গল্পের নাম রাত
লেখিকা শারমিন আঁচল নিপা
আমাদের গ্রামের পাশ ঘেষেই নদী। দাদা প্রতিদিন রাতে সেখানে যেতেন মাছ ধরতে। আমার বয়স তখন অল্প। একদিন আমি বায়না করে বসলাম আমিও মাছ ধরতে যাব দাদার সাথে। কিন্তু দাদা কোনোভাবেই নিতে রাজি হলেন না। এদিকে আমি জেদ চেপেই বসলাম যাবই যাব। তবুও দাদা রাজি হলেন না। তাই সেদিন চিন্তা করলাম দাদার পিছু পিছু লুকিয়ে যাব মাছ ধরতে। দাদা পাশের রুমেই থাকেন। আমি অধীর আগ্রহে না ঘুমিয়ে ঘাপটি মেরে শুয়ে আছি দাদা কখন ঘরের কপাট খুলবে। দাদা কপাট খুললেই আমিও আস্তে করে বের হয়ে যাব। মা ততক্ষণে বিভোর ঘুমে আচ্ছন্ন। বাবা থাকেন শহরে। মা আর আমিই এ ঘরে থাকি। তাই মাকে ফাঁকি দিয়ে বের হতে আমার তেমন বেগ পোহাতে হবে না, জানি।
হঠাৎ কপাট খুলার আওয়াজ পেলাম। আমি এবার নড়েচড়ে বসলাম। বুঝতে পারলাম দাদা মাছ ধরতে নদীতে যাবেন। তাই ধীর পায়ে আমিও ঘরের কপাট আস্তে করে খোলে লক্ষ্য করলাম দাদা বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন। আমিও এবার দাদার পিছু নিলাম। কিন্তু অবাক হলাম এটা দেখে দাদা নদীর দিকে এগিয়ে না গিয়ে, জঙ্গলের দিকে এগুচ্ছে। বাড়ির পাশের জঙ্গলটাকে বলে মইরা জঙ্গল। কেন এ নামকরণ করা হয়েছে জানা নেই। তবে এ জঙ্গলের কূল কিনারা নেই। কোথায় তার সমাপ্তি সেটা যেন কেউ বলতে নারাজ।
ভাবতে লাগলাম দাদা কী ভুল করে জঙ্গলের দিকে এগুচ্ছেন? আমি কি তাকে পিছু ডাকব? পরক্ষণেই আবার ভাবতে লাগলাম দাদাকে ডাকলে যদি দাদা রেগে গিয়ে আমাকে বাড়িতে দিয়ে আসেন। তাহলে তো আমি মাছ ধরা দেখতে পারব না। বয়স অল্প তাই বুঝও ছিল অল্প। কিছুটা ভয়ও লাগছিল। উত্তরের ঠান্ডা বাতাস ধেয়ে আসছিল। শরীরে সে বাতাস লেগে মাঝে মাঝে কাটা দিয়ে উঠছে৷ গরমের দিনেও শীতের আবেশ পাচ্ছিলাম।
এদিকে দাদা জঙ্গলের ভেতর দিকে যেতে লাগল। আমার কিছুটা ভয়ও লাগছিল। তবুও দাদা আছেন এ সাহসে জঙ্গলের দিকে এগুতে লাগলাম। দাদা জঙ্গলের একটু সামনে এগুতেই লক্ষ্য করলাম একটা কালো কুচকুচে নাম না জানা পাখি এসে অদ্ভুত সুরে ডাকছে। কচিমনে এটা একবার জানান দিচ্ছিল হয়তো এটা দাদা না। কোনো শয়তানের পাল্লায় পড়েছি। তাই মুখস্ত করা যত ধরণের দোয়া দূরুদ আছে পড়তে লাগলাম।
একটা পর্যায়ে বুঝতে পারলাম। এটা কোনো শয়তান না, এটা আমার দাদায়। কিন্তু দাদার এমন অদ্ভূত আচরণ দেখে আমি বিস্মিত হতে লাগলাম। দাদা আরও গভীর জঙ্গলের দিকে এগুতে লাগলেন। আমিও লুকিয়ে দাদার পিছু নিলাম। দাদা কিছুদূর এগুতেই থেমে গেলেন। আমিও দূরে দাঁড়িয়ে দাদাকে অবলোকন করতে লাগলাম। দাদা যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন সেখানে যেন পূর্ণিমা এসে ঢলে পড়েছে। জঙ্গলের এ জায়গাটা বেশ ফাঁকা হওয়ায় চাঁদের আলো এমন ত্যাজী হয়ে পড়েছে যে, দিনের মতো আলোকিত লাগছে। কথা সেটা নয় কথা হচ্ছে দাদার অদ্ভুত কিছু আচরণে আমি ভয় পেতে লাগলাম। আমি লক্ষ্য করলাম সেখানে শুধু, দাদা দাঁড়িয়ে না, আমার মৃত ফুফুও দাঁড়িয়ে আছে।
আমার বুকের ভেতর কাঁপতে লাগল। তবে ঘটনা দেখার উদ্বেগ ও জাগল। দাদা ফুফুর দিকে তাকিয়ে কাঁদতে লাগল। তবে ফুফু হাসছিলেন। গলা ফাটিয়ে হাসছিলেন। ফুফুর হাসিতে যেন আমার মাথা ধরে গেল।
ফুফু মারা গেছেন আত্মঘাতিতে। কেউ বলে সুইসাইড করেছে কেউ বলে মেরে ফেলেছে। দু পক্ষের দু ধরণের কথায় ফুফুর শরীরটাকে ময়না তদন্তের নাম করে ক্ষত বিক্ষত করা হয়েছিল। আর তারপর প্রমাণ হয় ফুফু আত্মহত্যা করেন। এরপর ফুফুকে মাটি দেওয়া হয়। মাটি দেওয়ার পর প্রায় সপ্তাহ খানেক ফুফুর কবর থেকে কান্নার আওয়াজ আসত। সপ্তাহখানেক এমন হওয়ার পর হুজুর এসে দোয়া পড়ে যান। এরপর সব ঠিক হয়ে যায়।
আজকে হঠাৎ ফুফুকে এভাবে দেখব ভাবতে পারিনি। ভাবতে ভাবতেই দাদার দিকে তাকাতেই আমার কলিজা নড়ে গেল।
দাদাকে খেয়াল করলাম পরিধান করা ফতোয়ার ছোটো পকেট থেকে একটা সাপ বের করলো। সাপটা প্রশস্তে বেশ বড়ো নয়। একদম ক্ষীণক্ষীনে চিকন। কিন্তু লম্বায় অনেক বড়ো। দেখতে অনেকটা এখনের যুগের ডিসের তারের মতো। সাপের রঙটা ছিল সবুজ। মাথাটা আবার কালো রঙ করা। বুকের ভেতরটায় এমন দৃশ্য দেখে কম্পন দিতে লাগল। শরীরটা কাঁপতেও লাগল। এদিকে শরীর যেমন ভয়ে কাঁপছে। অপরদিকে জঙ্গলের দক্ষিণের বাতাসেও শরীর শীতে কাঁপছে। ভয়ে আর শীতে শরীর ঠান্ডা হয়ে জমাট বেঁধে গেছে। তবুও আমি পিছু হটলাম না। সামনের দিকে তাকিয়ে দাদার কাজকর্ম গুলো অবলোকন করতে লাগলাম।
দাদা সাপটা বের করেই ফুফুর দিকে এগিয়ে দিল। এগিয়ে দিতেই ফুফুর সারা শরীর সাপটা পেঁচিয়ে ধরে মুখের দিকে কামড়াতে লাগল। সাপের কামড়ের বিষ কতটা ত্যাজী ছিল জানি না। তবে ফুফুর চিৎকারে পুরো জঙ্গলের ভয়ানক প্রাণীগুলোও হয়তো চুপ হয়ে গিয়েছিল। এদিকে আমি এতই ভয় পেলাম যে আমার মূত্র বিসর্জন হয়ে গেল। এরকম ভয় এর আগে কখনও পেয়েছি কি'না জানি না। তবে এরকম শাস্তির কথা জাহান্নামীদের হবে পড়েছিলাম।
কিন্তু এদিকে এটাই মিলাতে পারছিলাম না। ফুফু কীভাবে এখানে আসলো? কেনই বা দাদা এত রাতে এখানে আসলো? দাদা সাপটায় বা কোথায় পেল? দাদার পকেটে সবসময় সাপটা থাকলে, কেন কোনোদিন সাপটা দেখিনি। সব গুলো প্রশ্নই যেন মাথায় গিজগিজ করতে লাগল। আর এদিকে আমার শরীর বরফের থেকে ঠান্ডা হয়ে গেল।
হঠাৎ করে সাপটা কামড়াতে কামড়াতে মরে গেল। এদিকে সাপটা মরে যাওয়াতে ফুফু চুপ হয়ে গেল। সারা শরীরটা ফুফুর সাপের বিষে নীল হয়ে আছে। জিহ্বাটা বের করে নিজের হাত দিয়েই টেনে ধরল সে। জিহ্বাটাও কালো হয়ে গেছে। তাকে দেখে বুঝা যাচ্ছে না, এতক্ষণ সে এখানে আর্তনাদ করছিল।
আমি বরফের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে শুধু ঘটনা দেখছিলাম। ফুফু এবার কী যেন দাদার কানে ফিসফিস করে বলল। দাদা কথাটা শুনে পেছন ফিরে তাকাল। ভেবেছিলাম দাদা হয়তো বুঝে গেছে আমি পেছনে দাঁড়িয়ে আছি। তাই ভয়ে কাঁপতে লাগলাম। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে দাদা পেছন ফিরে আমার দিকে তাকিয়েও কোনো ভ্রূক্ষেপ করলো না। দেখে মনে হচ্ছে উনি উনার মধ্যে নেই। এদিকে দাদাকে লক্ষ্য করতে গিয়ে ফুফুকে হারিয়ে ফেললাম। ফুফু কোনদিকে গেল সেটা লক্ষ্য করতে পারেনি। এদিকে দাদা একদম আমার পাশ কাটিয়ে গেল, তবুও আমার দিকে তার কোনে নজর পড়ল না। মনে হচ্ছে অন্য কেউ তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। আমার ভয়টা আরও বাড়তে লাগল।
দাদা এগিয়ে যাচ্ছিল আমিও দাদার পিছু নিলাম আবার। দাদা বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছে। আমিও দাদার পিছে পিছে বাড়ির দিকে এগুতে লাগলাম। একটা পর্যায়ে দাদা বাড়িতে চলে আসলো। আর নিজের ঘরে প্রবেশ করলেন।
আমিও নিজেকে সামলে হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে প্রবেশ করলাম। মা আমাকে হাঁপাতে দেখে ঘুম থেকে উঠে অবাক হয়ে তাকালেন। আমার শরীর ভেজা। বিশ্রি একটা গন্ধ আসতে লাগল শরীর থেকে।
মা তড়িঘড়ি করে উঠলেন। আমাকে ধরে জিজ্ঞেস করলেন
"কী হয়েছে?"
আমি সবটা চেপে গেলাম। গ্রাম হওয়ায় ওয়াশরুম টা ঘরের বাইরে ছিল। তাই মাকে উত্তর দিলাম
"ওয়াশরুমে গিয়েছিলাম মা। আসতে গিয়ে ভয় পেয়ে যাই। তাই কাপড় নষ্ট করে ফেলি।"
মা আমার কথা শুনে কিছুটা অবাক হলেন। যে আমি মাকে ছাড়া কখনও ওয়াশরুমে যাইনি। সে আমি একা একা ওয়াশ রুমে গেলাম। তবুও মা নিজেকে সামলে নিলেন। বাইরে গিয়ে গরম পানি করে আমাকে গোসল করালেন। তারপর সূরা পড়ে ফুক দিয়ে বিছানায় উঠালেন। ততক্ষণে ফজরের আযান পড়তে লাগল। আমি আযান শুনেই নামাজ পড়তে লাগলাম।
নামাজ শেষে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। সারা শরীর আমার কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসলো। যতবার চোখ বন্ধ করছিলাম ততবারেই আমার দাদা আর ফুফুর চেহারা ভেসে আসছিল। অনেক চেষ্টার পর দোয়া পড়তে পড়তে আমার চোখে ঘুম আসলো।
পরদিন ঘুম থেকে উঠলাম সকাল ১১ টায়। উঠেই আমি গতরাতের কথা ভাবতে লাগলামি। ঘর থেকে বের হয়েই সরাসরি দাদার রুমে গেলাম।
কিন্তু দাদাকে একদম স্বাভাবিক লাগছে। কোনোরকম পরিবর্তন দাদার মধ্যে লক্ষ্য করলাম না। প্রতিদিন দাদা যেমন থাকেন আজকেও ঠিক তেমনি লাগছে। কিন্তু ভাববার বিষয় হলো মা প্রতিদিন সকালে মাছ কুটতে বসে। আজকেও তার ব্যতিক্রম হলো না। আজকে মা মাছ কোথায় পেল সেটায় ভাবাতে লাগলাম। তাই আমি দাদার রুম থেকে বের হয়ে সরাসরি মায়ের কাছে গেলাম। মাকে জিজ্ঞেস করলাম
"মা তুমি মাছ কোথায় পেয়েছো?"
মায়ের সোজাসাপটা উত্তর
"তোর দাদা নিয়ে এসেছে। প্রতিদিন তো তোর দাদায় রাতে মাছ ধরে আনে। দেখ গতকাল একটা বড়ো বোয়াল ধরেছে তোর দাদা। আজকে এটাই রান্না করব।"
মায়ের কথা শুনে আমার বুক আবারও কেঁপে উঠল। দাদা তো কাল মাছ ধরতে যায়নি। তাহলে মাছ কোথায় পেল দাদা! এ মাছগুলো কীভাবে আসলো? এগুলো কী সত্যি কোনো মাছ? ভাবনা যেন আমাকে ছাড়ছেই না। আমি পুনরায় দাদার রুমে গেলাম। দাদাকে কিছুই বুঝতে না দিয়ে হালকা গলায় জিজ্ঞেস করলাম
"এই যে দাদা প্রতিদিন এত কষ্ট করে মাছ ধরো, তোমার কষ্ট হয় না।"
"কষ্ট কেন হবে রে, তোর জন্য নিয়ে আসি। এই যে তুই মজা করে খাস আমার খুব ভালো লাগে।"
দাদার মধ্যে কোনোরকম পরিবর্তন পেলাম না। তবে আমিও নাছোরবান্দা এর রহস্য তো আমি উদঘাটন করবই। তাই ইচ্ছা করেই দাদাকে বললাম
"দাদা জানো আমার মনটা অনেক খারাপ।"
"কী হয়েছে তোর?"
"জানো দাদা গতকাল ফুফুকে স্বপ্ন দেখেছি। দেখার পর থেকেই খারাপ লাগছে ভীষণ। আচ্ছা দাদা ফুফু কী সত্যিই আত্মহত্যা করেছিল? নাকি কেউ ফুফুকে মেরে দিয়েছে? কী হয়েছিল ফুফুর সাথে? মরার পরেই বা ফুফুর কবর থেকে কান্নার শব্দ কেন আসতেছিল? ফুফু কী কোনো বড়ো গুনাহ করেছিল?
আমার কথা শুনে দাদা একটু চমকে গেলেন। এতদিন পর এরকম কথা দাদা আশা করেননি। দাদার এ নিয়ে কথা বলারও হয়তো ইচ্ছে নেই। তাই তিনি কথার প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন
"যা দেখেছো ভালো দেখেছো। খারাপ স্বপ্নের ব্যখ্যা দিতে হয় না। আবার শুনতেও হয় না। অতীত কখনও ঘাটতে নেই। যাও গিয়ে নাস্তা করে নাও। গতকাল নাকি তুমি এমনিতেই ভয় পেয়েছো। এখন আবার এগুলো নিয়ে কথা বললে আরও ভয় পাবে। আর আমি একটু বাজারে যাই। আজকে বাজারে অনেক কাজ আছে।"
কথাগুলো বলেই দাদা উঠে দাঁড়ালেন। আমি আর কথা বাড়ালাম না। সোজা ঘর থেকে বের হয়ে আসলাম। কিন্তু আমার মন না চায়তেও গত রাতের ঘটনাতেই পড়ে আছে। তাই চিন্তা করলাম দাদা বের হলেই দাদার ঘরটা চিরুনি তল্লাশি করব। এতে যদি দাদার ঘরে কিছু পাওয়া যায়। হতে পারে দাদা কালো জাদু করে, নাহয় অন্য কোনো রহস্য। এ রহস্য আমাকে উদঘাটন করতেই হবে।
বেলা ১২ টা বাজে। মা নাস্তা খাওয়ার জন্য অনেক বকাবকি করছে। তবে আমার মন নাস্তা খাওয়ায় একদম বসলো না। আমি নজর রাখছি দাদা কখন বের হবে সেদিকে। কারণ দাদা বের হলেই কেবল আমি দাদার ঘর তল্লাশি করতে পারব।
ঠিক ১২ টা ৩০ এ দাদা বের হলেন বাজারের উদ্দেশ্যে। দাদা বের হতেই আমি আস্তে করে দাদার ঘরে ঢুকে পড়লাম। পুরো ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগলাম। তবে এমন কিছুই পেলাম না যাতে করে রহস্য উদঘাটন হবে৷ আমি বেশ হতাশ হয়েই বসে গেলাম। মনটা বিষন্ন লাগছে৷ ঠিক তেমন সময় আমার হাতের ধাক্কা লেগে টেবিলের নীচ থেকে একটা ডায়েরি পড়ল।
ডায়েরিটা দেখে কেন জানি না মনে হলো আমি যা খুঁজতেছি সেটা পেয়ে গেছি। তাই বেশ ব্যস্ত হয়েই ডায়েরিটা হাতে নিলাম। সেখানেই বসেই ডায়েরিটা খুলে পড়তে লাগলাম। এতে বুঝতে পারলাম দাদা কোনো কালোজাদুর সাথে সম্পৃক্ত না। এটুকু আশ্বস্ত হতে পেরে আমার ভীষণ ভালো লাগছে। ডায়েরিটা পড়ে বুঝতে পারলাম দাদার সবচেয়ে আদরের সন্তান ছিল ফুফু। ফুফুকে তিনি অনেক স্নেহ করতেন। আর বেশির ভাগ লেখা ফুফুকে নিয়েই লেখা। আর এরপর লেখা ছিল দাদীকে নিয়ে। আমাদের নিয়েও লেখা তবে টুকটাক। ফুফুর কতগুলো ছবি ডায়েরিতে রাখা। বুঝতে পারছিলাম ফুফুর মৃত্যুতে দাদা অনেক কষ্ট পেয়েছিলেন। তেমনি দাদী চলে যাওয়ার পরও দাদা ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলেন। ডায়েরিতে সে বিষয়গুলোই লিপিবদ্ধ করা ছিল। তবে শেষ পাতাগুলো পড়ে রিতীমতো আমার শরীর ঘামতে লাগল।
ডায়েরির শেষ পাতাগুলো দাদা ফুফুকে নিয়ে লিখেছেন। দাদার লেখার সারমর্ম এই দাঁড়ায় যে,
দাদা তার সন্তানদের মধ্যে ফুফুকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। ছোটো থেকে ফুফুকে সবচেয়ে বেশি প্রায়োরিটি দিয়ে তিনি বড়ো করেছেন। দাদার কলিজা বলা চলে ফুফু। বয়সের সাথে সাথে ফুফুও বড়ো হয়। বড়ো হওয়ার একটা পর্যায়ে ফুফু প্রেমে পড়ে। দাদাও অবশ্য বিষয়টা খুব ভালোভাবে মেনে নিয়েছিলেন। ফুফুর খুশির জন্য দাদা আকাশের চাঁদটা ধরে আনতে প্রস্তুত।
সময় যায় ফুফুর সম্পর্কের রঙ বদলায়। একটা পর্যায়ে ফুফু বুঝতে পারেন উনার ভালোবাসা কেবল একতরফা। তিনি যাকে ভালোবাসেন সে ভদ্রলোক ভালোবাসেন অন্য কাউকে। বিষয়টি ফুফু একেবারেই মানতে পারছিলেন না। দাদাকে বলার পর দাদা ফুফুকে অনেক যত্ন করে বুঝান। কিন্তু নাছোরবান্দা ফুফু একদমই মানতে পারছেন না বিষয়টি। ছোটোবেলা থেকে যা চেয়েছেন তা পেয়েছেন তিনি। তাই হুট করে না পাওয়ার ধাক্কাটা তাকে ভীষণভাবে আঘাত করছে৷
ফুফু অনেক চেষ্টা করল তার প্রিয়তমকে তার করার জন্য। সব চেষ্টায় যেন ব্যর্থ হলো। অবশেষে ফুফু আশ্রয় নিল কালোজাদুর। প্রিয়তমকে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন তিনি। কালোজাদুর কবলে পড়ে সব ধরণের অন্যায় করতে লাগলেন। শয়তানকে খুশি করার একটা সময় গিয়ে, একটা নবজাতককেও বলি দিলেন।
বিষয়টি দাদা যখন বুঝতে পারলেন তখন দাদার আর কিছু করার ছিল না। ফুফুকে এই বিপথ থেকে ফিরিয়ে আনার অনেক চেষ্টা করেই তিনি ব্যর্থ হলেন। এদিকে ফুফু শয়তানকে খুশি করতে আরও মরিয়া হয়ে গেলেন। শয়তানকে খুশি করার জন্য তিনি আমাকে বলি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। বিষয়টি দাদা বুঝতে পেরে ফুফুকে নিজ হাতে হত্যা করলেন। ফুফু তার কলিজার টুকরা ছিলেন। নিজের সন্তানকে মেরে যেন তিনি পাথর হয়ে গেলেন।
এদিকে সবাই ভাবলেন ফুফু আত্মঘাতিকে মারা গেছেন। কিন্তু সত্য এটাই যে ফুফুকে দাদা হত্যা করেছেন। মৃত্যুর পরও ফুফুর কবর থেকে আজাবের আওয়াজ ভেসে আসত। সেজন্য ফুফুর কবরে ঘটা করে দোয়া পড়ানো হয়।
ডায়েরিটা পড়তে পড়তেই দাদাকে আমার সামনে অবলোকন করে ভয় পেয়ে গেলাম। আমাকে ভয় পেতে দাদা আমাকে অভয় দেখালেন। তারপর দাদা যা বললেন তা শুনে আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম।
এবার আসি মূল ঘটনায়। এর বেশ কিছুদিন পরেই ফুফুর আত্মা ফিরে আসে শয়তানের ঢাল হয়ে। এসেই সে দাদাকে খুন করে৷ আর সেদিন দাদা রাতে নদীতে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন। দাদার মৃত্যুর পর দাদার আত্মা ফিরে আসে আমাদের বাসায়। ফুফু যাতে কোনো সমস্যা করতে না পারে তাই দাদা প্রতদিন রাতে ফুফুর সাথে দেখা করতে যান। আর প্রতিরাতেই ফুফুকে ধ্বংস করার অনেক চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এতদিন পারেন নি। তবে গতরাতেই তিনি ফুফুকে একেবারে ধ্বংস করেন সাপের ধ্বংশন দিয়ে।
আমি বুঝতে পারছিলাম দাদা আমাদের মাঝে বেশিক্ষণ থাকবেন না৷ তার কাজ শেষ তিনি চলে যাবেন। ভাবতেই যেন আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছিল৷ আমি ছলছল চোখে দাদার দিকে তাকাতেই দাদা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
"কষ্ট পাস না দাদাভাই। তুই আমার হার্টের হার্টবিট। সবসময় তুই ভালো থাকিস। কখনও পাওয়ার জেদে খারাপ পথ বেছে নিস না৷ পাওয়া না পাওয়া নিয়েই জীবন।"
এরপর দাদা গেলেন আর কখনও ফিরে আসলেন না। সবাই এটাই ভেবে নিলেন দাদা হয়তো নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে পানিতে ডুবে মারা গেছেন।
সেদিনের পর থেকে দাদাকে কখনও দেখিনি। তবে শেষ রহস্যটার জট না খুলতে পারলে আমিও হয়তো সবার মতো এটাই ভেবে নিতাম দাদা পানিতে ডুবে মারা গেছেন।
1 মন্তব্যসমূহ
tnk
উত্তরমুছুন