গল্পের নাম : আমার সে!
লেখিকা : নৌশিন আহমেদ রোদেলা
কলেজ শেষে চিরচেনা মোড়টাতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম। রিক্সার অপেক্ষা। আমার জীবনটা এই অপেক্ষা দিয়েই পূর্ত। কাক ডাকা ভোর থেকে ঝিঁঝিঁ ডাকা নিঠুর রাত পর্যন্ত চলে কেবল অপেক্ষা। চোখের মোটা ফ্রেমের চশমাটা ঠেলে দিয়ে গায়ের সুতি শাড়ির কুঁচকে যাওয়া আঁচলটা ঠিক করতে করতেই আটকে গেলো চোখ। ঘোলা চোখে দেখতে পেলাম তাকে। অনেক বছর আগের ধুকপুক মন নিয়ে লজ্জামাখা চোখে কম্পিত ঠোঁটে বলা "আমার সে!" মুহূর্তেই থেমে থাকা হৃদপিণ্ডটা কেঁপে উঠলো তুমুল গতিতে। পাশ থেকে কেউ একজন বললো,
--- আসসালামু আলাইকুম ম্যাম। রিক্সা খুঁজছেন? মোড় থেকে এনে দিই?
ঘোর লাগা চোখে পাশে তাকিয়ে বললাম,
--- না বাবা। লাগবে না। তুমি যাও...
ছেলেটি মাথা নিচু করে চলে যেতেই আবারও নজর ফেরালাম আমি। ওইতো মানুষটা। যৌবনের কাঁচা চুলে পাঁকন ধরেছে আজ। অসম্ভব সুন্দর চোখ দুটো ঢেকে আছে ভারি চশমায়। গায়ে হালকা রঙের পাঞ্জাবি। সেই সুঠাম দেহ ঘামে সিক্ত। এখনও কতো জৌলুশ তার চেহারায়। অথচ আমি? ভেঙে ঘুরিয়ে যাওয়া পরিণীতা। ঝাপসা চোখটা সরিয়ে নিয়ে এদিক ওদিক তাকালাম। রিক্সাটা পাচ্ছি না কেন আজ? আঁচলের কোণা পেঁচিয়ে আবারও আড়চোখে তাকালাম। ১৫ বছর আগে ফেলে আসা কিশোরী মনটা আবারও এমন চঞ্চল হয়ে উঠলো কেন? কি চায় সে? আবারও তাকাতেই চমকে উঠলাম আমি। এমা! সে তো এদিকেই আসছে। আমাকে কি দেখে ফেলেছে? এতোবছর পরও আমার চেহারাটা কি মনে আছে তার? আমার অস্থিরতা বাড়িয়ে দিয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো সে,
--- আরে, শ্যামা না? এতোবছর পর!
আমি তাকালাম। বুকের ঝড়টাকে ঢেকে হাসিমুখে বললাম,
--- হ্যা। আমি শ্যামা। এতোবছর পরও চিনে গেছো দেখছি। তো,কেমন আছো?
--- আছি বেশ। তোমার কি খবর? এখানে কেন?
--- আমিও আছি। এই কলেজেই আছি। তুমি এখানে? বাজার করতে এসেছিলে নাকি?
--- হ্যাঁ। আজ তো শনিবার, অফিস ছুটি তাই বাজারের ব্যাগ নিয়ে ছুটতে হলো। এই শহরেই থাকো? আগে কখনো দেখি নি তোমায়।
আমি হাসলাম। দাঁড়িয়ে থাকার শেষ শক্তিটুকুও কি লোপ পাচ্ছে আমার? এই বয়সে এসে কিশোরীদের মতো এই ছটফটানি কি মানায় আমায়? তার কথাগুলো আজও আগের মতোই উচ্ছল। প্রাণবন্ত! গুটিয়ে রাখা পাঞ্জাবির হাতায় কপালের ঘাম মুছে চশমাটা ঠেলে দিয়ে বললো,
--- এই এলাকায় থাকো শ্যামা? আমার বাসাটা খানিকদূরেই। আজ না হয় আমার বাসায় চলো। দুপুরের খাবারটা আমার ঘরে খেলে কি খুব দোষ হবে শ্যামা?
শুকিয়ে যাওয়া গলায় শুকনো ঢোক গিলে বললাম,
--- অন্যকোনদিন খাবো । আয়োজন ছাড়া কি দাওয়াত হয়? তোমার বউকে বলো আয়োজনের পসরা সাজাতে। আমিও না হয় আয়োজন করেই আসবো।
সে হাসলো। তার সেই বাঁকা দাঁত আগের মতোই ঝলকে উঠলো। টুল পড়া হাসিতে মাতাল করে বললো,
--- তা বেশ। সাথে তোমার বরকেও এনো। আয়োজন করেই খাওয়াবো না হয়।
আমি হাসলাম। সে বললো,
--- রিক্সা নেবে? চলো হাঁটি!
আমি মাথা নাড়লাম। পাশাপাশি হাঁটছি দু'জন। পয়ত্রিশ বছরে পা রেখেও বুকের উত্তাল সমুদ্রটা আজও নবীন! শহরের সেই চিরচেনা পার্ক। বন্ধুদের আড্ডামহল আর হিজলফুলের চাঁদরে ঢাকা রাস্তাটা আজও ঠিক আগের মতোই। বর্ষার দুপুরে মেঘের ঘনঘটা। হঠাৎ করেই শুরু হওয়া আকাশের অঝোর কান্না! বৃষ্টি থেকে বাঁচতে হাতের ব্যাগটা মাথায় ঠেকিয়ে দৌড়ে গাছের নিচে আশ্রয় নিতে পা বাড়াতেই আটকে গেলো হাত। থেমে গেলাম আমি। চমকে তাকালাম। সে বললো,
--- আজ বৃষ্টিতে ভিজবে না শ্যামা? হিজলফুল আর বৃষ্টির গন্ধে মাখামাখি হবে না? আগে তো খুব চাইতে....
--- তুমি তো চাইতে না আদিব। কখনোই চাইতে না।
--- আজ চাইছি। অনেক বছর ধরে চাইছি কিন্তু বৃষ্টিটা পাওয়া হয়ে উঠছে না।
আমি হাসলাম। আকাশের দিকে মুখ করে চোখ দুটো বুজে নিয়ে বললাম,
--- তোমার বউ বুঝি ভীষন মিষ্টি আদিব?মনে আছে? কলেজে থাকতে বলতে, " আমার বউ হবে আস্ত এক সরসী। যেখানে থাকবে মুগ্ধতা, মাদকতা... সে থাকবে অনন্য,অপরূপা। তাকে দেখলেই জুড়িয়ে যাবে বুক। আদিবের বউ কি যেমন তেমন হবে নাকি রে? স্পেশাল হবে। অনেক স্পেশাল! "
আদিব হাসলো। বৃষ্টি ভেজা মুখ আর ঝাপসা হয়ে যাওয়া চশমায় এতোটা মনোমুগ্ধকর কেন লাগছে তাকে? কেন? কিশোরী প্রেমটা যে আবারও উথলে উঠছে। কান্না পাচ্ছে, ভীষণ কান্না!
--- তোমার চুলগুলো তো আগের মতোই আছে শ্যামা। একটুও বদলায় নি বয়স। খোঁপাটা কি খুলবে শ্যামা? আগে যখন বৃষ্টি হতো, কলেজ ক্যান্টিনে বসে লম্বা চুলগুলো খুলে দিয়ে শাড়ির আঁচল গুটিয়ে বেরিয়ে যেতে মাঠে।
--- আর তুমি বলতে, " শ্যামা? তুই এমন পাবদা মাছের মতো "হা" করে ভিজছিস কেন রে? কাজল ছড়িয়ে কেমন পেত্নী পেত্নী লাগছে তোকে। যাহ্ এক কাপ চা এনে দে আমায়। কেমন শীত শীত লাগছে...."
আদিব গলা ছেড়ে হেসে উঠলো। সেই হাসিতে আগেরই ঝংকার। আগেরই মাধুর্যতা!
--- আমায় তো "কানী তনয়া" বলে খুব ক্ষেপাতে আদিব। আজ তোমার চোখেই চশমা! তবে চশমায় বেশ মানিয়েছে তোমায়।
--- বুড়ো হয়ে যাচ্ছি শ্যামা। আজকাল কানা হতে বেশ ইচ্ছে করে আমার। কানা তনয়!
আমি হাসলাম। ইটে বাঁধানো ব্রেঞ্চে বসে পা দুলাতে দুলাতে বললাম,
--- হঠাৎ "কানাতনয়" হওয়ার শখ। আচ্ছা? এখানে আর আসোনি তুমি? আর্শি,তনু,বিলাশি,অর্জন সবাইকে নিয়ে আর বসো নি? ১৫ বছর হয়ে গেলো দেখি না ওদের।
আদিব আমার পাশে বসলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,
--- হঠাৎ কেনো হারিয়ে গেলে শ্যামা?
--- ঠাঁই পাই নি তাই।
--- আমি ফিরিয়ে দিয়েছিলাম বলে?
আমি হাসলাম। কিশোরী মনের আক্ষেপ সইতে না পেরেই যে হারিয়ে ছিলাম কিভাবে বলি আমি তাকে? কাঁপা কাঁপা বুকে ভালোবাসি কথাটা বলার পর তার ফিরিয়ে দেওয়াটা যে সহ্য হয়নি কি করে বলি আমি তাকে? অন্যের বরকে কি এসব বলা সাজে? যে ধৈর্যটা ১৫ বছর আগেই পাই নি, আজ সে ধৈর্যটা কোথায় পাবো আমি ?
--- তোমার বউকে কালো গোলাপে সাজিয়েছিলে আদিব? কতো শত প্ল্যান করতে মনে আছে? আর্শি আর অর্জনের কি উৎসাহটাই না ছিলো তাতে। দল বেঁধে বউ সাজানোর কি রোমাঞ্চকর প্ল্যানিং-ই না চলতো এই বর্ষায়। এই পার্কে, এই ব্রেঞ্চ দুটিতেই। শেষ পর্যন্ত সাজিয়েছিলে আদিব?
আদিব হালকা গলায় বললো,
--- নাহ!
আমি অবাক হয়ে বললাম,
--- কেন?
--- তার কালো গোলাপ পছন্দ নয় শ্যামা। বৃষ্টি ভেজা কদম পছন্দ। লাল টকটকে হিজল ফুলেই মুগ্ধ সে। আমি তাকে কদম ফুলে সাজাতে চাই শ্যামা। তাইতো ব্যাগপুড়ে কদমফুল কিনেছি,দেখো!
আমি তাকালাম। ব্যাগের মাঝে একগুচ্ছ কদম উঁকি দিয়ে চলেছে নিঃসংকোচে। কলেজে পড়ার সময় আদিবকে কদমফুল পেড়ে দেওয়ার জন্য কতো জ্বালাতনই না করতাম আমি। তখন ও নাক সিটকাতো৷ বলতো, "কদম কোনো ফুল নাকি রে? বেহুদা ঢং না করে যা তো এখান থেকে। " আজ সেই আদিবের হাতেই একগুচ্ছ কদম ফুল। ভাবা যায়? আদিব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
--- চুলগুলো খুলবে শ্যামা?
আমি স্থিরদৃষ্টিতে তাকালাম। তারপর কি ভেবে খুলে দিলাম। সাথে সাথেই পিঠ ঢেকে গেলো একরাশি কালো চুলে। আদিব বললো,
--- বিয়ে করো নি কেন শ্যামা?
আমি চমকে উঠলাম। তার ঠোঁটে রহস্যময়ী হাসি। হাতেরাখা কদমের গুচ্ছে চোখ বুলাচ্ছে সে৷ আমাকে চুপ থাকতে দেখে বললো,
--- ১৫ টা বছর ধরে কদম ফুল হাতে অপেক্ষা করছি শ্যামা। বর্ষায় হারিয়ে আবারও ফিরে আসতে এতোগুলো বছর লেগে গেলো তোমার?
আমি নির্বাক তাকিয়ে আছি। বৃষ্টির পানির সাথে চোখের জলটাও মিশে হারিয়ে যাচ্ছে অজানায়। তার চোখে খুশি, আনন্দ আর একঝাঁক প্রাপ্তি!
#bdstory24hr #bdstory #lovestory
0 মন্তব্যসমূহ