গল্পের নাম :পার্সেল
লেখিকা : শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব-১
এক্স মানে আমার প্রাক্তন প্রেমিক হুট করে গতকাল আমায় কল দিল। বাসা থেকে বের হয়েছি সবে। ফোনে জুঁই আপুর সাথে কথা বলছিলাম সে সময়। মূলত জুঁই আপুর বাসায় যাওয়ার জন্যই বের হয়েছি। আমার প্রাক্তনের নাম সাহিল পেশায় একজন ব্যবসায়ী। তার সাথে আমার ব্রেক আপ কী কারণে হয়েছিল সেই মস্ত বড় কাহিনি নাহয় পরেই বলি, আগে মূল কাহিনির সারসংক্ষেপ শুরু করি।
প্রাক্তনের নম্বর থেকে কলটা পেয়েই আমি জুঁই আপুর সাথে দ্রূত কথা বলা শেষ করলাম। কথা শেষে প্রাক্তনকে কল দিলাম। কল দেওয়ার পর পরই মনে হলো ওপাশ থেকে বড়সড় ঘূর্ণিঝড় টর্নেডো আমার দিকে ধেয়ে আসছে। বেচারা অনেক ক্ষিপ্ত উনার কন্ঠ শুনেই বুঝা যাচ্ছে। আগে কখনও উনাকে এভাবে চিল্লাতে শুনিনি। বরাবরেই তিনি ছিলেন বেশ শান্ত মেজাজের রক্ষণশীল রসকষহীন মানুষ। আমি তার ভাবগতি বুঝার আগেই তিনি চেঁচিয়ে বলে উঠলেন
- আমার বাসায় পার্সেল পাঠায়ছেন কেন? ফাজলামোর একটা লিমিট থাকা দরকার। সবসময় সব ফাজলামো ভালো লাগে না।
তার কথার কোনো মানে আমি বুঝতে পারছিলাম না৷ তার সব কথার মধ্যে পার্সেল পাঠিয়েছি কথাটার মানে আমার বোধগম্য হলো না সত্যই। কিছুটা রেগে গিয়ে উত্তর দিলাম
- পাগলা কুত্তায় কী আমায় কামরায়ছে যে আপনাকে টাকা খরচ করে পার্সেল পাঠাব? কী সব হাবিজাবি বলতেছেন?
- আপনি পাঠাননি তো কে পাঠায়ছে এ পার্সেল? আপনি ছাড়া এ কাজ অন্য কেউ করেনি। এগুলো আপনারেই কাজ।
মাথায় মনে হচ্ছে আগুন জ্বলে উঠল উনার কথা শুনে কিছুটা রাগ দমিয়ে নিয়ে হালকা গলায় বললাম
- তা আমি কী পাঠাইছি শুনি?
- আপনি কী পাঠায়ছেন আপনি জানেন। আমি তো বাসায় না যে পার্সেল গ্রহণ করব৷ এত লেইম কাজ কেন করেন?
- খবরদার না জেনে হাবিজাবি কথাগুলো বলবেন না। নিজের কাজ করেই কূল পাই না, আসছে.... উনারে আমি পার্সেল পাঠাইছি! আমার কী টাকা গাছে ধরে যে, গাছ থেকে টাকা টপটপ করে পড়তেছে আর তা ছিড়ে আপনাকে পার্সেল পাঠাইছি ৷ করোনায় টিউশনগুলোও কমে গেছে। এমনিতেই ইনকাম কম তার মধ্যে আসছে পার্সেল আমি পাঠাইছি বলতে। ডেলিভারিম্যানের নম্বর দেন, দেখি পার্সেল কে পাঠায়ছে৷
অপর পাশ থেকে আরও জোরে চেঁচানোর শব্দ আসলো। কিছুটা বাশ গলায় গর্জন দিয়ে বললেন
- আপনি জানেন আপনি কোন ডেলিভারিম্যানকে দিয়ে কী পার্সেল পাঠায়ছেন। আপনি তাকে কল দেন আমার কাছে নম্বর চাচ্ছেন কেন?
- আবার বলেতেছেন আমি পার্সেল পাঠাইছি।
- হ তুই ছাড়া এ কাজ কে করবে৷ তুই পাঠায়ছিস।
তাহার মুখে তুই সম্বোধন টা শুনে আমার ভেতরটায় হাহাকার লেগে গেল। চিন্তা করতে লাগলাম বেচারা কী নেশা করে আবোল তাবোল করছে। এটাও হতে পারে। কিন্তু তার মতো ব্যাক্তি নেশা করবে তা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। যে ব্যক্তি আমাকে আপনি ছাড়া সম্বোধন করে নাই সে কী করে তুই বাক্যটা সম্বোধন করলো সেটার উত্তর মেলাতে আমি ব্যস্ত হতে গিয়েও তার বজ্র কন্ঠের জন্য পারলাম না৷
- কী হলো কথা বলতেছিস না কেন? কী পাঠায়ছিস তুই?
- তোর কাটা মন্ডু পাঠাইছি। অনেক বাড়াবাড়ি করে ফেলতেছিস। তোরে কোন দুঃখে আমি পার্সেল পাঠামু? সমস্যা কী তোর? কিছু বলতেছি না বলে যাতা বলতেছিস। তুই তুকারি করতেছিস কোন সাহসে? পার্সেলে কী পাঠাইছি সেটা বল আগে। সেটা যদি বলতে না পারস আর প্রমাণ দিতে না পারস তোর খবর আছে। তোরে আমি তোর বাসায় এসে থেতলাইয়া যামু।
আমার তুই তুকারি শুনে উনি বেশ ভদ্র হয়ে গেলেন। উনার সম্বোধন এবার তুই থেকে আপনিতে চলে আসলো পুনরায়। বুঝতে পারল একটু আগের তুই শব্দটা প্রয়োগ করার অপকারিতা স্বরূপ আমার মুখ থেকেও তুই তুকারি শুনতে হয়েছে। যেখানে আমিও কী না উনাকে আপনি ছাড়া সম্বোধন করেনি কখনও৷
- আপনি পার্সেল পাঠান নাই?
- নাহ।
- আপনিই পাঠায়ছেন।
- প্রমাণ দেন।
বলতে বলতেই কলটা কেটে গেল। এদিকে মাথাটা আমার বিগড়ে গেল। এতটাই রাগ উঠল বলে বুঝানো দুষ্কর। ফোনটা কেটে যাওয়ায় যেন রাগটা আরও বেড়ে গেল। গজগজ করে পুনরায় রাগ দমানোর জন্য কল দিলাম। কল ধরে গালি দিয়ে রাগ কমাতে যাব এমন সময় অন্য একটা কন্ঠস্বরের আগমণ ঘটল।
- মেডাম আমি সাহিলের কলিগ + ফ্রেন্ড আপনাদের ব্যাপারটা আমি প্রথম থেকেই জানি৷ কী হয়েছে বলুন তো? সাহিল এত রেগে গেল কেন? মেডাম আপনি কী সত্যিই পার্সেলটা পাঠাননি?
- দেখুন ভাইয়া আমি পার্সেল পাঠালে কেন অস্বীকার করব? পার্সেলটা কী সত্যিই আমার নামে গয়িছিল নাকি এটা বানোয়াট কোনো কাহিনি।
- আপনি তো জানেন মেডাম সাহিল কখনও হুট করে রেগে যায় না। সত্যিই পার্সেল পাঠানো হয়েছে। সে ভাবছে আপনি পাঠায়ছেন আর আপনি বলছেন আপনি পাঠাননি। কিন্তু তার অভিযোগে আপনার নাম।
- আমি সত্যিই পাঠাইনি। আর হুট করে উপলক্ষ ছাড়া পার্সেল কেন পাঠাব? আপনারা কোথায় এখন?
- সাহিলের অফিসে।
- ওয়েট আমি আসতেছি। সামনাসামনি যা কথা হবার হবে। যদি প্রমাণ হয় পার্সেল আমি পাঠাইনি তাহলে তার নাক ভেঙে আমি বাসায় ফিরব।
- আপনি শান্ত হোন আমি ঠিকানা দিচ্ছি আপনি চলে আসেন।
- জি আচ্ছা আসতেছি।
বলেই ফোন কাটার টুটু শব্দ কানে আসলো। আমি ঠিকানা অনুযায়ী একটা রিকশা নিয়ে গেলাম। সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে আমার গুণধর প্রাক্তনের নাক ফাটানোর অপেক্ষা করছিলাম।
বেশিক্ষণ আপেক্ষা করতে হলো না। মিনেট পাঁচেকের মধ্যেই আমার গুণধর প্রাক্তন হাজির। তিনি হাজির হওয়ার সাথে সাথেই ১০ নম্বর বিপদ সংকেত দিয়ে কাহিনির সূত্রপাত ঘটল।
গল্পের : নাম পার্সেল
লেখিকা : শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব-2
প্রাক্তন মহাশয় এসেই আমার নাক বরাবর দাঁড়ালেন। আমি তার দিকে দৃষ্টিপাত করার সাথে সাথেই উনি আমাকে জোরে বলে উঠলেন
- পার্সেলে কী পাঠায়ছেন বলেন।
- বোম পাঠাইছি বোম। মেজাজ গরম করে দিচ্ছেন কিন্তু৷ ফলতু লোক কোথাকার।
- আমি ফালতু?
- তো আপনি কী হীরা মানিক মুক্তা?
- আপনার চেয়ে ভালো আছি অন্তত।
এর মধ্যেই পাশ থেকে এক ভদ্রলোক বলে উঠলেন
- মেডাম এটা পাবলিক প্লেস একটু আস্তে। আর সাহিল চুপ কর তো তুই। ও নাহয় দু চারটা কথা শুনাচ্ছে তুই কেন ওর কথায় এত ক্ষেপছিস। ওর বয়স কম এরকম কথা ওর মুখে মানায় তোর তো বয়স কম না তুই কেন এমন করছিস।
সাহিল বেশ ক্ষিপ্ত গলায় বলল
- কোনো ভদ্র ঘরের মেয়ে কী সন্ধ্যার পর এভাবে আসে।
আমি রাগটা আর দমাতে পারলাম না নিজের হাতটা মুষ্টি করে বললাম
- নাকটা কিন্তু ঘুষি দিয়ে এখনই ফাটিয়ে দিব। আমাকে অভদ্র বলা হচ্ছে? নিজে কী? কোন মেয়ে পার্সেল পাঠায়ছে আর দোষ দিচ্ছেন আমাকে। নিশ্চয় নতুন কোনো প্রেম করেছেন। আর নাহয় আপনার মতো এরকম হাধারাম ছাগলকে কে পার্সেল পাঠাবে।
- আমি ছাগল?
- ছাগল বলে ভুল করেছি হনুমান বলা দরকার ছিল।
- মুখ সামলে কথা বলুন। খুব বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলতেছেন।
এর মধ্যেই আমার মোবাইলটা বেজে উঠল। লক্ষ্য করলাম জুঁই আপু কল করেছে। আমি কলটা ধরার আগেই সাহিল মোবাইলটা টেনে নিয়ে বলল
- লাউড দিয়ে কথা বলুন। নিশ্চয় পার্সেলের জন্য কেউ কল করেছেন।
- আরে হনুমান জুঁই আপা কল দিয়েছে।
- তবুও লাউড দিয়েই কথা বলতে হবে।
বলেই কলটা ধরে লাউড দিল। জুঁই আপু ওপাশ থেকে বলে উঠল
- কীরে ১০ মিনিটের রাস্তা এত দেরি করে আসতেছিস কেন?
- আপু আমি সাহিলের সাথে। একটু কাজ আছে। কাজটা শেষ করেই আসছি। তুমি একটু আম্মু ফোন দিলে বলবে আমি ঘুমিয়ে গেছি। প্লিজ আপু এটুকু হেল্প করো।
আপু কিছুটা রাগী সুরে উত্তর দিল
- তুই ঐ হতচ্ছাড়ার সাথে কী করছিস?
- আপু আমি এসে সব বলছি। আপাতত মা কল দিলে বইলো আমি ঘুমুচ্ছি আর আমি মায়ের কল আর ধরব না এখন।
- চট জলদি চলে আসিস। বেশি দেরি যেন নাহয়।
- তুমি চিন্তা করো না আমি চলে আসব সময় মতো।
ফোনটা কেটে গেল। সাহিল আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল
- আপনার বোন আমাকে হতচ্ছাড়া বলল কেন? এ সাহস তো আপনার বোনকে আমি দিই নি।
- হতচ্ছাড়াকে হতচ্ছাড়া বলবে না তো কী বলবে?
- যাইহোক আপনার বাবার নম্বরে কল দিয়ে বলি আপনি আপনার জুঁই আপুর বাসায় না গিয়ে মাফিয়াগিরি করতে এখানে এসেছেন।
- কল দিন না। এরপর আপনি যে কোথায় যাবেন সেটা চিন্তা করে কল দিন। আমাকে মাফিয়া বলার পরিণাম মাফিয়ার মতো পিটিয়েই করব। যাইহোক পার্সেলের নাটক কেন করেছেন? নিশ্চয় পার্সেলের নাটক করে আমার সাথে কথা বলার তালবাহানা খুঁজছিলেন।
- এই যে আপনাকে আমি বাদ দিছি আপনার বিহেবিয়ার ভালো না এজন্য। রাগ বেশি তাই। সেধে সেধে আপনার কাছে আবার যাব কেন?
সাহিলের এ কথাটায় আমি চুপ হয়ে গেলাম। সাহিলকে আমি প্রচন্ড ভালোবাসি। উপর দিয়ে ওকে অনেক রাগ দেখালেও ভেতরটায় রয়েছে ওর প্রতি অসীম দূর্বলতা। আমার চোখ গড়গড়িয়ে পানি পড়ার উপক্রম। চোখের জল মুছার মতো কোনো পন্থা অবলম্বন করতে পারলাম না। মুছার আগেই গড়িয়ে পড়ল। আমার রাগ বরাবরেই বেশি। তার মধ্যে হুটহাট সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি অনেক। কিছু কিছু সময় না চাইতেও অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়ে জড়িয়ে পড়ি। সাহিলের সাথে আমি অনেক রাগ অভিমান করলেও তাকে ভালোবেসেছিলাম অনেক। সাহিল আমার ভালোবাসা দেখতে পায়নি দেখতে পেয়েছিল শুধু রাগটা। কিছুক্ষণের জন্য পরিস্থিতিটা একটু শিথীল আছে আমার নীরবতায়। আমি নিজেকে সামলে উত্তর দিলাম
- পার্সেল আমি পাঠাইনি। শুধু শুধু দোষারূপ কেন করছেন? আমি কেনই বা পার্সেল পাঠিয়ে অস্বীকার করব?
সাহিলের বন্ধু পাশ থেকে সাহিলকে বেশ ধমক দিয়ে বললেন
- বিষয়টা আগেই মিটে যেত তুই যদি ঝগড়াটা না করতি। এখানে হয়তো মিস আন্ডারস্টেন্ডিং হচ্ছে।
কথাটা বলেই উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন
- ভাইয়া তুমি কী সাহিলকে পছন্দ করো।
আমি কথাটার উত্তর দিতে গিয়েও চুপ হয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দিলাম
- অনেক পছন্দ করি। উনি চাননি আমি উনার সাথে যোগাযোগ করি তাই উনাকে আর জ্বালাইনি। যতক্ষণ উনার কথা মনে পড়ত ততক্ষণ চিঠি লিখতাম।
বলেই ব্যাগে থাকা ৪০-৫০ টা চিঠি বের করে ছুড়ে দিলাম সাহিলের দিকে। বেশ কান্না গলায় বলে উঠলাম
- আপনি কখনও ভালোবাসার মর্ম বুঝবেন না। এ চাওয়ার গতি যে কত প্রখর আপনার বুঝার ক্ষমতা নেই। আপনাকে আমি গত একমাসে এত মনে পড়ার পরও জ্বালাইনি। আপনার অন্তত বুঝার দরকার পার্সেল পাঠিয়ে আপনাকে বিরক্ত আমি করব না। সবসময় আমাকে ভুল বুঝে এসেছেন। যাইহোক পার্সেল কে পাঠাল তা নিয়ে আমার আর মাথা ব্যথা নেই। আমার তরফ থেকে ভুল হলে দুঃখিত। আমি এখন স্টেবল না যা বলব সব রাগে বলব।
সাহিল চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে শুধু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম। ১০ টার উপর বাজে। দ্রূত জুঁই আপুর বাসায় যাওয়া দরকার। নিজেকে সামলে সামনে এগুতে নিব এর মধ্যে শ্বাস কষ্ট বেড়ে দ্বিগুণ। দমটা জোরগতিতে ফেলতেই সাহিল সামনে আসলো। তীক্ষ্ণ গলায় যা বলল তা শুনে আমার কষ্টটা আরও দ্বিগুণ গতিতে বাড়তে লাগল সে সাথে শ্বাসকষ্টটাও।
গল্পের : নাম পার্সেল
লেখিকা : শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব-3
তীক্ষ্ণ গলায় যা বলল তা শুনে আমার কষ্টটা আরও দ্বিগুণ গতিতে বাড়তে লাগল সে সাথে শ্বাসকষ্টটাও।
- আপনাকে আমি খুব পছন্দ করতাম। তবে আপনার মাত্রা অতিরিক্ত রাগ আপনার থেকে আমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। অতিরিক্ত রাগী মেয়েদের কেউ পছন্দ করবে না এটাই স্বাভাবিক। আর আজকের ঘটনার পর থেকে আপনি আমার মন থেকে উঠে গেছেন। কোনো ভদ্র পরিবারের মেয়ে এত রাতে বাইরে থাকে না। রাত বাজে ১০ টার উপর পরিবার ফাঁকি দিয়ে তো বেশ ভালোই বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। না জানি আরও কত এমন করছেন। আপনার প্রতি যে বিশ্বাস ভরসা ছিল সেটাও নষ্ট হয়ে গিয়েছে। মন থেকে পুরোপুরি আপনি উঠে গেছেন।
সাহিলের কথা গুলো শুধু শুনছিলাম। ভাবছিলাম এটা কী সত্যিই সে বলছে নাকি অন্য কেউ। এত কঠিন কথা সে কী করে বলছে? নরমসরম মানুষটা হুট করে এত রুডেই বা হলো কী করে। যে মানুষটা আমাকে সব সময় উৎসাহ দিত সে মানুষটা আজ আমার সামনে দাঁড়িয়ে এমন কথায় বা বলছে কী করে। তার কী মুখে একবারও আটকালো না? মনের ভেতরটায় এত বড় একটা ধাক্কা লাগল সে ধাক্কা সামাল দিতে ঘনঘন নিঃশ্বাস বের হতে লাগল। তবুও নিজেকে সামাল দিয়ে বললাম
- আমাকে নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না। আপনি সামনে থেকে সরুন আমি বাসায় যাব। জুঁই আপু অনেকক্ষণ যাতব অপেক্ষা করছে।
সাহিল পথটা আরও আটকে দিয়ে বলল
- আপনি অভদ্র হলেও আমি আপনার মতো না। আপনার মতো ইয়ং একটা মেয়েকে আমি কোনোভাবেই রাস্তায় একা ছাড়তে পারি না। এটা আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে আপনাকে পৌঁছে দেওয়া। পারিবারিক শিক্ষা বলতে পারেন।
আমার রাগটা বাড়তে লাগল। আমি যে খুব রাগী তা না। আমার মন ভীষণ পরিমাণ নরম। তবে মাঝে মাঝে হুটহাট কাজ করে বসি। প্রচুর পরিমাণে মুড সুইং হয় মাঝে মাঝে। এখনও হচ্ছে। তবুও নিজেকে দমিয়ে নিলাম। নিঃশ্বাস নিতে বেশ কষ্ট হলেও নিঃশ্বাস স্বাভাবিক করে নিলাম। আমার দুইটা হাত উপরে তুলে এবং আমার পা দুটো ইশারা করে বললাম
- আমি একজন স্বাবলম্বী মেয়ে। আমার দুটো হাত এবং দুটো পা এখনও অক্ষত আছে। এখানে যেহেতু আসতে পেরেছি। এখান থেকে চলেও যেতে পারব। সেটুকু ক্ষমতা আল্লাহ আমায় দিয়েছেন। আপনার মতো মানুষের সাথে যাওয়ার মতো রুচি আমার নেই। পথ ছাড়ুন।
বলেই সামনে এগুতে নিলাম। সাহিল পুনরায় পথ আটকে দিয়ে বলল
- একা যাওয়ার সাহস করলে
একদম নাক ভেঙে দিব। ফাজিল মেয়ে কোথাকার। নিজেকে কী ভাবেন আপনি? এখন কয়টা বাজে লক্ষ্য করেছেন? ১০ টার উপর বাজে। আপনার বাবা,মা তো জানে না আপনি এখানে এসেছেন। আপনার কাজিন গুলো আপনার সাহস বাড়িয়ে দিয়েছে। কিছু হলেই কাজিনগুলো সব ম্যানেজ করে আপনাকে সবসময় বাঁচিয়ে দেয়। একবার যদি আপনার পরিবার জানত এসব, কী হত ভেবে দেখেছেন? সবসময় এমন রাগ দেখাবেন না। মেয়েদের এত রাগ ভালো না। আপনার জু্ঁই আপার বাসা কোথায়?
সাহিলে দিকে চোখটা বড় করে তাকালাম। সে কী আমার প্রতি ভালোবাসা দেখাচ্ছে নাকি রাগ সেটা বুঝার চেষ্টা করছিলাম। সাহিলের চোখ দুটো আমার চোখে নিবদ্ধ হলো। সাথে সাথে চোখটা নামিয়ে উত্তর দিলাম
- খিঁলগাও।
সাহিল ধমকের সুরে বলল
- এখান থেকে খিঁলগাও এর দূরত্ব জানেন? একা একা চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত কোন সাহসে নিয়েছেন? ঠিক মতো তো রাস্তাও চিনেন না। বেয়াদব মেয়ে কোথাকার। বাইকের পেছনে এসে বসুন। আমি দিয়ে আসতেছি। এরপর যদি কোনো কথা বলেছেন সত্যি সত্যি মাইর দিয়ে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করিয়ে আসব।
আমি সাহিলের কথার মানে বুঝতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। হনুমানটা এসব কী বলছে! সে কী আমার প্রতি দূর্বল নাকি এমনিতেই এসব করছে। বেশ দুটানায় পড়ে গেলাম। কী করলে ভালো হবে বুঝতে পারছিলাম না। ওর সাথে যাব নাকি একাই যাব। রাত ও বেশ হয়েছে। এত রাতে কখনও বাসার বাইরে থাকিনি। এ সময় একা যাওয়াটা ঠিক হবে না। তার উপর রাস্তা ঘাটও চিনি না। একা গেলে যেকোনো মুহুর্তে বিপদে পড়তে পারি।তবে এত সহজে মেনে নিলে হনুমানটার আবার ভাব বেড়ে যাবে।৷ তাই নিজের ভাব বজায় রেখে বললাম
- সামনে থেকে সরুন। আমি একাই যেতে পারব। এতসব বাহানা একদম ভালো লাগছে না। বেশ রাগ উঠছে এবার।
- আপনার তো শুধু রাগটায় আছে৷
এমন সময় পাশ থেকে সাহিলেয় বন্ধু বলে উঠলেন
- মেডাম সাহিলের সাথে যান এটাই ভালো হবে। একা যাওয়া রিস্ক হয়ে যাবে। আমি আপনাকে আসতে বলেছি আপনার একা যাওয়াটা আমি সায় দিতে পারছি না। রাস্তায় কিছু হলে এটার দায় পড়বে আমার উপর।
আমার ফোনটাও বেজে চলেছে অনবরত। জুঁই আপা কল দিচ্ছে সাথে মেসেজও। কলটা ধরার সাথে সাথে জুঁই আপা বেশ অস্থির গলায় বলে উঠল
- আসছিস না কেন এখনও? তোর বাবা জানতে পারলে আমাকে আস্ত রাখবে না। দ্রূত আয়।
- আমি আসতেছি চিন্তা করো না। এখনি আসতেছি।
- আমার ঘুম পাচ্ছে প্রচুর। এসে আমাকে কল দিস। আর সাবধানে। একটা উবার নিয়ে চলে আয়।
আমি শান্ত গলায় উত্তর দিলাম
- আচ্ছা।
ফোনটা কেটে সাহিলের বন্ধুকে হালকা গলায় বললাম
- আপনি বলেছেন তাই আপনার কথা মেনে নিচ্ছি। নাহয় কোনোদিনও ওর মতো হনুমানের সাথে যেতাম না।
সাহিল বেশ রাগ গলায় বলে উঠল
- একদম হনুমান ডাকবেন না।
- তো কী ডাকব আপনাকে।
রাগারাগির চরম পর্যায়ে যেন আমার পুনরায় চলে যাচ্ছি দুজন। এ রাগারাগিতে ব্যাগরা বসিয়ে দিল সাহিলের মোবাইলের রিংটোন। মোবাইলটা হাতে নিতেই আমি তার হাত থেকে মোবাইলটা খপ করে টেনে নিলাম। যেমনটা সে আমার সাথে করেছিল। লক্ষ্য করলাম সাহিলের বাবা কল করেছে। আমি ফোনটা ধরে লাউড দিতেই ঘটনার নতুন মোড় নিল।
গল্পের : নাম পার্সেল
লেখিকা : শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব-4
সাহিলের বাবা সাহিলকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন
- সাহিল তোমার মায়ের ঔষধ পার্সেল করে পাঠিয়েছি তুমি রিসিভ করোনি কেন? ডেলিভারিম্যান তোমাকে কল দিয়েও নাকি পাচ্ছে না। আমি তোমাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম যে তোমার মায়ের ঔষধ পার্সেল করেছি। সারাক্ষণ কী নিয়ে এত ব্যস্ততা যে পার্সেলটা রিসিভ করতে পারো নি। বাসায় তো তুমি ছাড়া কেউ ছিলে না তাই তোমার নম্বর দিয়েছিলাম।
সাহিলের বাবার কথা শুনে রাগে মাথাটা টগটগ করতে লাগল। সাহিলের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তিনি ভয়ে ঢুক গিলতেছেন। পার্সেল নিয়ে এত কান্ড করে ফেললেন অথচ পার্সেল পাঠালেন উনার বাবা। সাহিল ঢুকটা গিলে আংকেলের কথার জবাব দিয়ে বললেন
- আব্বা ডেলিভারিম্যানকে জিজ্ঞেস করলাম কে পাঠিয়েছি উনি তো নাম বলেনি। তাই পার্সেলটা রিসিভ করেনি। আর আমি তো বলেছিলাম পার্সেলটা যেন কেয়ারটেকার কাছে রেখে যায়। উনি বলল আমাকেই নিতে বলেছে যিনি পাঠিয়েছেন।
আংকেল বেশ কড়া গলায় উত্তর দিলেন
- পার্সেলে আমি আমার নাম দিইনি তাই বলতে পারেনি। আর কাঁচের বোতলে কিছু ঔষধ ছিল অন্য কাউকে দিলে ভেঙে যাওয়ার সম্ভবনা ছিল তাই বলেছিলাম তোমার হাতে দিতে। তুমি পার্সেল না নিয়ে ফেরত পাঠালে কেন?
- আচ্ছা আব্বা দেখতেছি কী করা যায়।
- কী আর করবে? ফোন রাখো এবার। কোনো কাজেই তো ঠিক মতো করতে পারো না। বিয়ে করতে বলতেছি সেটাও তো করতেছো না। পছন্দ আছে কী না জিজ্ঞেস করলাম তাও বলতেছো না। সব কাজেই তো তোমার উল্টা পাল্টা। গুছালো না একদম। যাইহোক আজকে তোমার কাকার বাসায় থাকব সবাই। তুমি তোমার ফুপির বাসা থেকে খেয়ে সময় মতো বাসায় চলে যেও।
সাহিল জবাব দেওয়ার আগেই টুটু করে ফোন কাটার আওয়াজ আসলো। সাহিলের বন্ধু পাশেই কোমরে হাত ধরে সাহিলের দিকে তাকিয়ে আছে কপাল কুচকে। আমি চোখ দুটো বড় বড় করে সাহিলের দিকে তাকিয়ে আছি। উনি অসহায়ের মতো আমাদের দিকে তাকালেন। তেমন কিছুই বলার উনার নেই সেটা বেশ ভালোই বুঝা যাচ্ছে। রাগটা দমানোর কোনো চেষ্টা করলাম। জোরে চেঁচিয়ে বললাম
- আমি পার্সেল পাঠাইছি? তাই না? ফাজলামোর সীমা থাকা দরকার। কোনো কিছু না জেনে না বুঝে যা তা বলা। আমাকে এতক্ষণ মিথ্যা অভিযোগ কেন দেওয়া হচ্ছিল? আমার উত্তর চাই। নাহয় কিন্তু সত্যি সত্যি নাক ফাটিয়ে ভোঁতা বানিয়ে দিব।
সাহিল গলাটা নীচু করে জবাব দিলেন
- মানুষ মাত্রই ভুল। ভুল তো হতেই পারে। আপনি এত রেগে যাচ্ছেন কেন? আর মেয়ে মানুষের এত রাগ ভালো না। রাগ কমান জীবনে অনেক উন্নতি করতে পারবেন। আর আপনি যে নাক ফাটাতে পারবেন সেটা আমি বিশ্বাস করি। কারণ আপনার মতো মাফিয়া মেয়ের কাছে এসব ব্যাপার না। মেয়েদের কোনো বৈশিষ্ট্য আপনার মধ্যে নেই। এই যে এত কাজ পারেন তবুও আপনার সব কাজ তলিয়ে যায় আপনার রাগের কাছে। যাইহোক ভুল হতেই পারে। ইটস ওকে।
আমাকে কথাগুলো গড়গড় করে বলে পাশ ফিরে তাকিয়ে তার বন্ধুকে বেশ জোর গলায় বললেন
- তুই এভাবে তাকিয়ে কী দেখছিস? যা বাসায় যা। আমি উনাকে ড্রপ করে দিয়ে বাসায় চলে যাব।
সাহিলের বন্ধু রাগ গলায় বলে উঠলেন
- মেডাম যদি সামনে না থাকত তোকে আমি জুতা খুলে মারতাম। এতক্ষণ কী নিয়ে এত ঝগড়া এত ঝামেলা হলো? আসলেই তুই হতচ্ছাড়া। মেডামের বোন একদম ঠিক বলেছেন। গোড়ায় গলদ তো তোর মধ্যেই আছে। এতক্ষণ কী না তোর হয়ে সাফাই গাচ্ছিলাম। বারবার ভাবছিলাম মেডাম হয়তো মিথ্যা বলছে কিন্তু না এখন প্রমাণ হলো তুই একটা আস্ত গাঁধা। তোর গাঁধামোর জন্য এমন হয়েছে।
সাহিল কাপালটা ভাঁজ করে উত্তর দিল
- যা তো যা। যা হয়েছে তো হয়েছেই। এত হাইপার কেন হচ্ছিস? আমি আসতেছি উনাকে দিয়ে তুই চলে যা।
সাহিলের বন্ধু আমার দিকে তাকিয়ে বেশ মৃদু গলায় বললেন
- মেডাম বুঝার ভুল হওয়ায় এমনটা হয়েছে আপনাকে হয়তো অনেক কথা বলেছি এজন্য দুঃখিত। আপনি কিছু মনে করবেন না।
আমি মুখটা একটু প্রশস্ত করে উত্তর দিলাম
- আমি কিছু মনে করিনি। আপনার ফ্রেন্ডের এটা প্রথম না। অনেক ভালো আপনার ফ্রেন্ড। না জেনে অনেক কথায় বলে। তাহার কাছে আমার করা সব কাহিনিই সাজানো মনে হয়। কাউকে স্ক্রিনশর্ট না পাঠিয়ে ও দোষী হতে হয়। কথা শুনতে হয়। দোষ উনার না দোষ আমার কাপালের। কাপালে হয়তো ছিল এসব। যাইহোক ভাইয়া ভালো থাকবেন।
তিনি আমার কাছে বেশ ভদ্রভাবে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। মোবাইলের স্ক্রিনটায় লক্ষ্য করে দেখলাম ১১ টার উপর বেজে গেছে। জুঁই আপু নির্ঘাত ঘুমিয়ে পড়েছে নাহয় এতক্ষণে হাজার বার কল দিত। দ্রূত যাওয়া দরকার। সাহিলের দিকে তাকিয়ে দেখলাম একদম নিশ্চুপ হয়ে আছে৷ আমি বেশ গম্ভীর গলায় বললাম
- আমাকে দ্রূত দিয়ে আসুন। জুঁই আপা নাহয় বেশি রাত হলে বকাবকি করবে। অভদ্র ঘরের মেয়ে হলেও এত রাত পর্যন্ত বাইরে থাকার অনুমতি আমার পরিবার আমাকে দেয়নি। আজকে হয়তো জুঁই আপা ম্যানেজ করে নিয়েছে সবসময় তো আর করবে না। আর সারা রাত এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে নালিশ বাবা, মায়ের কাছে চলে যাবে ।
সাহিল নীচু গলাতেই জবাব দিল
- বাইকে উঠুন।
আমি বাইকে উঠলাম। সাহিলের বাইকে উঠেছি প্রায় দেড় মাস পর। তার সাথে দেখা বা যোগাযোগ নেই দেড় মাস হয়ে গেছে। বাইকে বসতেই সাহিলের মোবাইলটা বেজে উঠল। সাহিল মোবাইলটা হাতে নিতেই বললাম
- কথা বললে লাউড দিয়ে বলবেন।
সাহিলও বাধ্য ছেলের মতো ফোনটা লাউড দিল। ওপাশ থেকে একজন পুরুষের কন্ঠ ভেসে আসলো৷
- স্যার মানসুরা মিমি নামে একজন আপনাকে পার্সেল পাঠিয়েছে আমি আপনার বাসার নীচে, একটু যদি এসে রিসিভ করতেন। জ্যাম থাকার জন্য আসতে দেরি হয়ে গেছে।
মানসুরা মিমি নাম শুনে আমি চমকে গেলাম। কারণ এ নাম তো আমার। কিন্তু আমি তো পার্সেল পাঠাই নি। সাহিল ফোনে থাকা ছেলেটা কোনো উত্তর না দিয়েই আমার দিকে কটমটিয়ে তাকাল।
গল্পের : নাম পার্সেল
লেখিকা : শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব-5
সাহিল ফোনে থাকা ছেলেটাকে কোনো উত্তর না দিয়েই আমার দিকে কটমটিয়ে তাকাল। আমি ঢুক গিলতে লাগলাম। পুনরায় ভাবতে লাগলাম আমি তো পার্সেল পাঠাইনি তাহলে পাঠাল কে? শরীরটা না চাইতেও কাঁপতে লাগল। সাহিল ছেলেটাকে কোনো উত্তর না দিয়েই কলটা কেটে দিয়ে আমার দিকে তেড়ে এসে বললেন
- বাইক থেকে নামুন। পার্সেল আপনি পাঠাননি তাই না? তাহলে এ ছেলে কে? এ ছেলে কেন বলছে আপনি পার্সেল পাঠায়ছেন? মিথ্যা আর কত বলবেন? ফাজলামোর সীমা থাকা দরকার।
আমি কিছু বলতে নিলাম উনি আটকে দিয়ে বললেন
- একদম কথা বলবেন না। আপনার প্রতি সকল বিশ্বাস আমার উঠে গেছে। বাইক থেকে নামুন বলছি। একদম দেখতে ইচ্ছা করছে না আপনাকে। আপনার মুখ দেখলেই রাগে গা টা জ্বলে যাচ্ছে। নেহাত মেয়ে মানুষ নাহয় গাল ফাটিয়ে দিতাম চড় দিয়ে। ফাজিল মহিলা মানুষ।
আমি কিছুটা চুপ থেকে উত্তর দিলাম
- আমি সত্যিই পার্সেল পাঠাইনি। নিশ্চয় কেউ ষড়যন্ত্র করছে।
- আপনি কী সিলিব্রিটি যে আপনার সাথে মানুষ ষড়যন্ত্র করবে? সিলিব্রিটি হলে নাহয় মেনে নিতাম। কিন্তু আপনার মতো সাধারণ পাবলিকের সাথে কে ষড়যন্ত্র করবে? কথা ঘুরানোর একদম চেষ্টা করবেন না। এক তো আকাম করেছেন আর সেটা ঢাকার জন্য একের পর এক মিথ্যা বলছেন। আর কত নীচে নামাবেন নিজেকে? স্বীকার করলে কী খুব ক্ষতি হবে? স্বীকার করতে সমস্যা কোথায়? এখনও সময় আছে হয় সত্যিটা স্বীকার করেন নাহয় একদম সামনে থেকে দূর হোন। যেখানে ইচ্ছা যেভাবে ইচ্ছা চলে যান।
- এটা কেমন কথা বলছেন? রাত এগারটার উপর বাজে বলতে গেলে বারোটা ছুঁই ছুঁই৷ এখন আমি কী দিয়ে যাব? একা সি এন জি নিয়ে গেলেও তো ভয় লাগবে। এ জায়গাটা মোটেও ভালো না। ঢাকা মেডিকেল কলেজের এ জায়গাটায় এমনিতেই গাঁজাখুরদের আড্ডা বেশি। আর এখানে আপনি আমাকে একা ফেলে দিতে চাচ্ছেন? আপনার কী বিবেক চলে গেছে? আর বললাম তো আমি পার্সেল পাঠাইনি। একটু আগেই তো আপনি বলেছেন আপনার পরিবার এমন শিক্ষা দেয়নি যে একটা মেয়েকে রাস্তায় একা ফেলে যাবেন। এখন পারিবারিক কোন শিক্ষার পরিচয় দিচ্ছেন?
আমার কথাটা শুনে সাহিল আরও রেগে গেল। রাগটা সে দমাতে পারল না মোটেও। আমার বাহুটা টেনে বাইক থেকে নামিয়ে দিল। তারপর বেশ জোর গলায় চেঁচিয়ে বললেন
- নিজেকে কী মনে করেন আপনি? আপনার মতো সস্তা মেয়ের ধারে কাছেও আমি নেই। রাস্তার মেয়েকে রাস্তায় ফেলে যাব এতে পারিবারিক শিক্ষার কী আছে? একদম কিছু বলার চেষ্টা করবেন না। হ্যাংলা দেখেছি আপনার মতো হ্যাংলা কখনও দেখিনি। সাধারণত শুনেছি ছেলেরা মেয়েদের জ্বালায় এখন তো দেখছি আপনি ছেলেদের ও একধাপ পেছনে ফেলে দিয়েছেন। একটা ছেলেকে হ্যাংলার মতো জ্বালাতে লজ্জা লাগে না? স্টুপিড মেয়ে কোথাকার।
আমি চুপ হয়ে শুধু কথা গুলো শুনলাম। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে গড়গড়িয়ে। মোবাইলের স্ক্রিনে লক্ষ্য করলাম ১২ টা ১০ বাজে। জুঁই আপু হয়তো ঘুমিয়ে গেছে তাই ফোন দিচ্ছে না। একা কীভাবে যাব সে চিন্তায় করছি। বিকাশে টাকা থাকলেও এত রাতে তোলার মতো কোনো উপায় নেই। ব্যাগে আছে মাত্র ১০০ টাকার মতো। এ টাকা দিয়ে যে সিন এন জি ভাড়া করে যাব তারও কোনো উপায় নেই। তার উপর এত রাতে এদিকে সিন এন জি পাব কী না সন্দেহ। ফোনেও টাকা নেই যে কাউকে কল দিব। মোবাইলে ডাটাও নেই যে উবার বা পাঠাও কল করব। আর বিকাশ সবসময় ব্যবহার করেছি এপস দিয়ে সুতরাং এপস ছাড়া কীভাবে ঢুকতে হয় তাও জানা নেই। নাহয় বিকাশে ঢুকে ফোনে টাকা ভরতে পারতাম। সব রাস্তায় যেন বন্ধ। এ মুহুর্তে বেশ অসহায় বোধ হচ্ছে আমার। মাথা কাজ করছে না মোটেও। সব এলোমেলো লাগছে।
এদিকে সাহিল কিছু না বলেই বাইক নিয়ে তরতর করে চলে গেল। আমি একা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। ভীষণ অসহায় লাগছে এখন। রাস্তার পাশে বসেই কেঁদে দিলাম। বেশ জোরে জোরেই কাঁদতে লাগলাম আমি৷ একজন ছেলে এসে বেশ নম্র গলায় বললেন
- আপু কী হয়েছে? আপনি কাঁদছেন কেন? কোনো সমস্যা?
আমি ভয় পেয়ে গেলাম আরও। মৃদু গলায় উত্তর দিলাম
- কিছু না। এমনি....
- এ জায়গাটা ভালো না। আপনি যে এভাবে এখানে বসে কাঁদছেন কখন কী হয়ে যায় বলতে পারবেন না। কী হয়েছে একটু বলবেন?
আমি বুঝতে পারছিলাম না তাকে কী বলব। সত্যিটা বললে যদি দুর্বলতার সুযোগ নেয় সে চিন্তাও কাজ করছে মাথায়। আমি কিছুটা বু্দ্ধির সমাবেশ ঘটিয়ে বললাম
- আমার হাসবেন্ডের সাথে কথা কাটাকাটি করে এদিকে চলে এসেছি। আমি রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি। ফোনে টাকাও নেই যে উনাকে আমি কল দিয়ে এদিকে আসতে বলব। আপনি কী একটু আমার হাসবেন্ডকে কল দিবেন প্লিজ।
- আপনার হাসবেন্ডের নম্বরটা দিন।
আমি গজগজ করে সাহিলের নম্বর দিলাম। উনি নম্বরটা ফোনে টুকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন
- উনার নাম কী?
- সাহিল। সাহিল বিন মালেক।
- আচ্ছা ঠিক আছে৷
তিনি কল দিয়ে ফোন লাউডে দিলেন। কিছুক্ষণ কল বাজার পর সাহিল ওপাশ থেকে হ্যালো বলল। সাহিল হ্যালো বলতেই লোকটা বেশ নম্রভাবে জিজ্ঞেস করলেন
- আপনি সাহিল সাহেব বলছেন?
- জি কেন?
- আপনার ওয়াইফ শহীদ মিনারের এদিকে আছে। রাস্তা হারিয়ে একা একা বসে কাঁদছেন। উনার মোবাইলে টাকা নেই তাই কল দিতে পারছেন না। ভাইয়া জানেন তো জায়গা টা ভালো না যেকোনো সময় বিপদ হতে পারে। আপনি একটু এদিকে এসে উনাকে নিয়ে যান।
- আমার ওয়াইফ মানে?
আমি সাহিলের প্রশ্ন শুনে পাশ থেকে লোকটাকে বললাম
- বলুন মিমি।
লোকটাও আমার কথা শুনে বললেন
- মিমি নামের একজন ভদ্র মহিলা। আপনি উনাকে এসে একটু নিয়ে যান।
ওপাশ থেকে তারপর যা বলল তা শুনে আমার কষ্টটা আরও দ্বিগুণ মাত্রায় বাড়তে লাগল। শরীরটাও কাঁপতে লাগল।
গল্পের : নাম পার্সেল
লেখিকা : শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব-6
ওপাশ থেকে তারপর যা বলল তা শুনে আমার কষ্টটা আরও দ্বিগুণ মাত্রায় বাড়তে লাগল। শরীরটাও কাঁপতে লাগল।
- আপনি কোথাও ভুল করেছেন। আমি মিমি নামে কাউকে চিনি না। কোন না কোন রাস্তার মেয়ের জন্য কল করেছেন কে জানে! রং নম্বর।
বলেই ফোনটা কেটে দিল। যদি একটু আঁচ করতে পারতাম সে এমন বলবে তাহলে তাকে কল দেওয়ার প্রসঙ্গ আনতামেই না। বুকের ভেতরটায় আচমকা কষ্টের দাবানল জ্বলতে লাগল। শরীরটাও কেমন জানি নিস্তেজ, অসাড় লাগছিল। জোরে চিৎকার দিয়ে কাঁদতে মন চাইলেও যেন কাঁদতে পারছিলাম না। নিজেকে সামলে নিতে চেয়েও পারছিলাম না। যে মানুষটাকে আমি রক্ষণশীল মনে করে নিজেকে দোষী করতাম আজ সেই মানুষটা কি'না আমাকে এভাবে ফেলে চলে গেল! আমি পাথরের মতো বসে আছি। লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে হালকা গলায় বললেন
- ভাইয়া মনে হয় অনেক রেগে গেছেন। কিছু তো করার নেই। অনেক সময় এরকম রাগ হয়ে যায়। আপনি যাবেন কোথায়? আমি কী আপনাকে পৌঁছে দিব। আর ভাইয়ার বাসা কোথায়?
- তেজকুনি পাড়ায়। আমার বাসা শ্যামলী। আপনি একটু আমার বাসায় দিয়ে আসবেন দয়াকরে।
লোকটা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন
- দেখেন আপু আপনাকে আমি তেজকুনি পাড়ায় দিয়ে আসি এটাই বেটার হয় কারণ এটা কাছে। আমার বাইকে এত তেলও নেই যে শ্যামলী পর্যন্ত যেতে পারব। সুতরাং আপনাকে ভাইয়ার বাসাতেই দিয়ে আসি। এমনিতে ভাইয়ার রাগ পড়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন এত রাতে আপনার বাসায় গেলেও উনি এ বিষয়টা নিয়ে ফ্যাক্ট ধরতে পারেন। এতে আপনাদের স্বামী, স্ত্রী এর মধ্যে সমস্যা হতে পারে। আমার মনে হয় আপনি তেজকুনি পাড়াতেই যান। আশা করি আমার কথাটা আপনি বুঝতে পেরেছেন।
আমি কী উত্তর দিব বুঝতে পারছিলাম না। এখানে একা বসে থাকাটাও ঝুঁকিপূর্ণ আর উনার সাথে যাওয়াটাও উচিত হবে কি 'না তাও প্রশ্নবিদ্ধ। শেষমেষ চিন্তা করে বললাম
- আচ্ছা ঠিক আছে আমাকে দিয়ে আসুন।
আমি উনার সাথে বাইকে উঠলাম। বাইকে উঠার পর মনে হলো একবার সাহিলের সাথে দেখা করার জন্য বাইক রাইড দিয়ে যেতে চেয়েছিলাম তাই সে বেশ করে না করতেছিল যেন বাইক রাইড না নিই অন্য কারও বাইকের পেছনে না উঠি। কিন্তু আজকে আমাকে এই রাতে একা ফেলে যেতে তার বুক কাঁপল না। সময় কতটা পাল্টে দেয় মানুষকে। পরিস্থিতি সব কিছু যেন বদলে দেয়। এত রাতে এরকম পরিস্থিতিতে দাবিত হব বুঝতে পারিনি। ভাবতে ভাবতেই বাইকটা থেমে গেল। খুব বেশি না ৩০ মিনিটের মধ্যেই গন্তব্যে চলে আসলাম। সাহিলের বাসার সামনে নেমে উনাকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বললাম
- আপনি চলে যান আমি এখানেই সিসি ক্যামেরার নীচে বসে থাকতে পারব। সিসি ক্যামেরার নীচে কেউ কোনো খারাপ করার সাহস পাবে না। সাহিল হয়তো বাসায় নেই। আর তার পরিবারও বাইরে। সুতরাং আপনি নিশ্চিন্তে যেতে পারেন।
লোকটা হালকা গলায় বললেন
- দেখুন বিষয়টা আপনাদের স্বামী, স্ত্রীর। উনার কাছে আপনাকে দিয়ে যেতে পারলেই বেটার হয়। উনি হয়তো বাসায় আছেন৷ আমি নাহয় একটু ডেকে আপনাকে উনার কাছে দিয়ে যাই। কারণ আমি একটা বাইরের পুরুষ আপনাকে দিয়ে গিয়েছি এটা উনি জানার পর আরও ক্ষেপে যেতে পারেন। এরচেয়ে উনার ভুল ভেঙে দিয়ে যাই। আর বিষয়টা বুঝিয়ে দিয়ে গেলে আপনাদেরেই ভালো হয়।
আমি আমতা আমতা করে বললাম
- আপনার ভুল ভাঙাতে হবে না। আপনি চলে যান। আমি বিষয়টা দেখছি কী হয়। সকাল হলে বাসার গেইট খুললে আমিই চলে যাব। এখন ডাকাডাকি করলে বিষয়টা আরও গোলমেলে হবে।
লোকটার মনে কী চলছিল জানি না। তিনি গেইটটার সামনে দাঁড়িয়ে কেয়ারটেকারকে সাহিলের কথা জিজ্ঞেস করলেন। উনারা উত্তর দিলেন উনি বাসায় নেই। আমি এবার আরও জোর গলায় বলার সুযোগ পেলাম। উনাকে তীব্র গলায় বললাম
- আপনি চলে যান। বাকি ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ধন্যবাদ সাহায্য করার জন্য। আর এখানে ডাকাডাকি করে তো লাভ নেই। কারণ দেখছেনেই তো উনি বাসায় নেই। আর উনি আসলে তো এখানেই আসবেন। সুতরাং সমস্যা হবে না।
লোকটা তেমন কোনো উত্তর না দিয়েই চলে গেলেন। রাত বাজে একটা। একা একটা মেয়ে বসে আছি এখানে। আশপাশ খুব একটা চিনি না। সাহিলের বাসায় এসেছিলাম একবার। এ জায়গাটা খুব একটা চেনা যে তাও না। সামনে মামার বাসা থাকলেও এত রাতে যাওয়ার সাহস হচ্ছে না। কারণ মামা বিষয়টা জানলে আমার বাসায় জানাজানি হবে আর আমার বাসায় জানাজানি হলে আমাকে বাসা থেকে বের করে দিবে। সব মিলিয়ে ভয়ে চুপ হয়ে বসে আছি। আশেপাশে কুকুর ডাকছে ঘেউঘেউ করে। কুকুরের ডাক যেন কানে লাগছে অনেক। বসে বসে শুধু কাঁদছি। ভেতরটা হাহাকার করছে। একা ফেলে রেখে যাওয়া কী তার ঠিক হয়েছে কি'না ভাবতে লাগলাম। তাকে দোষ দেওয়ার আগে নিজেকেই নিজে অভিযোগ করলাম। কতটা অসহায় বোধ হচ্ছিল আমি জানি। এরকম একটা পরিস্থিতিতে এই প্রথম পড়লাম। ভালোবাসা মানুষকে উন্মাদ, পাগল করে দেয়। আমিও নাহয় সেরকমেই ছিলাম। আমাকে তো একটু বুঝানো যেত। না পাওয়ার যন্ত্রণা কতটা প্রখর সেটা বুঝার ক্ষমতা ওর নেই। সে জায়গাটায় বসে চোখের জল ফেলছিলাম শুধু। ভয়ের কথা নাহয় পরেই বর্ণণা করলাম। সব মিলিয়ে অস্বস্তিকর একটা পরিবেশের সম্মুখীন হলাম।
প্রায় অনেকক্ষণ বসে রইলাম এক জায়গায়। ভয়ে বুক কেঁপে উঠছিল বারবার। মনে হচ্ছিল এই বুঝি আমার কিছু হয়ে যাবে। কাউকে কল দেওয়ার সাহস ও পাচ্ছিলাম না আর সবচেয়ে বড় কথা আমার ফোনেও টাকা ছিল না। মাথাটা ঘুরপাক খাচ্ছিল অনেক। শুধু আল্লাহ,আল্লাহ, করছিলাম। মনে হচ্ছিল এই বুঝি আমার হার্ট এটাক হবে। প্রতিটা প্রহর প্রতিটা বছর মনে হচ্ছিল। মোবাইলও চার্জ প্রায় শেষের দিকে। রাত তিনটে প্রায় বাজে। সারাদিন কিছু খাইনি। ক্ষুধায় পেট জ্বলতে শুরু করল। বুকও ব্যথা করছে অনেক। কাঁদতে কাঁদতে মাইগ্রেনের ব্যথাটাও ঝেঁকে বসেছে। চোখের পাতাও যেন ব্যথা করছে আমার। সব মিলিয়ে দম বন্ধকর পরিস্থিতি লাগছে।
এ পরিস্থিতির সাথে মোকাবেলা করেছি প্রায় ঘন্টা খানেক। ৪ টা ২৩ এ ফজরের আযান পড়তে লাগল। শুনেছি আযানের পর পর দোয়া কবুল হয়। মনে মনে দোয়া করতে লাগলাম একটা রাইড যেন পাই। তাহলে প্রথমে খালামনির বাসায় যাব৷ আর খালামনিকে বলব জুঁই আপুকে বলতে আমি তাদের বাসায় ছিলাম। নাহয় জুঁই আপু এ কাহিনি জানলে বাবা,মাকে বলে দিবে। মাথার হিতাহিত বুদ্ধিটাও তখন লোপ পাচ্ছিল। জুঁই আপুও এর মধ্যে কল দেয়নি। হয়তো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। বলেছিল বাসার কাছে গিয়ে কল দিতে কিন্তু সে সুযোগ আর হয়ে উঠেনি।
একটু একটু আলো ফুটতে শুরু করল। শরীরটায় শক্তি নেই বললেই চলে। আলো ফুটতেই পা ছেছড়াতে ছেছড়াতে মূল রাস্তার কাছে আসলাম। আল্লাহর অশেষ রহমতে একটা বাইক পেলাম । ব্যাগে টাকা আছে মাত্র দেড়শো। উনাকে গন্তব্য বলার পর ভাড়া চাইল ৩০০। আমি কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে বললাম
- আমার কাছে এত টাকা নেই। আপনি ১৫০ রাখুন।
লোকটা আর কথা বাড়াল না আমার কথায় মেনে নিলেন। আমি ছুট লাগালাম গন্তব্যের দিকে। অর্ধেক রাস্তায় আসতেই বাইকের পেছন থেকে ছিটকে নীচে পড়লাম।
গল্পের : নাম পার্সেল
লেখিকা : শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব-7
অর্ধেক রাস্তায় আসতেই বাইকের পেছন থেকে ছিটকে নীচে পড়লাম। মাথাটা পিচ রাস্তায় বেশ জোরে থুবরে পড়ল। মনে হলো মাথায় ভালোই চোট পেয়েছি। কোনো রকমে মাথাটা টিকে আছে এটাই যথেষ্ঠ। নাহয় আরেকটু জোরে পড়লে মাথাটা ফেটে যেত। হাত পায়ের কিছু অংশ ছিলে গেছে। কোমরে ভীষণ ব্যথা অণুভব হচ্ছে। ব্যাথার পরিমাণটা গাঢ় সেটা বুঝতেই পারছি ব্যথার প্রখরতা দেখে। তবুও নিজেকে সামলে নিলাম। বাইকের লোকটাও বাইক থামিয়ে আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন
- আপনার কিছু হয়নি তো?
আমি মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দিলাম
- আমি ঠিক আছি৷
বলেই উঠে দাঁড়ালাম। পুনরায় গাড়িটা চলতে লাগল। মাথাটা ভীষণ ব্যথা করতেছে। এক তো মাইগ্রেনের অসহ্য ব্যথা দ্বিতীয়ত মাথায় বেশ জোরে আঘাত পেয়েছি।
সকাল বেলা রাস্তা বেশ ফাঁকা হওয়ায় খালামনির বাসায় আসতে বেশি সময় লাগেনি। খালামনির দুই মেয়ে এক ছেলে। বড় মেয়ে সোহা আমার প্রিয় বান্ধবীর মতোই বলা চলে। আমি আমার বেশিরভাগ সময়টা ওর সাথেই কাটাই। ছোট মেয়ে সায়রাও আমার খুব কাছের একজন। দুজনের সাথেই আমার সম্পর্কটা বন্ধুর মতো। আমি বাসায় গিয়ে গেইটে নক করতেই সায়রা দরজা খুললো। দরজা খুলে আমাকে এ অবস্থায় দেখে বেশ হতচকিয়ে বলল
- আপু আপনার কী হয়েছে?
আমি ব্যথাকাতুরে গলায় উত্তর দিয়ে বললাম
- একটু সমস্যা হয়েছে। বাসায় এসে সব বলছি। সোহা কোথায়?
- ঘরেই আছে।
- আন্টি আর বাবা কোথায়?
- ওরাও ঘরে আছে।
মূলত খালুকে আমি বাবা বলে ডাকি। কারণ খালু আমাকে সবসময় মা, মা বলে সম্বোধন করে তাই খালুকে বাবা ছাড়া অন্যকিছু ডাকতে মন সায় দেয় না।
আমি ঘরে প্রবেশ করলাম। বোরকাটা খুলে হিজাবটা খুলে নিলাম। সোহার দিকে তাকাতেই সে সায়রাকে পানি আর স্যাভলন আনতে বলল। সোহা যেহেতু পূর্বের সব ঘটনা জানে এবং পূর্বের কিছু ঘটনার সাথে সে জড়িত সে সূত্র ধরে সোহা বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছিল যে আমার সাহিলের সাথে কিছু হয়েছে। সায়রা চলে গেল স্যাভলন আর পানি আনতে। সোহা এবার বলে উঠল
- আপু সাহিলের সাথে কিছু হয়েছে তাই তো?
আমি চুপ হয়ে রইলাম। পুনরায় সে বলে উঠল
- আপু আপনি বলবেন নাকি সাহিলকে কল দিব আমি।
আমি বুঝতে পারছিলাম সবটা না বললে সোহা ক্ষ্যান্ত হবে না। বরং বিষয়টা সাহিলকে কল দিয়ে আরও জটিল করে তুলবে। তাই সোহাকে সবটা খুলে বললাম। সোহা আন্টিকে বুঝিয়ে বলল। আন্টি বাকিটা ম্যানেজ করে নিল। জুঁই আপুকে কল দিয়েও বিষয়টা হ্যান্ডেল করে নিল।
অপরদিকে আমি গোসল করলাম। সারা শরীরের ক্ষত হয়ে গেছে। রাস্তায় পড়ে গিয়ে বেশ ভালোই ছিলে গেছে। রক্তও জমাট বেঁধে গেছে কিছু জায়গায়। মাথার পাশটাও বেশ ব্যথা করতে লাগল। গোসলটা করে বের হয়ে খাটের কোণে বসলাম। কান্নায় চোখ ভিজে গেল। চিন্তা করতে লাগলাম সে মুহুর্তে সাহিলের বাসার ঠিকানা না দিয়ে আন্টির বাসার ঠিকানা দিলেও তো হত। বিপদে পড়লে হিতাহিত বোধটাও চলে যায়। খুব বেশি অপরাধ বোধ কাজ করতে লাগল। হুট করে কেনই বা তার সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিলাম সেটাই বুঝতে পারছি না। যাইহোক ভুল মানুষেরেই হয় সেখান থেকে আমি কী শিক্ষা নিলাম সেটাই মুখ্য। যেহেতু ভালোবাসি তাকে,তার মানে এই না সামান্য ব্যাপারে ঘৃনা করব। অভিযোগের পাল্লা ভারী করব। বরং মন থেকে সে কোনো ভুল করলে ক্ষমা দিয়েছি আর আমি কোনো ভুল করলে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। চাইলেও তো এ জীবন শেষ করা যাবে না। আত্মহত্যার মতো স্টেপ নেওয়া আমার মতো ভীতু মানুষের পক্ষে সম্ভব না। বসে বসেই কাঁদতে লাগলাম। ঠিক ভুলের হিসাব যতই করছিলাম ততই যেন তলিয়ে যাচ্ছিলাম। হিসাবটা বরাবরের মতোই মিলাতে পারছিলাম না।
এমন না যে সাহিলের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল প্রেম করার উদ্দেশ্য। বিয়ের মতো বড় আশা নিয়েই তার সাথে আমার পারিবারিকভাবে পরিচয় হয়। কোনো একটা কারণে বিয়েটা স্থগিত রাখা হলেও তার প্রতি আমার পছন্দ অসীম আর যতদূর জানতাম আমার প্রতি তার পছন্দ অসীম ছিল বলেই আমাদের পথচলা এগিয়েছিল পরিবারের অগোচরেই।
সব কিছু ভালোই চলতেছিল। তবে আমি তাকে ভীষণ ভালোবেসেছিলাম অল্প সময়েই। তাই পাগলামিও করেছিলাম প্রখর। হয়তো সে বিষয়টা স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারেনি। মোটকথা আমিও বুঝতে পারিনি। বরাবরেই ছেলেদের সাথে কথা কম বলায় আমি বুঝতে পারিনি সে কী চায় কেমন চায়। মূলত সমস্যাটা সে জায়গায় হয়েছে। তবে সে একটু বুঝিয়ে দিলে আমি হয়তো নিজেকে সুন্দর করে তার সামনে উপস্থাপন করতে পারতাম৷ কিন্তু সে সুযোগটা আমি পাইনি। এর আগেই ওর সাথে আমার তৃতীয় কোনো কারণে ঝগড়া লেগে যায়। তার ধারণা আমি তার বন্ধুমহলে আমাদের মেসেজের স্ক্রিনশর্ট ছড়িয়ে বেরিয়েছি। কিন্তু বিষয়টা পুরোটা ভিত্তিহীন ছিল। এমন কিছুই আমি করিনি। তাকেও আমি বিষয়টা বুঝাতে অক্ষম হয়েছি আর সেদিন থেকে আমি তার ব্লক লিস্টে। এরপর কিছুদিন পর লক্ষ্য করলাম সে ব্লক খুলেছে আপনাআপনি। আমি আর কিছু বলেনি। তাকে জ্বালাইও নি। যখন মনে পড়ত তার আইডিতে গিয়ে তার পুরনো ছবি গুলো ঘাটতাম আর চিঠি লিখতাম। কারণে অকারণে চিঠি লিখে আবেগের পাল্লা ভারী করতাম। খুব বেশি কষ্ট হলে আল্লাহর সামনে দাঁড়াতাম। মনে হতো আমার চাওয়াতেই ভুল ছিল তাই পাইনি। হারাম সম্পর্কে জড়িয়ে তাকে চাইলে অবশ্যই আল্লাহ আমায় দিবেন না। কারণ এক পাত্রে বিষ আর এক পাত্রে মধু রেখে তো পান করলে সেটাতে কোনো সুফল আসবে না। তাই সেদিনের পর থেকে চিন্তা করলাম ওর সাথে আর ঠিক করার চেষ্টা করব না। বরং উপর আল্লাহর কাছে ওকে সুন্দর করে চাইব। এ পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। কিন্তু হুট করেই পার্সেলের কাহিনি নিয়ে কী থেকে কী হয়ে গেল টেরেই পেলাম না। কাহিনিটা এমন পর্যায়ে চলে যাবে চিন্তা করতে পারেনি। সব মিলিয়ে আমি নির্বাক এখন। চাইলেও এ ঘটনার বিস্তর সমাবেশ ঘটাতে পারছি না।
সোহা খাবার এনে ডেকে বলল
- কান্না রেখে খান। যা হওয়ার তো হয়েছেই। সাহিলের উচিত হয়নি এভাবে ফেলে যাওয়া। ধরে নিলাম রাগের মাথায় আপনি ভুল করেছেন কিন্তু সে তো বাচ্চা না। এটাও ধরে নিলামর রাগের মাথায় সে রেখে গেছে কিন্তু পরবর্তীতে সাহিলকে কল দেওয়ার পর লোকটাকে রং নম্বর বলা মোটেও উচিত হয়নি। আল্লাহ আপনাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। যা হয় ভালোর জন্য। নাহয় কত মানুষ রেইপ হয়। যে সিচুয়েশনে ছিলেন আপনার যে কিছু হয়নি এটাই কম কী। ছোট বেলা থেকে নামাজ পড়েন তো তাই আপনাকে আল্লাহ পছন্দ করে বিপদ থেকে উদ্ধার করে আনছে৷
আমি আর কোনো কথা বললাম না। খাবার টা নিয়ে খেয়ে একটু বিশ্রাম করে নিলাম।
বেলা বাজে ১২ টা ৫৬। বাইরে থেকে যোহরের আযানের ধ্বনি আসছে কানে। মাথাটা এখনও ব্যথা করছে। চোখ দুটো ও ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে জীবনের শেষ সময়ে। কোনোরকম উঠে অজু করে নামাজে দাঁড়ালাম। শরীরটা ভীষণ ব্যথা করছে। উঠ বস করে নামাজ পড়তে কষ্ট হচ্ছে। তবুও নামাজটা পড়ে নিলাম। নামাজটা শেষে গা গুলিয়ে বমি আসতে লাগল। টাল সামলাতে না পেরে গড়গড়িয়ে বমি করলাম। লক্ষ্য করলাম গলা দিয়ে গড়গড়িয়ে বমির পরিবর্তে রক্ত বের হচ্ছে। সোহা বিষয়টা লক্ষ্য করেই জোরে চিল্লায়ে উঠল। পাশের রুম থেকে আন্টি আর বাবা চলে আসলো।
গল্পের : নাম পার্সেল
লেখিকা : শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব-8
পাশের রুম থেকে আন্টি আর বাবা চলে আসলো। নাক মুখ দিয়ে ব্লাড বের হওয়া আরও বাড়তে লাগল। সে সাথে মাথা ব্যথাও তীব্র আকারে শুরু হলো। শরীরটা অসাড় হতে লাগল। গা গুলিয়ে বমির পরিমাণ বাড়তে লাগল। খালামনি এক পাশে ধরে আছে আমাকে। কষ্ট হচ্ছিল অনেক। আমাকে তাড়াহুড়ো করে হাসপাতালে নেওয়া হলো। ক্রমশেই আমার শরীর খারাপ হতে লাগল। চোখটা আপনা আপনি বন্ধ হয়ে গেল।
জ্ঞান ফিরল অনেক পর। আনুমানিক একদিন পর। এর মধ্যে জ্ঞান ফিরলেও আমি তেমন টের পাইনি। পরিলক্ষিত হলো হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি। মাথার আঘাতটা স্বাবাভিক ছিল না। সে আঘাতের জন্যই নাক মুখ দিয়ে রক্ত বমি বের হয়েছিল। এখনও চোখ বেশ ঝাঁপসা। আম্মু, আব্বু পাশেই বসে আছে। যদিও খালামনি বিষয়টা অন্যভাবে হ্যান্ডেল করেছে। আব্বু, আম্মু জানে না আমার কী হয়েছিল৷ তারা জানে হুট করে খালামনির বাসায় পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পেয়ে এমন হয়েছে৷
তবে বিপত্তি ঘটে আরও একদিন পর। সোহা আমার পাশে চিন্তিত মুখে বসে আছে। প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো আমার জটিল কিছু হয়েছে তাই সে চিন্তিত। পরে লক্ষ্য করলাম আমার অবস্থা আগের চেয়ে ভালো কিন্তু তার চিন্তার কারণ ভিন্ন। চাপা সুরে জিজ্ঞেস করলাম
- সোহা হয়েছে কী বলবে? এত চুপচাপ আর চিন্তিত কেন?
সোহা কিছুটা চাপা সুরেই জবাব দিল
- আগে আপনি সুস্থ হন তারপর সব বলছি। সাহিলের দিক থেকে আবার একটা ঝামেলা হয়েছে সেটা ঠিক করার চেষ্টা করছি।
সাহিলের নামটা নিতেই যেন আমার বুকটা ধুক করে উঠল। জানার জন্য মনটা উদগ্রীব হয়ে গেল। আমি অনেকটা আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম
- কী হয়েছে আমাকে বলো। এখনই বলো। কী ঝামেলা করেছে নতুন করে।
সোহা আর চুপ থাকতে পারল না। কিছুটা রাগ রাগ সুরে জবাব দিল। রাগটা অবশ্য আমার উপর না। রাগটা সাহিলের উপর।
- দেখেন আপু আন্টি আংকেলকে তো আব্বু, আম্মু অন্যকিছু বলে বুঝিেয় নিয়েছিল যাতে আপনার কোনো সমস্যা না হয়। আংকেল যেন চিন্তামুক্ত থাকেন। কারণ আংকেল পুরো ঘটনা জানলে চিন্তা করে আরও শরীর খারাপ করবেন আর আপনার উপরও এর প্রভাব পড়বে। তাই আমরা বিষয়টা ঠিকেই ম্যানেজ করে নিয়েছিলাম। কিন্তু সমস্যা হয়েছে অন্য জায়গায়।
বলেই চুপ হয়ে গেল সোহা। আমি আরও উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করলাম
- চুপ কেন? বলো?
উত্তরে সোহা বলল
- সাহিলের এক ফ্রেন্ড আংকেলের নম্বরে কল দিয়ে ঐদিন রাতে যা হয়েছে তা সব বলে দিয়েছে। আংকেল এখন হাইপার। বলতেছে আপনার চিকিৎসা যেন বন্ধ করে দেওয়া হয়। এমন মেয়ে উনার দরকার নেই। কিন্তু আমি আবার বু্দ্ধি করে উনার ফ্রেন্ডকে কল দিয়ে বিষয় টা ম্যানেজ করার চেষ্টা করছি। দেখা যাক কী হয়।
আমি একটু হতাশ হলাম সোহার কথা শুনে। সাহিল এমনটা কেন করলো বুঝতে পারলাম না।আমি তো আমার পরিবার ম্যানেজ করেই নিয়েছিলাম সেখানে আমাকে এভাবে দ্বিতীয়বার ফাঁসানোর তো কোনো দরকার পড়ে না। সোহাকে ভাঙ্গা মনটাকে জুড়ে দিয়ে বললাম
- ওরা কল কেন করেছিল? এসবেই বা কেন বলেছিল? এদিক থেকে কী কোনো কথা তাদের কাছে গেছে? তাও আবার বাবাকে জানিয়েছে এত পরে। জানালে তো সে সময়েই জানাতে পারত। দুদিন পর কেন?
- আরে ওরা ভেবেছে আপনি অসুস্থ, হয়তো আপনি সুসাইড এটেম্পট নিয়েছেন তাই ভয়ে এমনটা করেছে। ওরা নাকি জিডি করতে চায় আপনার কিছু হলে যেন ওদের উপর দায় না পড়ে।
অসুস্থতা নিয়েই বেশ হাসি পেল। মুচকি হেসে বললাম
- সাহিল হয়তো আমাকে চিনতে পারেনি এখনও। ওদের সমস্যা কেন হবে? আমি তো এ ঘটনা কাউকে বলিনি। আর ওদের দায়ী করেও কিছু বলেনি। আর আমার মতো মেয়ে সুসাইড করবে এটা ওর একটু বেশি ভাবনার ফল। পরকালে ভয় পাই যথেষ্ঠ। সুইসাইড করে নিশ্চয় দীর্ঘস্থায়ী জাহান্নামী হতে চাইব না। আর প্রত্যাবর্তন যেহেতু করেছি এ পথ তো বেছে নিব না। তুমি তো আমাকে চিনতে। আমি কেমন বলে দিতে।
- তা তো আমি বলেছিই। এবং সুনিশ্চিত ও করেছি আপনি সুইসাইডাল না। আর আপনার কিছু হলে ওদের কোনো সমস্যা হবে না।
- আর আব্বু,আম্মুকে বুঝিয়েছো কীভাবে?
- সাহিলের ফ্রেন্ড সাহায্য করেছে।
বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম
- মানে?
- হ্যাঁ। উনাকে কল দিয়ে বলেছিলাম আংকেলকে যেন কল দিয়ে বলে ভুল করে এমনটা বলেছে। উনিও তাই করেছে। এখন তো আংকেল আন্টি ভাবছে কেউ ফাজলামো করেছে। এদিক দিয়ে সামলে নিয়েছি আমি মোটামুটি। পুরোপুরি সন্দেহ না কাটলেও মোটামুটি সন্দেহ কেটে গেছে। বাকিটাও ম্যানেজ করে নিব আমরা। আপনি সুস্থ হন। আপনাকে অনেক মিস করছি। বিশেষ করে আপনার হাসি। আপনার হাতের রান্না। আপনার শাসন গুলো।
সোহার কথায় ব্যাগরা দিয়ে বললাম
- সাহিলের সাথে কথা কী হয়েছে? ও কেমন আছে?
সোহার রাগ তড়িৎ গতিতে বেড়ে গেল। বেশ রাগী গলায় উত্তর দিল
- এই ছেলের নাম এখনও নিচ্ছেন? একের পর এক সমস্যায় পড়তেছেন। হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছেন ওর জন্য। যন্ত্রণায় কাঁতরাচ্ছেন। কই একটা বারও তো আমাকে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করল না কেমন আছেন। বরং উল্টা ফেঁসে যাওয়ার ভয় পাচ্ছে। তাই আংকেলকে কল দিয়ে নিজেকে ঠিক প্রমাণ করার চেষ্ট করেছে। এতকিছুর পর এখনও এমন কথা জিজ্ঞেস করতেছেন? আপনার একটু লজ্জা হওয়া উচিত আপু। এ ছেলেকে ভুলেন। মাত্র দু মাসের পরিচয় আপনাদের। এর মধ্যে এক মাস কথা বলেছেন আর বাকি একমাস যোগাযোগ বন্ধ ছিল। এত অল্পতে এত আবেগী হলে চলে বলেন? এত দু্র্বল কেন আপনি?
সোহার কথা শুনে নিজেকে নিজে ধিক্কার দিতে লাগলাম। সত্যিই তো আমি এতকিছুর পরও ওর কথা কেন বলছি! হয়তো ওর প্রতি আসক্ত আমি। কিছু কিছু ভালোবাসা যুগ-যুগান্তরের হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। অল্প সময়েই সবটা জায়গা দখল করে নেয় আবার যাওয়ার সময় সবটা শূন্য করে দিয়ে চলে যায়। বরাবরেই মাত্রাহীন ভালোবাসা বেহায়া করে দেয় মানুষকে আর করে দেয় বেসামাল। আমিও সে কাঁতারেই চলে গেছি। তাকে প্রচন্ড রকম ভালো কখন বেসে ফেলেছিলাম জানি না। যখন বুঝতে পারি তখন সেখান থেকে ফিরে আসার সুযোগও পাইনি। এতকিছুর পরও আমার মন পড়ে আছে তার তরে।আমার কষ্ট বাড়তে লাগল। সাহিলের কথা মনে হতেই আমার দম বন্ধ হতে লাগল।
"হয়তো প্রথম ভালোবাসা এমনই। যে ভালোবাসা আসে সুক্ষ্ম সময়ের জন্য আর যখন আসে তখন মাতাল করে দেয় আর চলে যাওয়ার পরও সে নেশার টাল সামলানো প্রবল কঠিন হয়ে পড়ে। "
এর মধ্যেই ডাক্তার আসলো। আমাকে দেখে সোহার দিকে তাকিয়ে বললেন
- রোগীর গার্ডিয়ান কোথায়?
- ফার্মেসীতে গেছে ঔষধ আনতে।
আরও কিছু কথোপকোথন তাদের মধ্যে হতে লাগল। তবে কথোপকথন গুলো ধীরে ধীরে মৃদু হয়ে গেল। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে শরীর ঠান্ডা হয়ে যেতে লাগল।
all viral video এখানে
গল্পের : নাম পার্সেল
লেখিকা : শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব-9
আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে শরীর ঠান্ডা হয়ে যেতে লাগল। সেই সাথে কাঁপতেও লাগল শরীর। চোখ ঝাপসা হয়ে আপনা আপনি বন্ধ হয়ে গেল। একদম শক্তি নেই শরীরে। অনেকটা লতানো ডগা যেমন শক্তিহীন হয়ে দেহের ভারে নুইয়ে পড়ে আমার অবস্থাও ঠিক সেরকমটাই হয়ে আছে। চোখ দিয়ে আপনা আপনি পানি পড়ছে। সেই মুহূর্তে আমার মধ্যে অদ্ভূত এক অণুশোচনা শুরু হলো। চিন্তা করতে লাগলাম আমি যদি এখন মারা যাই আল্লাহর সামনে কী নিয়ে দাঁড়াব? এই শূন্য আমল নিয়ে দাঁড়াতে পারব তো? জাহান্নামের আযাব সহ্য করতে পারব তো? ক্রমশেই আমার অনুতাপ বেড়ে পাহাড়সম হলো। এ দুনিয়ার জীবনে কী করলাম সেটাই ভাবতে লাগলাম। অথচ দুনিয়ার শেষ অধ্যায়ে যেখানে মৃত্যুই অবধারিত। অনুশোচনার ভার যখন নিতে পারছিলাম না তখন সেখানে শুয়ে শুয়েই তওবা করলাম। উপর আল্লাহর কাছে বললাম "হে আমার রব আপনি আমায় একটা সুযোগ দিন আমি কথা দিচ্ছি আমি সুস্থ হয়ে নিজেকে পরিবর্তন করব। আপনার তরে আমার জান মাল সপে দিব।" এসব বিড়বিড় করতে করতেই পুনরায় জ্ঞান হারালাম।
বেলা বাজে ১১ টা। শরীরটায় শক্তি পাচ্ছি আগের থেকে। মনে হচ্ছিল আল্লাহ আমার তওবা কবুল করে নতুন প্রাণ দিয়েছেন। নাহয় এত দ্রূত একদিনে এতটা শারিরীক উন্নতি কখনই সম্ভব হত না যদি না আমার রব আমাকে তার বরকতময় নিয়ামত দান না করতেন।
ডাক্তারের কথা অনুযায়ী আমি ঝুঁকিমুক্ত এখন। এবং আমাকে বাসায় নিয়ে যেতে পারবে। আব্বু, আম্মু আমাকে বাসায় নিয়ে আসলো। বাসায় আসার পরও মন পড়ে রইল সাহিলের কাছে। এত কিছুর পরও কেন তাকে ভুলতে পারছি না জানি না। কেনই বা তাকে ঘৃণা করতে পারছি না। আমি বরাবরেই খুব শক্ত স্বভাবের। যার তার কাছে নিজের আবেগ সহজে প্রকাশ করতে পারি না। কিন্তু সাহিলের সাথে পরিচয় হবার পর থেকে তার সান্নিধ্যে এসে কেমন যেন পাল্টে গেছি আমি। শক্ত মনটা যেন তুলোর মতো নরম হয়ে গেছে। আর সে তুলোতে চোখের পানি পড়ে যন্ত্রণাটা এত ভারী হয়ে আছে যে সহ্য করতে কষ্ট হচ্ছে। আনমনে এক কোণে বসে শুধু সাহিলের কথায় ভাবছিলাম। এমন সময় সোহা আসলো বাসায়। আমার মনমরা মুখটা দেখেই সে বুঝতে পেরেছিল আমি সাহিলকে নিয়েই চিন্তা করছি। সোহা আমার মোবাইলটা এগিয়ে দিয়ে বলল
- আপনার মোবাইলটা আমার কাছে ছিল। সাহিলের আইডি আমি ব্লক করে দিয়েছি। আর ওর ফ্রেন্ড আপনার খবর নিতে মেসেজ দিয়েছিল। বলেছি আপনি সুস্থ হলে কথা বলিয়ে দিব। আমি কী উনাকে এখন কল দিব?
আমি মাথা নেড়ে শুধু সম্মতি প্রদান করলাম। সাহিলের ফ্রেন্ডকে কল দিয়ে আমাকে দেওয়া হলো। উনি বেশ ভদ্রতার সহিত আমার খোঁজ খবর নিলেন। আমিও উত্তর দিলাম। সাহিলের কথা জিজ্ঞেস করতেই উনি উত্তর দিলেন
- ওর মন ভালো না। ও ঢাকার বাইরে আছে। বিষয়টা নিয়ে ওর পরিবারে একটু ঝামেলা হয়েছে। আর বাসার সামনে গিয়ে নাকি চেঁচামেঁচি করছেন?
আমি বিস্মিত সুরে জবাব দিলাম
- চেঁচামেঁচি কেন করব? আমি কী সাহিলকে জোর করে বিয়ে করতে চাই নাকি? আমি সাহিলকে ভালোবাসি তার মানে এই না তাকে আমি জোর করে চাইব। আর মতের বিরুদ্ধে গিয়ে তার বাসায় উঠব। আমি তখন মোটেও স্টেবল ছিলাম না। কী থেকে কী করেছি জানা নেই। অনেকটা দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। আর যে জায়গায় ছিলাম সেখানে তো আমার রেইপ ও হতে পারত। আল্লাহর অশেষ রহমতে তেমন কিছু হয়নি।
সাহিলের বন্ধু কথাটা শুনেই কিছুটা ক্ষমাসুলভ কণ্ঠে বললেন
- এমন বলো না ভাইয়া। আর তুমি আমার অনেক ছোট তোমাকে তুমি করেই বলছি। তুমি সুস্থ আছো এতেই আলহামদুলিল্লাহ। সেসময় আমি তোমাকে খুঁজেছি ঐদিকটায় তবে পাইনি। পরে জানতে পারি তুমি একটা ছেলের বাইকে করে চলে গেছ।
- হ্যাঁ অচেনা একটা ছেলে। চিনিও না তাকে। তবে সাহায্য করেছিল অনেক।
- এরপর আর খুঁজ নিতে পারেনি। আর সাহিলও তখন স্টেবল ছিল না। এমন ঘটনার সম্মুখীন সেও হয়নি কখনও। যা হয়েছে একটা মিসআন্ডারস্টেন্ডিং।
- সেটা যাইহোক ভাইয়া আমি সাহিলকে এখনও ভালোবাসি। ভালোবাসি মানে এই না তাকে আমার পেতেই হবে। দূর থেকেও ভালোবাসা যায়। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে আমি সাহিলের থেকে ভালো পাব তবে শূন্যতার জায়গায় একটায় থাকবে যে ওকে পাইনি।
- তা তো ঠিকেই। বিষয়টা নিয়ে আমরা পরে একদিন বসে আলোচনা করব। এখন তো চারপাশে সব গরম হয়ে আছে। সাহিলের পরিবারও বিষয়টা জেনেছে। তবে একটা কথা কী জানো?
- জি বলুন কী?
- সাহিল তার পরিবারের কাছে তোমার নামটা ফ্ল্যাশ করে ছোট করেনি তোমায়। কারণ তোমাকে তো ওর বাসায় সবাই চিনে। তোমার নাম বললে তোমার ব্যাপারে তাদের খারাপ ধারণা জন্মাতে পারে তাই সে এতকিছুর পরও তোমার নামটা বলেনি।
- সে যাইহোক, ভাগ্যে থাকলে তাকে পাব। অপেক্ষা আর সবরে অনেক কিছুই মিলে। আমি কাউকে অভিযোগ দেওয়ার আগে নিজের দোষটা খুঁজে বের করি। দোষটা আমারেই ভাইয়া। আমি নাহয় আমার দোষ গুলো শুধরাতে থাকি। সাহিল, সাহিলের মতো থাকুক। ওর খোঁজ নেওয়ার দরকার পড়লে নাহয় আপনাকে কল দিয়ে জেনে নিব। তবে চাই না ওর সাথে আমার যোগাযোগ হয়ে পুনরায় প্রেম প্রেম কিছু হোক। আমি চাই হলে হালাল ভাবে সবটা হোক। প্রেম করে হারাম করার ইচ্ছা আমার নেই। আল্লাহ আমায় হেদায়াত আর প্রত্যাবর্তন করার সুযোগ দিয়েছেন সুতরাং আমি নাহয় আমার লেনদেন আল্লাহর সাথেই করি। উনি উত্তম মনে করলে আমি সাহিলকে উত্তম উপায়েই পাব।
- ভালো থেকো ভাইয়া। আর কোনো খোঁজ নিতে হলে আমায় মেসেজ দিও আমি ব্যস্ত না থাকলে অবশ্যই তোমাকে জানাব। ইগনোর করব না ইনশাআল্লাহ ।
- ঠিক আছে। আরেকটা কথা ভাইয়া।
- কী কথা বলো।
- সাহিলকে বলবেন আমি সুইসাইডাল না। ওর জন্য সুইসাইড করে পরকাল ধ্বংস করব না। আমি পরকালকে অনেক ভয় পাই আর মৃত্যুকেও। আমার বোন বলেছে আপনারা খোঁজ নিয়েছেন আমার কিছু হলে সেটার দায় যেন আপনাদের উপর না পড়ে এজন্য। ওকে বলে দিবেন এমন কিছুই হবে না। আর আমি প্রথমে আপনার যে ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলেছিলাম উনাকেও বলবেন এসব নিয়ে চিন্তা না করতে। তবে আপনি আমার বড় ভাইয়ে মতো খোঁজ নিয়েছেন, নিতেই পারেন এতে দোষের কিছু না। তবে উনাদের বলবেন আমার জন্য উনাদের কোনো সমস্যা হবে না।
- ভাইয়া বিষয়টা তা না। আমরা তিনজনেই খুব চিন্তিত ছিলাম তোমার কিছু হয়েছে কী না। ভালো আছো কী না। তাই খোঁজ নিতে তোমার বাবাকে কল দিয়েছিলাম। পরে তোমার বোন সোহা জানাল এতে তোমার আরও সমস্যা হচ্ছে। তাই পরবর্তীতে বিষয়টা সলভ করে নিয়েছি।
- হুম বুঝতে পেরেছি। ভালো থাকবেন ভাইয়া।
কলটা কেটে গেল। আমি চুপ হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলাম। মনে মনে তওবা করলাম। যোহরের আযানের সুর কানে আসলো মসজিদ থেকে। তাড়াতাড়ি গিয়ে ওযু করে আমার রবের সামনে দাঁড়ালাম। তখন এত মনোযোগ দিয়ে নামাজটা আদায় করলাম সেটা বর্ণণা করার সঠিক শব্দ আমার শব্দ মালার ঝুড়িতে নেই। মনে হয়েছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ শান্তি আমি পেয়েছি। কিন্তু প্রত্যাবর্তন যেমন করেছি তেমনি শয়তানের কাজও ওয়াস ওয়াসা দেওয়া। তাই বারবার সাহিলকে মনে পড়ছিল। মন চাচ্ছিল ওকে একটা কল দিই। কিন্তু আমি শয়তানকে জয়ী হতে দিই নি নফসকে নিযন্ত্রণ করেছি। যখনই এমন মনে হয়েছে তখনই নামাজে দাঁড়িয়েছি।
সারাটা দিন এমন করেই পার করলাম । ঠিক সন্ধ্যা সাতটা বাজে একটা অচেনা নম্বর থেকে কল আসলো। আমি কলটা ধরতেই ওপাশ থেকে বলে উঠল
- আপনি কী মানসুরা মিমি?
- জি।
- আপনার নামে একটা পার্সেল এসেছে।
পার্সেলের কথাটা শুনতেই বুকটা ধুক করে উঠল। তখনই মনে পড়ল আমার নাম দিয়ে সাহিলকে কে পার্সেল পাঠিয়েছিল তখন? আর সাহিল কী সেটা গ্রহণ করেছিল? এরকমটা ভেবেই চুপ হয়ে ছিলাম। ওপাশ থেকে বলে উঠল
- ম্যাম আপনার বাসাটার নম্বরে যদি বলতেন।
বাসার ঠিকানা দেওয়ার আগে উনাকে প্রশ্ন করলাম
- কে পাঠিয়েছে পার্সেল?
- অজ্ঞাত পরিচয়ে পাঠিয়েছে ম্যাম। এখানে নাম নেই।
কথাটা শুনে আমি আরও চিন্তিত। শান্ত গলায় চিন্তা নিয়েই বাসার নম্বর দিলাম।
ঠিক পাঁচ মিনিট পর কলিং বেলটা বেজে উঠল। বুঝতে পেরেছিলাম পার্সেলের লোকটা চলে এসেছে। আমি সোহাকে পাঠালাম পার্সেলটা আনার জন্য। সোহা পার্সেলটা নিয়ে আমার কাছে আনলো। একটা লাল রঙের রেপিং পেপার দিয়ে বক্সবন্দি করা আছে কিছু। আমি বক্সটা বেশ কৌতুহল নিয়ে খুললাম।
গল্পের : নাম পার্সেল
লেখিকা : শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব-10
আমি বক্সটা বেশ কৌতুহল নিয়ে খুললাম। বক্সটা খোলার সাথে সাথেই লাল রঙের মলাট করা কুরআন পেলাম। তারপর মেসওয়াক। কালো পুতির কারুকার্জ করা একটা তাজবিহ। এর একটু নীচের দিকে একটা জায়নামাজ আর ছোট একটা দস্তরখানা। বক্সের সর্বশেষে নীচের অংশে পেলাম একটা বই। বইয়ের নাম অতঃপর হেদায়াত। আমি বুঝতে পারছিলাম না এমন গিফট কে পাঠাল! গিফট দাতার কোনো চিন্হ নেই। সোহা কিছুটা বিস্মিত গলায় বলল
- এগুলো কে পাঠিয়েছে?
আমি নির্বাক, নিশ্চুপ। কারণ উত্তরটা আমারও জানা নেই। ভুল করে চলে এসেছে কি'না সেটা ভাবতে লাগলাম। ভুল করে চলে আসাটা অস্বাভাবিক না তবে আমার নাম দিয়ে তো কেউ ভুল করবে না। তার মানে যে আমাকে পার্সেলটা পাঠিয়েছে সে আমার পরিচিত। কিন্তু কে সে? সাহিল না তো? না...না এ কী ভাবছি আমি! সাহিল এত ঝামেলার মধ্যে পার্সেল পাঠাবে বলে আমার মনে হয় না। মাথাটায় প্রশ্নের সমাবেশ ঘুরপাক খেতে লাগল। সোহা তার প্রশ্নটা পুনরায় করল। আমি মৃদু গলায় উত্তর দিলাম।
- জানি না... অজ্ঞাত কেউ পাঠিয়েছে।
গিফট গুলো একপাশে রেখে দিলাম। বইটা হাতে নিয়ে বালিশের কোণে রাখলাম। মাথার ঝিম ধরাটা কমলে বইটা পড়া শুরু করব। এমনিতেও আমি খুব বইপোকা মানুষ। কোনো বই সামনে পেলে না পড়া পর্যন্ত আমার শান্তি মিলে না। এখন মাথাটা হালকা ব্যথা করছে বিধায় পড়ছি না, নচেৎ বইটা ঠিকেই পড়ে নিতাম। সোহা কিছুক্ষণ থেকে তার বাসায় চলে গেল। মা এসে গিফট গুলো দেখে জিজ্ঞেস করলেন কে পাঠিয়েছে। উত্তরে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড তাজিয়ার নাম বলে দিলাম। তা না হলে মায়ের সন্দেহের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমি পড়ে যেতাম৷ তাজিয়ার নাম শুনে মা তেমন প্রতিক্রিয়া না করেই রুম থেকে বের হলেন।
আমার মাথাটা আগের চেয়ে হালকা লাগছে। বইটা হাতে নিলাম। বইটা খোলার আগে লম্বা কয়েকটা নিঃশ্বাস টেনে নিলাম,পরক্ষণেই তা ছেড়ে দিলাম। এবার বইটা খুলে পড়া শুরু করলাম। বইটার প্রথম গল্পটা এমন ছিল একটি বেনামাজি,বেপর্দা মেয়ে কীভাবে হেদায়াত পেল। কীভাবে সে হারাম সম্পর্ক থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টিতে নিজেকে সমর্পণ করল। বইটা যতক্ষণ পড়ছিলাম ততক্ষণেই মনে হয়েছিল বইটা নিশ্চয় আমার জন্য লেখা। নিজের করে যাওয়া স্বীয় পাপের জন্য অনুশোচনা জাগতে লাগল। এ দুনিয়ায় চাওয়া পাওয়ার খেলায় আমরা ভুলেই যাই আমাদের মূল লক্ষ্য কী। কেন আমরা এ দুনিয়ায় এসেছি। একটা বারও ভাবি না সৃষ্টিকর্তা অর্থাৎ আমার রব আমাকে এ দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন কী জন্য আর আমরা কী করছি। যখন আমরা মনের মতো কিছু পাই না তখন সাথে সাথে উপর আল্লাহকে অভিযোগ করে বলি আমি কী এমন করেছি যে আল্লাহ আমায় এত কষ্ট দিচ্ছেন। অথচ হিসাবের খাতা খুললে দেখা যাবে আল্লাহ শুধু আমাকে ছাড়েই দিয়ে গেছেন।
একটা বার চিন্তা করে দেখি আমাদের আল্লাহ কীভাবে ছাড় দিচ্ছেন। আমাদের দুনিয়ায় পাঠানো হয়েছে আল্লাহর ইবাদত করার জন্য। আল্লাহর হুকুম আহকাম পালনের জন্য। তার মধ্যে কিছু কাজ ফরজ যা আমাদের প্রতিনিয়ত পালন করতেই হবে। বিনা ওজরে তা ছাড়া যাবে না। নামাজ ফরজ সেটা আমরা প্রতিটা মুসলিম জানি। এটাও জানি পর্দা ফরজ। অথচ আমরা কতটা মানতে পারছি। হিসাবের খাতায় নামাজের জায়গায় বসালে দেখা যাবে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জায়গায় অনেকে এক ওয়াক্তও পড়ে না। অনেকে নামাজ কয়েক ওয়াক্ত পড়ে। আবার কেউ কেউ নামাজ পাঁচ ওয়াক্ত পড়লেও সহীহ ভাবে মন দিয়ে পড়ে না পড়তে হয় তাই পড়ে। অথচ চিন্তা করে দেখলাম আমার রব আমাদের কতটা ছাড় দিচ্ছেন। কারণ একজন মা যখন সন্তান লালন পালন করেন তখন কতটা আদর যত্নে লালন পালন করেন সেটা আমদের সবার জানা। অথচ সে সন্তান ভুল করলেও মা তার সন্তানের গায়ে হাত তুলে শাসন করে,শাস্তি দেয়। অথচ আমরা প্রতিনিয়ত কত ভুল করছি সে পরিমাণ শাস্তি যদি আমার রব আমাদের দিতেন আমাদের অবস্থাটা ঠিক কেমন হত একবার চিন্তা করা উচিত। তার উপরও আমরা কী করে এ কথাটা বলি আমি কী এমন করেছি যে আল্লাহ আমায় এত কষ্ট দিচ্ছেন।
আরেকটা মজার বিষয় হচ্ছে এই যে আল্লাহ আমাদের যেমন কষ্ট দেয় এ কষ্টের প্রতিদানও আখিরাতে উত্তম ভাবে দিবেন। মা সন্তানের বিষয়টা একটু তুলনা করি মা যেমন শাসন করে শাস্তি দেয় ছেলে /মেয়ের ভালোর জন্য তেমনি আল্লাহও আমাদের কষ্ট দেয় আমাদের বিপদে ফেলে আমাদের ভালোর জন্য। কারণ আমরা জানি না আমাদের মঙ্গল কিসে। কিন্তু আল্লাহ আমাদের ব্যাপারে পুরোপুরি অবগত। তাই আমরা যেরকমটা চাই মাঝে মাঝে সেরকমটা হয় না আমাদের ভালোর জন্য। অপরদিকে একজন বাবা, মা সন্তানকে এ শাস্তি/কষ্টের বিনিময়ে কিছু দিতে পারেন না কিন্তু আমাদের আল্লাহ আমাদের কতই না ভালোবাসেন যে আমাদের কষ্টের বিনিময়ও তিনি রেখেছেন আখিরাতে, উনার এত অবাধ্য হওয়ার পরও৷ তারপরও যদি বলি আল্লাহ আমায় এত কষ্ট কেন দিচ্ছেন। আমাকেই কেন দিচ্ছেন তাহলে আমার মতো বিশ্বাসঘাতক আর কেউ হবে না৷ যে কি' না আল্লাহর এত ছাড় এ নিয়ামত পেয়েও আল্লাহর কাছে অভিযোগ করছি।
একটু আগেও সাহিলের জন্য মন খারাপ হচ্ছিল। এখন আমার মন খারাপ হচ্ছে এটা ভেবে কী করে আমি এমন ভুল করলাম। বিয়ের উদ্দেশ্যে প্রেম করা তো এক পাত্রে মধু আর বিষ নিয়ে একত্রে পান করার মতো। হালাল আর হারামকে এক করে তো আর সেখানে ফায়দা হবে না। ক্রমশেই আমার অনুশোচনা বাড়তে লাগল। ভাবতে লাগলাম আমার রব কতই না মহান এতকিছুর পরও তিনি বলছেন
হে ইমানদারগণ, তোমরা সবাই তওবা করে আল্লাহর দিকে ফিরে আসো, যাতে করে তোমরা সফল হতে পারো।[ সূরা নূর আয়াত- ৩১]
অতঃপর তারা কি আল্লাহর দিকে তওবা করে কি ফিরে আসবে না এবং তাদের গোনাহ সমূদ জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করবে না? অথচ আল্লাহ তায়ালা তো ক্ষমাশীল এবং মেহেরবান।
[ সূরা মায়েদা আয়াত- ৭৪]
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা বলেন- হে ঈমানদার মুসলমানগণ, তোমরা খেলেস দিলে তওবা করে আল্লাহর দিকে ফিরে আসো,আশা করা যায়, আল্লাহ রব্বুল আলামীন তোমাদের ছোট খাট ক্রটি বিচ্যুতি মার্জনা করে দেবেন এবং সেই জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। যার পাদদেশে দিয়ে ঝর্ণা ধারা প্রবাহিত।
[সূরা তাহরীম আয়াত- ৮]
আল্লাহর কাছে তাদের তওবাই সত্যিকারের তওবা যারা অজ্ঞতাবশতঃ খারাপ কাজ করার সাথে সাথেই তওবা করে। আল্লাহ তায়ালা তাদের তওবা কবুল করেন। আল্লাহতো মহাজ্ঞানী ও হেকমতওয়ালা।
[ সূরা নিসা আয়াত- ১৭]
কিন্তু যারা তওবা করে ও নিজেদের কর্মনীতির সংশোধন করে নিবে এবং যা গোপন করেছিল তা প্রকাশ করে তাদেরকে আমি মাফ করে দিব, প্রকৃতপক্ষে আমি তওবা গ্রহণকারী ও দয়ালু। [ সূরা বাকারা আয়াত- ১৬০]
আরেকটা বিষয় হচ্ছে আমাদের প্রিয় মা জননীকেও যদি আমরা ভুল করে একাধিক বার মা, মা বলে ডাকি মাও এক সময় বিরক্ত হয়ে বলবে এত ডাকছিস কেন? এত ডাকার কী হয়েছে? অথচ আমার রবকে আমরা যত ডাকব তিনি তত খুশি হবেন। কত মহানেই না তিনি। খারাপ লাগা বাড়তে লাগল। সে সাথে অনুশোচনা। পূর্বে করা গুনাহের জন্য আমার তওবা করা প্রয়োজন। অন্যথায় আমিও ধ্বংস। সাহিলকে চাইতে হলে হালাল উপায়ে আল্লাহর কাছে চাইতে হবে। বিয়ের উদ্দেশ্যে প্রেম করে চাওয়া যে শয়তানের বড় ধোকা সেটা আমরা ক্রমশ ও ভুলে যাই।
নিজেকে স্থির করে নিলাম। দুই রাকাত তওবার নামাজ পড়ে স্বীয় পাপের জন্য অনুতপ্ত হলাম। চোখের জল ফেললাম। নামাজ শেষ করে নতুন করে এক পরীক্ষার সম্মুখীন হলাম। এবার বেশ দুটানায় পড়ে গেলাম আমি কী করব এটা ভেবে। সাহিল কল করেছে। তার কল কী ধরব কি'না বেশ চিন্তিত আমি। অনেক ভেবে কলটা ধরে কানের কাছে রাখলাম। কোনো শব্দ করলাম না। ওপাশ থেকে কী বলে সেটা শোনার অপেক্ষায়।
গল্পের : নাম পার্সেল
লেখিকা : শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব-11
ওপাশ থেকে কী বলে সেটা শোনার অপেক্ষায়। একজন মধ্য বয়স্ক লোকের কণ্ঠ শুনতে পেলাম। বুঝতে পারলাম তিনি সাহিলের বাবা।
- হ্যালো
-আসছালামুআলাইকুম।
- ওয়ালাইকুমুচ্ছালাম।
- জি কে?
- আমি সাহিলের বাবা। তোমার পরিচয়টা দাও তো।
আমি আমতা আমতা করতে লাগলাম। চুপ হয়ে শুধু এলোমেলো কণ্ঠসুরের আওয়াজ করতে লাগলাম। তিনি আমার ইস্তততা টের পেয়ে বললেন,
- আমি জানি না তুমি কে! যেহেতু আমার ছেলের জন্য তুমি এত পাগল। তোমার পরিচয় আর বাসার ঠিকানা আমায় দাও আমি তোমাকেই আমার ছেলের বউ করে নিয়ে আসব। এমনিতেও ওর জন্য পাত্রী দেখা হচ্ছে। কোনো না কোনো কারণে হতচ্ছাড়াটা বিয়েতে রাজি হচ্ছে না। আমার মনে হচ্ছে ওকে তুমিই হনুমান থেকে মানুষ করতে পারবে।
আংকেলের শেষ কথাটা শুনে মনের অজান্তেই হেসে দিলাম আস্তে করে। না জানি পাশে হনুমানটা দাঁড়িয়ে কী করছে। কী রকম তার মুখ ভঙ্গি হচ্ছে কে জানে! আমার তো মনে লাড্ডু ফুটতেছিল। তবে একটা ভয়ও কাজ করছিল। কারণ আংকেল তো জানে না আমি মিমি। আমার সাথেই সাহিলের বিয়ের কথা বার্তা এর আগে একবার হয়েছে। একটা ঝামেলা হওয়ায় বিয়েটা স্থগিত ছিল। তাই এ মুহূর্তে পরিচয় দেওয়ার সাহস আমার হলো না। বেশ কৌশলে বললাম
- আংকেল আমি সাহিলের সাথে কথা বলে আমার পুরো বায়োডাটা আমি পাঠিয়ে দিব। আপনি চিন্তা করবেন না। আমার জন্য দোয়া করবেন। আপনি আমার বাবার মতো।
-ঠিক আছে। মনে থাকে যেন।
বলেই কলটা কেটে গেল। ভাগ্যিস আংকেল আমার নম্বর জানে না। জানলে আজকে নির্ঘাত বিপদে পড়তাম। এর আগের বার যখন বিয়ের কথা চলছিল তখন আংকেলকে শুধু আব্বু আর আম্মুর নম্বর দেওয়া হয়েছিল। এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম। তবে মনের ভেতরে অদ্ভুত একটা ভালো লাগা কাজ করছে। কিন্তু এখন কোনোভাবেই সাহিলের সাথে যোগাযোগ করা যাবে না। একটু আগে করা তওবার কথা, আমার রবকে দেওয়া কথার বরখেলাপ করা যাবে না। নিজেকে সামলে নিলাম। চুপচাপ বসে রইলাম। সর্বশেষ সাহিলের যে ফ্রেন্ডের সাথে কথা হয়েছিল তিনি বেশ ভালো ছিলেন। অসুস্থ থাকা অবস্থায় তিনি সোহার কাছ থেকে আমার খোঁজ খবর নিয়েছেন এবং আমার সাথে কথা বলার সময়ও আমাকে বুঝিয়েছেন। কোনো দরকার পড়লে উনার কাছ থেকে জেনে নিব। কারণ সাহিলের সাথে কথা বলতে গেলেই সাহিলের প্রতি দুর্বলতা চলে আসবে আর পুনরায় প্রেম প্রেম সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ব। যেহেতু ওয়াদা করেছি খাস পর্দা করব তাই সাহিলের সাথে কথা বলার মতো ভুল কাজ করা যাবে না। নিজেকে সামলে নিলাম। সাহিলকে অনেক কল দেওয়ার ইচ্ছা থাকলেও দিলাম না।
অনেকক্ষণ পর সাহিলের ফ্রেন্ডকে একটা নক দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম
- আপনার ফ্রেন্ড কেমন আছে? কোনো খবর কী আছে তার?
তিনি বেশ সাবলীল ভাষায় রিপ্লাই দিয়ে বললেন
- ও আগের চেয়ে ভালো আর তোমার জন্য একটা গুড নিউজ আছে। ওর বাবা তো ওকে বলেছে তুমি যেহেতু ওকে এত পছন্দ করো সেহেতু সাহিল যেন তোমাকে বিয়ে করে নিয়ে যায় বাসায়। উনার এতে কোনো আপত্তি নেই। ব্যাপারটা এমন মেয়ে যখন এত পছন্দ করে তাহলে বিয়ে করে ফেল।
- আলহামদুলিল্লাহ। যা হবে ভালোর জন্য।
- তুমি অপেক্ষা করো সাহিলেই তোমাকে কল দিবে ইনশাআল্লাহ। বিয়ের ব্যবস্থা করবে ইনশাআল্লাহ।
- অদৃষ্টে যা লেখা আছে তাই হবে। ভাগ্যের লিখন তো খন্ডানো যাবে না। আমি সবর করতেছি আমি আশা রাখছি আমার রব আমাকে খালি হাতে ফেরাবেন না। আল্লাহর কাছে সব চাইলে পাওয়া যায়। অবশ্যই আমি তাকে পাব উত্তম উপায়ে। ভালো থাকবেন। এতটুকু সহায্য করার জন্য ধন্যবাদ।
- ভাইয়া এভাবে বলো না তুমি আমার ছোট বোনের মতো। আমিও আশা রাখছি সুসংবাদ পাব অতিদ্রূত।
কথোপকোথনের সমাপ্তি ঘটল। আমি নিজেকে পরিবর্তনে ব্যস্ত করলাম। পূর্বের করা সব পাপ গুলো একের পর এক লিপিবদ্ধ করলাম ডায়রিতে। প্রতিটা পাপের জন্য আল্লাহর নিকট তওবার নামাজ পড়ে ক্ষমা চাইলাম। চোখের জল ফেললাম। কারণ আল্লাহ তার বান্দার চোখের জল অনেক পছন্দ করেন। যখন তার বান্দা চোখের জল ফেলে তওবা করে তখন আল্লাহ সে বান্দাকে ফিরিয়ে দিতে পারেন না। নামাজ গুলো পড়ে বেশ শান্তি লাগছে।
এভাবেই কাটছে সময়। সাহিলকে যতবার মনে পড়ে ততবার নামাজ পড়ে ওকে হালাল ভাবে চাচ্ছি। আমি চাচ্ছি না সাহিলকে ভেবে ভাবনার যিনা করতে। পরপুরুষকে নিয়ে ভাবতেও এখন খারাপ লাগে। তবে আমরা মানুষ আমাদের তো একদিনে সব ঠিক হয়ে যাবে না চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে হবে৷ অবশ্যই আল্লাহ সবটা সুন্দর করে দিবেন।
এদিকে বাসায় পর্দা নিয়ে বেশ সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। আগে বোরকা হিজাব পড়লেও মাহরাম নন মাহরাম মেইনটেইন করা হত না। সবার সামনেই মাথায় উড়না দিয়ে চলে যেতাম। এবার তো সব মেইনটেইন করা হচ্ছে তাই চাচাত, ফুফাত, ভাইরা আসলে তাদের সামনে যাচ্ছি না বলে বেশ কথা শুনতে হচ্ছে। অনেকে তো অসামাজিক বলে গালিও দিচ্ছে। তবুও আমি আমার রবের জন্য সবটা মেনে নিচ্ছি হাসিমুখে। কারণ আমি জানি পরকালের এর প্রতিদান স্বরূপ আমার জন্য রয়েছে মহামূল্যবান জিনিস। আর বেপর্দা নারীর শাস্তি সম্পর্কে যদি নারীরা একটু ভাবত আর উপলব্ধি করতে পারত আমার মনে হয় না কোনো নারী বেপর্দা হয়ে ঘুরে বেড়াত।
অতঃপর হেদায়াত বইটার একটা অংশে পড়েছিলাম বেপর্দা নারীর পুরুষ্কার এবং শাস্তি সম্পর্কে । আমরা সবাই জানি, যে নারী পর্দা করে,ফরজ ইবাদত পালন করে,রমজানের রোজা রাখে সে নারীর জন্য জান্নাতের আটটি দরজা খুলে যায়। জান্নাতের সুখ সম্পর্কে সবার জানা। সেখানে বান্দা যা চাইবে সব পাবে। যত চাইবে তত দিবে। যত খুশি তত আনন্দ করবে। সেখানে সুখের শেষ নেই। নেই কোনো পেরেশানি নেই কোনো দুঃখ। সেখানে কেবল শান্তি,শান্তি,আর শান্তি।
অপরদিকে নারীর বেপর্দা হয়ে চলার শাস্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে যে,
১) যে নারী মাথার চুল খোলা রেখে বের হবে। মাথায় চুল পরপুরুষকে দেখাবে পরকালে তাকে তার মাথার চুল দ্বারা ঝুলন্ত অবস্থায় রাখা হবে এবং ঐ সময় তার মাথার মগজ ফুটন্ত পানির ন্যায় টগবগ করে ফুটবে।
কারণ আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে মহিলাদেরকে মাথা ঘাড় ও বুক মোটা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন। অথচ বর্তমান সমাজের দিকে তাকালে দেখা যায় মহিলারা মাথার চুলকে কত বাহারি প্রসাধনীতে রূপসজ্জায় সাজিয়ে নানা ঢংয়ে রাস্তায় বেপর্দা অবস্থায় চলাফেরা করছে। অথচ পর্দা সহকারে চলা, চুল ঢেকে রাখা সকল নারীর উপর ফরজ।
২) যে নারী হারাম সম্পর্কে লিপ্ত হবে তাকে জাহান্নামে নিজের স্তন দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হবে।
আল্লাহ মাফ করুন। আরও কঠিন শাস্তির বর্ণণা রয়েছে যেগুলো বর্ণণা করতে গিয়েও যেন বুক, হাত, পা কাঁপছে। বেপর্দা হয়ে চলে কত পাপ করেছি তার হিসাব নেই। কত ছবিই ফেসবুকে দিয়েছি কত ছেলে দেখেছে তার তো কোনো ইয়াত্তা নেই। আর সবচেয়ে বড় পাপটা ইদানিং আমরা বেশি করি ফেসবুকে ছবি দিয়ে। কারণ এ ছবি গুনাহে জারিয়ার কাজ করে। যতবার একজন পরপুরুষ এ ছবি দেখবে ততবার আমার আমলনামায় গুনাহ লেখা হবে। হায় আফসোস আমদের অধিকাংশ নারীরাই আমরা ফেসবুকে ছবি দিয়ে আনন্দ পাই। যদি একবার অন্তত উপরে বর্ণিত দুটি শাস্তির কথাও চিন্তা করি আমার মনে হয় না কোনো নারীর সাহসে কুলাবে দ্বিতীয় বার বেপর্দা হয়ে চলার। কারণ উপরে বর্ণিত শাস্তি ছাড়াও বেপর্দা নারীর জন্য রয়েছে আরও কঠিনতর শাস্তি।
এত নফরমানী করার পরও আমার রব কত মহান। কারণ তিনি আমাদের খাওয়াচ্ছেন,পড়াচ্ছেন। এতকিছুর পরও তিনি বলছেন তার বান্দা যদি তওবা করে নিজেকে শুধরে নেয় তিনি তার বান্দার সকল গুনাহ মাফ করে দিবেন। তাহলে এখনও কেন আমরা এত গাফেল? আমাদের কী উচিত না এখনই তওবা করা?
শাস্তির বর্ণণার কথা মনে হতেই আমি পুনরায় তওবা করলাম। তওবা শেষে ঘাড় ঘুরাতে আঁৎতে গেলাম।
গল্পের : নাম পার্সেল
লেখিকা : শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব-12
তওবা শেষে ঘাড় ঘুরাতেই আঁৎতে গেলাম মায়ের মলিন মুখ দেখে। মা কিছু একটা বলতে চাচ্ছে তবে বলতে সাহস পাচ্ছে না এমন মনে হচ্ছে। আমি কিছুটা মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করলাম
- কিছু বলবে?
মা আমতা আমতা করে বলল
- এখন তো তোর শরীরটা ভালোই। এক পাত্রপক্ষ অনেক জোরাজোরি করতেছে তোকে দেখার জন্য। আমরা খোঁজ নিয়েছিলাম। পাত্রের পরিবার, পাত্র যথেষ্ঠ ভালো। আর্থিক দিক দিয়ে স্বচ্ছল। ভালো পরিবার। আর ছোট পরিবার। আর পাত্র ১ম শ্রেণীর সরকারি চাকুরি করে। উনাদের বলেছিলাম তুই একটু অসুস্থ তবে উনারা অনেক করে বললেন তোকে দেখেই চলে যাবে। ছবি দেখে তোকে অনেক পছন্দ করেছেন উনারা।
বিয়ের কথা শুনতেই যেন আমার ভেতরটা কেঁপে উঠল। এখনও আমার মনে সাহিলের বাস। মনের সমস্ত জায়গা জুড়ে তার বিচরণ। এখন অন্য কাউকে কেন জানি না বিয়ে করার কথা ভাবতে পারছি না। মনে হচ্ছে মনে একজনকে রেখে অন্য কাউকে বিয়ে করলে তাকে ঠকানো হবে। আমি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললাম
- মা জানই তো আমার শরীরের অবস্থা। এখন এসবে মন সায় দিচ্ছে না। অন্তত গ্রেজুয়েশন কমপ্লিট করে বিয়েটা করি। আর তো ১ বছরের মতো লাগবে। আমাকে একটু সময় দাও। আমার সময়ের দরকার।
- তোকে তো এ পর্যন্ত কম সময় দেওয়া হয়নি। ঠিকঠাক একটা পছন্দ তোর থাকলে নাহয় ভেবে নিতাম তার জন্য অপেক্ষা করছিস। প্রেমও তো করার যোগ্যতা নাই তোর। ছেলে দেখলেই তোর গা যেন জ্বলে যায়। বরাবরেই ছেলে পিটানোতে ওস্তাদ। আর এখন যথেষ্ঠ বড় হয়েছিস। বয়সও তো কম হচ্ছে না। একটা বয়সে মেয়েদের ডিমান্ড থাকে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে মেয়ে যতই যোগ্য হোক না কেন ডিমান্ড কমে যায়। সুতরাং অমত করার কোনো অপশন নেই। যেহেতু তোর ও কোনো পছন্দ নেই সুতরাং বিয়ে তো আমাদের পছন্দেই করতে হবে।
- মা তোমাদের পছন্দে বিয়ে করলেও তো আমার একটা পছন্দ থাকে তাই না?
- তুই ছেলে না দেখেই কীভাবে পছন্দ অপছন্দের কথা বলছিস?
মায়ের এ কথার জবাব আমি দিতে পারছিলাম না। ভেতরে হাহাকার লাগলেও মনকে সান্ত্বনা দিতে লাগলাম হয়তো এতে আমার ভালো রয়েছে কিন্তু আমি দেখতে পারছি না। আমরা অনেক সময় নিজেদের কিসে ভালো কিসে খারাপ বুঝতে পারি না। তখন আল্লাহর পরিকল্পনা না বুঝেই মন মতো কিছু না হলে আল্লাহকে অভিযোগ করে বসি। অতঃপর একটা সময় পর দেখা যায় যে, সেটাই আমার জন্য ভালো ছিল। সুতরাং এখনও হয়তো এমন কিছুই আমার সাথে ঘটছে। আমি মাথাটা নুইয়ে দিয়ে বললাম
- তাদের সামনে যেতে আমার আপত্তি নেই। তবে শুধু মেয়ে মেহমান যারা আসবে তাদের সামনে যাব আর পাত্রের সামনে। এছাড়া পাত্রের, বাবা,বড় ভাই ওদের সামনে যেতে পারব না। আমার পর্দা নষ্ট হবে।
মা আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকাল। এটা শোনার জন্য মা মোটেও প্রস্তুত ছিল না। আমি বরাবরেই শালীন ভাবে চলাফেরা করি। তবে এ কথাটা আশা করেনি। মা কিছুটা রাগ গলায় বলল
- পাত্রপক্ষ তোকে না দেখে ওদের বাড়িতে বউ করে নিবে নাকি! এটা কেমন কথা!
- মা দেখবে না কেন? পাত্র স্বয়ং আমাকে দেখবে। পাত্রের মা, বোন আমাকে দেখবে। তাদের কী চোখ নেই নাকি যে পাত্রের বাপ ভাইকেও আমাকে দেখাতে হবে। আমি গরু নাকি যে ধরে ধরে সবাই দেখে পর্যবেক্ষণ করবে। আমি সাফ জানিয়ে দিচ্ছি তোমাদের দেখানোর হলে আমি যেভাবে বলছি সেভাবে দেখাবে নাহয় আমি পাত্র পক্ষের সামনে যাব না।
মায়ের রাগটা আরেকটু বেড়ে গেল। মা এবার হালকা চেঁচিয়ে বলল
- বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। আমরা যা বলব তাই হবে। কাল দেখতে আসবে। নিজেকে প্রস্তুত রাখিস।
আমি আর কোনো উত্তর দিলাম না। কারণ এখন আমার পরীক্ষা হলো আমি আল্লাহকে দেওয়া কথা রাখব নাকি দুনিয়ার মোহে ডুবে যাব। পরকালের প্রশান্তি খুঁজে নিব নাকি খুঁজে নিব জাহান্নামের আগুন। নিজেকে প্রস্তুত করলাম এ পরীক্ষা দেওয়ার জন্য।
পরদিন ঠিক চারটে বাজে আমাকে দেখতে আসলো। আমি একটা বোরকা আর হিজাব পরে নিলাম। মা আমার কান্ড দেখে বলল
- এরকম সং সেজে যাচ্ছিস কোথায়?
- কেন পাত্র পক্ষের সামনে যাব। তোমাদের তো বলেছিলাম শুধু পাত্রের মা বোন আর পাত্রের সামনে যাব। ওদের সামনে গেলেও আমি হিজাব পরেই যেতাম কারণ পাত্রকে মুখ দেখানো জায়েজ আর কোনো পুরুষকে না। আর এখন তো ওদের সাথে পাত্রের দুলাভাই ও এসেছে। তাদের সামনে নিকাব ছাড়া বোরকা ছাড়া আমি কেন যাব?
মা আমার দিকে রাগী চোখে তাকালেন পাশের রুমে পাত্রপক্ষ থাকায় চিল্লায়ে কথা বলতে পারছেন না। এর মধ্যেই বাবা এসে বললেন
- বোরকা পরেছো কেন?
মা রাগ রাগ গলায় বাবাকে সবটা বলল। বাবা পারছে না শুধু কিছু বলতে পাশের রুমে পাত্রপক্ষ থাকায়। এ মুহূর্তে উনাদের সামনে আমাকে হাজির না করলেও সমস্যা বাড়বে বৈ কমবে না। তাই এভাবেই উনাদের সামনে আমাকে নিতে বাধ্য হলো। আমি উনাদের সামনে গিয়ে সালাম দিলাম। উনারা আমাকে দেখে কিছুটা অবাক হলো। তবে সেটা মুখ অবয়বে প্রকাশ পেলেও তেমন কিছু বলল না। সালামের উত্তর নিয়ে বসতে বলল। আমি তাদের কথা মতো বসলাম। তারপর পাত্রের মা বললেন
- মা আমরা আমরাই তো মুখ কেন ঢেকে রেখেছো?
- আন্টি আপনি থাকলে সমস্যা নেই৷ আপনার ছেলে থাকলেও সমস্যা নেই আমি আপনাদের সামনে মুখ খুলতে পারব। তবে বাকি যারা গায়রে মাহরাম আছেন মানে অন্য পুরুষ তাদের সামনে মুখ খুলব না।
- তা বললে হয় নাকি মা। আমার ছেলের বাবা কী তার বউমাকে দেখে নিয়ে যাবে না? তারও তো একটা পছন্দ আছে। আমরা আমরাই তো মা।
- আমি তো আপনার ছেলের সাথে সংসার করব। আপনার ছেলের পছন্দ হলেই তো হলো। আমি এটুকু কথা দিতে পারি বিয়ের পর আপনাদের হক পালনে আমি কৃপণতা করব না। তবে আমার পর্দা ভঙ্গ হয় এমন কোনো কাজ করতে আমাকে বলবেন না। আপনি আমার সাথে চলুন৷ আমাকে ভালো করে দেখে নিন।
আমার কথাটা শুনে উনার মুখটা কালো হয়ে গেল। মুখটা এমন করে রেখেছেন যেন আমি মস্ত বড় বেয়াদবি করে ফেলেছি এ কথাটা বলে। উনার মুখটা এমন হওয়াতে আমার বাপ, মা ও বেশ লজ্জা পাচ্ছেন সে সাথে তাদের চোখ রাগে লাল হয়ে গেছে৷ আমার আচরণ তাদের ভালো লাগছে না এটা বেশ ভালোই বুঝতে পারছি। তবে আমার কাছে এখানে উপস্থিত কারও সন্তুষ্টি মখ্য বিষয় না। আমার কাছে মুখ্য বিষয় হলো আমার রবের সন্তুষ্টি। এর মধ্যেই আন্টি মুখটাকে আবার ও হাসিমাখা করে বললেন
- বুঝতে পেরেছি তোমার সমস্যাটা। আমরা তো আর পর কেউ না যে তুমি এমন করছো৷ আমরা তো তোমার আপন মানুষেই।
কথাটা বলার সাথে সাথে উনি এমন একটা কাজ করে বসলেন যে আমি বিভ্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গেলাম। এখন কী করব সেটাই আমি বুঝতে পারছি না। কারণ
গল্পের : নাম পার্সেল
লেখিকা : শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব-13
এখন আমি কী করব সেটাই বুঝতে পারছি না। আন্টি হুট করেই আমার নিকাবটা টেনে মুচকি হেসে বললেন
- পাগল মেয়ে এখানে আমরা সবাই তোমার আপনজন।
আমি হিতাহিত বুঝটা হারিয়ে ফেললাম মুহুর্তেই। কিছু বুঝে উঠার আগেই বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে দৌড় দিলাম। জানি না তাদের ভাব মূর্তি কী হয়েছে। আমি রুমে আসার সাথে সাথে আমার মা আমার পিছু রুমে ঢুকলেন। বেশ রাগী গলায় বললেন
- আমাদের মান সম্মান এভাবে মাটিতে লুটিয়ে দিতে একটা বারও ভাবলি না? ওরা কী ভাববে?
- ওরা যা ভাবার ভাবুক। অনুমতি ছাড়া কোনো ভদ্র পরিবার টান দিয়ে নিকাব খুলবে না অন্তত। উনারাই তো ভুল করেছে আমি না।
কথাটা বলার সাথে সাথে মা আমার গাল কষিয়ে কয়েকটা চড় বসিয়ে দিলেন। আমি শুধু নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। মায়ের সাথেও এভাবে চড়া গলায় হয়তো কথা বলা উচিত হয়নি। কিন্তু পরিস্থিতি যেন সব প্রতিকূলে। চাইলেও সবটা সুন্দর করে গুছিয়ে নিতে পারছি না।
এদিকে উনারা নাস্তা না খেয়েই চলে গেলেন। বাবা বেশ রেগে গেছেন। তবে কিছু বলছেন না। আমার কাছে থেকে অন্তত এটা আশা করেননি তারা। সব কিছু এলোমেলো লাগছে। এদিকে না চাইতেও সাহিলের কথা মনে পড়ছে৷ আমি চাই না আমার সব আমল সাহিলকে চিন্তা করে ধ্বংস হয়ে যাক। আমি চাই এ ভাবনার যিনা থেকেও নিজেকে মুক্ত করতে। সাহিলকে যতবার মনে পড়ছে ততবারেই আমি তওবা করতে লাগলাম।
বাসার পরিস্থিতি এতক্ষণ বেশ গরম থাকলেও আল্লাহর অশেষ রহমতে এখন সব ঠান্ডা এবং স্বাভাবিক। মনে হচ্ছে আমি আল্লাহর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আর আল্লাহই আমার সব কাজ সহজ করে দিচ্ছেন। নাহয় আমার পরিবার এত দ্রূত ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার কথা না। কিন্তু এদিকে সাহিলের চিন্তা আমার মাথা থেকে কোনোভাবেই সরছে না। যতই সরাতে চাচ্ছি ততই যেন ঘিরে ধরছে। কী করব বুঝে উঠতে পারছি না। এমন সময় আমার এক বান্ধবীর কথা মনে পড়ল যে কি'না অনেকদিন যাবত দ্বীনের পথে আছে। ওর নাম রুকাইয়া। ওর কথা মনে হতেই আমি ওকে কল দিলাম। কলটা ধরার সাথে সাথে সালাম দিলাম সেও সালামের উত্তর নিল। কিছুক্ষণ কুশল বিনিময় করলাম। তারপর ওকে সমস্ত ঘটনা খুলে বললাম। সমস্ত ঘটনার শুনার পর ও বলল ইস্তেখারা নামাজ পড়তে সাহিলের ব্যাপারটা নিয়ে।
যখন কোনো হালাল নিয়্যত বা কাজের ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা হয় বা দুটানা কাজ করে তখন ইস্তেখারা নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে চাইলে পরদিন যদি কাজটা করার জন্য মন সায় দেয় তাহলে বুঝতে হবে কাজটা আমার জন্য মঙ্গলজনক আর মন সায় না দিলে বুঝতে হবে এতে আমার কোনো কল্যাণ নেই। অনেকে আবার স্বপ্নের মধ্যমে বুঝতে পারে কোনটা ঠিক কোনটা বেঠিক। তবে সবাই স্বপ্ন দেখবে বিষয়টা এমন না৷ আর কোনোরকম অনুভূতি না আসলে পর পর সাতদিন এ নামাজ পড়তে হবে। কাজটা যদি কল্যাণকর হয় তাহলে সেটা দ্রূত সহজ হয়ে যাবে আর অকল্যাণকর হলে সেটা থেকে আল্লাহই আহসান করে দিবেন।
রুকাইয়ার কাছ থেকে নামাজের বিবরণটা জেনে নিলাম। সাধারণত দুই রাকাত নামাজের মতোই এটা পড়তে হবে। এ নামাজ পড়ার পর ইস্তেখারার দোয়াটা পড়ে আল্লাহর কাছে জিজ্ঞাসা করতে হবে কাজটা আমার জন্য মঙ্গলজনক কি'না। নামাজটা পড়ার পর মন যেদিকে ঝুঁকবে আমাকে সে পথেই বেছে নিতে হবে৷ নামাজটা যেকোনো সময়েই পড়া যায়। তবে সুন্নত হচ্ছে এশার নামাজের পর নতুন অযু করে নামাজটা পড়ে শয়ন করা। এতে অনেক সময় স্বপ্নের মাধ্যমেই বুঝিয়ে দেওয়া হয় কাজটা আমার জন্য কতটা কল্যাণকর অথবা না।
আমি মনস্থির করলাম নামাজটা পড়ার জন্য। এখন রাত ১১ টা বাজে। সরাসরি ওয়াশরুমে গিয়ে অযু করলাম। তারপর নামাজে দাঁড়িয়ে ইস্তেখারার নামাজ পড়ার আগে দু রাকাত সালাতুল হাজতের নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে চেয়ে নিলাম আল্লাহ যেন আমাকে ইস্তেখারার সঠিক ফলটা সহজেই বুঝিয়ে দেন। যখনেই কোনো কিছু চাওয়ার প্রয়োজন পড়বে তখনই সালাতুল হাজতের নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে চাইতে হয়। তাই আমি পূর্বে নামাজের সঠিক ফলটা যেন পাই সেটা চেয়ে নিলাম।
তারপর সালাতুল হাজত শেষ করে ইস্তেখারার দু রাকাত নামাজ পড়লাম। অতঃপর ইস্তেখারার দোয়া পড়ে আল্লাহকে বললাম
"হে আমার রব সাহিলের সাথে এত ঘটনা হওয়ার পরও কী তার জন্য বিয়ের ব্যাপারে অপেক্ষা করা কী আমার জন্য কল্যাণকর হবে কি'না আমাকে বুঝিয়ে দিন"
দোয়াটা করে সরাসরি শুয়ে পড়লাম। ঝিকির করতে লাগলাম। ঝিকিরের এক পর্যায়ে চোখটা লেগে আসলো। ঠিক এমন সময় কোনো মেয়ে আমাকে বলল সাহিলের ব্যাপারে পাগলের মতো চিন্তা করাটা আমার বোকামি। এরপরই মেয়েটা একটা বিকৃত রূপ ধারণ করল। আমি ভয়ে দম নিতে পারতেছিলাম। এমন সময় লক্ষ্য করলাম সাহিল আমার সামনে। সাহিলকে এত সুন্দর লাগছিল বলে বোঝাতে পারব না। ঐ মেয়েটা আমার হাত পা যেন চেপে ধরেছিল মনে হচ্ছিল। আর এদিকে সাহিল আমার এ অবস্থা দেখে আমার দিকে তার হাতটা বাড়িয়ে দিল। আমি তার হাত ধরতেই মেয়েটা সাথে সাথে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল। আমি সাহিলের হাতটা শক্ত করে ধরলাম। বেশ শান্তি লাগছে এবার। মনে হচ্ছিল একটা খারাপ সময় থেকে সাহিল আমাকে বাঁচিয়ে তার সান্নিধ্যে নিয়ে এসেছে। ঠিক এমন সময় স্বপ্নেই বলে উঠলাম আল্লাহ আমি সাহিলকে পেয়ে গেছি আলহামদুলিল্লাহ। বেশ জোরেই চিৎকার করে উঠলাম। সাথে সাথে ঘুম ভাঙল। আমি দম নিলাম দীর্ঘ দীর্ঘ ।
এরপর থেকে আমার মন বারবার বলছে ওর বিষয়ে একটু অপেক্ষা যেন করি৷ ওর বিষয়ে অপেক্ষা করলে আমার ভালো হবে। আমার মন এককভাবে শুধুই এটাই বলে যাচ্ছিল। পরদিন সকালে উঠে রুকাইয়া সমস্ত বিবরণ দেওয়ার পর সে ও বলল মন যা সায় দেয় তাই যেন করি। আর আলহামদুলিল্লাহ স্বপ্ন ভালো দেখেছি। পরদিন সারাটা দিন সাহিলের বিষয়টায় ইতিবাচক প্রভাবেই আমার মনে বিরাজ করল। আমার আর বুঝতে বাকি রইল না সাহিলের ব্যাপারে বিয়ের বিষয় নিয়ে অপেক্ষা করাটা আমার জন্য বরকতময় হবে ইনশাআল্লাহ।
তবুও আরেকটু নিশ্চিত হবার জন্য পরদিন আবার ইস্তেখারা নামাজ পড়ে শুইলাম। এবার স্বপ্নে দেখলাম।
গল্পের : নাম পার্সেল
লেখিকা : শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব-14
তবুও আরেকটু নিশ্চিত হবার জন্য পরদিন আবার ইস্তেখারা নামাজ পড়ে শুইলাম। এবার স্বপ্ন দেখলাম আমি তার আম্মুর মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছি। আমি তাকে কুরআন তিলাওয়াত শিখাচ্ছি। সে তিলাওয়াতে ভুল করছে আর আমি তাকে ঠিক করে দিচ্ছি। মিষ্টি মিষ্টি শাসন করছি৷ একসাথে নামাজ পড়ছি। আমার সাথে তার বিয়ে হচ্ছে। আমি কবুল বলতেছি। তারপর একটু হাবিজাবি স্বপ্ন দেখতে লাগলাম। এমন সময় মনে হলো কেউ আমাকে আবার চেপে ধরেছে। ঠিক এমন সময় আমি সাহিল বলে চেঁচিয়ে উঠতেই স্বস্তি ফিরে পাই। মনে হচ্ছিল আমি কোনো বিপদে পড়ছি আর সাহিলের জন্য বেঁচে যাচ্ছি।
খপ করে ঘুম থেকে উঠলাম। এবারও আমার মনে সায় দিল বিয়ের বিষয়ে সাহিলের জন্য অপেক্ষা করাটাই উত্তম হবে। পরদিন সারাদিন আমার মনে এটাই চলেছে যে এ বিষয়ে অপেক্ষা করাটাই উত্তম হবে। আমার ভেতরটা এবার প্রশান্ত হলো। স্বপ্নের ব্যাপারটা আমার আন্টিকে, বড় বোনকে আর বান্ধবীকে বলার পর ওরাও বলল অপেক্ষা করার জন্য। আমি এবার দৃঢ় মনে চিন্তা করলাম সাহিলের জন্য অপেক্ষা করব। হয়তো এতেই আমার জন্য উত্তম হবে।
শুরু হলো আমার অপেক্ষার পালা। অপেক্ষার পর্ব সহজে শেষ হয় না বরং এ পর্ব স্বল্প হলেও দীর্ঘ মনে হয়। প্রতিটাক্ষণ সাহিলের কথা মনে পড়ে আমার। তবে আমি চাই না তাকে ভাবতে। কারণ সে আমার জন্য গায়রে মাহরাম। তাকে ভাবনাতেও আনলে আমার গুনাহ হবে আর বিষয়টা ভাবনার যিনার আওতায় পড়ে যাবে। তবে আমরা মানুষ চাইলেও মনকে একদিনে পরিবর্তন করা সম্ভব না। নিজেকে আস্তে আস্তে পরিপূর্ণ করতে হবে। আমি আমার ভুল ত্রুটি গুলো ডায়রিতে লিপিবদ্ধ করতে লাগলাম। প্রতিদিন কয়টা হারাম কাজ আমি ভুলবশত বা ইচ্ছাকৃত করেছি সেটা লিপিবদ্ধ করে প্রতিদিনের তওবা সাথে সাথে করে ফেলতাম। এভাবেই আমার সময় পার হচ্ছে।
সময়ের বহমান নদী পার হলেও সে নদীতে মাঝে মাঝে স্রোত এসে ধাক্কা দিয়ে পরীক্ষা করে নীচের মাটি কতটা শক্ত হয়েছে। অর্থাৎ সামান্য ধাক্কায় আমি তলিয়ে পড়ব নাকি আকড়ে ধরে থাকতে পারব। ঠিক তেমনি হেদায়াতে প্রাপ্তির পরবর্তী ধাপ হলো রবের পক্ষ থেকে পরীক্ষা। প্রায়শই দেখা যায় একজন ব্যাক্তি হুট করে নামাজ শুরু করলে ভালো কাজ করলে অনেক বিপদের সম্মুখীন হয়। তখন ভয় পাবার মতো কিছু নেই। কারণ এটাই আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার পরীক্ষা। বান্দা যদি তখন সবর করে তাহলে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিদান স্বরূপ রয়েছে অনাবিল সুখ। কোনো কিছু অর্জন করতে হলে অবশ্যই ত্যাগের পাল্লা ভারী হতে হয়। তেমনি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হলেও বিপদে ধৈর্য ধারণ করতে হবে আল্লাহকে ডাকতে হবে।
ঠিক তেমনি আমিও কিছু পরীক্ষার সম্মুখীন হলাম। ভার্সিটিতে আমার এ পোশাকের জন্য কটুক্তির সম্মুখীন হতে লাগলাম। সে সাথে পরীক্ষা হলে বেশ বিপাকে পড়তে হয়। কারণ মুখ খুলে প্রমাণ দিতে হয় আমি এডমিট কার্ডের মেয়েটা কি'না। এটা দোষের না। তবে এ ব্যবস্থাটা ভিন্নভাবেও চালু করা যায়। অর্থাৎ যারা পর্দা করে তাদের মুখ একজন মেয়ে শিক্ষিকা দিয়ে পর্যবেক্ষণ করালে সবচেয়ে বেশি ভালো হয়। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপেই নেওয়া হয়নি। ফলে পর্দা যারা করে তাদের জন্য এটা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে যায় যে, একজন গায়রে মাহরামের সামনে মুখ খুলে দেখানোটা। ইতস্ততটাও প্রবল হতে শুরু করে। এরচেয়ে বড় সমস্যা হয় ভাইভা বোর্ডে ভাইভা দিতে গেলে। কারণ কিছু শিক্ষকের ধারণা মেয়ে পর্দা করে মানে সে জঙ্গী দলে নাম লিখিয়েছে। আর সেজন্যই সেখানে তাকে পোশাক নিয়ে বিভিন্ন অপ্রাসঙ্গিক কথা বলে অপদস্ত করা হয়। এর জলজ্যান্ত প্রমাণ আমি। নিকাব পরিধান করার জন্য আমার পরীক্ষা ভালো হওয়া স্বত্ত্বেও আমাকে কোনোরকম পাস করানো হয়। অথচ ভার্সিটি থেকে কোনো ড্রেসকোড মেইনটেইন করে যেতে বলা হয়নি। যারা অশালীন ভাবে এসেছে তাদেরকে কোনো প্রশ্ন করা হয়নি ড্রেস নিয়ে, অথচ যারা পর্দা করে এসেছে প্রশ্নের সম্মুখীন তাদেরকেই হতে হয়েছে। কেন এমনটা করা হয় তার উত্তর আমাদের সমাজে নেই। কারণ সমাজব্যবস্থাটায় এখন প্রতিকূলে চলে গেছে।
বেশ কিছুদিন আগে আমার এক বন্ধু আমার সামনে আসলো। আমাকে দেখে অবাক হয়ে বলল
- হুট করে এত হাজী হয়ে গেলি কেন? কোনো হুজুরের প্রেমে পড়েছিস নাকি?
কথাটা শুনে আমার বেশ হাসি পেল। এ প্রশ্নটা একদম সবাইকে শুনতে হয় যারা নতুন পর্দা শুরু করে। মডারেট একটা মেয়ে হুট করে পর্দা শুরু করলে শুধু ফ্রেন্ড সার্কেল না বরং নিজের বাবা, মা থেকে শুরু করে আত্মীয়স্বজনরা সবার মনের ধারণা এটাই হয় যে মেয়ে হুজুরের প্রেমে পড়ে হুজুরের কথা শুনে এ কাজ করতেছে। অথচ তারা যদি জানত আল্লাহর ভালোবাসায় মগ্ন হয়ে কতটা সুখের আশায় এমন করেছি তাহলে তারাও সেদিন থেকে এক আল্লাহর সন্তুষ্টির কথা চিন্তা করত। তারা গাফেল, অথচ তাদের মাথায় সুবুদ্ধি কবে আসবে জানি না। একজন মানুষকে যদি বলা হয় আগুনে ঝাঁপ দিতে তাহলে কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ দিবে না। তবে আমরা ঠিকেই দুনিয়ার মোহে পড়ে আগুনের পথটাই বেছে নিয়েছি। আমাদের চিন্তাশক্তি উপরের চাকচিক্য পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রয়েছে অথচ গভীরে গেলে যে এটার ফল মরিচীকা ছাড়া কিছুই না সেটা আমরা বুঝতে পারি না।
আমরা অনেক সময় নামাজ তরক করে বসে থাকি। সামান্য অজুহাতে নামাজ পড়ি না। অনেকেই বাসায় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়লেও কোথাও বেড়াতে গেলে সে অভ্যাস ছুটে যায়। অথচ আখিরাতে সর্বপ্রথম নামাজের হিসাব নেওয়া হবে। আবার অনেকে নামাজ পড়তে হবে বলে বাধ্য হয়ে পড়ে, রুকু সিজদা ঠিক মতো দেয় না। অনেকে মানুষকে নামাজী প্রদর্শন করতে নামাজ পড়ে। এরকম নামাজ কখনই কবুল হবে না। নামাজ পড়তে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। শুধু নামাজ না প্রতিটা আল্লাহর হুকুম আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পালন করতে হবে। অন্যথায় সে হুকুম পালন করলেও কবুল হবে না।
দুনিয়ায় একপক্ষ কারও প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করলে দুর্বলতা প্রকাশ করলে অপর পক্ষের নিকট থেকে শুধু অবহেলায় পায় আর আল্লাহর জন্য ভালোবাসা প্রকাশ করলে বিনিময়ে আল্লাহ উত্তম প্রতিদান দেয়। তাহলে আমরা কেন দুনিয়ার মোহে ডুবে আছি। লাভবান কে না হতে চায়? তাহলে আমরা কেন লাভের পথ বাদ দিয়ে লোকসানের পথ বেছে নিচ্ছি? আমাদের কি উচিত না সঠিক পথ বেছে নেওয়া?
সুখ দুঃখের পালা বদল নিয়েই পার হচ্ছে সময়। বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল সাহিলের জন্য আগের মতো খারাপ লাগে না তবে একেবারে ভুলেও যাইনি। মোনাজাতে তাকে আমি চাই। যদি সে আমার জন্য উত্তম হয় অবশ্যই আল্লাহ মিলিয়ে দিবেন এ আশায় সবর করেই যাচ্ছি। আমি জানি সবরকারীর সাথে আল্লাহ আছেন। সবরের উত্তম প্রতিদান রয়েছে। আমি জানি এ যন্ত্রণার সাথে স্বস্তি রয়েছে। যদি সাহিলকে নাও পাই তবুও হতাশ হওয়ার কিছু নেই কারণ আল্লাহ এমন কাউকে মিলিয়ে দিবেন যে আমার জন্য তার চেয়ে উত্তম। তাই চুপ করে সবর করাই শ্রেয়।
কেটে গেল আরও কয়েকদিন। দুপুরবেলায় যোহরের নামাজ পড়ে শুয়ে ছিলাম। মনটা ভীষণ খারাপ লাগছে। অকারণেই মন খারাপ হচ্ছে আমার। এমন সময় মা ছুটে আসলেন আমার রুমে। বেশ হাঁপাতে লাগলেন। মায়ের হাঁপানো দেখে ভয় পেয়ে গেলাম। মাকে জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে? মা উত্তরে বললেন
গল্পের : নাম পার্সেল
লেখিকা : শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব-15
মাকে জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে? মা উত্তরে বললেন
- আমরা আগে যে বাসায় থাকতাম সেখানের পাশের বাসার তোর মিনু আন্টি আজকে সকালে মারা গেছে। উনার ছেলে মাত্র কল করে জানাল। তোকে তোর আন্টি কত ভালোবাসত। খুব মায়া হচ্ছে রে, দেখতে যাবি তুই?
মায়ের কথা শুনে বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল। মৃত্যু কখন কার কীভাবে হয় বলা যায় না। মৃত্যুর হাতছানি বয়স মেপে হয় না। বয়স মেপে হলে হয়তো আমরা জানতে পারতাম কার মৃত্যু কখন হবে। ইশ একদিন আমাকেও মরতে হবে। এ জীবনের গ্যারান্টি নেই, নেই কোনো মাত্রা। একটা অনিশ্চিত জীবনযাপন আমরা করছি। আর সে জীবনে আমরা বেশির ভাগ সময় রবের দিকে এগিয়ে না গিয়ে মরিচীকার দিকে ছুটে বেড়াই। এ আক্ষেপ আমি কোথায় রাখব৷ জীবনের কতটা বছর আমি গাফেল ছিলাম। তবুও স্বস্তি এটা ভেবে যে, এত কিছুর পর আমার রব আমাকে ক্ষমা চাইলে, খাস দিলে তওবা করলে ক্ষমা করে দিবেন। আমি বেশ নীরব হয়েই এসব ভাবতে লাগলাম। এমন সময় মা আবার বলে উঠলেন
- কী রে চুপ হয়ে কী ভাবছিস?
আমি নীরবতা কাটিয়ে উত্তর দিলাম।
- কিছু না মা। তবে মা দেখো মানুষ কখন মারা যায় বলা যায় না। আর আমরা মৃত্যু হবে এটা চিন্তায় করি না। সবসময় গাফেল আর নফরমানী করেই যাচ্ছি। প্রতিটা মুসলিমকে জিজ্ঞেস করলে সবাই বলবে জান্নাতে যেতে চায়। কিন্তু কয়জন এ জান্নাতের জন্য মেহনত করছে বলো? এই যে তুমি আমি, আমাদের জীবনের নিশ্চয়তা কোথায় বলতে পারো? আমাদের জীবনের নিশ্চয়তাও নাই। কী নিয়ে আখিরাতে দাঁড়াবে একবার কি চিন্তা করেছো? আজকে মিনু আন্টি মারা গেছেন কাল আমাদের পালা না, এটা কী করে নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি বলো! আমাদের কি উচিত না দুনিয়ার মোহ ছেড়ে আখিরাতের দিকে দাবিত হওয়া। মা আমরা সবাই জান্নাতের সাথী হতে চাই। শুধু এ দুনিয়ায় না আখিরাতেও একসাথে জান্নাতে থাকতে চাই। মা আর কত রবের দিক থেকে দূরে থাকবে এবার তো একটু রবকে নিয়ে চিন্তা করো। চিন্তা করো তিনিই এ দু জাহানের মালিক। যার কথা ছাড়া একটা পাতাও নড়বে না। যার জন্য আমরা এখনও নিঃশ্বাস নিতে পারছি। এত ভালো আছি তাঁর জন্য কী আমরা একটা বারও শুকরিয়া আদায় করতে পারি না? মা আর কত অন্ধকারে ডুবে থাকবে? আলোর পথ তোমাকে হাতছানি দিচ্ছে চলো আলোকে আলিঙ্গন করি। রবের ভালোবাসায় সিক্ত করি এ অন্তর। দুনিয়ালোভী না বরং আখিরাত লোভী হই। ভালো কাজ দ্বারা আখিরাতটা সুন্দর করি। নাজাত কীভাবে পাব সে চিন্তা করি। জান্নাত কীভাবে পাব সে চিন্তা করি। রবের সন্তুষ্টির জন্য অন্তর কুরবানী করে দিই। তবেই না স্বস্তি মিলবে। মা একবার আল্লাহর দিকে এগিয়ে যাও আল্লাহ তোমার পথ সহজ করে দিবেন। যত কষ্টই হোক না কেন এ পথে তুমি যতটা স্বস্তি পাবে আর কোথাও পাবে না। এ পথে নেই কোনো হতাশা। দুঃখ থাকলেও এ পথে রয়েছে স্বস্তি। মা আর নিজেকে গাফেল রেখো না।
মায়ের চোখগুলো টলমল করছে। এতদিন মাকে অনেক দাওয়াত দিলেও সেটা মায়ের অন্তরে গাঁথেনি। আজকের দাওয়াত আর আন্টির মৃত্যুতে মায়ের অন্তর নরম হয়েছে সেটা মায়ের অশ্রুভরা চোখ দুটোই বলে দিচ্ছে। মা চোখের জলটা মুছতে মুছতে বলল
- তুই তৈরী হয়ে নে আমি আগে তওবার নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিই তারপর একসাথে তোর আন্টিকে দেখতে যাব। এখনই আমি তওবা করব আমার কৃতকর্মের জন্য তারপর বাকি কাজ করব। কারণ পরে তওবা করব এ আশায় বসে থাকলে যদি সে তওবা করার সুযোগ আমি না পাই। আমাদের জীবনের ১ সেকেন্ডের ভরসা নেই।
বলেই মা দৌড়ে তার রুমে গেল। মায়ের এ পরিবর্তন আমাকে সিক্ত করল। আমার এতদিনের মেহনত আল্লাহ কবুল করেছেন। আল্লাহ আমার মাকে হেদায়াত দিয়েছেন। মনে মনে চাচ্ছিলাম আমার বাবাকেও যেন হেদায়াত দেওয়া হয়। ভেতর থেকে বুক ফেটে কান্না আসছে তবে কষ্টের কান্না না, স্বস্তির কান্না। মায়ের এ পরিবর্তন আমাকে কতটা শীতল করেছে আমি জানি।
আমি তৈরী হতে লাগলাম আন্টিকে দেখতে যাওয়ার জন্য। এর মধ্যে মা নামাজ শেষ করে বোরকা পরে মুখ ঢেকে নিকাব পরে আসলেন। মা সাধারণত বোরকা পরলেও নিকাব পরত না। আজকে মাকে নিকাব পরতে দেখে আরও শান্তি লাগছে। আল্লাহর ইশারায় কখন কোন মানুষ পাল্টে যায় বলা যায় না। তাই কখনও কাউকে কটুক্তি করা উচিত না। যে যত খারাপেই হোক না কেন তাকে আমরা ইসলামের দাওয়াত দিব তাকে কটুক্তি করে কিছু বলব না। কারণ এমনও হতে পারে একদিন সে বেদ্বীন ব্যক্তিও আল্লাহর ইশারায় হেদায়াত পেয়ে আমার চেয়ে উত্তম হয়ে যাবে। তাই যারা দ্বীন মানে তাদের মনে কোনো অহংকার রাখা যাবে না আর বেদ্বীনদের খারাপ নজরে দেখা যাবে না। তাদের জন্য অন্তর থেকে দোয়া করতে হবে। তাদের সৎকাজে আদেশ এবং অসৎ কাজে নিষেধ করতে হবে। পারলে প্রতিদিন নরমভাবে দাওয়াত দিতে হবে। একটা সময় আল্লাহই তার মন পরিবর্তন করে দিবেন।
আমাদের মধ্যে অনেক দ্বীনী মানুষেই অহংকার পোষণ করে মনে। ফলে তার জন্য তার সমস্ত আমল নষ্ট হয়ে যায়। দ্বীন নিয়ে কখনও অহংকার করা যাবে না। বরং আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে হবে এবং অন্যদের জন্য দোয়া চাইতে হবে।
বেলা বাজে ১২ টা। মিনু আন্টির বাসায় আসলাম। আন্টিকে গোসল করানো হচ্ছে। কেউ আর মিনু আন্টিকে আন্টি বা নাম বলে সম্বোধন করছে না সবাই বলছে লাশকে গোসল করানো হচ্ছে। ইশ জীবন কেমন যেন ছন্নছাড়া। কিছুক্ষণ আগে যে মানুষ জীবিত ছিল হাসছিল,কথা বলছিল আর এখনই সে মানুষটা লাশ হয়ে নিথর হয়ে পড়ে আছে। আমি আর মা একটা রুমে গিয়ে বসলাম। সেখানে সবাই বসে আছে। আমি বসে বসে চোখের জল ফেলছিলাম আর মিনু আন্টির জন্য দোয়া করছিলাম। সে সাথে নিজের মৃত্যুর কথা স্মরণ করে আঁৎকে উঠছিলাম। কলিজা দুভাগ হয়ে যাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। কান্না না চাইতেও চোখ দিয়ে বেয়ে পড়ছে। আন্টির আত্মার মাগফিরাত কামনা করতে লাগলাম। সেখানে কিছুক্ষণ থেকে আন্টিকে শেষ দেখা দেখে বাসায় আসলাম।
বাসায় আসার পরও মনটা বেশ ছন্নছাড়া লাগছে। মাও আজ বেশ অস্থির। মা,মেয়ে একসাথেই নামাজে দাঁড়ালাম। একসাথেই আল্লাহর কাছে দুহাত তুলে মনের যত চাওয়া সব পেশ করলাম। এ দিনটার স্বপ্নই দেখছিলাম। আমার মাকে আল্লাহ তার প্রিয় বান্দা যেন বানায় সে দোয়ায় করলাম। মনে মনে আল্লাহর কাছে উত্তম জোরা চাইলাম যাতে করে তার সাথে দুহাত তুলে আল্লাহর কাছে চাইতে পারি। আমি জানি আল্লাহ আমার এ নেক চাওয়া পূরণ করবেন। আর আমি সে অপেক্ষায় আছি।
রাত বাজে ১১ টা বাবা এখনও বাসায় ফিরছে না। কয়েকবার কল দিলাম বাবার ফোনটা বন্ধ। বেশ চিন্তা হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি অফিস থেকে বের হয়েছে অনেক আগে। তবে বাবা এখন কোথায় সেটাই বুঝতে পারছি না। প্রায় ঘন্টাখানেক মা আর আমি অপেক্ষা করতে করতে পার করলাম। কয়েকবার আল্লাহর কাছে নামাজ পড়ে সাহায্য চাইলাম।
ঠিক ১২ টা ২৭ এ বাবা বাসায় আসলেন। বাবার সাদা শার্টটা রক্তে লাল হয়ে আছে। মা চিৎকার দিয়ে বলল
- কী হয়েছে তোমার?
মায়ের কথা শুনে বাবা বিমর্ষ গলায় জবাব দিলেন
গল্পের : নাম পার্সেল
লেখিকা : শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব-১৬/শেষ পর্ব
মায়ের কথা শুনে বাবা বিমর্ষ গলায় জবাব দিল
- রাস্তায় এক্সিডেন্ট হয়েছে। আমার কলিগ মারা গেছে। তার শরীরের রক্তই শার্টে লেগে আছে। মিমির মা মানুষের মৃত্যু কখন আসে বলা যায় না। একটু আগে কথা বললাম আর এখনই সে নাই। কলিজাটা হুহু করতেছে। এ দুনিয়ার কোনো ভরসা নাই। আখিরাতমুখী হতে হবে। মরীচিকার পেছনে ছুটে লাভ নেই। আমার কলিগের মৃত্যুটা যেন আমাকে হেদায়াত দিয়ে গেল। জলদি গরম পানি করো। গোসল করে আগে তওবার নামাজ পড়ব। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইব তারপর অন্য কাজ করব। কতটা গাফেল ছিলাম। জানি না আল্লাহ ক্ষমা করবেন কি'না।
বাবার মুখ থেকে কথাটা কেড়ে নিয়ে বললাম
- বাবা আল্লাহর মতো দয়াবান আর কেউ না। এত নফরমানীর পরও আল্লাহ ওয়াদা করেছেন তাঁর বান্দা তাঁর কাছে ক্ষমা চাইলে ক্ষমা করে দিবেন। বাবা মন থেকে ক্ষমা চাও। আল্লাহর নিকট হাত তুলে চোখের পানি জড়াও। নিশ্চয় আল্লাহ ফিরিয়ে দিবেন না।
বাবা কান্না করে দিয়ে বললেন
- ঐদিন না বুঝলেও আজকে বুঝতেছি কেন তুই এমন করেছিলি। মারে হেদায়াত অনেক বড় পাওয়া আল্লাহ আমায় দিয়েছেন। শুকরিয়া আদায় জরুরি।
এর মধ্যেই মা পানি নিয়ে আসলো। বাবা সরাসরি চলে গেল ওয়াশরুমে। গরমেও গরম পানি দিয়ে গোসল করার একটা বদ অভ্যাস বাবার আছে। তাই এ গরমেও গরম পানি দিয়ে গোসল করে বাবা নামাজে দাঁড়াল। কীভাবে যেন আল্লাহ সব কিছু সুন্দর করে দিচ্ছেন। সত্যিই আল্লাহর পরিকল্পনা শ্রেষ্ঠ পরিকল্পনা। আজকে বাবার এ পরিবর্তন আমাকে ভীষণ ভাবে প্রশান্তি দিচ্ছে। এত দ্রূত যে সব দোয়া আল্লাহ কবুল করবেন বুঝতে পারিনি। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে তবে এ চোখের পানিতে পরম শান্তি রয়েছে,রয়েছে আনন্দ আর আনন্দ।
সেদিনের দিনটা ভীষণ ভালো কেটেছে। পরদিন সকাল বেলা নামাজ পড়তে উঠলাম। আজকের ফজর নামাজ পড়তে উঠে চোখটা যেন জুড়িয়ে গেল। মা, বাবাও উঠেছে নামাজ পড়তে। আমি নামাজ পড়ে মোনাজাতে শুকরিয়া আদায় করলাম। কতটা শান্তি যে লাগছিল বলে বুঝাতে পারব না।
সেদিনের সারাটাদিন খুব ভালো কেটেছিল। সাহিলকে মনে পড়লেও এতটা খারাপ লাগে না আগের মতো। সবকিছুই বেশ সুন্দর করে যেন চলতে লাগল।
বাইরে মৃদু রোদ। জানালার ফাঁক দিয়ে যেন রোদ উঁকি দিচ্ছে ঘরে। জানালাটা খুলে দিতেই রোদটা যেন মুখ আলিঙ্গন করে নিল। আমি চোখ বন্ধ করে রোদটা উপভোগ করতে লাগলাম। এর মধ্যেই মা রুমে প্রবেশ করল। আমার কাছে এসে বসতেই আমি চোখ খোলে বললাম
- কিছু বলবে মা?
মা হালকা হেসে বলল
- তোর আন্টিকে মারা যাওয়ার দিন দেখতে গিয়েছিলি মনে আছে?
- হ্যাঁ মা। কিন্তু কেন?
- সেখানে তোকে একজন ভদ্র মহিলা তার ছেলের জন্য পছন্দ করেছেন। তারাও এমন মেয়ে চাচ্ছে যেমনটা তুই। আর উনার ছেলেও নাকি তোর মতো মেয়েই চাচ্ছে। তোর রাহেলা আন্টি ছেলের মাকে নিয়ে আসবে। আর ছেলে আসবে দেখতে। তারা একদম ইসলামি রিতী অনুযায়ী দেখে যাবেন। আমি কি আসতে বলব? তোর কোনো আপত্তি নেই তো?
হালকা গলায় বললাম
- আল্লাহ ভালো জানেন। আসতে চাচ্ছেন আসতে বলো। দেখে যদি সব ঠিক মনে হয় তাহলে ইস্তেখারা পড়ব। তারপর সিদ্ধান্ত নিব। তারা কখন আসবেন?
- আমি ফোন দিলে একটু পরেই আসবেন।
- সমস্যা নেই আসুক। আমি তৈরী হয়ে নিচ্ছি।
মা হাসতে হাসতে বের হয়ে গেলেন। মা বের হওয়ার পর ভেতরটায় হালকা খারাপ লাগা অনুভব হলো। হুট করেই সাহিলকে মনে পড়ল। আমি নিজের আবেগ দমন করলাম। কারণ এটা শয়তানের ওয়াসওয়াসাও হতে পারে। সামনে যা আসছে তা গ্রহণ করায় শ্রেয়। জানি না কে সে ভদ্রলোক আমাকে দেখতে আসবেন। তবুও সালাতুল হাজত নামাজ পড়ে আল্লাহকে মনের সব কথা ব্যাক্ত করলাম। তারপর তৈরী হলাম। একটু পরেই উনারা আসবেন। কারণ উনারা এখন রাহেলা আন্টির বাসায় আছেন। আর রাহেলা আন্টির বাসা আমাদের বাসার সাথেই।
আসরের নামাজের পর পরই তারা আসলেন। পাত্র আর পাত্রের মা এসেছেন দেখতে। আমি গেলাম তাদের সামনে। তাদের সামনে যেতেই আমার বুকের ভেতর ধুক করে উঠল। সাহিল আর তার মা বসে আছে। সাহিলের পরিবার্তনটা আমাকে ভীষণভাবে ভাবাচ্ছে। তার দাঁড়ি গুলো আরও লম্বা হয়েছে। সুন্নতি লেবাস নিয়ে সামনে বসে আছে। আমি কথা বলার জন্য যেন কোনো বাক্য পাচ্ছিলাম না। এর আগে সাহিলের বাবা মায়ের সাথে বিয়ের বিষয়টা অন্য মাধ্যমে হয়ে স্থগিত হয়ে গিয়েছিল। আন্টি আমাকে ছবিতে দেখলেও সামনাসামনি কখনও দেখিনি। সেদিন সামনাসামনি দেখে আন্টির আমাকে ভীষণ পছন্দ হয়। পরে জানতে পারল আমরা রাহেলা আন্টির পরিচিত। তাই রাহেলা আন্টির মাধ্যমে আমাকে দেখতে আসে। আমার মা,বাবাও জানতে পারেনি উনারাই আসবে। কারণ রাহেলা আন্টি বিষয়টা ঐভাবে ভেঙে বলেনি। আমার শরীর কাঁপছে। আমি সামনে বসলাম। আন্টি আমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করলেন আমি উত্তর দিলাম। তারপর সাহিলের সাথে কথা বলার সুযোগ দিলেন। সাহিল আমার দিকে হালকা তাকাল তারপর বলল
- আল্লাহর কাছে আমি আপনাকে অনেক চেয়েছি। তবে এভাবে যে এত দ্রূত মিলিয়ে দিবেন বুঝতে পারিনি। সেদিন যে ছেলেটা আপনাকে ড্রপ করে আমার বাসার সামনে দিয়ে গিয়েছিল সে আমার বন্ধু ছিল। সেদিন ইচ্ছা করেই তাকে এমন উত্তর দিয়েছিলাম। আর সে আমার কথামতোই আপনাকে ড্রপ করে দেয়। এরপর সকালে যে ছেলেটা আপনাকে সোহার বাসায় দিয়ে যায় সেও আমার ফ্রেন্ড ছিল। তাই ভাড়া কম বলার পরও আপনাকে ড্রপ করে দিয়ে যায়। আমি আপনাকে সেদিন ছেড়ে যাইনি। তবে এটা বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলাম আপনার রাগটা কমানো উচিত। পার্সেলটা আমিই পাঠিয়েছিলাম। আর আল্লাহর কাছে আপনার হেদায়াত কামনা করেছি। আর সেদিন আপনার নামে যে পার্সেলটা এসেছিল সেজন্য আমাকে যে কল করা হয়েছিল সেটাও আমার ফ্রেন্ড ছিল। তাকে মেসেজ দিয়ে বলেছিলাম এমনটা বলার জন্য। এই সব কিছু একটা পরিকল্পনা ছিল। আল্লাহ আমার চাওয়া পূরণ করেছেন। আপনাকে হেদায়াত দিয়েছেন। আপনার সাথে মাঝখানে ঝামেলা করে কথা বলা বন্ধ না করলে আমাদের সম্পর্কটা হারামের দিকে চলে যেত। আমাদের বিয়েটা দুই পরিবার স্থগিত রাখলেও আমাদের কথা জারি ছিল। আর সে কথায় অল্প অল্প করে আমাদেরকে হারামের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। আমি যদি সেখানে থেমে না পড়তাম তাহলে বিষয়টা আমাদের দুজনকে জাহান্নামের দিকে নিত। তাই হয়তো একটু ঝামেলা করে দূরে সরতে হয়েছে। কারণ এছাড়া দুজনের মধ্যে দূরত্ব আনার উপায় ছিল না। আমি মন থেকে আপনার আমার হেদায়াত কামনা করেছি। আপনার প্রতিটা পরিবর্তন আমি লক্ষ করেছি। ভেবেছিলাম কিছুদিনের মধ্যে বাবা,মা কে বলে আপনার বাসায় পুনরায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাব৷ কিন্তু আল্লাহর পরিকল্পনা ছিল আরও সুন্দর তিনি নিজেই এর আগে আপনার সামনে আমাকে আনার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। নাহয় মৃত বাড়িতে আপনি আর মা যেতেন না। আল্লাহর পরিকল্পনা ছিল বলেই এমনটা হয়েছে। ঐ আন্টি রাহেলা আন্টির আত্মীয়। তার সূত্রেই ঐ আন্টিকে মা চিনত। কিন্তু অনেকদিন যোগাযোগ ছিল না৷ তবে মৃত্যুর কথা শুনে মা না এসে পারেনি। আর ঘটনাক্রমে সেখানে আপনি যান আর আপনাকে ঘরে নিকাব ছাড়া আমার মা দেখে পছন্দ করে আর সেখান থেকেই এখানে আসা। আমি যদিও আসার আগে জানতাম আপনার বাসায় আসতেছি। আপনি জানতে কি'না জানি না।
আমি স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম
- আমি জানলে হয়তো বুঝতেই পারতাম না আল্লাহর পরিকল্পনা এত সুন্দর। আমি ভেবে নিয়েছিলাম আল্লাহ আমার জন্য যা বরাদ্ধ করে রেখেছে তাই হবে। তাই বলে আমার প্রিয় জিনিসটাই আমাকে এভাবে ফিরিয়ে দিবে বুঝতে পারিনি। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য।
সাহিলের সাথে আমার কথার সমাপ্তি ঘটল। সাহিলের মা আর সাহিল দেখার পর্ব শেষ করে চলে গেল। সেদিন রাতে তারা আমার বাবা, মাকে জানাল আমাকে তাদের অনেক পছন্দ হয়েছে। আমার মা,বাবাও আর অমত করেনি। এ সপ্তাহের মধ্যেই আমাদের বিয়ের তারিখ ঠিক করা হয় এবং পুরোপুরি সুন্নতি তরীকা অনুাযায়ী বিয়ে হয়।
বিয়ে শেষে আমাকে তুলে আনা হয় শ্বশুর বাড়িতে। সকল কাজ শেষে এখন একা বসে আছি উনার অপেক্ষায়। নীল শাড়ি পরেছি। চুলগুলো খোপা করেছি। খোপায় বেলি ফুলের মালা দিয়েছি। চোখে গাঢ় করে কাজল। ঠোঁটে লিপস্টিকের ছঁটা। বেশ পরিপাটি হয়েই বসে আছি উনার নয়ন জুড়াব তাই। এ মুহূর্তেই সাহিলের আগমন। তিনি আমার কাছে আসলেন। একে অপরকে সালাম দিলাম। তারপর দু রাকাত শুকরিয়ার নামাজ আদায় করলাম। নামাজ শেষে দুজন দুজনের দিকে তাকালাম। পবিত্র এ চাওয়ায় শুধু সওয়াবেই লেখা হচ্ছে। আমার চোখ দিয়ে আনন্দ অশ্রু পড়ছে। তিনি চোখটা মুছে দিয়ে বললেন
- বলো তো আমাকে প্রথমেই পেয়ে গেলে ভালো হত নাকি এত দেরি করে পেয়ে ভালো হয়েছে?
আমি উনার বুকে মাথাটা ঠেঁক দিয়ে বললাম
- সবুরের ফল মিষ্টি হয়। নিশ্চয় কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে। রয়েছে উত্তম প্রতিদান। আল্লাহ কখনও তার বান্দার নেক চাওয়া অপূর্ণ রাখেন না। আপনাকে দেরি করে না পেলে হয়তো এ সুন্দর জীবনের আনন্দ উপভোগ করতে পারতাম না। আল্লাহর পরিকল্পনা উত্তম পরিকল্পনা।
সাহিল শুধু আমাকে জোরে জড়িয়ে ধরে তার সাথে মিশিয়ে রাখল। দুজন দুজনের নিঃশ্বাসের শব্দ উপভোগ করতে লাগলাম। একেই বলে ভালোবাসার পবিত্র বন্ধন।
0 মন্তব্যসমূহ