ঝামেলা করেছে? যদি ঝামেলায় না করত তাহলে তো উনি এভাবে বলত না কথা গুলো। তানভীরের কাছে সে নিরাপদ তো? ভাবনাটা মনে আসতেই তার ভেতরটা অজানা বিপদের আশঙ্কায় কেঁপে উঠল। তার জীবনে এত নেতিবাচক ঘটনা ঘটেছে যে ইতিবাচক কোনো ঘটনা ঘটবে সেটা যেন সে ভাবতেই পারছে না। কিছুটা ভয়,কিছুটা অনিশ্চয়তা আর কিছুটা শঙ্কা নিয়ে তানভীরের দিকে তাকাল। তানভীরের চোখের দিকে তাকাতেই যেন তার চোখে আলোর চোখ দুটো গেথে গেল। অদ্ভুত এক নেশা কাজ করছে আলোর মধ্যে সে নেশাটা হচ্ছে ভালোলাগার নেশা,তাকিয়ে থাকার নেশা।
"পৃথিবীতে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর নেশা হলো ভালো লাগার নেশা। এ নেশা থেকেই মানুষে জীবনে ঘটে যায় যতসব কাঙ্ক্ষিত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা।"
আর আলো যেন সে নেশা কাটিয়ে উঠতেই পারছে না। সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকার একটা প্রবণতা কাজ করছে। একটা ছেলের চোখ এত নিষ্পাপ হয় কী করে। তার চোখে তাকিয়ে যেন সব ভুলে থাকা যায়। আর আলো ইতোমধ্যে ভুলে গেছে তানভীরকে সে কী বলতে নিয়েছিল। আলোর এমন অদ্ভুত তাকানোতে তানভীর কিছুটা বিভ্রতবোধ করল। কিছু একটা বলতে চেয়েও যেন আটকে গেল। ভাবতে লাগল এ মেয়েটা অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে কী দেখছে। নিজের দিকে সে কয়েকবার নজর দিল। তারপর আলোকে বলল
- কী হয়েছে?
এর মধ্যেই আলোর চোখ থেকে তানভীরের চোখটা সরে গেল। আলো যেন সম্বিত ফিরে পেল। দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস টেনে হালকা করে সেটা ছেড়ে বলল
- এমনি চিন্তা করছিলাম।
- কী চিন্তা করছিলেন?
- এই যে আন্টি বলল আপনার কথায় আর কাজে কোনো মিল নেই। এর আগে কী এমন করেছেন যে আন্টি আপনাকে এত সন্দেহ করছে।বারবার কটু দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। নিশ্চয় মেয়েগঠিত কোনো সমস্যা আছে আপনার।
কথাটা শুনে তানভীর আলোর কাছে এসে আলোর হাতটা ধরে বলল
- হ্যাঁ আছেই তো মেয়েগঠিত সমস্যা। এই যে আপনার হাত ধরলাম এখন দেখবেন আপনাকে কী করি। আর মা এজন্যই আমাকে বিশ্বাস করছিল না।
কথাটা বলেই তানভীর হালকা সামনের দিকে এগুলো। তানভীরের এমন আচরণে আলোর দম যেন বন্ধ হয়ে যেতে লাগল।ভাবতে লাগল এতক্ষণ একটা হায়েনাকে সে মানুষ ভেবেছিল। এ হায়েনার থেকে নিজেকে বাঁচাবে কী করে। এসব ভাবতেই তানভীরের দিকে তাকাতেই তানভীর ফিক করে একটা হাসি দিয়ে আলোর হাতটা ছেড়ে দিয়ে একটু দূরে গিয়ে বসে বলল
- এত ভয় পেয়ে গেলেন কেন? কী মনে হয় আপনাকে এভাবে একা পেয়ে নিজের পুরুষত্ব দেখাব। পাগল আপনি? আর কী মনে করেন আমাকে? এতটাও কাপুরুষ নয় যে একা একটা মেয়েকে পেয়ে যা'তা করে বসব। আমার মা এ কথাটা বলেছে অন্য কারণে। মেয়ে নিয়েই ঝামেলা হয়েছে সেটা ঠিক তবে চারিত্রিক সমস্যা নিয়ে হয়নি।
আলো অবাক চোখে তাকিয়ে বলল
- আপনার কথার মানে বুঝছি না। একটু বুঝিয়ে বলুন।
- আপনাকে এত বুঝতেও হবে না। অনেক বুঝেছেন। এখন চুপচাপ বসুন।
- মেয়ে নিয়ে কী ঝামেলা হয়েছে বললে আমি সতর্ক থাকতে পারব।
- আপনাকে এ বিষয়ে বলার কোনো প্রয়োজন মনে করছি না। কারণ এটা জেনে সতর্ক হওয়ার মতো কোনো কারণ নেই। আপনি এখানে বসুন।
আলোও নাছোরবান্দার মতো তানভীরের কথার ভ্রুক্ষেপ না করে পুনরায় বলে উঠল
- আরে এমন করছেন কেন? বলুন না কী হয়েছে।
আলোর কথা শুনে তানভীর কিছুটা বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে আলোর মুখ বরারবর নিজের মুখ বাড়িয়ে বলল
- একদম চুপ। সাহায্য করতেছি বলে মাথা কিনে নেন নি যে আপনার সব কথার জবাব আমাকে দিতে হবে।এত ঘ্যানঘ্যান করবেন না। বেশ বিরক্ত লাগছে।দয়াকরে রাগ তুলবেন না। বসতে বলেছি বসুন। এমনিতেই মথা গরম তার উপর আপনার আজে বাজে প্রশ্নে মাথা ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। চুপ থাকুন একদম।
বলেই তানভীর বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। এদিকে আলো তার এমন ব্যবহারে কিছুটা ভয় পেয়ে গেল। আলোর হাত পা কাঁপতে লাগল। সামান্য এ কথায় যে সে রেগে যাবে সেটা আলো বুঝতে পারেনি। আলোর ভেতরে ধুকধুক করতে লাগল। আলো একদম নীচের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে তানভীরের দিকে তাকালে তানভীর আলোর চোখ থেকে চোখ সরিয়ে আর কোনো কথা না বলে রুম ত্যাগ করল।আলো বুঝতে পারছে না তানভীরের এমন ব্যবহারের কারণ সে জানে না কেন এমন হলো।তবে কোনো কিন্তু তো রয়েছেই। তবে সে ব্যপারে আলোর এখন না ভাবলেও চলবে।এ বাসায় থাকার ব্যবস্থাটা এখনও কনফার্ম হয়নি তার। আদৌ থাকতে পারবে কী না তাও জানে না। জাহানারা সুফিয়া বেশ জটিল মানুষ হলেও তার মন সরল মনে হয়েছে আলোর কাছে।আর তানভীরকে এতক্ষণ মজার মানুষ মনে হলেও এখন বেশ রাগী লেগেছে। মানুষের ভেতর আর বাহিরে পরখ করা বেশ কঠিন। কখন কী হয় সেটা জানা অসম্ভব। আলো অনিশ্চয়তা নিয়ে বসে আছে। জানে কী আছে তার কপালে। বারবার একটা ভয় তার ভেতর ঝেঁকে আসছে।সবসময় তার সাথে খারাপ হচ্ছে এখন কী ভালো হবে। এসব ভাবতে লাগল। এর মধ্যেই একজন মেয়েলি কন্ঠ বাইরে থেকে আওয়াজ দিয়ে বলল
- আপা ঘরে আসব কী?
আলো জানে না কে। আধুআধু গলায় বলল
- আসেন।
মহিলাটা ঘরে প্রবেশ করল। মধ্য বয়স্ক একটা মহিলা। মহিলার হাতে একটা খাবারের প্লেট। আলো বুঝতে পারলো উনি এ বাসায় কাজ করে।আলোর দিকে মহিলটা খবার বাড়িয়ে দিয়ে বলল
- আপা আপনার খবার।
আলো খাবার টা হাতে নিয়ে বলল
- আপনি খেয়েছেন?
- হ আপা খাইছি।
- আচ্ছা আপনাকে কী বলে ডাকব?
মহিলাটা হালকা হেসে বলল
- খালা বলে ডাইকেন।
আলো উনার কথা শুনে এক গাল হেসে বলল
- সম্পর্কের গরমিল করে ফেললেন। আপনি আমায় আপা ডাকছেন আর আমাকে বলছেন খালা ডাকতে বিষয়টা কেমন না?
উনি জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলল
- হ আফায় বিষয়টা ঠিক বলছেন। সুফিয়া খালাও আমারে খালা বলে ডাকে। আপনি সুফিয়া খালার কী হন?
- উনি আমার আন্টি হয়। তাহলে সম্পর্কের হিসাব করলে আপনি আমার আপা হন। তবে আপনার আর আমার বয়সের পার্থক্য অনেক। আপনাকে আপা ডাকলে আমার নিজেকে বুড়ি মনে হবে। আচ্ছা আপনার নাম কী?
মহিলাটা মুচকি হেসে বলল
- রাবু।
- তাহলে আপনাকে রাবু নানু বলে ডাকব। ঠিক আছে?
- আপনার ইচ্ছা।
- আপনার বাড়িতে কে কে আছে?
- শুধু একটা মেয়ে আছে আপা। মেয়েটারে তার মামার কাছে রেখে আসছি। আর আমি কাম কইরা মেয়েটার পড়ার খরচ চালাই।
আলো কিছুটা বিস্মিত হয়ে বলল
- নানা কোথায়?
কথাটা জিজ্ঞেস করতেই রাবু হালকা চোখের পানি জড়িয়ে বলল
- আমারে ছাইড়া আরেকটা বিয়া কইরা ঐ বউ লইয়ায় আছে। আর এর লাইগায় মাইনসের বাসায় কাম করি। আর মেয়েডারে তার মামা মামীর কাছে রাইখা আসছি। তারায় দেখাশোনা করে।
- আপনার মেয়ের কোনো অসুবিধা হয় না মামা মামীর কাছে থাকতে?
- নাহ তো আপা সে ভালোই আছে। আমার ভাই,ভাবী ভালোই যতন করে।
আলো নিশ্চুপ। রাবুর মেয়ে মামার কাছে থাকে শুনে নীলার কথা আলোর মনে পড়ে গেল। আলোর ভাবনার আকাশ জুড়ে এখন নীলা নামটার বিচরণ করছে। ভাবছে নীলা কী পেরেছে নিজের গন্তব্যে পৌঁছাতে। সাথে সাথে সেটাও ভাবছে নীলা মেয়েটা মামার কাছে ধর্ষণ হয়েছে আর এদিকে রাবু নানুর মেয়েটা তার মামার কাছে নিরাপদ আছে। কত অদ্ভুত এ দুনিয়া একই সম্পর্ক তবে তার নিয়তির লিখন দু ধরণের। আলোর নীরবতা দেখে রাবু আলোকে ডেকে বলল
- আপা কী ভাবতেছেন?
আলো ভাবনা থেকে বের হয়ে বলল
- তেমন কিছু না। আচ্ছা তানভীর ভাই কোথায়? উনি আসলো না কেন?
- ভাইজানের মেজাজ মনে হয় গরম।আমারে বলল আপনারে নাস্তা দিতে তারপর নিজের রুমে গিয়ে ঘাপটি মেরে আছে। আপনার কিছু লাগলে আমাকে বলেন।
আলো মৃদু হেসে বলল
- কিছু লাগবে না নানু আপনি যান।
- আচ্ছা গেলাম আফা।
বলতে বলতেই রাবু রুম থেকে বের হলো। আলো নাস্তাটা হাতে নিয়ে পরোটাটা ছিড়ে ছিড়ে খেতে লাগল আর ভাবতে লাগল তানভীরের কী এমন হয়েছে যে আলোর কথায় এতটা রিয়েক্ট করল। এসব ভাবতে লাগল আর খেতে লাগল।খাওয়াটা শেষ করার পর তার মনে হলে সে তানভীরকে রাগিয়েছে সুতরাং তার কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত। তাই কিছুটা ভয় ভয় নিয়ে রুম থেকে বের হলো। রুম থেকে বের হয়ে লক্ষ্য করল এ বাসাটা অনেক বড় আর অনেকগুলো রুম। কোন রুমে তানভীর সেটা সে জানে না। সে কিছুটা অনিশ্চয়তা নিয়ে তার পাশের রুমটায় দরজা খোলা পেয়ে হালকা উঁকি দিয়ে কিছুটা বিস্মিত হলো।কারণ
গল্পের নাম : অন্ধকারে_এক_চিলতে_আলো
লেখিকা-: শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব-7 পর্ব
সে কিছুটা অনিশ্চয়তা নিয়ে তার পাশের রুমটায় দরজা খোলা পেয়ে হালকা উঁকি দিয়ে কিছুটা বিস্মিত হলো।কারণ পুরো রুমটায় পেইন্টিং দিয়ে সাজানো। রুমটা বেশ ফাঁকা আর পরিপাটি । আলো দিশা না পেয়ে রুমটায় প্রবেশ করলো। একে একে সবগুলো পেইন্টিং দেখতে লাগলো। প্রতিটা পেইন্টিং এ কোনো নারী রুপের অবয়ব লুকিয়ে আছে মনে হচ্ছিল। বিস্ময়ের সাথে প্রতিটা পেইন্টিং সে দেখতে লাগল। কী অপরুপ হাতের নিপুণে আঁকা ছবি গুলো। ঘরের এক কোণে একটা গিটার রাখা। বিছানার পাশে ল্যাম্প টা আধু আধু করে এ দিনের বেলাতেও জ্বলছে। ল্যাম্পটার ঠিক পাশে তাজা ফুলগুলো ফুলদানিতে রাখা যা সুভাস ছড়াচ্ছে। ঘরটা বেশ সযত্নে সাজানো বুঝায় যাচ্ছিল। আলো ভাবতে লাগল এটা কী তানভীরের রুম? কিন্তু তানভীরের রুম হলে তানভীর কোথায়? রাবু নানু বলেছিল তানভীর রুমে ঘাপটি মেরে আছে। তাহলে হয়তো এটা তানভীরের রুম না। কিন্তু কার রুম? ভাবতে ভাবতেই আনমনে গিটারটা হাতে নিয়ে তারগুলো টেনে ধরল। তারগুলো টান দিতেই একটা বেসুরা আওয়াজ গিটার থেকে বের হয়ে আসলো। গিটারের আওয়াজটা পেয়েই তানভীর কোথায় থেকে যেন হাজির হয়ে রুমে প্রবেশ করলো। আর আলোর দিকে রুষানলে তাকিয়ে বলল
- এই মেয়ে হুট করে এ রুমে ঢুকেছেন কেন? মা জানলে আপনাকে আস্ত রাখবে না। এক তো এ রুমে ঢুকেছেন তার উপর অনুমতি ছাড়া জিনিসপত্র ধরতেছেন। বাসা থেকে কী কোনো ভদ্রতা শেখায় নি আপনাকে?
তানভীরের কথা শুনে যেন আলোর টনক নড়ল। সত্যিই তো কারও অনুমতি ব্যতীত রুমে প্রবেশ করা অন্যায় তার উপর জিনিস পত্র ধরা তো নেহাত অন্যায়। আলোর মুখটা চুপসে শুকনো হয়ে গেল। আধু আধু কন্ঠে ঢুক গিলতে গিলতে বলল
- দুঃখিত বুঝতে পারে নি। আপনাকে খুঁজতে বের হয়েছিলাম হঠাৎ করে এ রুমে চোখ গেল আর দেখে বেশ অন্যরকম লাগল তাই ঢুকার লোভ জাগল আর ঢুকে পড়লাম। সরি কিছু মনে করবেন না দয়াকরে। এটা সত্যিই ভুল হয়েছে। আচ্ছা এটা কী আপনার রুম?
তানভীর ভ্রুটা কুচকে কর্কশ গলায় বলল
- এত কিছু জেনে আপনার কী হবে? সবকিছুতে শুধু প্রশ্ন করেন। এটা যার ইচ্ছা তার রুম হোক। আপনাকে যে রুম দিয়েছি সে রুমে থাকুন। আর থাকতে চেয়েছেন সেটার ব্যবস্থাও করছি। এত লাফালাফি করলে এ বাসায় থাকা মুশকিল হয়ে পড়বে আপনার জন্য। আপনি বেশ ছটফটে স্বভাবের। ভাগ্য ভালো যার সাথে বিয়ে হয়েছে তাকে আপনি বিয়ে করেন নি। না হয় বেচারার কপালে একটা পাগল জুটত। বের হন রুম থেকে।
আলো তাকিয়ে তাকিয়ে শুধু তানভীরের কথাগুলো শুনছিল। আর ঢুক গিলতে লাগল। তানভীরের কপালে বিন্দু বিন্দু ইষৎ লোনা ঘাম জমে আছে বৃষ্টি ফোটা কণার মতো। মুখটা বেশ রাগান্বিত হয়ে আছে। আলোর ভয়টা বাড়তে লাগল। তবুও এ ভয় প্রকাশ করে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করা যাবে না। কারণ
"দুর্বলতা এমন একটা জিনিস যেটা একবার প্রকাশ পেলে সেটা কাটিয়ে উঠা বেশ কঠিন। কারণ আঘাতের মুখ্যম জায়গা হিসেবে মানুষ তখন সেটাকেই ব্যবহার করে"
তাই আলো নিজেকে সামলে নিয়ে নিজের কপালেও রাগ এনে জবাব দিল
- এই যে থাকতে দিচ্ছেন তার মানে মাথা কিনে নেন নি? আমার উনি আসলেই চলে যাব। আর আমি ভুল করেছি ক্ষমাও তো চেয়েছি তাহলে এমন কেন করছেন? এত চেঁচিয়ে উঠার কী আছে? আমি কী এ রুমে থাকতে এসেছি নাকি।
বলতে বলতেই আলোর গাল গড়িয়ে চোখের জল বৃষ্টি হয়ে নামতে শুরু করল। এ বিষয়টা বেশ অসচেতন হয়েই হয়েছে। আলো জানে না হুট করে তার চোখ দিয়ে এত অভিমানের জল কেন নেমে আসলো। সে তাড়াহুড়ো করে চোখের জলটা মুছে রুম ত্যাগ করল। তানভীর আলোর কথা শুনে চুপ হয়ে গেল। এতটা বকা দেওয়াও তার উচিত হয়নি। কিন্তু কেন জানি না অতীত মনে হয়ে তানভীরের ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে। সে চাইলেও নিজেকে সামলে নিতে পারছে না।
"অতীত বেশ ভয়ানক জিনিস। অতীতকে কাটিয়ে নিয়ে সামনে এগুনো গেলেও সেটা ভুলে যাওয়া বেশ দুঃসাধ্য ব্যাপার"
নিজের অজান্তেই সে রেগে যাচ্ছে যেটা একদম অনুচিত। তানভীরের মনে হলো আলোর কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত। এতটা কঠিন হওয়া তার উচিত হয়নি।
আর এদিকে আলো রুমে এসে ঘাপটি মেরে বসে আছে। নিজের জীবনের কালো অতীত গুলো তাকে যেন আরও তাড়া করছে। যত ভাবেই সে এটা কাটিয়ে উঠতে চাচ্ছে ঠিক ততটাই যেন সব তাকে ঘিরে ধরছে। আলোর কী তানভীরকে মিথ্যা বলাটা আদৌ উচিত হয়েছে। তানভীরকে তো বেশ মননশীলেই মনে হয় আলোর। তাহলে কী সে তানভীরকে সবটা বলে দেবে। এসব ভাবনা মনের মধ্যে আওরাতে লাগল সে। চুপ হয়ে বসে আছে। আনমনে কত চিন্তা আলোকে গ্রাস করছে সে নিজেও জানে না। আলোর বয়স সবে ১৪। এ বয়সের একটা মেয়ের উচিত হেসে খেলে বড় হওয়া। অথচ আলোকে সম্মুখীন হতে হচ্ছে চরম বাস্তবতায়।এ পথের শেষ কী? এর গন্তব্য কী সে জানে না। আচ্ছা নীলা কী গন্তব্যে পৌঁছাতে পেরেছে? নীলার ভাবনাটা আবার ঝেঁকে বসলো আলোর মনে। নীলার চোখ গুলো বারবার তার চোখে ভেসে আসছিল। আলো জানে না নীলা কোথায়? এ অন্ধকার গলিতে হারিয়ে গেল নাকি আলোর নিশানায় ছুটে গেল। ইশ নীলার খুঁজ যদি মিলত কত ভালোই না হত। কতশত চিন্তা তার মনে বাসা বাঁধছে। সে সাথে চিন্তা করছে ঐ লোকটা কী মরে গেছে নাকি বেঁচে আছে। কত নির্মম এ দুনিয়া নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে কত হিংস্র হতে হয়। যে আলো মানুষের রক্ত দেখলে ভয় পেত সে আলোই একটা লোককে রক্তাক্ত করে পালিয়েছে। আলো সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে এসবেই ভাবছিল। এমন সময় তানভীর হালকা কাশি দিয়ে রুমে প্রবেশ করলো। আলোর ভাবনায় ছেদ পড়ল সে পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখল তানভীর দাঁড়িয়ে আছে। তানভীরকে দেখে আলো মুখটা বাকিয়ে অভিমানের রেখা মুখে ফুটিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। তানভীর আলোর ঠিক কাছে বসে বলল
- শুনুন এভাবে আপনাকে বলা ঠিক হয়নি। সত্যি বলতে রুমটা আমার বড় ভাইয়ের। মা বেশ যত্ন করে রেখেছে। ভাইয়া কিছুটা মায়ের উপর অভিমান করেই বিদেশ চলে গিয়েছিল। এখন পর্যন্ত আসেনি। আর কবে আসবে বলেও না। রুমের যা পেইন্টিং গুলো দেখেছেন সেটাও আমার বড় ভাই করেছে। মা সে রুমটাকে বেশ পরিপাটি করে সবসময় সাজিয়ে রাখে। মায়ের একটা দুর্বল জায়গা ঐটা বলা যায়। আপনাকে যদি আমার জায়গায় মা ঐখানে দেখত বেশ রেগে বসত। আমি আপনাকে ওভাবে বকতে চাইনি তবে রাগের মাথায় বলে ফেলেছি।
আলো তানভীরের কথায় ওপাশ থেকে চোখ ফিরিয়ে তানভীরের দিকে তাকিয়ে বলল
- আপনার ভাই রাগ করে চলে গেল কেন? আর ফোনে কী কথাও বলে না?
- রাগের কারণ বলতে পারব না।সেটা একান্তই ব্যক্তিগত।বাইরের মানুষকে বলা উচিত হবে না। ভাইয়া সবার সাথেই কথা বলে। তবে দেশে আসতে চায় না। ভাইয়ার অভিমানটা জমিয়ে রেখেছে সেটা বুঝতে না দিলেও আমরা বুঝতে পারি।আপনি আর ঐ রুমে যাবেন না।
তানভীরের কথা শুনে আলো যেন এক রহস্যের জগতে পড়ে গেল।তানভীরের ব্যপারটাও আলোর কাছে এতক্ষণ রহস্যজনক মনে হয়েছিল এখন তার বড় ভাইয়ের বিষয়টাতে বেশ রহস্য পরিলক্ষিত করল। সবকিছু তার জানতে ইচ্ছা করছে। তবে জানতে চাওয়াটা উচিত হবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ এতে তানভীর আবার রেগে যেতে পারে। আর আলোর কোনোভাবেই উচিত না তানভীরকে রাগানো। কারণ তাকে এ বাসায় থাকতে হবে নাহয় বাইরে বের হলে আবার কোনো হায়েনার কবলে পড়বে। অনেক কৌতুহল থাকা সত্ত্বেও আলো তানভীরের কথার তেমন কোনো প্রতিউত্তর না দিয়ে শুধু হালকা গলায় বলল
- আমি আর যাব না। তখন আমাকে এভাবে বললেও যেতাম না। তবে হুট করে ধমক দিয়েছেন তো তাই মন খারাপ হয়ে গেছিল।
- হুম বুঝতে পরেছি। নাস্তা করেছেন? রাবু খালা কী নাস্তা দিয়েছেন?
- হ্যাঁ দিয়েছেন।আচ্ছা আপনি রাবু নানুকে খালা কেন ডাকেন? শুনেছি আপনার মাকে উনি খালা ডাকে তার মানে আপনার মায়ের খালা উনি। তাহলে রাবু নানু আপনার খালা হয় কী করে। সম্পর্কটা গরমিল করে ফেললেন না?
তানভীর নিজের জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলল
- সত্যিই তো ঠিক বলেছেন। এখন থেকে তাহলে আমিও নানু ডাকব।এ বিষয়টা আমার নজরে আসে নি। যাক বিষয়টা ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। তার জন্য আপনাকে একটা গিফট দেই কী বলেন?
আলো ছটফট গলায় জবাব দিল
- কী গিফট দিবেন? আর আমার কিছু লাগবে না।
- এমন কিছু দিব না যেটা আপনি নিজের কাছে রাখতে পারেন। গিফট হিসেবে আমি আপনাকে আমাদের ছাদে নিয়ে যাব।
- আপনার সাথে ছাদে যাব না। দেখা গেল ছাদ থেকে ধাক্কা মেরে রাগের মাথায় ফেলে দিবেন তারপর আবার সরি বলবেন।
আলোর এমন কথায় তানভীর জোরে হেসে দিয়ে বলল
- বেশ মজার কথা বলেন আপনি। আপনার প্রেমিক আপনাকে সামলায় কী করে কে জানে। যাইহোক ধাক্কা দিয়ে আপনাকে মেরে জেলের ভাত খাব না। এমনিতে একবার জেলে গিয়ে শিক্ষা হয়ছে।
শেষের কথাটা শুনে আলো অবাক হয়ে ড্যাবড্যাব চোখে তাকিয়ে বলল
- আপনি কী এর আগে খুন করেছেন?
- মানে?
- এই যে বললেন জেলে গিয়েছিলেন। তাই জিজ্ঞেস করলাম।
- আরে আপনি তো বেশ বোকা। খুন করলে কেউ ছাড়া পায় নাকি। জেলে গিয়েছি অন্য কারণে। কোনো একদিন বলব। এখন আপনি কী যাবেন আমার সাথে নাকি রুমেই থাকবেন।
তানভীরের কথা শুনে আলো যেন রহস্যের বেড়াজালে আটকে যাচ্ছিল। তবে এ মুহূর্তে সে ছাদে যাওয়ার লোভটাও সামলাতে পারছে না। লাজুক সুরে জাবাব দিল
- এত করে যখন বলছেন তাহলে তো যাওয়ায় যায়।
এরপর বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। ছাদের দিকে যাওয়ার জন্য রওনা দিল সে। ছাদের ঠিক কাছে গিয়ে গেটটার সামনে দাঁড়াল দুজন।গেটটা তালা দেওয়া। গেটের চাবি তানভীরের কাছে। তানভীর চাবিটা বের করে গেটটা খুলল। গেটটা খোলার সাথে সাথে এক ঝলক আলোক রশ্নি এসে আলোর মুখের থুবরে পড়ল। সে সাথে...
গল্পের নাম : অন্ধকারে_এক_চিলতে_আলো
লেখিকা-: শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব-৮ পর্ব
গেটটা খোলার সাথে সাথে এক ঝলক আলোক রশ্নি এসে আলোর মুখে থুবরে পড়ল। সে সাথে হালকা মৃদু মন্দ বাতাস গায়ে এসে লেপ্টে গেল। আলোর মধ্যে একটা শীতলতার অনুভূতি কাজ করছে। ভেতরটা প্রশান্ত লাগছে। ছাদের দিকে তাকিয়ে দেখল পুরো ছাদটায় সবজি,ফুলের বাগান দিয়ে সাজানো। হুট করে বন্দি জীবন থেকে এমন মনোরম পরিবেশ দেখে নিজেকে সামলাতে না পেরে দৌঁড়ে গেল ছাদের দিকে। আলোর এমন ছটফট স্বভাব দেখে তানভীরের কেমন জানি সন্দেহ হয়। মাঝে মাঝে আলোকে মানসিক ভারসাম্যহীন মনে করে। তার মনে হয় মেয়েটা হুট করে পাগলা গারদ থেকে ছাড়া পেয়েছে। তবে এ মুহূর্তে আলোর মুখের এক চিলতে হাসির কাছে সবকিছু ফিকে হয়ে গেছে। আলোকে যে সে কিছু বলবে সেটার উপায়ও নেই। আলোকে যতই দেখছে ততই কেন জানি না তানভীরের মনে ভালোলাগার একটা সুক্ষ্ম রেখা জাগছে। আলো ছাদের কার্নিশ ঘেসে দাঁড়িয়ে নিজের মুখটা সূর্যের দিকে তাক করে আছে৷ কতদিন রোদ পোহানো হয় না। এ রোদের সুমিষ্ট তাপ আলোর মরীচিকা ধরা শরীরটা যেন সতেজ করছে। পেছন থেকে তখন তানভীর এসে আলোর কানে বলল
- পাগলা গারদে কী রোদ পোহাতে পারেন নি?
কথাটা আলোর কানে যেতেই আলো চট করেই তানভীরের দিকে তাকিয়ে বলল
- এরকম টা বললেন কেন?
- কারণ আপনার কাজকর্ম দেখে মনে হয় পাগলা গারদ থেকে পালিয়ে এসেছেন। কারও মাথা টাথা ফটিয়ে পালিয়েছেন না তো আবার?
তানভীরের এমন কথা শুনতেই আলোর বুকটা ধুক করে উঠল। ভাবতে লাগল তানভীর কী, সব জেনে গিয়েছে। নাহয় ঐ লোকটার মাথা ফাটিয়ে এসেছে তানভীর জানলো কী করে। হাস্যজ্জ্বল মুখটা ক্রমশেই মলিন হয়ে গেল। অবচেতন মনে বলে উঠল
- আপনি জানলেন কী করে?
আলোর এমন জবাবে তানভীরও চমকে গেল।তাহলে কী আলো সত্যিই কারও মাথা ফাটিয়ে এসেছে? তানভীর এবার নড়ে চড়ে দাঁড়াল। কিছুটা জোর গলায় বলল
- তার মানে কী সত্যিই এ কাজ করেছেন?
তানভীরের অনিশ্চয়তা মাখা প্রশ্ন শুনে আলো বুঝতে পারল যে, সে আন্দাজে ঢিল মেরেছে।আলোও এবার প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলল
- আপনাকে একটু বাজিয়ে দেখছিলাম আর কী।কতটা বোকা আপনি। যা বলি তাই বিশ্বাস করে ফেলেন। মাথা ফাটানো কী এত সোজা? বললাম আর ফাটিয়ে আসলাম।আমি একটু চঞ্চল স্বভাবের। এর বাইরে কিছু না। আচ্ছা এবার বলুন জেল কেন খেটেছিলেন?
- সে এক লম্বা কাহিনি। আরেকদিন বলব।
- আজকেই বলুন না। জানার অনেক আগ্রহ জাগছে।
- পরে কোনোদিন বলা যাবে। আজকে বলব না।
- তাহলে আপনার ভাই কেন অভিমান করেছে সেটা বলুন।
- ভাইয়ার অভিমানের পেছনে যথেষ্ট কারণ রয়েছে। পারিবারিক বিষয় বলতে চাচ্ছি না।
- আমাকে বললে এমন কিছু হবে বলে মনে হয় না। কারণ বিষয়গুলো আমি কাকে বলব? আমি আপনার আশে পাশের কাউকে চিনি না। সুতরাং বলতেই পারেন।
কথাগুলো বলে আলো তানভীরের চোখের দিকে তাকাল। তানভীরের, আলোর চোখে চোখ পড়তেই কেন জানি না নিজের ভেতরে থাকা সমস্ত কিছু বলে দিতে মন চায়ছে । নিজেকে সে সামলাতে পারল না। অবচেতন মনে বলে ফেলল
- আচ্ছা বলব তবে বিষয়টা আপনার আর আমার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখবেন। পারবেন তো?
- অবশ্যই পারব।
- তাহলে শুনোন। প্রায় চার বছর আগে আপনার মতোই একজনকে এ বাসায় নিয়ে এসেছিলাম রাস্তা থেকে । মেয়েটার নাম ছিল রুশি। মেয়েটাও বেশ অসহায় দাবি করেছিল৷ তখন আমি ইন্টার পাশ করি। আর আমার বড় ভাই অনার্স কমপ্লিট করে। আমার মা স্বাভাবিকভাবে জটিল হলেও সরল মনের। মেয়েটার মা, বাবা কেউ ছিল না ফুফার কাছে মানুষ কিন্তু সেখানে তাকে অত্যাচার করা হতো তাই পালিয়েছিল। আমরাও বিষয়টা স্বাভাবিক ভাবে নিয়ে ওকে থাকতে দিই। বেশ ভালোই যাচ্ছিল সময়। মেয়েটাও খুব মিশুক ছিল। অল্পতেই মায়ের মন জয় করে ফেলে। রুশি আমার এক বছরের ছোট ছিল। দুজনের মধ্যে ভালোই বন্ধুত্ব ছিল । বেশ ভালোই যাচ্ছিল সময়। সব কিছু ঠিকঠাকেই ছিল। ভালোও লাগত কিছুটা। তবে প্রেমিক বা বউ হিসেবে না একজন বন্ধু হিসেবে।
"পৃথিবীর সবচেয়ে সুমধুর সম্পর্ক হলো বন্ধুত্বের সম্পর্ক। বন্ধুত্বের সম্পর্কে বিষাদময় অধ্যায়গুলোও আলোকিত হয়ে যায়"।
রুশির সাথে আমার সম্পর্কটা ঠিক ঐ ধরণের ছিল। কিন্তু একটা সময় পর রুশির মধ্যে বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করি। আগের চেয়ে আনমনা। কিছু নিয়ে চিন্তিত। ব্যপারটা বুঝতে পারতাম না কেন? তবে তাকে বেশ অগোছাল মনে হত। অনেক বার জিজ্ঞেস করার পরও তেমন কিছু বলত না। চুপচাপ থাকত। আনমনা হয়ে থাকত। অনেকটা প্রথম প্রেমে পড়লে যেমনটা হত ঠিক তেমনটা। আমি ওকে কাছে থেকে চিনেছি তাই তার পরিবর্তন টা কারও নজরে না আসলেও আমার নজরে পড়ে।
আস্তে আস্তে আবিষ্কার করলাম সে আমার বড় ভাই সানীর সাথে বেশ আন্তরিক হচ্ছে। বড় ভাই পেইন্টিং করলে সেখানে বসে থাকত। বড় ভাইয়ের আশে পাশে ঘুরঘুর করত। বুঝতে পেরেছিলাম তাদের মধ্যে কিছু একটা চলছে। একটা সময় বেশ পরখ করে বুঝলাম সানী ভাইয়ার সাথে তার প্রেমটা জমে গেছে। আমার কেন জানি না একটু খারাপ লাগত। বুকের বা পাশটায় ব্যথা অনুভব করতাম।
তানভীরের এ কথাটা শুনে তানভীরের কথায় ব্যাগরা দিয়ে আলো বলে উঠল
- আপনি কী রুশিকে পছন্দ করতেন?
তানভীর নিজের জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলল
- ছিঃ কী সব বলছেন? ওকে আমি নিজের বন্ধু মনে করতাম। আমার কষ্ট লাগত কারণ ও আমাকে কেন জানি না এড়িয়ে যেত। তেমন কিছুই শেয়ার করত না।ওর বড় ভাইয়ের সাথে প্রেম চলতেই পারে বিষয়টা বেশ স্বাবাভিক। তবে আমাকে এড়িয়ে যাওয়ার তো কোনো কারণ নেই। আমাকে বললেই পারত। এমন একজনকে ভাবী হিসেবে পেলে আমিও খুশি থাকব। তবে তার এড়িয়ে যাওয়ার কারণটা আমাকে বিব্রত করত।
- আচ্ছা দুঃখিত এমন কথা বলে আপনাকে বিচলিত করার জন্য। তারপর কী হলো বলুন।
- তারপর বিষয়টা আরও পরিষ্কার হয় যখন সানী ভাই রুশিকে বিয়ে করার কথাটা মাকে বলে। আর মা ও সানী ভাইয়ের পছন্দে অমত করেনি। তাদের বিয়েও ঠিক হয়। কিন্তু রুশিকে কেমন জানি লাগত।মনে হতো কিছু বিষয় নিয়ে চিন্তিত।আমরা বিষয়টা বুঝতেও পারতাম না। তবে সানী ভাই বেশ উৎফুল্ল থাকত। দুজনের দুরকম ব্যবহার আমার নজর এড়িয়ে যায়নি। তবে রুশিকে কিছু জিজ্ঞেস করার তেমন সাহস পেলাম না। তাকে দেখে মনে হতো তার মনে কোনো চাপা কষ্ট ব্যাগরা দিয়ে বসেছে। শুধু ভাবতাম রুশি তো সানী ভাইকে ভালোবাসে তাহলে তার মন এত আনমনা কেন? ভাবনাটা এড়িয়ে যেতে চাইলেও পারতাম না। মনের গহীনে তাকে ঘিরে কতগুলো প্রশ্ন ঘুরপাক খেতই।
আস্তে আস্তে বিয়ের তারিখ ঘনিয়ে আসলো। মা রুশির ফুফা ফুফির সাথে দেখা করতে চেয়েছিল তবে রুশি চাইনি বলে আর এগুই নি বিষয়টা। রুশি আর সানী ভাই রোজ শপিং এ বের হতো এটা ওটা কিনত। কিন্তু রুশির মুখ অবয়ব দেখে কেন জানি না আমার মনে হত সে খুশি না। ভাবতে লাগলাম রুশি কী চায় না সানী ভাইকে। তবে পরক্ষণে আবার ভাবতাম রুশি সানী ভাইকে না চাইলে তো বিয়েটা এগুতো না। আস্তে আস্তে রুশির সাথে আমার দূরত্ব বাড়তে লাগল।
বিয়ের ঠিক আগের দিন আমি বেশ আনমনা হয়ে কী যেন ভাবছিলাম। এমন সময় দরজায় নক করার আওয়াজ পেলাম। দরজা খুলেই দেখলাম রুশি। রুশির চোখ বেশ ফুলা ছিল। অনেকক্ষণ ধরে কেঁদেছিল বুঝায় যাচ্ছিল। আমি দরজাটা খুলতেই সে রুমে প্রবেশ করে দরজা লাগিয়ে দিয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগল। আমি বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করলাম
- কাঁদছো কেন? কী হয়েছে?
রুশি কোনো উত্তর দিল না। শুধু বলল
- আমার কিছু ভালো লাগছে না।
- তুমি কি এ বিয়েতে রাজি না? সানী ভাইকে কি তুমি ভালোবাসো না?
রুশি মাথা নেড়ে নেড়ে উত্তর দিল
- হ্যাঁ বাসি। ভালোবাসি বলেই বিয়ে করতে রাজি হয়েছি। কিন্তু?
- কিন্তু কী?
- নাহ কিছু না।
কথাটা বলেই রুশি রুম থেকে বের হয়ে গেল। বুঝতে পেরেছিলাম সে আমাকে কিছু বলতে গিয়েও পারছিল না। আমি বিষয়টা নিয়ে কিছুক্ষণ ভেবে চুপ হয়ে যাই। তারপর নিজের মতো করে ঘুমিয়ে যাই।
সকাল বেলা মায়ের চিৎকারে ঘুম ভাঙ্গে। আমি তাড়াহুড়ো করে ঘুম থেকে উঠে রুম থেকে বের হই। লক্ষ্য করলাম কান্নাটা রুশির রুম থেকে আসছে। আমি দৌঁড়ে সেখানে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে যাই। কারণ....
কথাটা বলেই তানভীর থেমে যায়। তার চোখে অশ্রুজল টলমল করতে থাকে। আলো তানভীরের দিকে তাকিয়ে বলল
- কী হলো থেমে গেলেন কেন? তারপর কী হলো বলুন?
তানভীর এবার কান্নাটা আটকাতে পারল না। চোখ দিয়ে তার পানি পড়তে লাগল। কান্না জড়িত কন্ঠে জবাব দিয়ে বলল
- কারণ দেখলাম রুশি সিলিং ফ্যানে ঝুলছে। পাশে একটা ডায়রি ছিল সেখানে শুধু আমার নামটায় লিখে রেখেছিল। হয়তো আরও কিছু লিখতে গেছিল তবে পারে নি।
রুশির এ অবস্থাটা দেখে সানী ভাই পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ে। পুলিশ আসে। রুশির ডায়রিতে আমার নাম দেখে সবাই ভেবে নেয় যে রুশি আত্নহত্যা করেছে আমার জন্য। পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে যায়। সে সাথে আমার বড় ভাই ও আমাকে ভুল বুঝে। সেই যে সে বিদেশ গিয়েছে আর দেশে আসে নি।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো রুশি এক মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিল। তবে ডি এন এ টেস্ট করে জানা গেছে সে বাচ্চাটা আমার বা সানী ভাইয়ের না। তাই আমি জেল থেকে ছাড়া পাই। তবে আজও জানতে পারলাম না রুশি সেদিন কী বলতে এসেছিল। তার মনে কী চলছিল। কেন সে আত্নহত্যা করল। তার পেটের বাচ্চাটা কার ছিল। সব মিলিয়ে বিষয়টা এখনও গোলক ধাঁধায় আছে। আর ঠিক এ জন্য মা আপনাকে এত প্রশ্ন করছিল। কারণ সেদিন রুশিকে আমিই নিয়ে এসেছিলাম এ বাড়িতে। রুশির পরিবারের ঠিকানা এখনও জানি না। অনেক খুঁজ নেওয়ার পরও জানতে পারেনি। কোথায় থেকে এসেছিল সে জানে। সব মিলিয়ে বিষয়টা অস্পষ্ট। বড় ভাইয়ের ধারণা রুশির আত্নহত্যার পেছনে পরোক্ষভাবে আমি দায়ী। যার কারণে সে ঘটনার পর আমাদের বাসায় আর আসেনি। এখনও ভেবে পাই না রুশি কেন এমন করল।
কথাগুলো বলেই তানভীর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল
- হয়তো আকাশে আছো তুমি। কিন্তু একটা বার বলে যেতে পারতা তোমার কী হয়েছিল। তাহলে এত অপবাদের গ্লানি নিজের কাঁধে বয়ে বেড়াতে হত না। এ গ্লানি বহন করা বড্ড কষ্ট রুশি। একটাবার বলে যাও কে তোমার সাথে এত ঘৃনিত কাজ করেছে। তোমাকে আত্নহত্যা করতে বাধ্য করেছে।
বলেই কাঁদতে লাগল। আলো তানভীরের কথা শুনে একদম চুপ হয়ে গেল। রুশির মৃত্যুর রহস্যটা যেন আলোকেও ঘিরে ধরেছে। আলোও নীরব। কিছু বলতে চেয়েও পারছে না। দম বন্ধ লাগছে। তানভীরের কষ্টটা উপলব্ধি সে করতে পারছে। কারণ মিথ্যা অপবাদের গ্লানি বহন করা খুব কষ্ট দায়ক।
"পৃথিবীতে সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক ভারী বস্তু হচ্ছে মিথ্যা অপবাদ। যা মানুষের কাঁধে আসলে বহন করা দুষ্কর হয়ে উঠে।"
তানভীরকে সাত্ত্বণা দেওয়ার ভাষা আলোর নেই।
"পৃথিবীতে প্রতিটা মানুষেই তার নিজের জায়গায় কোনো না কোনো বিষয়ে দুঃখী। কারও বেশি কারও কম। দুঃখ আছে বলেই সবাই সুখের মর্ম বুঝে"
দুজনের মধ্যেই এখন নীরবতা বিরাজ করছে। নীরবতার অবসান ঘটিয়ে আলো তানভীরের দিকে তাকিয়ে বলল
- হয়তো কোনো একদিন আপনার মনে জমে থাকা সকল প্রশ্নের উত্তর মিলবে। এ মিথ্যা অপবাদের গ্লানি থেকে মুক্তি পাবেন। চলেন ঘরে যাওয়া যাক। এখানে আর ভালো লাগছে না। আপনারও বিশ্রামের প্রয়োজন।
তানভীর নিজেকে সামলে নিয়ে আলোকে উত্তর দিল
- চলুন।
এরপর দুজন ঘরে আসলো। ঘরে এসেই ড্রইং রুমে দুজন বসলো। তানভীর টিভিটা অন করল। আলো টিভির পর্দায় তাকাতেই ভয়ে চুপসে গেল। তার বুক ধুকধুক করতে লাগল নীলার গলা কাটা লাশটা টিভির পর্দায় দেখে। কিছু মানুষ তাকে ধর্ষণ করে গলা কেটে ফেলে রেখেছে। আলোর হাত পা কাঁপতে লাগল। তার মানে নীলা তার গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই কাটা লাশ হয়ে গেছে। কি নির্মম এ দুনিয়া। আলো জোরে জোরে দম নিতে লাগল। হুট করেই চেঁচিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল
- ওহ! আল্লাহ! এ কী হলো?
আলোর চিৎকার তানভীরের কানে পৌঁছাতেই তানভীর আলোর পাশে এসে বলল
- কী হয়েছে আপনার? আপনি কী মেয়েটাকে চিনেন? মেয়েটার লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে আছে। চিনলে বলুন ঐ থানায় যোগাযোগ করি।
আলো কী বলবে বুঝতে পারছে না। এ মুহূর্তে নীলাকে চিনে বললে আলোয় বিপদে পড়ে যাবে। কারণ ঐ লোকটার বিষয়টা সবাই জেনে যাবে। সে সাথে আবার আলোকে অন্ধকার গলিতে ডুবে যেতে হবে। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আলো তানভীরকে নীলাকে চেনার কথাটা বলতে পারল না। মাথা নেড়ে না বলল শুধু। তবে নীলার মৃত্যুটাও আলো নিতে পারছে না। মাথাটা বেশ ঘুরপাক খেতে লাগল। চোখগুলো বন্ধ হয়ে যেতে লাগল। এ কষ্টটা বুকটা চেপে ধরে রেখেছে আলোর। সে আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে গেল।
একটু পর যখন আলোর জ্ঞান ফিরল। তানভীর আলোর কাছে এসে যা বলল তা শুনে রীতিমতো আলোর গা, হাত, পা আবার কাঁপতে লাগল।
গল্পের নাম : অন্ধকারে_এক_চিলতে_আলো
লেখিকা-: শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব-9 পর্ব
তানভীর আলোর কাছে এসে যা বলল তা শুনে রীতিমতো আলোর গা, হাত, পা আবার কাঁপতে লাগল। কারণ তানভীর আলোর কাছে এসে চাপা গলায় তাকে বলল
- যে মেয়েটার খবর শুনে আপনি জ্ঞান হারিয়েছিলেন সে মেয়েটার মা,বাবার,খুঁজ পাওয়া গেছে। মেয়েটার নাম নীলা। আশ্চর্যের বিষয় হলো মেয়েটা বেশ কয়েকদিন যাবত নিখোঁজ ছিল। সবার ধারণা মেয়েটা তার প্রমিকের সাথে পালিয়েছে। তারপর হয়তো তার প্রেমিক তাকে বিক্রি করে দিয়েছে। মেয়েটাকে শেষ দেখা যায় একটা পতিতালয়ে। সেখান থেকে মেয়েটাকে এক লোক কিনে নিয়ে যায়। সে লোকের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, সে লোকটাও মৃত অবস্থায় পড়ে ছিল। কে বা কারা যেন তাকে খুন করেছে। সেখানে নাকি লোকটা তার বউকে নিয়ে থাকত। তবে বউকে কেউ দেখে নি। কারণ বউ নাকি সবসময় ঘরে বসে থাকত। ধারণা করা যাচ্ছে এই নীলা মেয়েটাকে নিয়ে তার বউ আর লোকটার মধ্যে ঝামেলা হওয়ার এক পর্যায়ে তার বউ তাকে খুন করে পালিয়েছে আর নীলা মেয়েটাকে খুনের পেছনেও হয়তো সে লোকটার বউয়ের হাত রয়েছে। তবে কে সে মেয়ে এখনও শনাক্ত করতে পারেনি কেউ। তদন্ত চলছে। কেইস টা নিয়ে বেশ মাতামাতি আর তুলপাড় শুরু হয়ে গেছে সামাজিক মাধ্যমে। মেয়েরা কত বোকা একটা ছেলেকে বিশ্বাস করে কেন তার হাত ধরে চলে আসবে। এই দেখুন না এ মেয়েটার কী হাল হলো।
আলোর ভয়ে বুকটা ধুকধুক করতে লাগল। পালপিটিশান বেড়ে যাওয়ার উপক্রম। হঠাৎ করে হার্টবিট ব্যাপক ভাবে বেড়ে যাওয়াকে মেডিকেলের ভাষায় পালপিটিশান বলা হয়। আলো ঘামতে লাগল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল
- এক গ্লাস পানি হবে।
তানভীর আলোর এমন অবস্থা দেখে তাড়াতাড়ি করে পানি এনে তাকে দিল। আলো পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে এক ঢুকে সবটা পানি খেয়ে ফেলল। তার গা,হাত,পা ঠান্ডা হয়ে যেতে লাগল। সারা শরীর পুনরায় নিস্তেজ হতে লাগল। মানুষের ধারণা কতটা ভিত্তিহীন সেটা ভাবতে লাগল। সবাই ভাবছে নীলাকে খুন করার পেছনে আলোর হাত রয়েছে। অথচ কেউ জানে না নীলাকে নরক থেকে বের করতে আলো ঐ লেকটাকে খুন করেছে। সবাই ভাবছে নীলা প্রেমিকের সাথে পালিয়েছে। অথচ কেউ জানে না নীলা তার নিজের আপন মামা কর্তৃক ধর্ষিত হয়েছে। মানুষ একটা বিষয় যাচাই বাছাই না করেই সেটা নিয়ে মাতামাতি শুরু করে দেয়। আলোর ভয়ের মাত্রাটা প্রখর হতে লাগল। আলো কী ধরা পড়ে যাবে। নাকি আলোকে ভুল বুঝবে সবাই। এখন কী তানভীরকে কিছু বলা ঠিক হবে নাকি লুকাবে। দুয়ের মাঝে পড়ে যাওয়া বিষয়টা কাটিয়ে উঠা বেশ কষ্টদায়ক। আলো নিজেকে সামলালো। হালকা গলায় বলল
- এটা কী করে নিশ্চিত হলেন যে মেয়েটা তার প্রেমিকের সাথেই পালিয়েছে? এমনও তো হতে পারে এর বাইরে অন্য কারণ রয়েছে। না জেনে একটা বিষয় নিয়ে মন্তব্য করাটা কতটা যুক্তিযুক্ত?
তানভীর ভ্রুটা কুচকে বলল
- বিষয়টা আমি না সাংবাদিকরা বলছে। আর আপনি এমন ভাব ধরছেন মেয়েটাকে আপনি চেনেন আর মেয়েটার নিখোঁজের কারণও জানেন।
তানভীরের কথাটা শুনে আলোর মুখটা আরও শুকনো হয়ে গেল। শীতের মধ্যেও বেশ ঘামতে লাগল। তবুও কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে বলল
- চিনি বা না চিনি সেটা প্রশ্ন না। একটা মেয়ে বাসা থেকে নিখোঁজ মানেই কী প্রেমিকের সাথে পালিয়েছে? এ মেয়েটার সাথে অন্যকিছু ও তো ঘটতে পারে। না জেনে এমন বলাটা মোটেও উচিত হচ্ছে না। আর তদন্ত না করেই ভুল তথ্য দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা ছাড়া সাংবাদিকদের আর কোনো কাজ নেই। একটা লোক পতিতালয় থেকে মেয়ে কিনে আনবে তাকে নিয়ে বউয়ের মাঝে ঝামেলা হয়ে যদি লোকটাকে মেরেও ফেলে তার বউ, তাহলে তো অন্যায় কিছু করে নি। আর লোকটার বউ যে নীলাকে খুন করেছে সেটাও তো ভিত্তিহীন। সাংবাদিকদের কথা অনুযায়ী লোকটার বউ বাসা থেকে বের হত না। তাহলে তো সে মেয়ের বাইরের কারও সাথে যোগাযোগ থাকার কথা না।একটা মেয়ের বাইরের কারও সাথে যোগাযোগ নেই সে হুট করে একটা মেয়েকে বাইরের লোক দিয়ে ধর্ষণ করে খুন করাবে এটা কেমন কথা? কতটা যুক্তিসঙ্গত?
তানভীর আলোর কথা শুনে এবার একটু নির্বাক। আলোর কথায় যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে৷ তবে সামাজিক মাধ্যম আর সাংবাদিক তো আলোর কথায় লাফাবে না। তারা তাদের পথ অনুসরণ করবে৷ এখানে আলো বা তানভীর কী বলল তাতে তাদের কিছু যাবে আসবে না। তানভীর কিছুক্ষণ চুপ থেকে আলোর দিকে তাকিয়ে বলল
- আপনি তো উকিল হলে ভালো হবে। যুক্তি দিয়ে সব পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন। তবে আমাদের কথায় এখানে কিছু আসবে যাবে না। পুলিশ বিষয়টা তদন্ত করছে। ঐ মেয়েটাকে খুঁজে বের করার ব্যবস্থা নিয়েছে। দেখা যাক কী হয়।
তানভীরের কথা শুনে যদিও আলোর বুকটা ধুক করে উঠেছে। তবুও আলো মৃদু গলায় জবাব দিল
- পুলিশ আর কী করবে? তারা কিছুদিন বিষয়টা নিয়ে লাফালাফি করবে সে সাথে বাংলাদেশের জনগণও লাফালাফি করবে। আর একটা সময় পর বিষয়টা দমে যাবে। এ দেশে একটা বিষয় নিয়ে হুলুস্থুল শুরু হয় আবার বিচার কার্যকর হওয়ার আগেই সব শেষ হয়ে যায়। বাংলাদেশের আইন ব্যবস্থা হচ্ছে হাস্যকর রম্য ব্যবস্থা। এখানে আইন মানেই নিরাপত্তা দানের পরিবর্তনে নিরাপত্তা কেড়ে নেয়া। এ দেশের পুলিশ কেমন সেদিনের রাতেই বুঝে গেছিলাম। যে পুলিশ একটা অপরিচিত মেয়েকে রাতের আধাঁরে নিরাপত্তা দেওয়ার পরিবর্তে নিরাপত্তা কেড়ে নেয় সে আর যাইহোক মানুষ না। এদের উপর ভরসা করাও বোকামো।
তানভীর তার থুতুনীটা নিজের হাত দিয়ে মুষ্টি করে ধরে বলল
- তা ঠিক বলেছেন। তবে দেখা যাক বিষয়টা কতদূর যায়। আপনার শরীর কেমন এখন? মনে হচ্ছে কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তিত এখনও?
আলো চুপ হয়ে আছে৷ তানভীরের কথার কী জবাব দিবে সে বুঝতে পারছে না। একটা মিথ্যা চাপা দিতে আলোকে হাজারটা মিথ্যা বলতে হচ্ছে। এ মিথ্যার খেলা সামনের দিকে এগিয়ে নিতেও আলোর ইচ্ছা হচ্ছে না। আলো এটাও জানে নীলার বিষয়টা ঘাটলেই আলোর পরিচয় টা খুব তাড়াতাড়ি প্রকাশ পেয়ে যাবে। তখন তানভীর বিষয়টা কীভাবে নেবে কে জানে। এর চেয়ে আগে বলে দেওয়ায় শ্রেয়। কিন্তু তানভীরকে সবটা বলার পর সে ও যদি ভুল বুঝে অথবা আলোর সরলতার সুযোগ নেয় সেটা ভেবে আলো কিছু বলতেও পারছে না।আলো শুধু ঘামছে। আলোর এমন অবস্থা দেখে তানভীরের কাছে আলোর বিষয়টা স্বাভাবিক লাগছে না। নীলার ব্যপারটাতেও আলোকে বেশ সিরিয়াস মনে হচ্ছে। তাহলে কী নীলার সাথে আলোর কোনো যোগ রয়েছে। তানভীরের মাথায় বিষয়টা আসতেই তানভীর বুদ্ধি করে আলোকে বলে উঠল
- ময়না তদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী নীলার যেদিন মৃত্যু হয় সেদিন আপনাকে আমি এ বাসায় নিয়ে আসি। মানে গতকাল। তাহলে কী নীলার সাথে আপনার কোনো যোগ রয়েছে। আপনি এ পর্যন্ত যা বলেছেন সেটা কী সত্যি নাকি মিথ্যা? আপনার কথায় আমি কেন জানি কোনো সত্যতা খুঁজে পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে মুখে এক বলছেন ভেতরে অন্য পুষে রাখছেন। দেখুন আপনি কে বলেন তো?
কথাটা বলে তানভীর আলোর দিকে তীব্র সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাল। আলো ঢুক গিলতে লাগল। সারা শরীরে কোনো বল পাচ্ছে না। শত লুকাতে চাইলেও আলো আর কিছু লুকাতে পারবে না। কারণ আলো এখন যদি সত্যিটা না বলে তাহলে পরবর্তীতে এ মিথ্যা আলোর জীবনে অন্ধকার নামিয়ে আনবে। আলো তানভীরের চোখে তাকাল। এ নিষ্পাপ চোখে যেন আলো ভরসা খুঁজে পাচ্ছে। হলকা গলায় তানভীরকে আলো বলল
- নীলাকে আমি চিনি। সেদিন রাতে নীলা আর আমি দুজন একসাথে পালিয়েছিলাম। তারপর নীলা কোথায় যায় সেটা জানি না। নীলার যে এ পরিণতি হবে চিন্তাও করতে পারে নি।
আলোর কথা শুনে তানভীর বিস্মিত হলো৷ তাহলে কী আলো ঐ লোকটাকে খুন করেছে। তানভীরের এবার নিজেকে ছন্নছাড়া মনে হচ্ছে। আলো এত বড় সত্যি লুকিয়েছে সে সেটা মানতেই পারছে না। খকানিকটা কষ্টও পেয়েছে। কিছুটা অসংগতি নিয়ে আলোকে জিজ্ঞেস করল
- তাহলে আপনার প্রেমিকের ব্যপারটা,বাবা,মায়ের ব্যপার,বিয়ের ব্যপার টা কী মিথ্যা?
আলো মাথা নেড়ে জবাব দিল
- জি।
- তাহলে এত বড় মিথ্যা কেন বলেছিলেন?
- সেটারও কারণ আছে।
- আপনিই কী তাহলে ঐ লোকটাকে খুন করেছেন?
আলো চুপচাপ। কোনো জবাব দিচ্ছে না। আলোর নীরবতা দেখে তানভীর জোরে চেঁচিয়ে বলল
- কী হলো জবাব দিচ্ছেন না কেন? খুন করেছেন কী না বলুন? আপনার নীরবতা বলে দিচ্ছে আপনি খুনী।তার মানে একটা খুনীকে সাহায্য করছিলাম আমি? অর্থাৎ ঐ লোকটা আপনার স্বামী। নিজের স্বামীকে নিজে খুন করেছেন। কতটা হিংস্র আপনি।
কথাটা তানভীর শেষ করতে না করতেই আলো চেঁচিয়ে বলল
- হ্যাঁ আমি হিংস্র।আমিই আমার স্বামীকে খুন করেছি। কেন করেছি জানেন? না জেনে তো জোরে জোরে বুলি আওরাচ্ছেন। মানুষকে বলে ফেলা খুব সহজ। তার ভেতরের সব জেনে তাকে বলা উচিত।কতদূর চেনেন আমাকে? কী মনে হয় আপনার? চৌদ্দ বছরের একটা মেয়ে আমি৷ কিন্তু আমার কথা বার্তায় কখনও তা মনে হয় না। মনে হয় বেশ বড় আর ম্যাচুর আমি৷ কিন্তু সেটাও কীভাবে হয়েছি জানেন? কতটা আঘাত পেয়ে হয়েছি জানেন? আমার মতো মেয়ে কেন খুন করেছে জানেন? না জেনেই চেঁচিয়ে উঠলেন? তাহলে শুনোন।
এরপর আলো তার জীবনে ঘটে যাওয়া কালো অধ্যায়ের বর্ণণা করতে লাগল। একের পর এক তার সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের কথা বলে যেতে লাগল। কীভাবে তাকে একের পর এক কষ্ট দেওয়া হয়েছে কত নোংরা সম্পর্কে সে জড়িয়েছিল।কীভাবে সে সেখান থেকে বের হয়েছে। কীভাবে তার নীলার সাথে পরিচয় হয়। সবটা বলেই আলো চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কাঁদতে লাগল। আলোর বুক ফেটে কান্না আসছে। বুকের ভেতর জমে থাকা সকল কষ্ট কান্না হয়ে নামছে।
এদিকে আলোর কথাগুলো শুনে তানভীর নিশ্চুপ। এতটুকু মেয়ে এত কষ্ট সহ্য করেছে সেটা তার সরল মনকে বেশ নাড়া দিয়েছে। বুকের ভেতর কিছু একটা চেপে আছে মনে হচ্ছে কথা গুলো শুনে। তানভীর জানে না বিষয়টা সে কীভাবে সামলাবে। তানভীরের মা এসব জানলে কীভাবে নিবে বিষয়টা। সন্ধ্যায় তানভীরের মা আসলে কী করে তাকে বুঝাবে। তবে আপাতত তার মাকে কিছু বলা যাবে না। ভেবে চিন্তায় সময় বুঝে সবটা বলতে হবে। আপাতত আলোর থাকার ব্যবস্থাটা করতে হবে। এসব ভেবেই আলোর দিকে তাকিয়ে আলোর পাশে বসে মৃদু স্বরে বলল
- দুঃখিত আলো। আপনাকে এভাবে সবকিছু না জেনে বলা ঠিক হয়নি।
- সমস্যা নেই। মানুষ মাত্রই এমন। জেনে, না জেনে কিছু বলে দেওয়াতেই আনন্দ পায়। আমি কিছু মনে করেনি৷ এখন আপনার ইচ্ছা আমাকে সাহায্য করবেন নাকি ছুরে ফেলে দিবেন। জীবনে অনেক কষ্ট সহ্য করেছি আরও হলেও পারব। অন্ধকারে এক চিলতে আলোর খুঁজে বের হয়েছিলাম আমি আর নীলা। সেখানে নীলা অলরেডি অন্ধকারে তলিয়ে গেছে আর আমি অনিশ্চয়তা নিয়ে এখানে বসে আছি। হয়তো আমার জীবনেও সে আলোর দেখা মিলবে না।
তানভীর আলোর দিকে তাকিয়ে বলল
- অন্ধকারে এক চিলতে আলো হয়েই আপনার জীবনে থাকব। পথচলা বেশ কঠিন তবে দুজন মিলে সামনে এগুবো। রুশি ছিল আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের মতো। রুশিকে বুঝে উঠার আগেই অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিল আপনার ক্ষেত্রে সেটা হতে দিব না।
তানভীরের কথায় যেন আলো স্বস্তি পেল। চুপচাপ হয়ে বসে স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস নিল। এর মধ্যেই আলোর কানে একটা মেয়েলি কন্ঠের চিৎকার ভেসে আসলো। আলো চমকে গেল চিৎকারটা পেয়ে। তানভীরও প্রস্তুত ছিল না এমন চিৎকারে। আলো আওয়াজটা লক্ষ্য করে দেখল আওয়াজটা উপরের ঘর থেকে আসছে। আলো ভাবতে লাগল চিৎকারটা কার? চিৎকারটা শুনেই বুঝা যাচ্ছিল কোনো মেয়েকে রুমে তালাবদ্ধ করে রেখেছে আর সে মেয়েটা রুমের দরজায় জোরে জোরে কড়া নাড়ছে আর বলছে আমাকে বের করো। এ ঘরে থাকতে আমার একদম ইচ্ছা হচ্ছে না। তাহলে কী কোনো মেয়েকে তানভীর এনে আটক করে রেখেছে? আলোর ভয়ে গা শিউরে উঠল।কড়া সন্দেহের দৃষ্টিতে তানভীরের দিকে সে তাকাল। তানভীরের দিকে আলোর এমন চাহনি বেশ অপ্রীতিকর অবস্থার সৃষ্টি করল। তানভীর কোনো কথা না বলেই রুম থেকে তড়িঘড়ি করে বের হলো।বিষয়টা আলোর কাছে সন্দেহজনক লাগাতে সেও তানভীরের পিছু নিল। তানভীরও উপরের রুমের দিকে ছুটতে লাগল। আলোও ছুটতে লাগল তানভীরের পেছনে। এক পর্যায়ে তারা রুমের কাছে এলো। তানভীর তাড়াহুড়ো করে দরজাটা খুলল।দরজা খুলার সাথে সাথে আলোর ভয়টা বেড়ে গেল। কারণ...
গল্পের নাম : অন্ধকারে_এক_চিলতে_আলো
লেখিকা-: শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব-10 পর্ব
তানভীর তাড়াহুড়ো করে দরজাটা খুলল। দরজা খুলার সাথে সাথে আলোর ভয়টা বেড়ে গেল। কারণ একটা ২১-২ ৩ বছর বয়সী মেয়ে দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে। তানভীরকে দেখেই ভয়ে কুঁকড়ে খাটের উপরে থাকা কাঁথা মুড়ি দিয়ে তানভীরকে লক্ষ্য করে বলল
- যাও আমার কাছ থেকে চলে যাও। একদম কাছে আসবে না আমার। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। প্লিজ যাও।
তানভীর মেয়েটার কথা শুনে হালকা গলায় বলল
- ফাবিহা আস্তে চিল্লাও। আমি তানভীর।এত জোরে চিল্লাচিল্লি করো না।আমি তোমার কিছু করব না।মা বাইরে গেছে। মা আসলে তুমি যা চাও তাই দিবে। তুমি এখন এভাবে চিল্লাচ্ছিলে কেন?
তানভীরের কথা শুনে আলো বুঝতে পারলো মেয়েটার নাম ফাবিহা। কিন্তু মেয়েটা তানভীরের কথায় শান্ত হয়নি উল্টো ভয়ে চুপস যেতে লাগল।পাশে থাকা জিনিস পত্র তানভীরের দিকে ছুরতে লাগল। আর বলতে লাগল
- আমার কাছে আসবে না একদম। আমার অনেক কষ্ট হয়। যাও বলছি।
আলো বুঝতে পারছে না ফাবিহা কেন তানভীরকে এত ভয় পাচ্ছে। তাহলে কী তানভীর ওর সাথে এমন কিছু করেছে যাতে করে ফাবিহা তানভীরকে সহ্যই করতে পারছে না।এসব ভেবে আলোর মাথা ঘুরপাক খেতে লাগল। এদিকে তানভীর ফাবিহাকে কিছু না বলে আলোর দিকে তাকিয়ে বলল
- এখানে এসেছেন কেন? ঘর থেকে বের হোন। ঘরের দরজা লাগাব। সবকিছুতে এত কৌতুহল ভালো না।
আলো তানভীরের কথার কোনো জবাব না দিয়ে ঘরটা থেকে বের হয়ে ঘরের বাইরে দাঁড়াল। তানভীরও ঘর থেকে বের হয়ে ঘরের দরজাটা লাগিয়ে হনহন করে নিজের ঘরের দিকে যেতে লাগল। আলোর ভেতরে থাকা প্রশ্নগুলো আলোকে দুমরে মুচরে খাচ্ছে। তাহলে কী তানভীর ঐ মেয়েটাকে অত্যাচার করছে। এসব ভাবতে ভাবতেই সবটা সাহস সঞ্চয় করে তানভীরের পথ আটকে দিয়ে ঠিক সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল
- আপনি আমাকে বলুন মেয়েটা কে? আর কেনই বা চিৎকার করলো এভাবে? আর আপনাকে কেন এত ভয় পাচ্ছে? এর পেছনে কারণ কী?
তানভীর আলোর দিকে এগিয়ে গেল। আলো দু পা পেছালো।তানভীর আলোর বাহু ধরে তাকে পাশ কাটিয়ে যেতে নিলে আলো আরও কিছুটা সামনে এসে তানভীরের পথ রুখে দাঁড়িয়ে বলল
- কী হলো? না বলে কোথায় যাচ্ছেন? বলুন ঐ মেয়েটা কে? আপনাকে কেন ভয় পাচ্ছে? তার মানে ঐ মেয়েটার সাথে খারাপ কিছু হয়েছে যার সাথে আপনি জড়িত।
তানভীর আলোর কথায় আলোর দিকে গর্জে তাকাল। আলো তানভীরের এমন রাগী চাহুনি দেখে খানিকটা পেছনের দিকে গেল।তানভীর আলোর দিকে তাকিয়ে বলল
- ঘরে থাকা যে মেয়েটাকে দেখেছেন সে আমার আপন বোনের মতো।আমার খালাত বোন ফাবিহা। পিঠাপিঠি ছিলাম দুজন। তাই দুজনের খুনসুঁটিও ছিল প্রচুর। মেয়েটা মানসিক ভারসাম্যহীন দীর্ঘ তিন বছর যাবত। আর আপনি কী না তাকে নিয়েই আমাকে যা'তা বলছেন।
তানভীরের কথায় আলো চুপ হয়ে গেল। না জেনে কাউকে সত্যিই কিছু বলা উচিত না। আলো ভয়ে ভয়ে বলল
- আমি বুঝতে পারে নি।দয়াকরে কষ্ট নিবেন না। তবে উনি মানসিক ভারসাম্যহীন হলেন কী করে?
-কিছু জানোয়ারের জন্য।
আলো বিস্মিত হয়ে বলল
- মানে?
- ফাবিহা একটা ছেলেকে প্রচন্ড রকম ভালোবাসত। তখন ফাবিহা ইন্টার ১ম বর্ষে পড়ত। আমার কাছে সবকিছুই বলত। নিজের ভালোবাসার কথা, নিজের কথা সব। একটা সময় পর ফাবিহা আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। জিজ্ঞেস করলে বলে তার প্রেমিক চায় না আমার সাথে সে কথা বলুক তাই কথা বলবে না। আমিও আর তার সিদ্ধান্তে দ্বিমত করেনি। চেয়েছি সে তার জায়গায় ভালো থাকুক। এরকম করে ফাবিহার সাথে আমার যোগাযোগ নেই অনেকদিন যাবত।প্রায় একবছর তো হয়ে যাবে। সে সময়টাতে রুশির সাথে দেখা। রুশির ঘটনাকে কেন্দ্র করে এত খারাপ সময় পার করি যে কীভাবে এক বছর ফাবিহার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিলাম বলতে পারব না। এক বছর পর হুট করে জানতে পারি ফাবিহা অসুস্থ। আমি আর মা তাড়াতাড়ি হাসপাতালে যাই। সেখানে গিয়ে জানতে পারি ফাবিহা রেইপ হয়েছে। সেটা খালা জানতে পেরে খালা স্ট্রোক করে। সে ঘটনার পর খালা আর সুস্থ হয়নি পরপারে চলে যায়। আর ফাবিহার তখন জ্ঞান ছিল না। জ্ঞান ফেরার পর ফাবিহা জানায় যে তার প্রেমিক তাকে ঘুরতে নিতে গিয়ে এক বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে তার প্রেমিক সহ তাকে সাতজন মিলে রেইপ করে। কথাগুলো বলার পর ফাবিহা আরও জোরে চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। পরবর্তীতে জ্ঞান ফেরার পর খালার খবর জেনে নিজেকে সে আর সামলাতে পারে নি।এক তো প্রিয়জন হারিয়েছে অন্যদিকে নিজের সব হারিয়েছে।সব মিলিয়ে সেদিনের পর থেকে সে আর স্বাভাবিক জীবনে আসতে পারে নি।মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। সে এখনও সে অতীতে ডুবে আছে। শুধু আমাকে না যেকোনো ছেলেকে দেখে সে চিৎকার করে উঠে। বাইরের আলো সহ্য করতে পারে না।
"মাঝে মাঝে মানুষ আঁধারে এমনভাবে ডুবে যায় তখন আলো তাদের সহ্য হয় না। তখন তারা আলোর কাছে আসার থেকে আঁধারের অতল সাগরে নিজেকে নিমজ্জিত করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।"
ফাবিহার ক্ষেত্রটাও এমন সে চাইলেও সে অতীত থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না।তার অতীত তাকে প্রতিনিয়ত কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। নিজের সবকিছু হারানোর প্রতিচ্ছবিটা তার চোখে দীর্ঘ তিন বছর যাবত প্রতিনিয়ত ভাসছে।
তানভীর কথা গুলো বলে আস্তে পায়ে আলোকে সরিয়ে ঘরের দিকে এগুতে লাগল। আলো ঠাঁই দাঁড়িয়ে চুপ হয়ে রইল। নিজের মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করছে তার, তানভীরকে এত কিছু বলেছে তাই। সেই সাথে ফাবিহার করুণ পরিস্থিতির জন্য খুব কষ্ট পাচ্ছে। প্রতিটা মানুষেই নিজের জায়গায় কোনো না কোনো বিষয়ে কষ্টে আছে।
"মানুষের কষ্টের জায়গা ভিন্ন হলেও কষ্টের পরিমাণ সবার সমান। কষ্টের মাত্রাটা সবার কাছে তার জায়গা থেকে প্রখর।"
আলোর মনে হচ্ছে তানভীরের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া উচিত। ভাবতে ভাবতেই মসজিদ থেকে আযানের ধ্বনি ভেসে আসছে। এমন সময় তানভীর আলোর কাছে এসে বলল
- মাগরিবের আযান পড়ে গেছে। কখন যে, দিন পেরিয়ে গেল বুঝতে পারেনি। মা আসবে কিছুক্ষণ পর। আমি নামাজে যাচ্ছি। আর রাবু নানুকে বলে আপনার খাবারের ব্যবস্থা করছি। খাবারটা খেয়ে নিয়েন। মা আসলে মাকে বুঝিয়ে আপনার থাকার ব্যবস্থাটা করে দিব। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।
বলেই তানভীর যেতে লাগল। আলো তানভীরকে পিছু ডেকে বলল
-শুনুন।
-বলুন কী বলবেন?
- আপনাকে ঐ সময় ঐভাবে বলাটা উচিত হয়নি। জীবনে এত নেতিবাচক বিষয় ঘটেছে যে ইতিবাচক কিছু আশা করতে ভয় হয়। আমাকে ক্ষমা করে দিবেন।
আলোর কথা শুনে তানভীর খানিকটা পিছিয়ে বলল
- কিছু মনে করে নি আমি। আশা করি এরপর থেকে আপনার জীবনে যা ঘটবে সব ইতিবাচক। নামাজে গেলাম আপনি থাকুন। আর খাবারটা পেলে খেয়ে নিবেন।
আলো হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। তারপর নিজের ঘরে এসে অযু করে নামাজে দাঁড়াল। অনেকদিন যাবত আলো নামাজে দাঁড়ায়নি। জীবনের এত চরম পরিস্থিতিতে পরে স্বাভাবিক জীবন যাপনের নীতির বাইরে চলে গেছিল। রবের কাছে যে মন খুলে সব বলা যায় সেটাও ভুলে গেছিল। আজকে সে নামাজ আদায় করে হাত তুলে মনের মধ্যে জমে থাকা সব কষ্ট রবের কাছে বলল। তার খুব ভালো লাগছে এখন।বেশ শান্তি লাগছে এখন। মনে হচ্ছে বুকের ভেতরে জমে থাকা বড় পাথরটা নেমে গেছে।নামাজটা শেষ করে খাটের পাশে রাখা ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে বসতেই রাবু খাবার নিয়ে আসলো আলোর জন্য।খাবার টা আলোর দিকে বাড়িয়ে বলল
- কখন থেকে রান্না করে বসে আছি। মাত্র ছোট সাহেব বলল আপনারে খাবার দেওয়ার জন্য। আপনার হয়তো ক্ষুধা লাগছে অনেক তাই না?
আলো রাবুর হাত থেকে খাবারের প্লেটটা নিয়ে রাবুকে মৃদু গলায় বলল
- খাবাবের কথা আমিই ভুলে গেছিলাম। আমার ক্ষুধা লাগেনি। বরং এখনও খেতে মন চাচ্ছে না।
- খালি পেটে থাইকেন না। খাইয়া লন।
আলো মাথা নাড়াল। রাবু রুম থেকে চলে গেল। আলোর প্লেটের ভাতে হাত নাড়তে লাগল। খাবারটা মুখে তুলতে তার একদম ইচ্ছা হচ্ছে না। কিন্তু এ মুহূর্তে না খেলে তানভীরের মা এসে জানলে অনেক প্রশ্নের সম্মুখী হতে হবে। সে জন্য বেশ জোর করেই কয়েক লোকমা মুখে তুলে নিল।বাকিটা সে চাইলেও গিলতে পারছে না। আর যতটুকু খাবার ভেতরে গিয়েছে ততটুকু খাবার ও বের হয়ে আসতে চাচ্ছে। আলো আর বাকিগুলো না খেয়ে হাতটা ধুয়ে শুয়ে পড়ল। শরীরটা বেশ খারাপ লাগছে তার। কী করবে বুঝতে পারছে না। হুট করে শীত ও বেশি লাগছে।কম্বলটা মুড়ি দিয়ে মাথাটা কম্বলের ভতরে ঢুকিয়ে শুয়ে আছে। সারা শরীর কাপুঁনি দিচ্ছে তার। ভেতরটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। কেন যে এমন লাগছে বুঝতে পারছে না।
এর মধ্যেই তানভীর কাশি দিয়ে আলোর রুমে প্রবেশ করল।আলোকে কাঁপতে দেখে আলোকে ধরে দেখল আলোর সারা শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। তানভীর তাড়াহুড়ো করে আলোর মাথায় জলপট্টি দিতে লাগল।প্রায় আধা ঘন্টা ক্রমাগত জলপট্টি দেওয়ার ফলে আলোর জ্বরটা একটু নামল। এর মধ্যে তানভীরের মা চলে আসলো। তিনি এসেই আলোর কাছে আসলেন। লক্ষ্য করলেন আলোর জ্বর হয়েছে।তিনি নিজে আলোর পাশে বসে জলপট্টি দিল কতক্ষণ । তারপর ডাক্তারকে কল দিল আসার জন্য। তানভীর এ সুযোগে তার মাকে বলল
- মা আলো আর শায়ান একটা সাবলেটে থাকত। কেনো এক কারণে সাবলেটটা ছাড়তে হচ্ছে।শায়ান কোনো একটা মেসে উঠে যাবে। তবে আলোর থাকা নিয়ে একটু সমস্যা হচ্ছে। শায়ান বলছিল আমাদের বাসায় আলোকে কিছুদিন রাখতে।তুমি সম্মতি দিলে আমি শায়ানকে জানাব।
জাহানারা সুফিয়া আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল নিষ্পাপ চেহারার, মলিন মুখটা চোখ বন্ধ করে জ্বরের তীব্রতায় ভুগছে। আলোর প্রতি খানিক মায়া জন্মালো তার। সে তানভীরকে হালকা গলায় জবাব দিল
- থাকতে চেয়েছে থাকুক।বাসায় তো আর জায়গার অভাব নেই। কিছুদিনের জন্য সমস্যা হবে না আশাকরি। আর আলো কী খেয়েছে?
- হ্যাঁ মা খেয়েছে।
- আচ্ছা শায়ানকে একটা কল দাও তো। আলোর সম্পর্কে না জেনে তো চিকিৎসা করা যাবে না।ডাক্তার তো আলোর সম্পর্কে জানতে চাইবে।
তানভীর কোনো কথা না বলে শায়ানকে কল দিল।অবশ্য তানভীর আগে থেকেই শায়ানকে বুঝিয়ে রেখেছিল।তানভীরের কল পেয়ে শায়ানও বেশ নাটক করল। ঠিক তানভীর যেমনটা শিখিয়ে দিয়েছিল তেমনটা। জাহানারা সুফিয়া শায়ানের সাথে কথা শেষ করতেই ডাক্তার আসলো। ডাক্তার আলোকে দেখে বলল
- হুট করে আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে জ্বরটা হয়েছে।এটা একটু যত্নেই সেরে যাবে। আমি ঔষধ লিখে দিয়ে যাচ্ছি নিয়ম করে খাওয়াবেন।
তানভীরের মা মাথা নাড়ল।ডাক্তারকে বিদায় দিয়ে আলোকে নিজ হাতে খাইয়ে ঔষধ খাওয়ায়ে দিল। রাবুকে বলল আলোর সাথে থাকার জন্য। আর তানভীরকে বলল নিজের ঘরে যাওয়ার জন্য।তানভীরও কোনো কথা না বলে নিজের ঘরে চলে গেল।
পরদিন সকালে আলো ঘুম থেকে উঠে খাট থেকে নামতে নিবে ঠিক এমন সময় তানভীর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য নিয়ে হাজির হলো।
গল্পের নাম : অন্ধকারে_এক_চিলতে_আলো
লেখিকা-: শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব-11 পর্ব
পরদিন সকালে আলো ঘুম থেকে উঠে খাট থেকে নামতে নিবে ঠিক এমন সময় তানভীর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য নিয়ে হাজির হলো। তানভীর আলোর দিকে তাকিয়ে বলল
- নীলার মৃত্যুর আপডেট বের হয়েছে। তোমার মাকে কারা যেন খুন করেছে গতকাল। সবার ধারণা এটা তুমি করেছো। তোমাকে পুলিশ হন্নে হয়ে খুঁজছে। তোমার কোনো ছবি বাসায় খুঁজে পায়নি তাই প্রচার করতে পারছে না। তুমি দেখতে কেমন সেটাও কেউ বলতে পারছে না। কী যে হবে কে জানে।আর তোমার মাকেই বা কে খুন করলো? আর দুঃখিত তুমি করে বললাম। তুমি আমার বেশ ছোট তাই তুমি করে বলতেছি।
আলো অবাক চোখে তাকাল তানভীরের দিকে।নিজের মায়ের মৃত্যুর খবর শুনে আলোর বুকটা অস্থির হয়ে গেল। সৎ মা হোক বা যাই করুক মা তো মা এই হয়। একটু কষ্ট অনুভব আলোর হচ্ছে। সে সাথে মাথায় প্রশ্ন জাগছে কে এ কাজটা করল। তার মায়ের শত্রু কে হতে পারে। পরক্ষণেই আবার ভাবলো এত পুরুষের সাথে তার মায়ের চলাফেরা সুতরাং তাদের কেউ হয়তো খুন করেছে। তবে সব বিষয়ে আলো না চাইলেও জড়িয়ে যাচ্ছে। অনিশ্চিত ক্ষীণ আশা নিয়ে আলো এখানে বসে আছে। আলো মৃদু সুরে তানভীরকে বলল
- তুমি করে বলেছেন আমি রাগ করেনি। আমি আপনার ছোট তুমি বলতেই পারেন। তবে সবকিছুতে না চাইতেও আমি জড়িয়ে যাচ্ছি। জানি না মাকে কে খুন করেছে।সবাই সবার কর্মফল পায় মাও পেয়েছে। মায়ের হাতে বাবা খুন হয়েছিল। আর আজকে মাকে অন্য কেউ খুন করেছে। সে যেমন করেছে ঠিক তেমনটায় ফিরে পেয়েছে। তবে সব জায়গায় আমি দোষী প্রমাণিত হচ্ছি। কী করব বুঝতে পারছি না। আলোর নিশানায় ছুটতে গিয়ে অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছি। একটা কাজ করলে কেমন হয় পুলিশে গিয়ে যদি আমি সব বলি ভালো হবে না?
আলোর কথা শুনে তানভীর তীক্ষ্ণ গলায় বলল
- পাগল হয়ে গেছ নাকি? পুলিশের কাছে এখন গেলে বিষয়টা নিয়ে তোলপাড় হয়ে যাবে। কিছুদিন যাক।বুদ্ধি বের করি।কী করা যায় ভাবি।তারপর সমস্ত প্রমাণ জোগাড় করে পুলিশে যাব।এর আগে ঘাপটি মেরেই বসে থাকতে হবে। একটু চুপচাপ থাকো আপাতত।আর মায়ের কানে কোনোভাবে কথা গুলো গেলে আর রক্ষা নাই। সুতরাং যা করতে হবে ভেবে চিন্তায়। তাদের কাছে তোমার কোনো ছবি নাই সুতরাং তোমার কাছে তারা সহজে আসতে পারবে না। আর এ সময়ের মধ্যে আমাদের সবকিছু চিন্তা করে বের করে নিতে হবে।সঠিক সময়ে সঠিক কাজ করতে হবে।একটু উনিশ বিশ হলে হিতে বিপরীত হবে।
মা আসলে স্বাভাবিক থাকবে একদম।আর বাকি ব্যবস্থা সময় মতো করা হবে। আর আজকে শায়ান আসবে। মা বলেছে দেখা করতে।আমি শায়ানকে তোমার ছবি দিয়েছি আর শায়ানের ছবিও তোমাকে দেখাব।মায়ের সামনে দুজনের আচরণ যেন একদম সাবলীল থাকে। এমন কোনো কাজ করা যাবে না যাতে ধরা পড়ে যাও দুজনে। একদম এমন আচরণ করবে যাতে মা মনে করে তোমরা সত্যি সত্যি ভাই বোন।মনে থাকবে তো?
- জি মনে থাকবে।
- আমি গেলাম এক কাপ কফি খেয়ে আসি। তুমি কী কফি খাবে?
- আমি এসব খাই না।
- এসব মানে কী? যেভাবে বলছো মনে হয় আমি তোমাকে মদ খেতে প্রস্তাব দিয়েছি।
আলো তানভীরের কথা শুনে কিছুটা বিরক্ত গলায় বলল
- আপনি একটু বেশিই বকেন। যেখানে আমি ছিলাম সেখানে দু মুঠো ভাত গিলতেও আমার কষ্ট হত। সেখানে চা কফি তো পরের ব্যপার। এখন সেগুলো না খেতে খেতে একটা অনীহা চলে এসেছে। তাই ভালো লাগে না।সব কথায় প্যাচাল পারা আপনার স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারি বদঅভ্যাস বাঁধিয়েছেন আপনি।
- সে যাইহোক। তুমিও তো কম না।ইস্পাতের মতো তোমার মুখ চলতেই থাকে। কখন কী বলো হিসাব নেই৷ আমি গেলাম। মা আসলে মাকে সামলিও। এমন কিছু করবে না যাতে মা সন্দেহ করে।
- বুঝেছি তো। একথাটা কয়বার বলেছেন বলুন তো।আপনি যান গিয়ে কফি খান। আমার খারাপ লাগছে। জ্বরটা আবার আসবে কী না কে জানে।
- কী বলো। দাঁড়াও আমি নাস্তা নিয়ে আসছি। নাস্তা খেয়ে এখনি ঔষধ খাবে।
- এখন আমি বসা থেকে দাঁড়াব?
- এ দাঁড়ানো সে দাঁড়ানো না।এত কথা বলো কেন? সবকিছুতে তোমার তর্ক। বসো চুপচাপ আমি নাস্তা নিয়ে আসছি। শায়ান ও চলে আসবে কিছুক্ষণের মধ্যে।
বলেই তানভীর রুম থেকে বের হলো। আর আলো নিঃশব্দ একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে চুপ করে বসে রইল। এর মধ্যেই তানভীরের মা রুমে প্রবেশ করলো।হাতে কী যেন নিয়ে।আলো তানভীরের মাকে দেখে একটু সোজা হয়ে বসে বলল
- আন্টি আপনি এত সকাল সকাল?
- গতকাল অনেক জ্বর ছিল তোমার। তাই সকাল সকাল দেখতে আসলাম জ্বর কমেছে কী না।এখন তো বেশ সুস্থ লাগছে।তোমার জন্য ডাবের পানি নিয়ে এসেছি। খেলে ভালো লাগবে।
তানভীরের মায়ের এমন মায়া ভরা কন্ঠস্বর শুনে আলো কেঁদে ফেলল।আলোকে কাঁদতে দেখে তানভীরের মা পাশে বসে আলোকে ধরে বলল
- কী হয়েছে তোমার? কাঁদছো কেন? খারাপ কী বেশি লাগছে?
তানভীরের মায়ের এমন সৌহার্দপূর্ণ কথায় আলো আরও জোরে কেঁদে দিল। অনেকদিন পর আলো বুঝতে পারছে মায়ের ভালোবাসা কী।এক মা থেকেও ছিল না। আরেক মাকে বুঝ হওয়ার আগেই হারিয়েছে। সব মিলিয়ে এত ভালোবাসা পেয়ে আলো আবেগ সামলাতে পারলো না।আলোকে কাঁদতে দেখে তানভীরের মা জড়িয়ে ধরে বলল
- কী হয়েছে তোমার।এভাবে কাঁদছো কেন? বেশি খারাপ লাগছে কী?
আলো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল
- মায়ের কথা অনেক মনে পড়ছে।তাই।
- আহারে কষ্ট পেও না।তোমার ভাই তো আজকে আসবেই।আর মায়ের সাথে কথা বললে আমার মোবাইল দিয়ে কথা বলো ভালো লাগবে।আপাতত ডাবের পানিটা খেয়ে নাও। তানভীর নাস্তা নিয়ে আসবে।তুমি খেয়ে নিও।আমি একটু বিশ্রাম নিয়ে অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরী হবো। কেঁদো না কেমন? আমি তো তোমার মায়ের মতো।
আলোকে তারপর নিজের কাছে এনে কপালে আলতো চুমু দিয়ে তানভীরের মা ডাবের পানিটা আলোর হাতে দিয়ে রুম থেকে বের হতে নিতে চাইবে এমন সময় তানভীর নাস্তা নিয়ে আলোর রুমে প্রবেশ করলো। তানভীরের মা তানভীরকে দেখে মৃদু গলায় বলল
- ওর একটু যত্ন নিও। হয়তো বাড়ির কথা মনে পড়ছে।
কথাটা বলেই উনি রুম ত্যাগ করলেন। আলো ডাবের পানিটা খেয়ে নিল। এর মধ্যে তানভীর খাবারটা বাড়িয়ে নিজের জন্য বানানো কফিতে চুমুক দিল। আর আলোকে বলল
- নাস্তাটা খেয়ে নাও
আলো আর কোনো কথা বলল না। চুপচাপ নাস্তাটা খেয়ে নিল। নাস্তা খাওয়া শেষ করতে না করতেই শায়ান আসলো বাসায়। শায়ান এসেই তানভীরকে ডাকতে লাগল। তানভীর আলোকে ইশারা করে বলল
- এখানে চুপচাপ বসো শায়ান এসেছে। মায়ের সামনে এমন ভাব ধরবে তোমরা দুজন দুজনকে চিনো। ঠিক আছে। যাতে বুঝতে না পারে তোমরা অপরিচিত।
বলেই রুম থেকে বের হলো। রুম থেকে বের হয়ে দেখল এতক্ষণে তানভীরের মা জাহানারা সুফিয়া শায়ানকে সোফার রুমে বসিয়ে নিজেও বেসেছে। তারপর শায়ানকে বলছে
- তোমার বোনের মনে হয় মন খারাপ। হয়তো মা, বাবার জন্য হয়তো মন খারাপ করছে।।তুমি একটু ওর কাছে যাও। গিয়ে দেখো কী বলে।
শায়ান মাথা নেড়ে সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল
- আমি এখনি গিয়ে দেখে আসছি।
বলেই তানভীরের দিকে তাকিয়ে বলল
- আলোর রুমটা কোথায়?
তানভীর আলোর রুমটা দেখিয়ে বলল
- তুই আলোর সাথে গিয়ে কথা বল। আমি কফি বানিয়ে নিয়ে আসছি তোর জন্য।
বলেই রান্না ঘরের দিকে গেল।আর শায়ান আলোর রুমে এসে আলোর পাশে বসল। আলোকে দেখে সে আর নিজেকে সামলাতে পারলো না।বিকৃত হয়ে গেল। আলোর হাতটা চেপে ধরে বলল
- আমি জানি তানভীর তোমাকে রাস্তা থেকে নিয়ে এসেছে। যদি এখানে থাকতে চাও আমার কথা মতো যা করতে বলি করো। নায়হ আন্টিকে সব বলে দিব।
আলো ভয়ে কাঁপতে লাগল। হাতটা জোর করে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল
- কী বলতে চাচ্ছেন আপনি? আর উল্টা পাল্টা কিছু করার চেষ্টা করবেন না। আমি কিন্তু চিৎকার করব।
- চিৎকার করলে তুমিই ফেঁসে যাবা। শুধু শুধু নিজের বিপদ ডেকে এনো না। তোমাকে ছবিতে দেখেই তোমাকে পাওয়ার একটা বাসনা মনে জেগেছে। একটু জড়িয়ে ধরব শুধু। এখানে কেউ দেখবে না। আমি আর তুমি ছাড়া। আন্টি বাহিরে আর তানভীর রান্না ঘরে। একটু সময়ের ব্যপারেই তো। এটুকু না করলে সব বলে দেবো কিন্তু আন্টিকে।
- আপনি কী আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছেন? আপনি যে এত কুৎসিত মনের সেটা কী তানভীর ভাই জানে।
- কেউ কিছু জানে না। আর জানবেও না। একটু জড়িয়ে ধরব প্লিজ। শব্দ করলে তোমারেই বিপদ।
বলেই শায়ান আলোকে জড়িয়ে ধরতে নিলে আলো আচমকা চেঁচিয়ে উঠে।।আলোর চেঁচানোতে জাহানারা সুফিয়া আর তানভীর দৌঁড়ে আসে। তানভীর আর জাহানারা সুফিয়াকে দেখে শায়ান একদম চুপ হয়ে বসে রইল। এমন ভাব ধরল সে যেন ভাজা মাছটাও উল্টে খেতে জানে না। এদিকে জাহানারা সুফিয়া আলোকে ভয় পেতে দেখে বেশ জোর গলায় বলল
- কী হয়েছে এভাবে চেঁচিয়ে উঠলে কেন?
আলো আর সত্যিটা লুকাতে পারল না।ঢুক গিলতে গিলতে এই মাত্র ঘটে যাওয়া সব ঘটনা বলল। আলোর কথা শুনে তানভীর বুঝতে পারছে না কী করবে। শায়ান যে এমন মুখোশধারী সে বুঝতেও পারে নি এতদিন। আর তানভীরের মাকে সবটা সত্যি কীভাবে বলবে বা সামলাবে সেটাও বুঝতে পারছে না। এবার আলোর কথা শুনে তানভীরের দিকে জাহানার সুফিরা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাল। তারপর
গল্পের নাম : অন্ধকারে_এক_চিলতে_আলো
লেখিকা-: শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব-12 পর্ব
তানভীরের দিকে জাহানার সুফিয়া সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাল। তারপর কিছুটা কঠোর গলায় বলল
- এভাবে সব লুকানো তোমার উচিত হয়নি।এর আগে এসব বিষয় নিয়ে অনেক ঝামেলা হয়েছে সেটা তুমি নিজেও জানো।তাহলে এ কাজ কেন করলে?
জাহানারা সুফিয়ার কথায় তানভীর নিশ্চুপ। কোনোরূপ উত্তর সে দিচ্ছে না।জাহানারা সুফিয়া তানভীরের উত্তরের তোয়াক্কা না করেই শায়ানের দিকে এগুতে লাগল।শায়ানের ঠিক কাছে গিয়ে বলল
- বোন আছে বাসায়?
শায়ান ভয়ার্ত গলায় উত্তর দিল
- হ্যাঁ।
জাহানারা সুফিয়া কথাটা শুনে শায়ানের গালে জোরে কষিয়ে একটা থাপ্পর দিয়ে বলল
- তোমার বোনের সাথে তানভীর এমন করলে কেমন লাগত? এত বেহায়া নির্লজ্জ হতে বিবেকে বাঁধল না।ঘরে তোমার মাকে দেখো না? নিজের বোন মায়ের সাথে এমন হলে কী করতে। বেয়াদব ছেলে নিজেকে শুধরাও। চাইলেই তোমাকে পুলিশে দিতে পারতাম। তবে তোমাকে কিছু না করে ছেড়ে দিলাম। একবার শুধরনোর সুযোগ দিলাম। আমার চোখের সামনে থেকে যাও।আর কোনোদিন যেন তোমাকে আমার সামনে না দেখি।আর তোমার পরিবারকে এ বিষয়ে আমি অবগত করব।যাতে করে তারা শাসন করতে পারে।
শায়ান ভয়ার্ত গলায় বলল
- আন্টি বাবা, মাকে বলবেন না দয়াকরে। আমি ভুল শুধরে নিব।
- আমি কী করব নাকি করব না সেটার পারমিশন তোমার কাছ থেকে নিব না।সুতরাং তুমি এখন যেতে পারো।নাহয় ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করব।
শায়ান আর কোনো কথা বলল না।চুপচাপ মাথা নীচু করে যেতে নিল। এমন সময় জাহানারা সুফিয়া তানভীরের পিছু ডাকল। শায়ান ডাকে সাড়া দিয়ে উনার দিকে তাকাল। উনি শায়ানকে কঠোর গলায় বলল
- আলোর পায়ে ধরে মাফ চেয়ে তারপর যাও। নাহয় পুলিশল দিব তোমায়।
শায়ান উনার কথায় ভয় পেয়ে আলোর পায়ের উপর পড়ে বলল
- আমাকে ক্ষমা করে দিন।এমন করাটা উচিত হয়নি। আপনি আমার বোনের মতো।
আলো কোনো কথা বলল না।পা টা ছাড়িয়ে নিয়ে বিছানার উপর উঠে গেল। আর শায়ান কোনো কিছু না বলে মাথা নীচু করে চলে গেল।এদিকে তানভীর বুঝছে না কী করবে। জাহানারা সুফিয়া তানভীরের দিকে এবার তাকিয়ে বলল
- আমাকে বলো কেন এমন মিথ্যা বললে? ফাবিহার ঘটনার পর, রুশির ঘটনার পরও কী তোমার টনক নড়ে নি।তাহলে এমনটা কেন করলে? আমার কাছে কেন লুকালে বলো?
- মা আমি ভয় পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম তুমি বিষয়টা কীভাবে নাও তাই। আমাকে ক্ষমা করে দাও।ভুলটা আমার তবে কারও বিপদ দেখলে ভালো লাগে না । মনুষ্যত্ব বলি দিয়ে বিনা সাহায্যে থাকতে পারি না।
- আলো কে? আলোর পরিচয় দাও।সমস্ত কিছু আমাকে খুলে বলো।
তারপর তানভীর আলোর সব ঘটনা তার মাকে বলল। জাহানারা সুফিয়ার নরম মনটা বিগলিত হলেও সে নিজেকে শক্ত করে জবাব দিল
- এখন পুলিশকে বলা ছাড়া কোনো উপায় নেই। আগে পুলিশকে সব বলতে হবে।তারপর আলোর বিষয়টা ভালো করে জানতে হবে সে সঠিক বলেছে কী না। যদি সে সঠিক বলে থাকে তাহলে তাকে সাহায্য করব। আর মিথ্যা বললে তো জেলে পঁচে মরবে। তবে এখন পুলিশের কাছে সব বলতে হবে।নাহয় হিতে বিপরীত হবে। সবাই ভাববে এসব সত্যি আর এসবের সাথে আমরা জড়িত।এর আগের বার রুশির ব্যাপারটা নিয়ে কী হয়েছিল তো দেখেছিলে তো।এবার আর কোনো ভুল পদক্ষেপ আমি নিতে চাই না।
- কিন্তু মা আলোর তো দোষ নেই। কেন সে শাস্তি পাবে।
- দোষ না করলে সে মুক্তি পাবে। আমি প্রমাণ জোগার করব। তবে এখন তাকে পুলিশে দিতে হবে এছাড়া উপায় নেই।
বলেই আলোর কাছে গেল জাহানারা সুফিয়া। আলোর হাতটা শক্ত করে ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল। যাবার বেলায় আলো তার পলকহীন ভাবে তাকানো চোখটা দিয়ে তানভীরের দিকে তাকালো।তানভীর শুধু নীরব দর্শকদের মতো দেখতে লাগল। নিজেকে সে সামলাতে পারছিল না।তবুও সামলে নিল।কারণ এখন চুপ থেকে দাঁত কামড়ি দিয়ে থাকা ছাড়া তার কোনো উপায় নেই। জাহানারা সুফিয়া থানায় নিয়ে আলোর সব ঘটনা বলল। পুলিশ আলোকে আটক করে নিল।আর জাহানারা সুফিয়াকে বলল
- আমরা বিষয়টা তদন্ত করছি।সত্যি যেটা সেটাই বের করব। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।
জাহানারা সুফিয়া আর কোনো জবাব দিল না। চুপচাপ উঠে চলে গেল। তার মাথায় কী চলছে সেটা বুঝার উপায় নেই। এদিকে তানভীর চুপ হয়ে বসে আছে। শায়ান যে এমন স্বভাবের সেটা সে মানতে পারছে না
আর আলোর জীবনে সে বলেছিল অন্ধকার নামতে দিবে না আজকে সেই কাজটায় হলো। নিজেকে বেশ ছন্নছাড়া মনে হচ্ছে। তানভীরের কাছে যদি একটা আলাদিনের চেরাগ থাকত তাহলে হয়তো সে দৈত্যের কাছে আলোর মুক্তি চাইতো। কিন্তু রূপকথার সে আলাদীনের প্রদীপ তো বাস্তবে আসবে না।
এদিকে আলোকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। মামলা টা কোর্ট পর্যন্ত চলে গেছে। নিজের সৎ মা,নীলা আর নিজের স্বামীকে হত্যার দায় চাইলেও সে এড়াতে পারছে না।যদিও সে নিজের স্বামীর খুন করেছিল পরিস্থিতির শিকার হয়ে আর বাকিগুলো কে করেছে জানে না।তবে দোষ তার ঘাড়ে।জেলের অন্ধকার রুমে বসে চোখ বন্ধ করে চোখের জল ফেলছে। দুবেলা শুকনো রুটি জুটছে। সে সাথে বকা তো আছে। আলোর এক চিলতে আলোর আশাটা নিভে গেল ধুম করে। জেলে বসে নিজের জীবনের সব ইতিবাচক আশা গুলো মাটিচাপা দিয়ে দিল। জেলের অন্ধকার গলিতে পার করলো তিনদিন। কোর্ট ছয়দিনের রিমান্ড মন্জুর করেছে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য।
আলোকে নিয়ে গেল জিজ্ঞাসা বাদের জন্য। আলোর সামনে দাঁড়িয়ে প্রথমে আলোকে মৃদু গলায় একজন মহিলা বললেন
- বলেন খুন গুলো কেন করেছেন?
আলো মহিলাটাকে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা বলল।তবে মহিলাটা নীলা আর আলোর মায়ের খুনের ব্যপারে কে খুন করেছে স্বীকার করছিল না বলে একের পর এক শারিরীক আঘাত করতে লাগল। আর জিজ্ঞেস করতে লাগল বাকি খুনগুলো কেন করেছে আর তার সাথে কারা জড়িত।আলোর উত্তর প্রতিবারেই এক। মাইরের আঘাতে আলোর ঠোঁট কেটে রক্ত বের হচ্ছে। সারা শরীর টিলার মতো উঁচু নীচু হয়ে লাল হয়ে আছে। মাঝে মাঝে গরম পানির স্প্রে করা হচ্ছে। অকথ্য ভাষায় গালি দেওয়া হচ্ছে।আলো আর পারছে না সহ্য করতে। সত্য বললেও কেউ বিশ্বাস করছে না।আলো বুঝাতেই পারছে না সে যা বলছে সত্য। আলোর মনে হচ্ছে এ লোকগুলো আলোকে শারীরিক ভাবে আঘাত করে পুরোপুরি জোর পূর্বক স্বীকারোক্তি নিতে চাচ্ছে।এক দিকে আলো যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছে না।অন্য দিকে বিনা কারণে নিজের ঘাড়ে আরও মৃত্যুর ভার নিতে চাচ্ছে না। আস্তে আস্তে আলো নেতিয়ে পড়ল।আজকের মতো আলোকে জিজ্ঞাসাবাদ বন্ধ করা হলো। তবে কালকে আবার শুরু হবে আলোর উপর নতুন অত্যচার। তা হলো জোর পূর্বক মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায়ের অত্যাচার।
এদিকে তানভীর ছটফট করতে লাগল। দুইবার থানায় গিয়েও আলোর সাথে দেখা করতে পারল না।কোর্ট আলোর সাথে কাউকে দেখা করার পারমিশন দেয়নি। সে জানে না তার মা কী করছে। মাকে কয়েকবার আলোর কথা জিজ্ঞেস করার পরও উনি তানভীরের কোনো জবাব না দিয়ে এড়িয়ে গেছেন। দিন কে দিন তানভীরের অস্থিরতা বাড়তে লাগল।
আর এদিকে আলোকে আজকে চতুর্থ দিনের মতো রিমান্ডে আনলো। আলোকে এবার ইলেকট্রিক শক দেওয়া হচ্ছে।যেভাবে পারছে যন্ত্রণা দেওয়া হচ্ছে। আলো কষ্টে একবার বলছে সে সবগুলো খুন করেছে তবে কারণ জিজ্ঞেস করলে কোনো কারণ বলতে না পারায় চলছে আরও অত্যাচার।আলোর বুকটা থরথর করে কাপঁছে। রিমান্ড শেষে আলো নীচে শুয়ে কাঁতরাতে লাগলো। হয়তো এর থেকে মরণ ভালো ছিল। আজকে আলোর ইচ্ছা করছে মরে যেতে তবে এখন যেন মরার উপায়ও এখানে পাচ্ছে না। ঠোঁট গাল কেটে আছে।সারা শরীর যন্ত্রণায় কাঁপছে। জীবনটা কেন এমন হলো কেন এত কষ্ট পাচ্ছে সে। সৃষ্টি কর্তার সাথে কথোপকথন করছে আর একের পর এক অভিযোগ দিচ্ছে। জীবনের কাঠ গড়ায় এসে সে নিঃশ্ব। এখনের জীবনের থেকে হয়তো আগের জীবনটা ভালো ছিল। দিনকে দিন যেন তার সুখের পাখি উড়ে গিয়ে অধঃপতন হচ্ছে। চোখটা লেগে এলো তার।
রাত তিনটায় যেন তার ঘুম ভাঙ্গলো।সে একটা আলোক রশ্নি দেখতে পেল। হাতটা দিয়ে যখনেই সে আলোক রশ্মিটা ধরতে যাচ্ছিল ঠিক তখনই যেন সেটা মিলিয়ে যাচ্ছিল। অনেক চেষ্টা করছে সে আলোক রশ্নিটা ধরতে তবে সে পারছে না। একটা সময় সে অন্ধকারে তলিয়ে গেল।
তার ঘুমটা ভাঙ্গলো। তার মানে এতক্ষণ সে স্বপ্ন দেখছিল। তবে এখন তার সারা শরীর কাঁপছে। জোরে জোরে হাঁপাতে লাগল। চোখগুলোতে অন্ধকারে ছেয়ে আসলো। নিস্তেজ হয়ে গেল একদম।
সকালে আলোকে দেখতে এসে আলোর অবস্থা দেখে একটু বিচলিত হলো পুলিশ। হাতটা ধরে দেখল ঠান্ডা হয়ে গেছে। তাহলে কী আলো মারা গেল??
গল্পের নাম : অন্ধকারে_এক_চিলতে_আলো
লেখিকা-: শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব-13 পর্ব
তাহলে কী আলো মারা গেল?? আলোকে ধরে হাসপতালে নেওয়া হলো।
এদিকে আজকে কেন জানি আলোর জন্য তানভীরের মনটা বেশি পুড়তে লাগল। চোখের কোণে কষ্টের লোনা জল জমতে লাগল। জমে থাকা কষ্টগুলো বাড়তে লাগল। ছুটে গিয়ে আলোকে দেখতে ইচ্ছা করল তার। তবে দেখার উপায় নেই। হাত পা যেন তার বাঁধা। নিজেকে বড্ড কাপুরুষ মনে হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে সে কিছুই করতে পারছে না।
আর জাহানারা সুফিয়া আলোকে পুলিশে দিয়ে দমে যায়নি। তিনি ইতোঃমধ্যে সকল প্রমাণ জোগাড় করেছেন। একজন এডভোকেটের সাথে কথা বলেছেন। যদিও সব প্রমাণ নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল আরও কিছুদিন পর কিন্তু আজকে আলোর অবস্থা শুনে তিনি তাড়াহুড়ো করে এডভোকেট সাহেরা খান কে নিয়ে চলে গেলেন সেখানে। সেখানে গিয়ে এডভোকেট সাহেরা খান প্রথমেই অভিযোগ করেন যে একটি ১৪ বছরের মেয়ে যদি কোনো অন্যায় করে সেটা কিশোরী আইনে পড়ে। তাহলে তাকে রিমান্ডে কেন দেওয়া হলো। সাহেরা খানের এমন অভিযোগে জানানো হয় যেহেতু আলো বিবাহিত ছিল সেহেতু তারা বয়স দিয়েছিল ১৮ বছরের বেশি। সে অনুযায়ী তাকে প্রাপ্ত বয়স্ক ধরা হয়। কিন্তু সাহেরা খান পাল্টা অভিযোগ দায়ের করল। একটি নিরাপরাদ মেয়েকে বিনা কারণে টর্চার করে মৃত্যুর মুখে ফেলে দেওয়ার জন্য।
আপাতত বিষয়টা পর্যবেক্ষণ চলছে। আর জাহানারা সুফিয়া অনুমতি নিয়ে আলোকে দেখতে গেল। হাসপাতালে আলোর নিথর দেহটা দেখে যেন তার মরে যাওয়া তিন বছরের মেয়েটার মুখটা চোখে ভেসে উঠল। জাহানারা সুফিয়ার প্রথম সন্তান ছেলে ছিল না। প্রথম সন্তান ছিল একটা মেয়ে। তবে রোড এক্সিডেন্টে মাত্র তিন বছর বয়সে মেয়েটা মরে যায়। আজকে আলোকে দেখে তার মেয়ে সায়রার কথা বেশ মনে পড়ছে । আলোর ঠিক পাশে গিয়ে বসলো। এর মধ্যে একজন ডাক্তার আসলো। জাহানারা সুফিয়া ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করল
- আলোর অবস্থা কেমন আছে? আর কী জন্য এমন হয়েছিল?
ডাক্তার হালকা গলায় জবাব দিল
- রোগীর অবস্থা ভালো। তবে রেগীর বিষয়ে পারমিশন ছাড়া কাউকে কিছু বলা যাবে না।
এর মধ্যেই জাহানারা সুফিয়ার ডাক পড়ল। মাত্র ৫ মিনিটের জন্য তাকে দেখতে দেওয়া হয়েছিল। জাহানার সুফিয়া শেষ বার আলোর মুখের দিকে তাকালো। আলোর অসহায় মুখটা তার মনটাকে চূর্ণ বিচূর্ণ করছে। নিজেকে সামলে নিয়ে শক্ত করে কেবিন থেকে উনি বের হলেন।
বাসায় ফিরলেন দুপুর ২ টায়। সাধারণত এ সময়টাতে উনাকে বাসায় পাওয়া যায় না। কয়েক বছর পর উনাকে বাসায় আসতে দেখে তানভীরও খানিকটা বিস্মিত হলো। সে বিস্মিত গলায় মাকে বলল
- মা তুমি এই সময় বাসায় কেন? শরীর খারাপ?
- তেমন কোনো কারণ নেই। আলো অসুস্থ আলোকে দেখতে গেছিলাম। আলোকে দেখা শেষে সরাসরি বাসায় চলে আসলাম।
আলোর কথা বলতেই তানভীরের বুকে কম্পন দিল। মায়ের চোখের দিকে নিজের অশ্রুসিক্ত চোখটা রেখে ভাঙ্গা গলায় বলল
- আলোর কী অবস্থা এখন? আর আলোকে কী দেখতে যেতে পারব এখন৷ মা সত্যিই বিশ্বাস করো আলোকে আমার কাছে মিথ্যাবাদী খুনী মনে হয়নি। শুধু শুধু আলো কষ্ট পাচ্ছে ঐ অন্ধকার রুমে। ওর জীবনের আলোটা নিভে যাবে মা কিছু উপায় না বের করলে।
- তোমরা বাচ্চারা সবসময় অস্থির হয়ে একেকটা কাজ করো বলেই জীবনে অনেক ভুল করে বসো। আবেগ দিয়ে সবসময় সব কাজ হয় না। একটু বিবেক একটু ধৈর্য রাখা প্রয়োজন। আবেগী হলে জীবনে কষ্ট পাওয়া ছাড়া আর কিছুই পাবে না। আলোর ব্যবস্থা করে এসেছি৷ সব কিছু প্রমাণ জোগার করা হয়েছে। এখন বাকিটা আদালত সিদ্ধান্ত নিবে। সেদিন যদি আলোকে পুলিশে না দিতাম তাহলে এ মিথ্যা জালে আলোও ফেঁসে যেত সে সাথে আমরাও। এখন যা হবে ভালো হবে। সময় দরকার।
মায়ের কথা শুনে তানভীরের মুখটা একটু প্রশস্ত হলো। আলোর জীবনে আবার সব ঠিক হতে চলল। শান্তি লাগছে তার। কেন জানি না আলো মেয়েটাকে সে চরম ভাবে এ কয়দিনে অনুভব করেছে। হয়তো একেই বলে ভালোবাসা।
"ভালোবাসতে যুগ যুগান্তের পরিচয়ের দরকার পড়ে না। মাঝে মাঝে খনিকের দেখাতেও ভালোবাসার মাত্রা প্রখর হয়ে যায়।"
তানভীর মৃদু গলায় বলল
- সবকিছু যেন ভালোভাবে শেষ হয়।
বলেই নিজের রুমের দিকে এগুতে লাগল। জাহানারা সুফিয়া তানভীরকে পেছন ডেকে বলল
- আরেকটা সুসংবাদ আছে।
তানভীর পেছন ফেরে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল
- কী সুসংবাদ?
- তোমার বড় ভাই সানী কল দিয়েছিল।কিছুদিনের মধ্যে সে বাড়ি আসবে। হয়তো তার ভেতরে জমে থাকা সব কষ্ট দূর হয়ে গেছে৷ যেহেতু সে আসবে তাই তার পছন্দের সব বিষয়গুলো বাড়িতে এনে রাখো। ওর রুমটাও পরিপাটি করে রাখো। ঠিক আছে।
সানী আসছে শুনে তানভীরের মনটা আরও বেশি আনন্দিত হয়ে গেল। সানীর সাথে দেখা নেই সেই কত বছর যাবত।একসাথে দুটো ভালো খবর তার মনটাকে স্বস্তি দিল।
অপরদিকে আলোর অবস্থার উন্নতি ঘটল।রিমান্ড স্থগিত করা হলো। সে সাথে আলোর বিষয়টা আদালত সমস্ত প্রামাণ দেখার পর পুনরায় তদন্ত করতে বলা হয়েছে। একই সাথে নীলার মামাকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেওয়ার রায় দেওয়া হয়েছে।
নীলার মামাকে গ্রেফতার করা হলো রিমান্ডেও নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর সমস্ত কিছু স্বীকার করেছে।নীলার মা, বাবা বিষয়টা জানার পর ভেঙ্গে পড়েছে। নীলার জীবনের পরিণতি এমন হবে তারা যেন এটা মানতেই পারছে না। তবে পরবর্তীতে নীলাকে কারা ধর্ষণ করেছে সে বিষয়টা এখনও ধোঁয়াশা আর আলোর মাকে কারা খুন করেছে সেটাও এখনও জানা সম্ভব হয়নি। নীলা আর আলোর মায়ের খুনের সময় আলো তানভীরের বাসায় ছিল সেটার প্রমাণ পেশ করার পর আলোকে দুটো খুনের থেকে পরিত্রাণ দেওয়া হয়েছে।
অপরদিকে আলোর স্বামী আলোকে মাত্র বারো বছর বয়সে বিয়ে করেছে অর্থাৎ সেটা বাল্য বিবাহ গন্য হওয়ায় সে বিয়েকে বিয়ে বলে বিবেচনা করা হয়নি। দিনের পর দিন একটা কিশোরী মেয়েকে সে লোকটা ধর্ষণ করেছে। আর আলো নিজেকে বাঁচাতে হত্যার মতো জঘন্য কাজটা করতে বাধ্য হয়েছে।
মামলাটা আদালতে দীর্ঘ চারমাস চলার পর এসব প্রমাণিত হয়। আর সে সাথে আলোর মায়ের খুনী এবং নীলার খুনীকে বের করার নির্দেশ দেওয়া হয়। আর আলোকে সব পরিস্থিতি বিবেচনা করে মুক্তি দেওয়া হয়। দীর্ঘ চার মাস কঠোর লড়াইয়ের পর আজকে আলোর মুক্তি। আজকে আলো অন্ধকার জেল থেকে বের হয়ে আলোর মুখ দেখবে। জীবনের এক চিলতে আলোর খুঁজ হয়তো সে পেয়ে যাবে এবার।
আলোর জীবনের এ আলোর রেখাটা দেখা সম্ভব হয়েছে এডভোকেট সাহেরা খান,জাহানারা সুফিয়া আর তানভীরের জন্য। অন্ধকার কারাগার থেকে বের হয়ে আলো প্রথমেই জাহানারা সুফিয়ার কাছে এসে কেঁদে দিল। জাহানারা সুফিয়া আলোকে বুকে জড়িয়ে নিল। নিজের মৃত মেয়েকে যেন সে আবার ফিরে পেয়েছে। আর তানভীর পাশে দাঁড়িয়ে মায়ের আর আলোর ভালোবাসার মুহুর্ত গুলো অবলোকন করছিল। আলো এবার তানভীরের দিকে তাকিয়ে তার চোখে পুনরায় আটকে গেল। সত্যিই আলো সেদিন তানভীরের চোখ চিনতে ভুল করে নি। এ নিষ্পাপ চোখের চাহনিতে আলো ডুবে গেল। আর তানভীর সে তো আলোর চাহনিতে নিজেকে যেন বিলিয়ে দিল।জাহানারা সুফিয়া আলোকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল
-কী ব্যপার চুপ কেন?
আলো তানভীরের চোখ থেকে চোখটা সরিয়ে নিয়ে বলল
- না কিছু না আন্টি।
জাহানারা সুফিয়া পাশে দাঁড়ানো সাহেরা খানকে ইশারা দিয়ে বলল
- তোমার জন্য দীর্ঘ চার মাস উনি পরিশ্রম করেছেন। উনাকে কিছু বলো।
আলো সাহেরা খানের পাশে গিয়ে মৃদু গলায় বলল
- এ ঋণ শোধ করার ক্ষমতা আমার নেই। আমাকে ভালোবেসে এটুকু সাহায্য করার জন্য ধন্যবাদ।
সাহেরা খান আলোর কথা শুনে হালকা হেসে বলল
- আমার এতে কোনো ক্রেডিট নেই। সব ক্রেডিট মিসেস জাহানারা সুফিয়া মেডাম আর তানভীরের। তারা তোমার পাশে ছিল। হয়তো তাদের সাথে রক্তের সম্পর্ক নেই তোমার তবে যে সম্পর্ক তৈরী হয়েছে সেটা আত্মার সম্পর্ক। তাদেরকে সম্মান করো কেমন। আবার দেখা হবে। ভালে থেকো।
বলেই এডভোকেট সাহেরা খান চলে গেলেন। তানভীর আর জাহানারা সুফিয়া আলোকে নিয়ে বাসায় আসলো।
আলো বাসায় প্রবেশ করতেই খানিকটা বিচলিত হলো। কারণ
গল্পের নাম : অন্ধকারে_এক_চিলতে_আলো
লেখিকা-: শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব- ১৪/শেষ পর্ব
আলো বাসায় প্রবেশ করতেই খানিকটা বিচলিত হয়ে গেল। কারণ বাসাটা পুরো অন্ধকার হয়ে আছে। চারপাশে কিছু দেখতে পারছে না সে। আজকাল অন্ধকার দেখলে আলোর গা গুলায়। বুকের ভেতরটা শিউরে উঠে। ভয় ভয় গলায় আলো তানভীরকে উদ্দেশ্য করে বলল
- এত অন্ধকার কেন চারপাশ?
কথাটা আলো বলে উঠতেই চারপাশ আলোকিত হয়ে গেল। পার্টি স্প্রে গুলো সাদা ধোঁয়ার মতো চারদিকে উড়তে লাগল। আলো বুঝে উঠতে পারছে না কী হচ্ছে। এর আগেই লক্ষ্য করল একটি সুন্দরী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে সে বাংলাদেশী না। কিন্তু মেয়েটি কে? আলো ভাবতে ভাবতেই মেয়েটি আলোর কাছে এসে ঠিক সামনে দাঁড়াল। অস্পষ্ট বাংলায় বলল
- কেমন লাগলো সারপ্রাইজটা?
আলো চুপ হয়ে রইল। তার বোধগম্য হচ্ছে না কী ঘটছে। তানভীরের দিকে সে তাকালো। তানভীর তখন মৃদু হাসছিল। কৌতুহল চোখে জাহানারা সুফিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল
- আন্টি মেয়েটি কে? আর কিসের সারপ্রাইজ কিছুই তো বুঝতে পারছি না।
জাহানারা সুফিয়া হাসতে হাসতে বলল
- এ হলো আমার বড় ছেলে সানীর বউ। সে বাংলাদেশী না। তার নাম এলিজাবেথ। তবে আমি তাকে নাম দিয়েছি সিথুন। আর তিনমাস আগে সানী বিয়ে করে সব অভিমানের পালা শেষ করে বাসায় ফিরে। তুমি তো তখন জেলে ছিলে তাই জানো না কিছু। আর এত পথ পেরিয়ে অন্ধকারে এক চিলতে আলোর মুখ দেখেছো তাই তোমাকে সিথুন সারপ্রাইজ দিয়েছে। মজার ব্যপার হচ্ছে সে তোমার জন্য একটা কেকও বানিয়েছি। আজকে আমরা সে কেক কেটে সিলেব্রেট করব।
জাহানারা সুফিয়ার কথা শুনে আলো খুশিতে স্তব্ধ হয়ে গেল। এত ভালোবাসা সে পাবে কখনও বুঝতে পারে নি। তার মনটা খুশিতে নাচতে লাগল। খুশির তাড়নায় মুখ দিয়ে কোনো কথায় যেন তার বের হচ্ছে না। শুধু চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এর মধ্যেই একজন বলে উঠল
- এটাই তাহলে সে আলো? যার কথা এ তিনমাসে মা আর তানভীরের মুখে এত শুনেছি।
আলো কন্ঠটা শুনে পাশে তাকিয়ে দেখল একজন সুদর্শন পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে। আলোর বুঝতে বাকি রইল না উনিই হলেন তানভীরের বড় ভাই সানী। আলো সানীর দিকে তাকিয়ে নম্র গলায় বলল
- ভাইয়া কেমন আছেন?
- হ্যাঁ ভালো আছি। কিন্তু তুমি কী আমাকে চিনো?
- চিনি না তবে তানভীর ভাইয়া আর আন্টির মুখে এর আগে আপনার কথা শুনে আন্দাজ করেছি আপনি সানী ভাইয়া৷ আর সিথুন ভাবীকে আমার অনেক পছন্দ হয়েছে।
আলোর কথা শুনে সানী মুচকি হাসলো সে সাথে সিথুনও।
জাহানরা সুফিয়া তানভীরের দিকে তাকিয়ে বলল
- যাও কেকটা নিয়ে এসো। আলো আর তুমি এক সাথে কেক কাটবে কারণ তুমি আলোকে এ বাসায় নিয়ে এসেছিলে।
পরক্ষণেই সিথুন আর সানীর দিকে তাকিয়ে বলল
- তোমরাও আলোর পাশে বসো।
কথাটা বলেই জাহানারা সুফিয়া একজন মধ্য বয়স্ক লোককে ইশারা করে বলল
- আলো উনি হলেন তানভীরের চাচা।
আলো তানভীরের চাচাকে সালাম দিল।।তানভীরের চাচা সালামের জবাবা দিয়ে আলোর পাশে এসে দাঁড়াল। মাথায় হাত বুলিয়ে দোআ করে দিল। জাহনারা সুফিয়া তখন হালকা গলায় বলল
- বাসায় একটা বিশেষ অনুষ্ঠান আছে তো তাই তানভীরের চাচা এসেছে। আগে কেকটা কাটো তারপর বলব কিসের অনুষ্ঠান।
জাহানারা সুফিয়ার কথাটা শুনে আলোর তর সইছে না। আলো ভাবতে লাগল এ বাসায় বিশেষ অনুষ্ঠান তানভীরের বিয়ে ছাড়া আর কী হতে পারে। কথাটা ভাবতেই আলোর বুকে তানভীরকে হারানোর বিয়োগ ব্যথা অনুভব করল। আলো বুঝতে পারলো এ কয়দিনে তানভীরকে সে কতটা ভালোবেসে ফেলেছে। তাহলে কী তানভীরকে সে হারিয়ে ফেলবে? আলো নিজেকে আর সামলাতে পারল না। অস্থির গলায় বলল
- কী অনুষ্ঠান এখনি বলুন। তারপর নাহয় কেক কাটা যাবে।
জাহানারা সুফিয়া হাসতে হাসতে বলল
- তানভীরের বিয়ে।
কথাটা শুনেই আলোর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রণা টা ইতোমধ্যে টের পেল। কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল
- কার সাথে?
আলোর প্রশ্নটা যেন সবাই এড়িয়ে গেল। জাহানারা সুফিয়া তাড়াহুড়ো করে বলল
- কেকটা কাটো এবার। এ সময় রাবু আবার কোথায় গেল। রাবু...রাবু...রাবু..
- জ্বি খালাম্মা।
- কাজের সময় কোথায় থাকো তুমি? তাড়াতাড়ি এসো। আর আসার সময় একটা ছুরি নিয়ে এসো। কেক কাটতে হবে।
- খালাম্মা আনতেছি।
বলেই রাবু দৌঁড়ে ছুরি নিয়ে আসলো। তানভীরের বিয়ের ব্যপার নিয়ে আলোর কষ্টটা প্রখর হলেও সে কষ্টটাকে হাসির আড়ালে চাপা দিয়ে কেকটা কাটলো। কেক কাটা শেষে সবাই রাতের খাবার খেয়ে নিল। আলো আলোর রুমে গিয়ে খাটে হেলান দিল। তানভীরের বিয়ে কার সাথে সেটাই সে ভাবতে লাগল। আজকে আলো সব পেলেও তার কাছে মনে হচ্ছে সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটা হারাতে যাচ্ছে। এমন সময় তানভীর কাশি দিয়ে আলোর রুমে প্রবেশ করলো। আলো কাশির আওয়াজ পেয়ে নড়েচড়ে বসে তানভীরের দিকে তাকাল। তানভীর হালকা গলায় আলোর দিকে তাকিয়ে বলল
- মুখটা এত ফ্যাকাশে কেন?, আর মন মরা হয়ে বসে আছো কেন? মন খারাপ নাকি?
আলো মাথা নেড়ে বলল
- না।
আচ্ছা আপনার যে মেয়ের সাথে বিয়ে সে মেয়ের নাম কী?তানভীর লাজুক গলায় বলল
- মিশকাত।
নামটা শুনতেই আলোর আশার আলো ধপাশ করে নিভে গেল। এতক্ষণ পর্যন্ত আলো আশা করছিল যে তানভীরকে নিয়ে হইতো একটা সারপ্রাইজ পাবে। তবে তানভীরের মুখে পাত্রীর নাম শুনার পর সে আশাটা থমকে গেল। কষ্টটা প্রখর হলো। তানভীরকে যে সে এত ভালোবেসে ফেলেছে বুঝতেই পারে নি। তবে নিয়তি মেনে নেওয়া ছাড়া তার কোনো উপায় নেই। মুখে যেন তার কষ্টের অন্ধকার নেমে আসলো। ভাঙ্গা গলায় বলল
- অভিনন্দন। আচ্ছা ভাবীর একটা ছবি কী দেখতে পারি?
- কেন দেখতে পারবে না। অবশ্যই দেখতে পারবে। দাঁড়াও দেখাচ্ছি তোমায়।
বলেই পকেটে হাত দিয়ে মোবাইলটা বের করে। মোবাইলটা চাপতে চাপতে বলল
- কোথায় যেন ছবিটা রেখেছিলাম। হ্যাঁ মনে পড়েছে। ওর জন্য মাই হার্ট লিখে একটা এলবাম বানিয়েছিলাম সেখানে রেখেছি। সত্যি বলতে কী মিশকাতকে আমি অনেক ভালোবেসে ফেলেছি। তাকে সবটা ভালোবাসা উজার করে দিলেও যেন মনে হবে ভালোবাসা দিতে পারে নি। বিশেষ ব্যপার হচ্ছে মিশকাতকে আমাদের পরিবারের সবাই খুব পছন্দ করেছে।
কথাগুলো তানভীর বলেই যেতে লাগল। আর আলোর চোখের কোণে কষ্টের পানি জমা হলো। তানভীরের প্রতি তার অনেক অভিমান জমেছে তবে সেটা প্রকাশ করার মতো অধিকার তার নেই। আলোর খুব কষ্ট হচ্ছে। তবুও নিজেকে সামলে নিল। এমন সময় তানভীর মোবাইলটা সামনে দিয়ে বলল
- এ হলো আমার হবু বউ।
আলো ছবিটা দেখে যেন আকাশ থেকে পড়ল।কারণ এটা তো আলোর ছবি। বিস্মিত গলায় তানভীরের দিকে তাকিয়ে বলল
- আপনি হয়তো কোথাও ভুল করছেন। এটা তো আমার ছবি। আমার নাম তো মিশকাত না।
তানভীর এবার অট্ট হাসি দিয়ে বলল
- ইচ্ছা করেই নামটা ভুল বলেছিলাম কারণ তোমার এক্সপ্রেশন দেখার জন্য। তুমি আমাকে ভালোবাসো কী না সেটা বুঝার জন্য। তোমার ফ্যাকশে মুখ দেখে আমি নিশ্চিত হলাম তুমিও আমাকে ভালোবাসো। আলো আমি তোমায় বড্ড ভালোবাসি। কালকে তোমার সাথে এনগেজমেন্টের ব্যবস্থা করব। বিয়ে নিয়ে হয়তো একটু ঝামেলা হতে পারে কারণ তুমি প্রাপ্ত বয়স্ক না। আচ্ছা তুমি রাজি তো আমাকে বিয়ে করতে?
তানভীরের কথা শুনে আলোর চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল আর মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠল। এ যেন আলো ছায়ার খেলা। মৃদু গলায় আলো বলে উঠল
- আমিও আপনাকে বড্ড বেশি ভালোবাসি।
আলোর কথাটা শুনে তানভীর আলোকে জড়িয়ে ধরে পরক্ষণেই ছেড়ে দিয়ে বলল
- আচ্ছা এখন গেলাম। অনেক কাজ বাকি। তুমি বিশ্রাম নাও কেমন।
আলো মাথা নাড়ল। তানভীর আলোর রুম থেকে বের হলো। আলোর শরীরটা ক্লান্ত। ঘুমে চোখটা এখন বুজে আসছে। তাই দরজা খোলা রেখেই ঘুমিয়ে গেল।
রাত ঠিক তিনটা একটা বিকট আওয়াজে সবার ঘুম ভাঙ্গলো। আওয়াজটা পেয়ে সবাই তাড়াহুড়ো করে উঠে ঘরের আলো জ্বালিয়ে ঘর থেকে বের হলো। লক্ষ্য করলো আওয়াজটা আলোর রুম থেকে আসছে। সবাই আলোর রুমে গিয়ে চমকে গেল। লক্ষ্য করল তানভীরের চাচা আলোর রুমের মেঝেতে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। আর আলো ছুরি নিয়ে মাথা নীচু করে বসে আছে। আলো জোরে জোরে দম নিচ্ছে। আলোকে এ অবস্থায় জাহানারা সুফিয়া দেখে চেঁচিয়ে বলে উঠল
- তুমি কী ভাইজানকে খুন করেছো? তোমার জন্য আমরা সবাই এত কিছু করলাম আর তুমি ভাইজানকে মেরে দিলে? কীভাবে পারলে এমন করতে?
কথাটা শুনেই আলোও চেঁচিয়ে বলল
- হ্যাঁ আমি চাচাকে খুন করেছি। কারণ অমানুষগুলো মানুষের মুখোশ পরে থাকে।এদেরকে চেনা বড় কঠিন। রাত তখন আড়াইটা আমি ক্লান্ত থাকায় দরজা খুলেই ঘুমিয়ে পড়ি।।হুট করে মনে হলো কেউ একজন আমার হাত চেপে জড়িয়ে ধরেছে। আমি স্পর্শ পেয়েই উঠে দেখি চাচা।চাচাকে দেখে চেচাঁতে নিলে চাচা আমার মুখটা চেপে ধরে বলল
- আরে মা চেঁচিও না। একটু আদর করে চলে যাব। তোমাকে দেখে সামলাতে পারিনি নিজেকে। রুশির মতো একদম তুমি। রুশিকে যেভাবে আদর করেছি ঠিক সেভাবে করব। আর কাউকে কিছু বলো না।
বলেই আমাকে ঝাঁপটে ধরল। আমি ছুটাবার অনেক চেষ্টা করেও যখন পারছিলাম তখন কেক কাটার সে ছুরিটা হাত বাড়িয়ে টেবিল থেকে নিয়ে আঘাত করি উনাকে। সেদিন রুশি নিজের কাছে হেরে গেলেও আমাকে আমি হারতে দেইনি। তাই মানুষের মুখোশ পড়া অমানুষকে খুন করলাম। আমাকে পুলিশে দিতে চাইলে দেন। আমার কোনো আফসোস নাই। অন্তত বলতে তো পারব আমি এ অমানুষকে শেষ করতে পেরেছি।
আলোর কথা শুনে সবাই চুপ। তানভীরের চাচা এমন সেটা যেন কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না। আবারও পুলিশকে খবর দেওয়া হলো। আলোকে ধরে নেওয়া হলো। পুলিশ রুশির বিষয়টা তদন্ত করে তানভীরের চাচার ডি এন এ টেস্ট করে নিশ্চিত করে যে রুশির পেটে তানভীরের চাচার সন্তানেই ছিল। অথচ সে সময়টায় তানভীরের চাচা সন্দেহের তালিকার বাইরে ছিল। তানভীরের পরিবার বড় একটা ধাক্কা খেল। সে সাথে রুশিকে নিয়ে হাজারও প্রশ্নের উত্তর মিললো। এদিকে আদালত আলোকে আইন হাতে তুলে নেওয়ার জন্য দু বছরের কারাদন্ড দিল।
তানভীর আজকে আলোকে দেখতে গেল। সেখানে আলোর দিকে তাকিয়ে বলল
- মারতে গেলে কেন? জোরে চিৎকার দিলে তো আমারা বাঁচাতে পারতাম তোমাকে। তোমারও সাজা হত না। তোমাকে ছাড়া থাকব কী করে?
আলো তানভীরের দিকে তাকিয়ে বলল
- এছাড়া উপায় ছিল না। তুমি ভালো থেকো। আর অন্য কাউকে বিয়ে করে সুখী থেকো। আমার মতো খুনীর জন্য আর আপেক্ষা করো না। রুশিকে নিয়ে যে প্রশ্ন জমেছিল অন্তত সে প্রশ্নের উত্তর তো পেয়ছো।
- আমি তোমার জন্য জনম জনম অপেক্ষা করতে রাজি। এ তো মাত্র দুই বছর। আমি এ খুনীটাকেই চাই আলো। ভালোবাসি তোমায়।
আলো মৃদু গলায় বলল
- বাসায় যাও। আমি আসব আবার ফিরে তোমার কাছে অন্ধকারে এক চিলতে আলো খুঁজতে।
সমাপ্ত।
0 মন্তব্যসমূহ